কল্যাণগড় কলোনি
মনুদার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি। স্টিম
ইঞ্জিন, লাল বগি, ভীড়। উঠে পড়ি ভেন্ডারদের জন্য নির্দিষ্ট কামরায়। বসার চেয়ে দাঁড়াবার জায়গা
বেশি। বাড়ি ফিরছে সবাই। ক্লান্ত। ঘর্মাক্ত। খালি ঝুড়ি, ভিজে
বস্তা, মাছের খালি বালতি টিন, দড়ির
গোল্লা আগলে বেঞ্চে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমি দরজার কাছে দাঁড়াই। হাবড়া? তা এক ঘন্টা, বা তারও বেশি, জানাল
একজন। উল্টোডাঙ্গা দমদম আসতেই হুড়োহুড়ি, স্রোতের তোড়ে ভেতরে
সেঁধিয়ে যাই। ঐ ঝুড়ি, বস্তা। মাছের খালি বালতি টিন নেই এই
যা। কামরা ভরে গেল। ঠাসাঠাসি। গরু ছাগলের মত একে অন্যের গায়ে হেলান দিয়ে ব্যালানস
করে করে দুলতে থাকে। বারাসত আসতে কামরা বদল করি। বসার জায়গা পেয়ে যাই। হাবড়ায় আমার
রাঙ্গামাসী থাকেন, মা'র রাঙ্গাদি। মণি
মা বলেছিলেন, 'একবার যাস রাঙ্গাদির কাছে। খুশি হবে।' অনেক দিন কেটে গেছে। একদিন মনুদা আসতেই, ঠিকানাটা
চেয়ে নিই। আজ যাচ্ছি।
হাবড়ায় নেমে রিকশা করতে হল। কল্যাণগঢ় বাজার দূরে।
রিকশাওয়ালা বলল, অশোকনগরে
নামলে কাছে হত। জানলাম। কল্যাণগঢ় বাজার মানে ছোটখাট একটা বাজার, খুব সাধারণ কিছু জিনিসপত্রের
দোকান। কাপড়ের, তরি-তরকারির, মশলাপাতি,
প্লাস্টিক সরঞ্জাম, চাল ডাল, খাতা পেনসিল, শাড়ি ব্লাউজ এই সব। তো এই বাজারে আছেন
হারুদা, রাঙ্গামার বড় ছেলে, আমাদের
বড়দার চেয়ে বয়সে বড়। কোন দর্জির দোকানে কাজ করেন। মনুদা বলেছিলেন, 'কল্যাণগঢ় বাজারে হারু চক্রবর্তীর
নাম বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে দাদার দোকান।' হলও তাই। রিকশা থেকে
নেমে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করতেই পেয়ে গেলাম। দরজির দোকান তখন খোলেনি। আমার পরিচয়
পেয়ে দোকানী বললেন, 'আজ দেরি হতে পারে। বেশি দূরে না। হাঁটা
পথ। তুমি ওর সঙ্গে যাও। হারুদার বাড়ি ওইই তোমাকে পৌঁছে দেবে।'
সঙ্গী আমার থেকে বয়সে কিছু বড়। হাঁটা পথ বলতে যতটা ছোট
পথ বোঝায়, হারুদার বাড়ি তা
থেকে অনেক লম্বা। সঙ্গী পথটাকে ছোট করার চেষ্টায় কল্যাণগঢ়ের নানা কথা বলতে বলতে
চলতে থাকেন। বুঝলাম, তিনি রাজনীতির লোক, এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থক। হারুদা এলাকার একজন নেতা। আশোকনগর-হাবড়ার
এই রিফ্যুজি কলোনীর নাম বিধান রায় একজন জ্যান্ত কংগ্রেসীর নামে, আইনমন্ত্রী অশোক সেনের নামে কেন গড়লেন, তার ব্যাখ্যা
তার কাছে হ'ল, কম্যুনিস্টদের এই
ঘাঁটীটার ঘাড়ে কংগ্রেসের ছাপ মেরে দেয়া। এটা বিধান রায়ের একটা চাল। এলাকাটা ছিল,
বৃটিশ এয়ার ফোর্সের রানওয়ে। বিধান রায় তার ওপরেই গড়ে তুললেন
অশোকনগর-হাবড়ার বিশাল রিফ্যুজি কলোনী। অশোকবাবু পরে নেহরুর আইনমন্ত্রী হয়ে আছেন
দীর্ঘকাল, কিন্তু এই এলাকা কংগ্রেসীদের হাতে নয়, রয়েছে বঞ্চিত মানুষের হাতে। কংগ্রেস দাঁত ফোটাতে পারেনি। আমার অবশ্য
পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই, তাই
সঙ্গীর কথাগুলোকেই মেনে নিচ্ছিলাম। এই কলোনীর লোকেদের চাকরি নেই। জমি নেই। দলমা
ঘেরা বাড়ির বেড়ার বাগানে যা তরিতরকারি ফলে তা দিয়েই হয় দিন গুজরান, বাড়তি কিছু থাকলে যেমন, আম, জাম,
কপি, মূলা, বেগুন সেসব
নিয়ে সবাই যায় কল্যাণগঢ় বাজারে। সেখানে ছোট ছোট মহাজনরা তা কিনে চলে যায় কলকাতায়।
তারা বেশি লাভে বিক্রি করে ফেরে। সঙ্গী কলকাতায় একবার গিয়েছিলেন। বাড়ির সজনে গাছে
সেবার অনেক ফলন। এক বস্তা সজনে ডাঁটা নিয়ে ট্রেনে চেপে বৈঠকখানা বাজেরে বিক্রি
করতে। কিন্তু স্টেশনে কামরা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একজন হামলে তা কিনে নেয়। পরে
বাড়ি ফিরে শোনে, বাজার অবধি পৌঁছুতে পারলে বা ফুটপাথে বসে
পড়তে পারলে অনেক বেশি টাকা পেত সে। তারপর, যা ফলন হয়
কল্যাণগঢ় বাজারেই বিক্রি করে দেয়। ট্রেনের ভাড়া পুলিশের গুঁতো এসব থেকে তো রেহাই
পাওয়া যায়! এখন কল্যাণগঢ়ের বড় ব্যাবসা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের চালের পাচার।
কল্যাণ্গঢ় বাজারের ছোট মাঝারি বড় সব মহাজনই এই চালের ব্যবসা করছে। পুলিশের চোখকে
ফাঁকি দিতে অনেক মহিলাকে কাজে লাগায় তারা। ট্রেনের ভাড়া দেয়, আর পাঁচ ছয় কেজির এক একটি পোঁটলা নিয়ে মেয়েরা আলাদা আলাদা ট্রেন বা কামরায়
বসে কলকাতায় পৌঁছে যায়। সেখানে মহাজনদের এজেন্টদের হাতে তুলে দেয় ওই সব পোঁটলা।
কম্যুনিস্টরা এ কাজে বাধা দেয় না কাউকেই। কলোনীর হত দরিদ্র মানুষের আয়ের আর কোন
উপায় তো নেই চারপাশে!
ঠিক তাই। ডানপাশে আকন্দের ঘণ বেড়া। বেড়ার ঘেরে নানা গাছ
গাছালি। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুটো টিনের ছাউনি দরমা বেড়ার দুটি কুটির।
সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ সঙ্গী চেঁচিয়ে ডাকে, 'ও হারুদা! দ্যাইখে যাও কারে আনছি। তোমার কুটুম গো!' রাস্তাটা
সোজা চলে গেছে, ডান দিক থেকে এসেছে একটা মেঠো পথ, সে পথে বাঁক নিতেই, ডান দিকে। একটা ময়লা সাদা থান
পরনে, কাঁচাপাকা চুলের বুড়ি। মুখে শরীরে অসংখ্য বলি রেখা।
আমার মায়ের মুখের আদল। বুঝে ফেলি, রাঙ্গা মা। 'তুই ব্যাইবলা না?' কাঁপা কাঁপা হাত পা শরীরে বুকে
জড়িয়ে ধরেন।'মনুরে বললাম, নিয়ে আয় নিয়ে
আয়, তার তো আর দেখা নাই। একা আসতে পারলি?' মায়েদের অহেতুক উৎকন্ঠা। আমি তো এসেই গেছি! বলি না। রাঙ্গামা আমাকে
একইভাবে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আসেন উঠোনের মাঝখানে। চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকেন। 'ওরা তোরা দ্যাখ, কেডা আইছে।' গলা
আরো চড়িয়ে পাশের বাড়ির দিকে হাঁকলেন, 'অ প্রভাত! প্রভাত! আয়
দ্যাখে যা, ব্যাইবলা আইছে রে!'
