সকালের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে
দাঁড়ালাম। চারতলার গেস্টহাউসের বারান্দায় এসে অনেক প্রশান্ত মনে হলো,বহির্জগৎ এবং নিজেকেও। ঝকঝকে চতুষ্পার্শের ছবি তুলতে তুলতে
ভাবলাম কাল রাতের ঘটনা অঘটনের কথা। এক সময় তো মনে হচ্ছিলোই যে গেস্টহাউস অবধি
পৌঁছবো তো!
জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে এই প্রথম পদার্পণ।
দেরাদুন কতবার এসেছি, ভুলে গেছি। আগের বারগুলোতে
ট্রেনেই বেশী,কখনো বা গাড়ীতে। দিল্লী থেকে ২৫ মিনিট আকাশযাত্রা সেরে
ল্যান্ড করামাত্র মোবাইল অন করে নিলাম। কারণ পিক-আপ নিয়ে কোনও মেসেজ ফ্লাইট চড়ার
আগে অবধি পাইনি।
মাল
নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় ট্রিং ট্রিং করে মেসেজ এলো। বাইরে কেউ আমার নামের
প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। অগত্যা মেসেজ পড়ে ড্রাইভারের নাম্বার ডায়াল করতেই
ল্যাগব্যাগর্নিশ একটা লোক ছুটে এসে আমার হাত থেকে ট্রলি কেড়ে নিলো। আমি সাথে যেতে
যেতে জিজ্ঞেস করলাম।
আপ মুকেশ হো?
কোনও উত্তর নেই। কেবল
সম্মতিসূচক মাথা নড়লো। আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করলাম। উত্তর কিছুই এলোনা ওপাশ থেকে।
এদিককার বাপ-মা’রা যে ছেলেপিলেদের এতো সুযোগ্য নাম দিয়ে
থাকে সেটা জেনে বেশ ভালোই লাগলো। নামটা তাহলে মুকেশ নয়! ‘মূকেশ’
গাড়ী স্টার্ট নিলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে বেশ গাঢ়। অল্প স্বল্প বৃষ্টির ছিটেফোঁটা।
এয়ারপোর্ট সে কিতনা দূর
হ্যায় গেস্টহাউস? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কিঁউ সাবতো পহুঁচ হি যাওগে।
মতলব কিতনা সময় লাগেগা।
কিতনি দূরী পে হ্যায় গেস্টহাউস?
কিুউ
সাব আপ তে পহুঁচ হি যাওগে।
আমি
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এই প্রশ্নের এই উত্তর! আরও কথা বলার আগে আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম। গাড়ী বেশ জোরে সামনের গাড়ীর পেছনে
ধাক্কা মারলো, ঠিক পারকিং থেকে বেরোবার মুখেই। খুব
অঘটন ঘটেনি দেখে সামনের গাড়ীর চালক শুধুই চোখ রাঙিয়ে আর দুএকটা অশ্রাব্য শব্দের ব্যাবহারে খ্যান্ত দিলো।
নিরুত্তাপ মুকেশ আবার গাড়ী এগিয়ে নিয়ে চললো।
টোল প্লাজার সামনে আবার সেই এক ঘটনা। এবারে
সামনের গাড়ীর চালক নেমে গালিগালাজ সহকারে দুটো চড়ও কষিয়ে
দিয়ে গেলো। তাতেও মুকেশ মূকেশ হয়েই বসে রইলো। আমার ততোক্ষণে ঘাম দিতে শুরু করেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বেশ
বড় কিন্তু সংখ্যায় কম। আমি এসি না চালাতে বললাম।
জানালাগুলো খুলে রাখতে বললাম। উত্তর নেই, কিন্তু কাজ হলো। খোলা জানালা দিয়ে সুন্দর একটা ভিজে মাটির গন্ধ আসছে, জল একটু গায়ে লাগছে কিন্তু সেটা
বেশ আরামের।
গাড়ী টোল প্লাজা ছেড়ে বেরোতেই চারিদিকে
নিশ্ছিদ্র আঁধার। কুহু কিম্বা সিনিবালি নয়, তবু আকাশে ভালোই আলো থাকার কথা। রাখী পূর্ণিমা সামনেই।
কিন্তু অন্ধকার অসীম। অবশ্য, যা মেঘ জমেছে
আকাশে তা ভেদ করে চাঁদের আলো পৌঁছয় না।
ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ তুলে ওয়াইপার ফ্রন্টভিউ
গ্লাস থেকে জল সরাচ্ছে। উল্টো দিকের গাড়ীর আলো কাচের ওপর
একটা ভয়ধরানো হিজিবিজি মাকড়সার জাল তৈরী করে দিয়েছে। হঠাৎ ড্রাইভারের কথাটা কানে যেন বেজে উঠলো – আপ তো পহুঁচ হি যাওগে। কেন এভাবে বললো? আমার প্রশ্নগুলো ওর কাছে বেশী
বেশী মনে হয়েছিলো? বিরক্ত হচ্ছিলো ও? হাজারো বাজে কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো। পহুঁচ হি যাওগে। মানে? সত্যি গন্তব্যে পৌঁছবো তো? ধ্যাৎ, কি যে আজেবাজে ভাবছি!