বাড়িতে আর ছিলেন বৌদি। একটা ময়লা লালপেড়ে শাড়ি জড়ানো
রোগা লিকলিকে শরীর। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বিস্ফারিত
আন্তরিক দৃষ্টি। ছবিদি, নীল রঙ্গের
শাড়ি। টান টান করে বাঁধা কালো কুচকুচে চুল, বেণিতে লালা
ফিতে। 'মা, আমি বাবলুকে কখনো দেখেছি?'
আমি ইয়ার্কি করি, 'আমি তো দেখেছি। তখন তুমি
এত্তটুকুন।' দাওয়া থেকে ছুটে নিচে নামেন, 'কী বিচ্ছুরে বাবা!' ছবিদি আমার মেজদার বয়সী, রাঙ্গামা বললেন। মীনুদি, আমার ওপরের দাদা বাচ্চুর
চেয়ে বড়, তখন ট্যুশানিতে, দেরি হবে
ফিরতে। হারুদা এখন পার্টি অফিসে। ফেরার সময় হয়েছে। প্রভাতদা এলেন, মামাবাড়ির দূর আত্মীয়, রাঙ্গামাদের এক-ই গ্রামের
মানুষ। একসঙ্গে দেশত্যাগী। পাশাপাশি জমি পেয়েছেন। প্রভাতদার দাদা একসময় ছিলেন দিনাজপুরে, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। তবলা বাজাতেন,
গানও গাইতেন। আমি ফাংশনে জল তরঙ্গ বাজালে, তিনি
সঙ্গত করতেন। নামটা মনে করতে পারছি না এখন।
হারুদা ছোটমামার মত। কৃষঞকায়, টানটান শরীর ঋজু ভঙ্গি। কম কথার মানুষ।
পাশের ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে আমাকে ডেকে নিলেন। সবার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন। মা, ছোটমামা, বড়মামা, বাবা, পাকিস্তানের রাজনীতি, সেখানে
বিহারী উদবাস্তুদের অবস্থা। একসময় বললেন, 'আমাদের এখানে
অবস্থা ভালো না। সবচেয়ে বড় অন্তরায় রোজগার। দত্তপুকুর থেকে বনগাঁ বিশাল এলাকার
নানা জায়গায় রিফ্যুজিরা মরিয়া হয়ে বাস করছে। কিন্তু রোজগার নেই। শিক্ষা নেই তো
চাকরি নেই। চাকরি নেই তো অর্থ নেই। অর্থ নেই তো রোজগারের সব পথ বন্ধ। প্রত্যেকটা
পরিবারে জীবন ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। সংগ্রামের সঙ্গে মিশছে স্মৃতি-কাতরতা...'
একসময় মনে হল, হারুদা নিজের কথাই বলছেন। আর
আমার যেন চোখ ফুটছে। আমার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের জীবন যাপন কি অন্য রকম? শিক্ষাটার জোরে আমি কিছু রোজগার করতে পারছি বটে, সত্যি,
ওই মূলধনটা আমার না থাকলে, আমিও কি হারুদাকে এই গল্পই শোনাতাম না? সারা পরিবেশটার সঙ্গে অজান্তে একাত্ম বোধ করতে থাকি। তাই দুপুরে মৌরালা
মাছের সলসলে ঝোল দিয়ে হাপুস ভাত যখন খাচ্ছিলাম (আজও ভুলতে পারি না সেই স্বাদ),
আর রাঙ্গামা ধমকের সুর তুলে বললেন, 'তুই আজ
থাইকে যাবি। কাল যাবি গা কলকাতায়', বৌদিকে বলি, 'এমন মৌরালা যদি কালকেও খাওয়াও, থেকে যাব।' সবাই খুশি। আমি থেকে গেলাম। বৌদি তাঁর একটা ধোয়া শাড়ি দিলেন। আমার লুঙ্গি।
মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল
আমাদের বাড়ির খুব একটা দূরে ছিল না মহারাজা স্কুল। ওই
পথেই আসতেন দূ র্গা ঠাকুর। ওই পথেই ছিল কুমোর পাড়া, যেখানে হাড়িকুড়ির ভাটায় শয়তান দুয়ো রানী লুকিয়ে
রেখেছিল সুয়োরানীর চাঁদ কপালে হাতে তারা রাজকুমারকে, যাতে
পুড়ে মারা যায় রাজার পুত্র। বাবা-মা সকালে মহারাজা স্কুলের পিছনের ওই পথেই অনেক
সময় বেড়াতে যেতেন, অনেক দিন আমি তাঁদের সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে,
মহারাজা স্কুল আর কুমোর পাড়ার পাশ দিয়ে যেতাম, কল্পনা করতাম, কোথায় রাজপুত্রের রূপের আগুনে পুড়ে
তৈরি হয়ে গিয়েছিল কাঁচা মাটির বাসন। কুমোরের ঘরে কী ভাবে ঠাঁই নিয়েছিল রাজপুত্র
তাদের সন্তান হয়ে।
ছোট স্কুল বড় স্কুলের তফাৎ বোঝার বয়স তখন আমার না। আমার
পড়াশুনার শুরু নিমনগরে সাঁওতাল পল্লির পাশে, যোগমায়া পাঠশালায়। আমার তিন বছরের বড় ভাই, বাচ্চু
পড়ত বাংলা স্কুলে। কান্নাকাটি করে এক বছর পরেই আমি বাংলা স্কুলে যাই, প্রধান কারণ, বাচ্চুর কাছেই শুনেছি, বাংলা স্কুলের গা ঘেষে রেললাইন, রেললাইন পেরুলেই
কাছারি, রেল স্টেশনটাও দূরে না, বড়
মাঠও কাছে। এছাড়া পাশেই মস্ত টলটলে পুকুর, জেলা স্কুলের।
এখানে এসে একবছর বাদে আবার উড়ান, মহারাজা স্কুলে। এর বড় কারণ ছিল, চন্দ্রবাবু স্যার। পাড়ার বাদল এই স্কুলে পড়ত, ওই বলত
চন্দ্রবাবুর কথা, 'সব পিরিয়ডেই গল্প আর শুধুই গল্প। মজার
মজার গল্প। রাজপুত্র, রাজকন্যা, দৈত্যি
দানব, রাজা রানী... আমাদের দিনাজপুরের রাজবাড়ির সব গল্প।
ক্লাশে পড়াশুনা নেই। শুরুতে টুকটাক, ব্যাস, বাকিটা গল্প আর গল্প।' তো এরপর কেউ বাংলা স্কুলে
থাকতে পারে? এর সঙ্গে যোগ হল, আমার
বিরুদ্ধে বাচ্চুর নালিশ। আমি স্কুল ফাঁকি দিয়ে রেললাইনে গাড়ি দেখতে চলে যাই,
কাছারির আশেপাশে যাই, রেল স্টেশনে যাই এই সব।
তো মেজদার ঘোষনা, 'বাব্লুর পাড়ার স্কুলেই পড়া ভালো।' তো আমি ভর্তি হলাম মহারাজা স্কুলে। সেই ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ আমি ছিলাম মহারাজা
স্কুলের ছাত্র। ক্লাশের সেকেন্ড বয়।
আমাদের স্কুলটা ছিল বিশাল দুটি ডানা মেলা খয়েরি রঙের এক
বুক টান ঈগল পাখির মত। শহরের যে কোন স্কুলের থেকে আলাদা। মহারাজা গিরিজানাথ
দিনাজপুর শহরে কয়েকটি স্কুল করেছিলেন, এটি তার মধ্যে বড়, নাম, মহারাজা
গিরিজানাথ হাই স্কুল। একটানা ডানা ছড়ানো স্কুলটার আগে পিছে মাঠ। সামনের মাঠটা খুব
বড়। পুব পাশে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর কয়েকটি কৃষঞচূড়ার গাছ। শীতে ঘণ সবুজ, গ্রীষ্ম ব র্ষা য় লালে হলুদে ছয়লাপ। গাছের নিচে অসাবধানে হুটোপুটি করলে
পায়ে জামায় রঙ লেগে যেত। কৃষঞচূড়ার ছায়া ছাড়িয়ে একটু এগুলেই উঁচু দা র্জি লিং রোড। শুনেছিলাম, বৃটিশরা
কলকাতা থেকে দা র্জি লিং অবধি হাই রোড তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিল, শেষটায় হয়নি, তার অংশ। পরে এঁটেল মাটির পথ, লম্বালম্বি, পরিত্যক্ত। গরুর গাড়ি চলে মাঝে মধ্যে।
গরুরা পা হড়কে হড়কে টানে ভারী গাড়ি। ব র্ষা য় এঁটেল মাটির কাদায় বসে যায় চাকা,
তখন গাড়োয়ান কাঁধ মেলায় গরু জোড়ার সঙ্গে। কখনো সখনো আমরা ছোটরা চাকা
ধরে প্রাণপণ তা ঘোরাবার চেষ্টা করতাম, হেই সামালো হেইও! ওই
ছোট্ট বয়সেই আমি যেন দা র্জি লিং রোডের ওপার থেকে অভিযানের আহবান শুনতে পেতাম।
টিফিন টাইমে নেমে যেতাম অন্য পারের ঢাল বেয়ে। তারপর সবুজ ধান ক্ষেত, কোন সময় ধান-কাটা-হলুদ, শুকনো। কোথাও টম্যাটোর ফলন,
কথাও কুলের ঝোপ, ম ট র শুঁটি... সারা বছর ধরে
কখনো সবুজ কখনো হলুদ, লাল নীল.. সব রঙই আমাকে হাতছানি দিত।
আটকেও যেতাম। ক্লাশের ফা র্সট বয়, মলয় সাহা (ওর জন্য কোনদিন
ক্লাশে ফা র্সট হতে পারিনি), আমার সঙ্গে থাকলেও ক্লাশে ফিরে
যেত দৌড়ে, আমার দেরি হয়ে যেত। তালুতে এক দু' ঘা বেত, নয়ত, 'স্ট্যান্ড আপ অন
দ্য বেঞ্চ,' খুব বেশি, 'স্ট্যান্ড আউট
অফ দ্য ক্লাশ রুম' (এটা ছিল খুব লজ্জার, কেননা, ক্লাশের বাইরে দাঁড়ালে, গোটা স্কুলের এ মাথা থেকে ও মাথার সবাই দেখতে পেত।) এসবে অভিযানের মাত্রা
কমত বটে, তবে তা বাদ পড়ত না।
স্কুল মাঠের প্রান্তে, পশ্চিমে, ছিল একটা মশজিদ।
মুয়াযযিন ছিল তার মালিক। মাথায় আধ কোঁকড়ানো কালো কুচকুচে ঠাসা চুল, গায়ের রঙ্গটাও কালো। দাড়িটাও। পরতেন কালো জোব্বা। লুঙ্গিটাও যতদূর মনে
পড়ছে কালো। গলায় মোটা দানার পুঁ তির মালা। ছোট মশজিদ। ডানদিকে কয়েক ধাপ উঠলে আযান
দেবার পাটাতন। আমি জীবনে এত মধুর আর
উদাত্ত আহবানের আযান শুনি নি। টিভিতে মক্কা শহরের আযান শোনার পরেও বলছি। আমি ঐ
আযান এতবার শুনেছি, স্কুল মাঠ থেকে বিকেলে খেলা শেষে বাড়ি
ফেরার সময়, সুরটা এখনো মনে পড়ে, এমনকি
আযানের আহবানের আরবী শব্দগুলোও। সেসবের অ র্থ অবশ্য জানি না। আমি নির্দ্বিধায় ঐ
আযান এখনো নি র্ভুল সুরে দিতে পারি। আজো কাউকে আযান মানে কি এটা বোঝাতে আমি দুকানে
হাত রেখে এই আযান দিয়ে তা বোঝাই। আমার মুয়াযযিনকে ভালো লাগত। ছোট বেলাতে তো বটেই,
বড় হয়েও। ওর বেশের মধ্যেই ভুর ভুর করত একটা বিবাগী মানুষের ধুপ
সুবাস। একটা খাটিয়া, এককোণে একটা উনুন, পাশে কিছু ঝকঝকে বাসন কোসন। আর সারা মশজিদ জুড়ে অনেকগুলো মাদুর। এই ছিল
তার সংসার আর ঐ শ্ব র্য। বাজারের পথে মুয়াযযিনকে আমাদের গলিপথ দিয়ে যেতে হত।
বারান্দা থেকে ডাকতাম। গলিতে দাঁড়িয়েই দাড়ি গোঁফের জঙ্গল ফুড়ে ঝকঝকে দাঁত মেলে
বলতেন কিছু। মনে নেই কি বলতেন, তবে ওর সঙ্গে কথা বলে খুশি
হতাম। মনের ভেতরে অদ্ভূত ইচ্ছা পাখা নাড়ত। আমিও যদি একদিন মুয়াযযিন হয়ে যাই?
শুধু একটা মশজিদেই না, সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে
যদি আযান দিয়ে দিয়ে ফিরি! মুয়াযযিনকে মনে হত ফকির, আমার ফকির
হতে ইচ্ছে করত খুব। এমন জীবনে তো বাঁধা বন্দ্ধনের বালাই নেই! উত্তেজিত হতাম। ক্লাশ
সেভেন এইট পর্যন্ত এই ইচ্ছাটা বুকে পুষতাম। আসলে যে কোন প্রবাহমান জীবনই আমার
বুকের পাখির ডানা দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে দিত। ১৯৭১ সালে আমি এপার বাংলায়। খবর পেলাম,
খান সেনাদের হাতে অসংখ্য বাঙালির নিধনের প্রত্যুত্তরে উত্তেজিত
বাঙালিরা হত্যা করেছে মুয়াযযিনকে। মুয়াযযিন বিহারী ছিল।
আমার সাবজেক্ট সংস্কৃত ছিল না। আমি পড়তাম উ র্দু। তাই
উর্দু স্যারের খুব প্রিয় ছিলাম। আমাদের সময়ে বইয়ে উ র্দু হরফ ছিল অন্যরকম, লেটার প্রেসে ছাপা। পড়তে সুবিধা হত,
তবে উ র্দুর ছাত্র হিসেবে মজা পেতাম না। উ র্দু ক্যালিগ্রাফি আমার উ
র্দু নেবার পিছনে কাজ করেছিল কিনা মনে নেই, তবে আমি এই
ক্যালিগ্রাফিকে খুব পছন্দ করতাম, আজো করি। বোধগম্যতা বজায়
রেখে এই হরফটাকে এত অলঙ্কারে সাজানো যায়,
খুব মজা লাগত। আমি উ র্দু তে খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। সত্তরের নিচে
মারক্স পেয়েছি বলে মনেই পড়ে না। মেজদা বলতেন, 'উ র্দু স্যার
তোকে ভালোবাসেন, তাই...' কথাটা মিথ্যে
বলব না। সত্যিই উনি মাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের গলি দিয়ে যাবার সময়, বেশির ভাগ সন্ধ্যের দিকে, আমার দুলে দুলে পড়ার সময়
এসে দাঁড়িয়ে পড়তেন। উ র্দু বই বের করে পড়াতে বসে যেতেন। আমরা একবার সিনেমা সিনেমা
খেলছিলাম আমাদের বাড়িতে, বারান্দায় শিশুদের হুল্লোড়। দেখি
উর্দু স্যার। গোলগাল বেঁটেখাটো মানুষটা ছোটদের সঙ্গে আমাদের 'সিনেমা হলে' ঢুকে গেলেন। একটা চেয়ারে বসে আমার
কারিগরির সিনেমা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। ‘দারুণ’। তিনি যে আমাকে ভালোবেসে বেশি মারক্স দিতেন না, তার পরিচয় মিলল ম্যাট্রিক পরীক্ষায়।
আমার বয়স তখন চোদ্দ। উ র্দু তে আমি ৭৭ পেয়েছিলাম ম্যাট্রিকে। মেজদা চুপ।
রবীন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন আমাদের ড্রিল স্যার। খুব কড়া
স্বভাবের মানুষ। যেমন ক্ষুরধার তেমনি ওজনদার। ক্লাশ থ্রিতে ভর্তি হয়েই ওনার ক্লাশ
পেয়েছিলাম। কেউ একটু নড়লে চড়লেই চিৎকার করে বলতেন, 'এই ছেলে! তোর তো সাহস কম না? আমাকে চিনিস? তুই তো এত্তটুকুন! দু আঙুলের চিমটিতে
ধরব আর টক করে মুখে ফেলে দেব, তারপর এক গ্লাশ জল। কোথায়
থাকবি কেউ টেরও পাবে না। তোর বাবা মা যদি কান্নাকাটি করেন একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি
দিয়ে দাঁতটা খুঁ চিয়ে থুক, ফেলে দেব তোকে বাইরে। খুব সাবধান।
আমার ক্লাশে কোন অমনোযোগ চলবে না।’ আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম।
তবে ইনি আমার কাব্যগুরু। এর কাছেই পেয়েছি প্রথম কাব্য ধারণা। কবিতা কি, তা ওঁর কাছ থেকেই প্রথম শিখেছিলাম। আমি তখন ক্লাশ থ্রিতে (আমার ক্লাশগুলোর
উল্লেখ করতে পারছি, কেননা, স্কুল
বিল্ডিনঙ্গের কোন রুমে কোন ক্লাশে কী ঘটেছিল স্পষ্ট মনে আছে), তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন কাজী নজরুলের 'ভোর হল দোর খোল'
কবিতাটি। পড়াতে পড়াতে একবার বললেন, আমার নাম
কি? রবিবাবু স্যার। মানে? আমি রবি।