গাড়ী একটা নির্মীয়মাণ রাস্তায় চলছে, ঝাঁকুনিতে বেশ মালুম পাচ্ছি। না, এইটা ড্রাইভারের দোষে নয়, মনকে স্তোকে আস্বস্ত করার চেষ্টা দিলাম। হঠাৎ একটা বিটকেল ঝাঁকুনি আর কর্ণবিদারী ‘শিশা হো ইয়া দিল হো’ – আমার দিল তো
প্রায় খাঁচাছাড়া হবার যোগাড়। ধাতস্ত হবার আগেই
আবার ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল’। ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল ছাড়ার
বোধহয় সময় ঘনিয়ে এলো রে...... । ‘মেরে কাম কি নহী...’। উফ, আর পারছিনা। কিছু বলার আগেই ‘সালামে ইশক মেরি জান জ্যারা কবুল’......... আমি কোথায় পালাবো বুঝতে
পারলাম না। পর পর বেজে চলেছে তারস্বরে কখনো ‘এক ম্যায় আউর
এক তু’ আবার পরক্ষণেই ‘চোলি কে পিছে’। পিছে ক্যা হ্যায় বলার আগেই ‘নাম গুম
জায়েগা’ ‘নাচ মেরে বুলবুল তো
প্যাসা মিলেগা’। গা রী রী করে
উঠলো। নাঃ এই অত্যাচার অসহনীয়। ধমকে দিলাম মুকেশকে।
ইয়ে ক্যা হো রাহা হ্যায়? ইয়ে বকোয়াস গানা বন্ধ করো।
কিঁউ সাব?
মতলব?
গাড়ী চালাতে ওয়াক্ত গানা তো আচ্ছা লাগতা
হ্যায় সাব।
ম্যায় বোল রহা হুঁ, ইস লিয়ে বন্ধ করো। মুঝে পরেশানি হো রহি হ্যায়। ইয়ে কোই গানা হ্যায়? অচানক চিল্লা
রাহা হ্যায়। বন্ধ করো আভি কে আভি।
লেকিন সাব ইয়ে তো বন্ধ নহি হো রহা হ্যায়।
এরপরে আমি আর কি বলি। বারকয়েক থাপ্পর মেরেও
সে মিউজিক সিস্টেম থামে না। পিলে চমকানো চিলচিৎকার চলতেই
থাকলো। আমি ওকে ভল্যুম কমাতে বললাম। ওদিকে আবার ক্যাঁচ কোঁচ শুরু। ওয়াইপার চলছে।
বেশ খানিকক্ষণ হ্যান্ডেল ধরে শক্ত হয়ে বসে
ঝাঁকুনি সামলাচ্ছি আর মনে মনে ফুঁসছি যে এই গাড়ীর
ব্যাবস্থা করেছে তার ওপর। নির্বিকার মুকেশ সামনে ঝুঁকে হাত দিয়ে ভিউগ্লাসের বাস্প মুছে মুছে এগোচ্ছে। যতোবার একটা
হাত স্টিয়ারিং থেকে সরছে, ততোবার গাড়ী ডাঁয় বাঁয় হয়ে যাচ্ছে। প্রমাদ গোণা আর শক্ত হয়ে
বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোনও ভূমিকা নেই। দূরে
একটা জনবসতির আলোর সারি দেখা দিলো। আমি আমার এতাবৎ চাপা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম।
পহুঁচা তো দো’গে, লেকিন কাঁহা জানা হ্যায় ও তো পতা হ্যায়?