মানে? আমি সূ র্য । মানে আমি সূযযি মামা।' বলেই তিনি টুক করে চেয়ার সরিয়ে টেবিলের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। আস্তে আস্তে
মাথা উঁচু করলেন, বললেন, 'এবার রবিবাবু
স্যার উঠছেন। মানে? সূ র্য উঠছে। মানে? সূযযিমামা উঠছে। মানে? রবিমামা উঠছে।' এবার তিনি টেবিলের ওপর হামাগুড়ির
ভঙ্গি করে বলতে লাগলেন, 'রবিমামা দেয় হামা। মানে? ভোরবেলায় সূ র্য আমাদের আকাশে হামাগুড়ি দিতে দিতে উঠছে। একটা শিশুর মত। সূ
র্যের গায়ে লাল জামা। আমার এই জামাটা অবশ্য শাদা।' বলেই বোকা
বোকা হাসলেন। আমরাও হেসে উঠি। কিন্তু আমি বুঝে ফেলি কবিতা লেখার অপার রহস্যটাকে।
আজো খুব ভোরে লাল সুর্য উঁকি দিলেই রবিবাবু স্যারকে টেবিলের ওপর হামাগুড়ি দিতে
দেখি। একইভাবে গদ্যের আড়ালে যে সাহিত্য, সেটাও রবিবাবু
স্যারের কাছেই প্রথম শেখা। মুখস্ত হয়ে আছে লাইনটা, "কেঁচো
সাপের মত ফুঁ সিয়া উঠিয়া কহিল, 'আমার মেজদিদি আছে।'. শরৎচন্দ্রের 'মেজদিদি' গল্পে
আছে লাইনটা। ক্লাশ ফাইভে আমাদের পাঠ্য় ছিল। অনেকবার পড়েও আমি 'কেঁচো সাপ' বলে কিছুকে কল্পনায় আনতে পারছিলাম না।
স্যার একদিন বুঝিয়ে বললেন কী ভাবে পড়তে হবে, 'কেঁচো #
সাপের মত ফুঁ সিয়া...' কেষ্টর চরিত্র কী ভাবে
অন্য একটি ছবিতে আরো বেশি স্পষ্ট হল, বুঝিয়েছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে যখন খান সেনারা ১৩ দিন মুক্ত থাকা দিনাজপুর
শহরের দিকে এগিয়ে আসছিল, শহরের
হিন্দু মুসলমান নি র্বি শেষে আশ্রয় নিয়েছিল সীমান্তের ওপারে, মুখ্যত রায়গঞ্জে আর বালুরঘাট এবং আশেপাশের ছোটবড় শহরে। রবিবাবু স্যার
গিয়েছিলেন রায়গঞ্জে। আমি মুক্তিযুদ্ধের শুরুর ২১ দিন ছিলাম বাংলাদেশের ভেতরে,
আনন্দবাজার পত্রিকার যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে। কলকাতায় ফিরে এসে শুনি,
দিনাজপুরের সবাই উত্তরবঙ্গে। রায়গঞ্জে গিয়ে আমার চেনা পরিচিত অনেকের
সঙ্গে দেখা করি, রবিবাবুর সঙ্গেও। তখনো তিনি সেই টগবগে
মাস্টার মশয়। শেষ দেখা ১৯৭৯ সালে। রায়গঞ্জে কী এক কাজে গিয়েছিলাম। তখন রাত। লন্ঠনের আলোর আধো অন্ধকারে স্যার শুয়ে আছেন মশারির
ভেতরে, তাঁকে দেখার উপায়
নেই। ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো, 'কতদিন দেখি না তোমাদের, অরুণ! বেশি দিন আর বাঁচব না।' তিনি আর বেশি দিন
বাঁচেন নি। দিল্লিতে বসে খবরটা পেয়েছিলাম। স্কুলের ফুটবল টিমে জোর করে আমাকে
নামানো, স্কুলের ফাংশানে আমাকে দিয়ে নাচ করানো, গান গাওয়ানো... সেই থেকে সব স্মৃতি হয়ে ঝুলে রইল আমার জীবনে।
আমাদের স্কুলে বাহাদুরের ছিল এক মস্ত ভূমিকা। বাহাদুর
হেডমাস্টারের ঘরের বাইরে, হল ঘরের
দেয়ালে পিঠ দিয়ে একটা টুলে বসে থাকত। কোমরে খাপে বন্দী একটা ভোজালি। বাহাদুরের কাজ
ছিল, বারান্দায় ঝোলানো ঘন্টা পিটিয়ে ক্লাশ শুরু আর শেষ,
স্কুল শুরুর আর শেষের ঘন্টা বাজানো। বাহাদুর ছিল বেঁটে। বৃদ্ধ।
কিন্তু গড়ণে শক্ত পোক্ত। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটা টিপের
উল্কি। বাহাদুর হাসলে ওই উল্কি কপালের নানা ভাঁজের ঢেউয়ে ডুবে যেত আবার ভেসেও উঠত।
আমার খুব মজা লাগত উল্কির ওই লুকোচুরি খেলা। কোমরে ভোজালি থাকলেও বাহাদুর ছিল সারা
স্কুলের ছেলেদের কাছের মানুষ। আমাদের ছোটবেলায় একমাত্র পরীক্ষা দেয়ার সময় ছাড়া
দোয়াত কলম চলত না। ডট পেনের তো দিনই শুরু হয় নি তখন। আমরা পেনসিলে লিখতাম। তখন পেনসিল শা র্পে না রের চল হয় নি। তো বাবা কাকার দাঁড়ি
কাটার ব্লেড ছিল আমাদের পেনসিল শা র্প করার একমাত্র মাধ্যম। আর স্কুলে বাহাদুর।
পেনসিল ভেঙে গেলেই আমরা ছুটে বাহাদুরের কাছে যেতাম। ক্লাশ চলতে চলতে স্যাররাও বাহাদুরের কাছে ছুটে যাবার অনুমতি দিতেন।
বাহাদুর কোমর থেকে বিশাল ভোজালিটা বের করে আমাদের পেনসিল শা র্প করত। পেনসিলগুলো
ওর হাতে যেন মাখনের এক একটা স্টিক। এখনো পেনসিল শা র্প করতে গেলে বাহাদুরের ভোজালিটাকে মনে পড়ে।
কিন্তু অত সুন্দরভাবে শা র্প করতে পারি না। একবার দু'বার শিস
ভাঙবেই ভাঙবে। এই বাহাদুর আমার জীবন থেকে কীভাবে অন্ত র্ধা ন হয়ে গেল, মনে করতে পারি না। বাহাদুর আমাদের ক্লাশে ডাকত, আমাদের
ছুটি দিত, আমাদের পেনসিল শা র্প করত। তাকে মনে রাখার মত আর
কোন ঘটনা ছিল না বলেই তার অ ন্ত র্ধা ন
আমাকে নাড়া দেয়নি নিশ্চয়।
আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন মীর মুশাররফ হোসেন। ঋজুদেহী। কায়েদ-ই-আযমের
মত লম্বাটে রুক্ষ্ম মুখশ্রী। সেটা বোধয় উনি নিজেও জানতেন। তাই কায়েদ-ই-আযমি টুপি
পরতেন। খুব কড়া মানুষ। সারা স্কুল তাঁকে ভয় পেত। শিক্ষকরাও। আমরা তো বটেই। আমাকে
স্কুলের সব মাস্টারমশয় স্নেহ করতেন, প্রশ্রয় দিতেন, একমাত্র আমাদের হেড মাস্টার ছাড়া। উনি
ভারতের মালদা থেকে আগত রিফ্যুজি। মুস্লিম লীগ করতেন,শহরে
লীগের নেতাদের সঙ্গে তার উঠবস ছিল। আমার বাবা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষ, হিন্দু। সেটা কোন কারণ কিনা তা বোঝার বয়স আমার যখন হ'ল, আমি স্কুল ছেড়ে দিলাম। সেটা একটা ঘটনা।
আমি গাইতাম ভালো। সেই সময় 'পাক সাদ জমিন' পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে
স্বীকৃত হয়েছে। আমাকে পাঠানো হল সেই গান শিখে এসে স্কুলের সবাইকে শেখাতে। জেলা
স্কুলে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে শিখে এলাম গানটা। এসেমব্লিতে আমরা কয়েকজন জাতীয়
সঙ্গীত গেয়ে গেয়ে লীড দিতাম। সবার শেখা হয়ে গেলে আমিও দাঁড়াতে লাগলাম সবার সঙ্গে,
লাইনে। একদিন, খুব রোদ্দুর, এসেমব্লিতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শেষ, হেডমাস্টার
বলছেন। এই সময় ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে চোখ দুটোকে সুবিধা দিতে আমার মুখটা একটু বিকৃত হয়ে
গেছে। হঠাৎ তাঁর কথা বন্ধ করে স্যার গ র্জে ওঠেন, 'এই অরুণ,
আমি হেডমাস্টার বলছি, আর তোমার হাসি পাচ্ছে?
তুমি জাতীয় সঙ্গীতকে অপমান করছ, জানো?'
ক্লাশ নাইনে পড়ি, এই 'অপমান'
শব্দটার ইঙ্গিত বুঝতে বাকি থাকে না। তিনি আমাকে লাইন ছেড়ে বাইরে
দাঁড়াতে বলেন। আমি লাইনের বাইরে দাঁড়াই। কয়েক দিন পরে জেলা স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা
দিয়ে জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে যাই। আমাদের এসিস্ট্যান্ট হেড স্যার, মৈনুদ্দীন সাহেব (মেথর পাড়ায় যাবার রাস্তায় থাকতেন, নামটা
ঠিক হল কী?) নতুন
স্কুলে আমার ভ র্তি র ব্যাপারে সাহয্য করলেন। স্কুলের সঙ্গে আমার আট বছরের সঙ্গ
ত্যাগ আমাকে একটুও দুঃখ দিল না।
কষ্ট পেলাম জেলা স্কুলে ঢুকে। এটা আমার স্কুল না। এটা
ওদের স্কুল। যাঁরা আমাদের শাসন করে, যাঁরা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিভিলেজড, তাদের স্কুল।
আমার সহপাঠী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদুরে ছেলে, এক রায় সাহেব
বাহদুরের নাতি, জেলার প্রধান কাস্টমস অফিসারের ছেলে এমনি আরো
অনেকে। এদের জন্য ক্লাশের ছাদ থেকে ভারী কাঠের বীমে ঝোলানো মাদুরের শক্ত পাখা,
এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল, দোলে। পাখা নাড়ায় দেয়াল
ভেদ করে বাইরে চলে যাওয়া দড়িটা, এক জ রা জী র্ণ বৃদ্ধ চাচা
সেটা টানেন দুলে দুলে, সারাদিন। আর ভেতরে হাওয়ায় চুল ওড়ে ,বইয়ের পাতা ওড়ে আমাদের সকলের। নিষ্ঠুরতার এমন শিক্ষা দিয়েই তৈরি হয় এখানে
ভবিষ্যতের আমলা। আমি আমলা হতে চাই না। এদের সকলের পায়ে চামড়ার জুতো। এখানে
বাঙালিরাও পড়ে বিহারীরাও। এই স্কুলে টিফিনের সময় মুসলমানদের জন্য পেটভরা লুচি আলুর
দম, হালুয়া বা মিষ্টি, হিন্দুদের জন্য
পেটভরা রাধা বল্লভী সন্দেশ রসগোল্লা... না না এটা আমার স্কুল হতে পারে না, মনে হল। দম বন্ধ হয়ে আসে। মহারাজা স্কুলের জন্য মন খারাপ হতে থাকে। টিফিন
দিত না আমাদের স্কুল, আমরা মনের আনন্দে স্কুলের টিফিন
টাইমটাকে ছুটির টাইম করে দা র্জি লিং রোডের ওপারে টম্যাটো আর ম ট র শুঁ টি ছিঁড়ে
ছিঁড়ে খেতাম। আমাদের সবার পায়ে জুতো থাকত বা থাকত না। আমাদের গরম লাগত না। খাতা
নাড়িয়েও কোনদিন হাওয়া খেয়েছি মনে করতে পারি না। আমাদের স্কুলে বিহারী বন্ধু ছিল
না। পাড়ার বিহারী বন্ধুরা যেত ইকবাল স্কুলে উর্দু মাধ্যমে পড়তে। আমাদের স্কুলে
গরীব আর মেধাবীদের পড়তে সাহায্য করার জন্য স্কলারশিপ চালু ছিল। আমি হাফ ফ্রিতে পড়তাম।
জেলা স্কুলে এসে অনুতাপ হচ্ছিল, তবে হেডমাস্টারের কারণে ফিরে যাওয়ার
আগ্রহ বোধ করতাম না। সময় সব কিছুকে সামলে নেয়। জেলা স্কুলে ছিলেন সেই সময়ের নামী
কবি, কাদের নওয়াজ। আমি অমরের (আমার মেজদা) ছোট ভাই, শুধু এই পরিচয়েই আমাকে ভর্তি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমার প্রতি ওঁর
নজরদারির সঙ্গে সৃষ্টিশীল হকিস্টিক স্যার আর ইংরেজির দুর্মুজ স্যার আমাকে গ্রাস
করে নিলেন। এমন নামে তাঁরা কেন পরিচিত ছিলেন জানা হয় নি। হকিস্টিক স্যার আমাকে
উৎসাহিত করলেন আমার সাংস্কৃতিক দিকটায়, দুর্মুজ স্যার গড়ে
তুললেন আমার এক রোখা চরিত্র। আমাকে এভাবে একসময় স ম্পূ র্ণ গিলে ফেলল জেলা স্কুল।
তবে মহারাজা স্কুল ছেড়ে আসার দুঃখ আমার চিরকাল ছিল।
বিশেষ করে হেডমাস্টার মীর মোশাররফ হোসেনের বুকের ভেতরটা ঝুঁ কে দেখার যেদিন সুযোগ
পেলাম, সেদিন থেকে দুঃখের
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুতাপ। আমি তখন ভারতে। ১৯৬৪ সাল। দিনাজপুরে গেলাম পুজোর
ছুটিতে। সেদিন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। লন্ঠনের আলো জ্বলছে সব বাড়িতে। স্যারের বাড়িতেও।
ওঁর কারণে স্কুল ছাড়তে পারি, কিন্তু এই দী র্ঘ বিচ্ছেদে
কেবলই মনে হয়েছে কোথাও আমার ভুল ছিল। আমি
ওঁকে ভুল ব্যাখ্যা করেছিলাম। আমাকে ওই সময় দেখলে যে কারো মনে হতেই পারত, আমি হাসছি, বিশেষ করে দূর থেকে দেখলে। ছাত্রদের
মধ্যে শ্রদ্ধা এমনি জাগে না, জাগাতে হয়। তিনি হয়ত সেই চেষ্টা
করেছিলেন। আমি এক তরফা ব্যাখ্যা করে এক তরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুল ছেড়েছিলাম।
বাড়িতে ঢুকেই স্যারের ছেলে, আমাদের বছর তিনেকের সিনিয়র,
পান্নাদা, তার নাম ধরে ডাকি। উত্তরে স্যারের
গলা, 'কে?' আমি বলি, 'আমি অরুণ। অরুণ চক্রবর্তী।' স্যার প্রায় ছুটে এলেন,
হাতে লন্ঠন, 'অরুণ? তুমি?'