হাঁ সাব। পি-ডব্ল্যু-ডি গেস্টহাউস।
নহি, ঠিক সে পতা
করো। মুঝে কোম্পানি গেস্টহাউস মে জানা হ্যায়।
অ্যাইসা হ্যায় ক্যা?
মুঝে আপকা মালিক কা নাম্বার দো। মুঝে উনসে
বাত করনা হ্যায়। - আর কোনও উপায়ান্তর নেই আমার কাছে।
কোথায় যে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে!
ঘটাং করে গাড়ী থামলো রেলফাটক পার হয়ে একটা
চায়ের দোকানের সামনে। নিজের মোবাইলটা অন করে এগিয়ে
দিলো। মালিকের নাম্বার আমার ফোনে টুকে নিলাম। এগিয়ে দিতে কাছে আসতেই ভক করে একটা গন্ধ নাকে এলো। চুল্লুর। বেশ
টেনেই এসেছে তাহলে। এটাই প্রথমবার নয়, পাহাড়ে এর আগেও অভিজ্ঞতা হয়েছে। এদিকে তরল সেবন করে আকছাড় ড্রাইভারেরা গাড়ী চালিয়ে থাকে, তবে এইরকম টাল্লি হতে আগে কাউকে দেখিনি। আমারও কপাল। ফোন লাগিয়ে মালিককে বললাম মুকেশকে ঠিকঠাক বলে দিতে
আমার গন্তব্যটা।
গাড়ী থেকে নেমে আমার ফোন নিয়ে সে ব্যাটা দূরে
দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বলে ফিরে এসে আবার গাড়ী স্টার্ট
দিলো।
সন্ধ্যে সওয়া সাতটায় এয়ারপোর্টে গাড়িতে চড়েছি, আর এখন বাজে সাড়ে নটা। প্রতিটি
মোড়ে গাড়ী থেমেছে। চালক নেমেছে। আবার গাড়ী চলেছে। আমার ধৈর্য তলানিতে এসে ঠেকেছে।
গাড়ী রোকো। - এক ট্রাফিক কনস্টেবলের সামনে
আমি বললাম মুকেশকে।
পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে আন্দাজ পেলাম যে আমরা
ঠিক উল্টো দিকে ঘুরছি। দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো। যাই হোক, খানিকটা বুঝে নিয়ে এবারে আমিই দিকনির্দেশ করতে শুরু করলাম।
আই-টি পার্ক, সহস্ত্রধারা
রোড চলো। উসকে নজদিক হ্যায় হসমুখ এপার্টমেন্ট।
মুঝে তো আই-টি পার্ক বোলে নহি?
কুছ মৎ বোলো। ম্যায় জ্যায়সা বোল রাহা হুঁ
ওয়সা করো।
আপ গুসসা হো রহে হো সাব?
নহি, মুঝে জোর কি
লগি হ্যায়। মুঝে জলদি পহুঁচা দো মেরে গেস্টহাউস তক।
ক্যিঁউ, আপ তো পহুঁচ
হি যাওগে সাব।
বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। আরও মিনিট দশেক
যাত্রাযন্ত্রণা সহ্য করে নামলাম গেস্ট হাউসের দোরগোড়ায়।
বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে বেজে চলেছে - ‘ক্যিঁউ, আপ তো পহুঁচ হি যাওগে সাব’। নাঃ, অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েনের পরে সত্যি সত্যিই আমি পৌঁছেই গেলাম আমার গন্তব্যে। মুকেশ কথা কম বলে, কিন্তু কথাটা রেখেছে শেষ অবধি।
দেবাশিস ভট্টাচার্য ‘শিবাজী’