লন্ঠন উঁচিয়ে আমাকে নীরিক্ষণ করলেন, নীরবে। 'কোথা থেকে এলে, বাবা?' আমি
তাঁর দু' পা ছুঁ য়ে প্রণাম করি। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন,
সাঁপটে। আমাকে বুকে জড়িয়ে
ধরেই বলতে থাকেন, 'এ তোমরাই পার। তোমাদের পরিবারই পারে
শিক্ষকের প্রতি এমন শ্রদ্ধা জানাতে...' অনুতাপে আমার চোখে জল
এসে যায়।
তারপর ৩০ বছর কেটে গেছে। ১৯৯৫ সাল। একটা খামে ভরা চিঠি।
বয়ানটা ঠিক মনে নেই। তবে এই রকম, 'বাবা, অরুণ। আমি ও আমার স্ত্রী মালদা থেকে সকালে
রওনা হয়ে দিল্লি পৌঁছুবো রাতে, একটা থাকার জায়গা করে রাখলে
ভালো হয়...' আমি আত্মহারা। আমার এতদিনের অপরাধের
প্রায়শ্চিত্তের এই মহা সুযোগ। ছেলে মেয়ে আর বউকে বললাম আমার জীবনের মস্ত বোকামীর
কথা। স্যারের মুখটা ভোলবার নয়। কায়েদ-ই-আযম। অনেক লেটে গাড়ি এলো, প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে। আমার বন্ধুর গেস্ট হাউসে স্যার উঠলেন। এসেছেন,
মূল উদ্দেশ্য, আজমীঢ়ে ফকির হয়ে যাওয়া ছোটছেলের
খোঁজে। আমি স্যারকে নিয়ে দিল্লিতে নানা জায়গায় ঘুরলাম, সবার
সঙ্গে পরিচয় করালাম। আমার মাস্টার মশয় আর দিদিমণিকে। স্যারের চারপাশে অনেক মানুষের
আনাগোণা শুরু হয়ে গেল। ডাক্তার, লেখক, সাধারণ
মানুষ। এমনকি গেস্ট হাউসে মেয়ের বিয়ে দিতে আসা নাগপুরের কণ্যাপক্ষ, মাস্টারমশয়কে ছাড়লেন না। দিদিমণিকে বসিয়ে দিলেন মেয়েদের নানা কাজের মাঝে।
দিদিমণি লজ্জায় সিঁটিয়ে থাকেন। যাবার দিন ঘণিয়ে এলো। স্যার বললেন, তোমার বৌ ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছবি তুলব। আমার ছয় কপি চাই। আমার ছেলে মেয়েদের
দেব। তোলা হল। স্যার ফিরে গেলেন। যাবার সময়, তিনি আমাকে ধমকে
(মনে পড়ে গেল পুরানো দিন) বগি থেকে নামিয়ে দিলেন। 'তুমি নামো,
নামো নইলে আমি কেঁদে ফেলব।' আমি হতভম্ব। প্লয়া টফ র্মে দাঁড়িয়ে থাকি। বিমূঢ়, যতক্ষণ না ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে গড়াতে থাকে।
১৯৯৭ সাল। স্যার তখন বালুবাড়িতে এক দোতলায় থাকেন। সঙ্গে
দিদিমণি। দেখা করতে গেলাম। দেয়ালে আমাদের ছয়জনের সেই ছবি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, 'আমার বাড়িতে মাত্র এই একটি ছবি।
তোমাদের এই ছবি। আর কারুর কোন ছবি আমি রাখিনি, রাখব না।'
স্কুলের সেই এসেমব্লি থেকে এই মুহূ র্ত টা অবধি সব স্মৃতি প্লাবণের
মত ধেয়ে এলো আমার চোখে। আমি কেঁদে ফেললাম।
কৈশোর ছুটছে
আমরা পাঁচবন্ধুর মধ্যে, আগেই বলেছি, পড়াশুনোটা ছিল
গৌণ, আড্ডাটা ছিল মূখ্য। আমরা সাধারণ মেধার, পাশ করব না, এমনটা মনে হত না। আমরা যতটুকু পড়তাম,
তা পাশ করার জন্য, জানার জন্য না। আমার অবশ্য
সেই বিলাসীতার সুযোগ ছিল না। আমার বুকের ভিতরে নিজেকে প্রমাণ করার একটা দরকারি
ব্যাপার ছিল। বাড়িতেও নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ ছিল। আর সমাজে সবার কাছেও। কেননা,
আমি ছিলাম মূলত কলকাতার ফুটপাতের একটি ছেলে। অর্জুন রাজনীতি করত,
তবে তার রাজনীতি ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার, দেশজুড়ে কম্যুনিজমের প্রতিষ্ঠা ট্রতিষ্ঠা নিয়ে ওর কোন মাথা ব্যাথা ছিল বলে
মনে হয় না। অভীকের মধ্যে অনেক গুণ থাকায় ও ছিল জীবন সম্পর্কে দিশাহারা। কখনো তার
মন গীতিকার হতে চাইত, কখনো কবি, ক্যামেরাম্যান,
চিত্রপরিচালক, কখনো বা সিনেমাটোগ্রাফার। অভীক
অধ্যাপক হতে চায়নি কোনদিন, তাই তার অধ্যয়ণে আগ্রহ ছিল না।
সত্যর এসব ব্যাপার ছিল না। আমাদের মধ্যে ওর মধ্যেই ছিল সমকালীন কলকাতার প্রবাহ।
রকবাজী ওর যেন চেতনায়। চন্ডীর ব্যাপারটা আলাদা। ও জানত, ওর
রক্তে পড়াশুনার স্রোত নেই। সেটা ওর পারিবারিক পরিমন্ডলের দান। তো যা হয়, আমরা ছিলাম খুব সাধারণ মনের সংস্কৃতি মনা পরিবারের ছেলে। যার
কেন্দ্রবিন্দুতে অচিরেই মেয়েদের মুখ সেঁটে যেতে থাকে।
সালটা মনে নেই। টালা পার্কে শিল্প মেলা। চন্ডী বাদে
আমরা চারবন্ধু গেছি। সন্ধ্যে বেলায়। খুব ঘোরা ঘুরি মজাটজা করে বসেছি বিজলি গ্রিলের
দোতলায়। সেই প্রথম বিজলি গ্রিলের নাম শোনা। খুব ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাজারে এসেছে তারা।
এই মেলাতে তাদের কাঠের দোতলা রেস্ট্যুরেন্ট। আমরা একটা টেবিল ঘিরে যথারীতি হুল্লোড়
করছি, হঠাৎ সত্য আমাদের
ইশারায় সতর্ক হতে বলে। সামনে একটি চাঁপা ফুলের রঙের মেয়ে। পরনে চাঁপা রঙের ফ্রক।
গায়ের রঙ ফ্রকটাকে আলো দিচ্ছে নাকি ফ্রকটা গায়ের রঙকে, বোঝার
উপায় নেই। আমরা চারজনেই মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকি তাকে। সঙ্গে বাবা মা। অভী মেয়েটাকে
দেখে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ। কবিতার মত মেয়েটা, বলল। সত্যি,
মেয়েটা খুব সুন্দর, চেয়ে থাকার মত। অবশ্য
আমাদের ঐ কৈশোরের শেষপর্বের জীবনে, যা কিছুই সুন্দর লাগার
কথা। বাবা মাকে অনুসরণ করে মেয়েটা উঠে যায়। আমরাও তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে ওদের পিছু
নিই। ওরা আইস্ক্রিম কেনে, পিছু পিছু আমরাও। ওরা যে দোকানে
যায়, আমরাও সেই দোকানে নাড়াচাড়া করি বিক্রির জিনিস, আড় চোখে উপভোগ করি নাকে না-আসা চাঁপার সুগন্ধ। দারুণ ভীড় মেলা জুড়ে। বোধয়
সেদিন ছুটির দিন ছিল। চারপাশের রাস্তা দিয়ে মানুষের ঢল, টালা
পার্ক মুখো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের চার জোড়া চোখ থেকে হারিয়ে গেল মেয়েটা। আমরা
হতাশ। ক্ষণিকের আনন্দটুকু যেন হঠাৎ যাদু কাঠির ছোঁয়ায় উবে গেল।
মনে নেই প্রস্তাবটা কার। আমাদের সবার এই মন খারাপে যে
কেউ বলতেই পারে, 'ধুস,
চল ফিরে যাই!' আমরা তাই কাছেই ট্রাম ডিপো,
সেখানে পৌঁছে যাই। অনেক ট্রাম অনেক দিকে যায় সেখান থেকে। আমরা যাব
কলেজ স্ট্রিট, অভীকদের বাড়িতে আড্ডা মেরে তারপর যা যার
ডেরায়। কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম খুঁজছি, হঠাৎ দেখি চাঁপা ফুল।
ঘরঘর করে যে ট্রামটা যাচ্ছে, তার জানালায়। সত্য চিৎকার করে
ওঠে, 'ওই তো!' বলেই চলন্ত ট্রামের
পিছিনে ছুটতে থাকে, আমরাও। টালা ব্রিজের ওপরে ওঠার সময়
ট্রামের গতি একেবারে কমে এলো, কিন্তু আমরা সেকেন্ড ক্লাশের
দরজাটা ধরতে না ধরতেই ব্রিজের ওপাশের ঢালে হুড় হুড় করে ট্রামটা নেমে যায়, আমাদের থেকে বেশ দূরেও চলে যায়। আমরা ছুটতেই থাকি। হই হই করতে করতে।
লোকেরা হয়ত ভাবছিল, ট্রামে আমাদের কিছু রয়ে গেছে, আমরা ভুলে নেমে পড়েছি। ট্রাম একটা রেড লাইটে দাঁড়াতেই আমরা প্রাণপণ ছুট।
কিন্তু কাছে যেতেই ফস্কে যায়। আবার ছুট। এখন মনে করতে পারি না, জীবনে আর কখনো অত বেগে অতটা রাস্তা ছুটেছে কিনা, ছুটতে
পারতাম কিনা। আমাদের চারজনের একজনেরও মনে হয়নি, ধ্যুৎ ছেড়ে
দে। মেয়েটা যেন আমাদের গালে চড় মেরে পালিয়ে যাচ্ছিল, আর আমরা
তাকে ছাড়ব না। পাঁচ মাথার মোড়ে ট্রাফিক লাইটে ট্রামটা ধরে ফেলতে পারব নিশ্চিত।
কিন্তু না, গ্রীন পেয়ে গেল ট্রামটা। আমরা ঝাঁকার ওপর দিয়ে,
ঠেলা গাড়ি টপকে, একে ওকে ধাক্কে ঢুকে পড়ি
কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। এই রাস্তা দিয়ে অনেকগুলো ট্রাম চলছে এক অপরের পিছু পিছু।
এবার তো স্পীড নিতে পারবে না। দৌড়ুতে দৌড়ুতে শ্রী সিনেমার কিছু আগে ধরে ফেললাম
আমাদের লক্ষের ট্রামটাকে। অভী উঠল আগে, 'এখানে নেই তো!'
মানে চাঁপা ফুল এই ট্রামে না। সত্য দৌড়ুতে দৌড়ুতে বলে 'তবে সামনেরটায়!', বলেই ছুট এবং ধরেও ফেলে। নেমে আসে 'নাঃ এতেও নেই!' তার আগেরটা ধরে সে, হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে দৌড়ুতে থাকা আমাদের তোলে। ট্রামটা তখন হাতিবাগান ছাড়িয়ে
হেঁদুয়া মুখো। সামনে কোন ট্রাম আর নেই। অর্জুন এবার মুখ খোলে, 'কী হল বলত? মেয়েটা তো আর ট্রাম থেকে নেমে যায়নি,
আমাদের চোখে পড়ত তাহলে। হাওয়া হয়ে গেছে তাও না। তাহলে? সত্যই একটা সম্ভাবাবনার হদিশ দেয়, 'বোধয় মেয়েটা তিন
নম্বর ট্রামে উঠেছিল, তাই হাতিবাগান থেকে ডান দিকে
শোভাবাজারের দিকে বেঁকে গেছে, আমরা ভুল ট্রামের পিছনে
ছুটছিলাম এতক্ষণ। মানে আমরা এক নম্বর ট্রাম ভেবে ছুটেছি। ধ্যাৎ শালা! তোদের কারো
মাথায় এলো না এটা? মেয়েটা কোন ট্রামে উঠেছে এটা দেখা উচিত
ছিল'. অভী মিনমিনিয়ে বলে, 'তা কী করে
হবে?. আমরা তো মেয়েটা যে ট্রামে ছিল, তার
পিছনেই ছুটেছিলাম সারাক্ষণ। অন্য ট্রামের পিছনে তো দৌড়াইনি?' সেটাও ঠিক। কিন্তু মেয়েটা কী করে উধাও হল? আজো তার
হিসাব মেলাতে পারি না।
ফেল পাশ
পার্ট ওয়ান পরীক্ষা এগিয়ে আসছিল। এমনিতেই আমার কাছে
বইপত্র কম, কেনার পয়সা নেই,
ভরসা একমাত্র অ্যালবার্টস হিস্ট্রি অফ ইংলিশ লিটারেচার আর গোল্ডেন
ট্রেসারি, একটু ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম বইকি। আমি অবশ্য বরাবর সব
মাস্টার মশাইদের স্নেহধন্য ছাত্র। স্কুল জীবন থেকেই। কলেজেও। সিএনআর তো তাঁর বাড়ির
দরজা হাট খুলে রেখেছেন আমার জন্য। প্রায়ই যাই। এটা ওটা জেনে আসি, শিখে আসি, মৃদু তর্কেও জড়িয়ে যাই। এভাবেই খুব বেশি
বই না-ঘেঁটেও আমার পড়াশুনো চলে, সেই স্কুল থেকে। কিন্তু বিএ
ক্লাশের সেকেন্ড ইয়ারে এসে, পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সামনে
দাঁড়িয়ে ঘাবড়ে গেলাম। ছুটকো ছাটকা পড়াশোনায় যে এই ইউনি ভার্সটি লেবেলের পরীক্ষায়
পার পাওয়া সহজ না, বুঝতে পারছিলাম। আমি সিএন রায় ছাড়াও
অন্যান্যদের বাড়িতে যাতায়াত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু মুশকিল হল কবিতা নিয়ে। গোল্ডেন
ট্রেসারির অনেক কবিতা ছিল আমাদের পাঠ্য়। ইংরেজী কবিতা আমার ভালো লাগত বলে আমার
কাছে পুরো বইটা ছিল। কোথা থেকে ঐ বইটা সংগ্রহ করেছিলাম, মনে
পড়ছে না। কিন্তু এই অগাধ সাগরে আমার মত ছিঁচকে ছাত্রের পক্ষে তা সামলানো সহজ ছিল
না। সবচেয়ে বড় বিপদ, এটা ক্লাশে পড়াতেন টিএনসি-- তারকনাথ
চক্রবর্তী, কলেজে ইংরেজীর হেড।
একদিন টিএনসি কলেজ আসছিলেন। আমি বাইরে রাস্তার ওপরে।
দৌড়ে যাই। 'স্যার, আমি অমুক কবিতাটি ধরতে পারছি না। আপনার বাড়িতে একদিন আসি, স্যার?' টিএনসি একটু দাঁড়ালেন। আমাকে আপাদমস্তক
দেখলেন। 'চলে এসো। মাসে ৭৫টাকা দিলেই হবে।' 'না না স্যার ট্যুশান নিতে নয়। একদিন সকালে মাত্র এই একটি কবিতা নিয়েই
আলচনা করতে আসব।' 'কিন্তু টাকা তো লাগবে। ৭৫ টাকার নিচে আমি
পড়াই না।' আমি মরীয়া, "স্যার আমি
বোধয় বোঝাতে পারছি না। আমি নিজেই খেতে পরতে পারি না। অত টাকা কোথায় আমার?'
'তাহলে, বাবা অরুণ, তোমার
জন্য ৭০ টাকা। তার নিচে নামতে পারব না।', বলেই কলেজের গেটের
দিকে পা বাড়ান। আমি লাফিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়াই, 'আপনি ভুল
বুঝেছেন সিরা। আমি তো মাত্র একটা কবিতার কঠিন জায়গাগুলো বুঝে নিতে চাই...' স্যার আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলেন, 'সে আমি
বুঝেছি বৈকি। তুমি অন্য কারো কাছে যাও', বলে মেইন গেটের
সিঁড়ি বেয়ে গেট পেরিয়ে চলে যান। আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। একি ব্যবহার একজন
শিক্ষকের? টাকা ছাড়া একটা কবিতার কয়েকটা লাইনও না? আমার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে যায়, পায়ের পেশি শক্ত লোহা,
গেটের দেয়ালে লাথি মারি। পায়ে ব্যথা লাগে খুব।
টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। পার্ট ওয়ান ইউনি ভার্সি
টির পরীক্ষা, তাই টেস্ট দিয়ে
পাস করলেই কলেজ ফাইন্যালে বসার অনুমতি দেবে। ইংরেজী পরীক্ষার একই দিনে দুটি পার্ট
পেপার হয়ে গেলে। পরের দিন বাকি দুটি পার্ট। সেদিনের ফার্সট পার্টটা দিয়ে যখন
সেকেন্ডটায় বসেছি, মাথা গরম হয়ে গেল, এই
পেপার সেট করেছেন টিএনসি, মানে তারকনাথ চক্রবর্তী। সেদিনের
অপমানের রক্ত যেন সারা শরীর থেকে ছুটে গিয়ে মাথায় জমে গেল। আমি মনে মনে চিৎকার করে
উঠি, 'নো নো নেভার। নেভার আই উইল আনসার দোজ কোশ্চেনস সেট বাই
সাচ আ বারবারিক ব্লাড থার্সটি টিচার!' আমি ঠিক এ কথাগুলোই
একটু বড় বড় অক্ষরে আনসার শিটে লিখে দিলাম। শেষটায় যোগ করলাম, 'আই লীভ দ্য একজামিনেশন হল ইন প্রোটেস্ট।'
স্বভাবতই আটক গেলাম। বাকি পেপারগুলোর মারক্স আমাকে পাশ
করালেও, আমি সেন্ট আপ হলাম
না। কলেজ অফিসে গিয়ে দেখলাম, লিস্টের কোথাও আমার নাম নেই।
মানে, আমার ছাত্র জীবন থেকে আরো একবছর বাদ হয়ে যাচ্ছে। পূর্ব
পাকিস্তানে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সামিল হওয়ায় আইএসসি পরীক্ষা দিতে না পারায় দু বছর,
এবার যুক্ত হল তার সঙ্গে আরো এক। সত্য, অভীক,
অর্জুন সব শুনে আমাকে শান্ত করার জন্য বসন্ত কেবিনে নিয়ে যায়। অনেক
বোঝায়। 'জিদ করিস না। টিএনসি'র কাছে
একবার যা, ওনার রাগ কমে যাবে।' অর্জুন
বলে, 'তুই একজন শিক্ষককে বারবারিক, ব্লাড
থার্সটি বলে অন্যায় করেছিস।' অভীক বলে, 'সমাজে গুরু শিষ্য পরম্পরা মানতে হয়। গুরুরা সব সময় নির্ভুল।' আমি মানি না। চুপ করে থাকি। ওদের পারিবারিক সামাজিক মানসিকতায় ওরা
সারেন্ডার করে বসে আছে, তাইতে আমি কেন আমার সিদ্ধান্ত
পাল্টাব? ঘটনাটা কয়েকদিনের মধ্যে কলেজে চাউড় হয়ে গেল। সব
শুনে কেউ গালাগাল দিতে লাগল তারকবাবুকে, কেউ আমার জন্য দুঃখ
প্রকাশ করল, কেউ বলল, পড়াশুনার
ব্যাপার। ঝঞ্ঝাট মিটিয়ে ফেলাই ভালো। আমি শুনে যাই। কিন্তু এ সবে মাথার রক্ত শরীরে
ছড়ায় না। মাথাতেই জমাট বেঁধে থাকে।
আমার প্রিয় মাস্টারমশাই, তিনি আমাকে এই কলেজে ইংরেজী অনর্সে ভর্তির সুযোগ
করে দিয়েছেন, একদিন টীচার্স রুমে ডেকে পাঠালেন, 'আমি তারকবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি, উনি বলেছেন, তুমি ক্ষমা চাইলেই উনি তোমাকে মাফ করে দেবেন। তুমি ফাইন্যালে বসতে পারবে।'
সিএনআরের সামনে থতমত খেয়ে যাই। ওঁর চোখমুখ দেখে বুঝতে পারি, উনি আমার ব্যবহারে আহত হয়েছেন। আমি মাথা নিচু করে খানিক চুপ করে থাকি।
তারপর ভয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলি তারকবাবুর ব্যবহারের কথা, আমার
চোখে শিক্ষক ছাত্রদের সম্পর্কের কথা, আমার বিশ্বাসের কথা,
আমার প্রত্যয়ের কথা। বুঝলাম, তিনি কনভিনসড
হলেন না। বললেন, 'এভাবে নিজের ভবিষ্যত খারাপ কোর না, অরুণ। বলেছিলে তোমার অলরেডি দু' দু'টো বছর নষ্ট হয়েছে, আরো একটা বছর নষ্ট কোর না।'
আমি কথাটা ঘুরিয়ে নিই, স্যারকে বলি, 'আপনি আমাকে অন্য কলেজে ভর্তি করে দিন, স্যার। যে কোন
কলেজে। আমার ভালো দামী কলেজের দরকার নেই। আমার নিজের ওপর ভরসা আছে, স্যার। আমি সামলে নেব। যদি
সফল হই এই সব এক দু' বছরের
হিসাব আমারও মনে থাকবে না।' আরো খানিক এই ভাবে আমাদের একে
অপরকে বোঝাবার পালা চলল। তিনি আরো কয়েকজন স্যারকে ডাকলেন, সবাই
সিএনআরের সঙ্গে একমত, 'ক্ষমা চেয়ে নাও, অরুণ।'
সবাই পরীক্ষায় বসল। আমি না। অভীক, অর্জুন, সত্য
তিনজনই। চন্ডী পড়ত আমাদের এক ক্লাশ নিচে, গুরুদাস কলেজে।
এদের কারো সঙ্গে আমার সাব্জেক্টের মিল নেই। অভীকের বাংলা অনর্স, অর্জুনের পলিটিক্যাল সায়েনস আর সত্যর ইকনমিক্স। তাই ওরা পরীক্ষা দিতে গেলে
আমি শেষের সময় ক'টি বসে থাকতাম বসন্ত কেবিনে। ওরা এলে আড্ডা
হত। তারপর যে যার ঘরমুখো। আমি অবশ্য যেতাম আমজাদীয়ায়, পাড়ার
ছেলেদের সঙ্গে আর এক প্রস্থ আড্ডা, তারপর ঘরে ফেরা।
পরীক্ষা শেষে আমরা যেন মুক্ত পাখি। পার্ট টু'র কথা তো ভাবব পার্ট ওয়ানের রেজাল্টের
পরে! মাস দুই তিন অপেক্ষা তো করতেই হবে। তবে কলেজে পড়াশুনো থেমে থাকে না। ওরা
তিনজন ধীরে ধীরে সিরিয়াস হতে থাকে। পার্ট টু মানে জীবন মরণ যুদ্ধ। নিজেদের কাছে,
পরিবারের কাছে, সমাজের কাছেও। কলেজে নিয়মিত
যেতে থাকে। ক্লাশ ফাঁকি দেয় না। আমি অবশ্য না। আমার হাতে অঢেল সময়। সিএনআর বলেছেন,
পার্ট ওয়ান শেষ হলে তিনি অন্য কোন কলেজে আমাকে ভর্তির ব্যবস্থা
করবেন। সেই আশায় বসে আছি। আমি সিটি কলেজে আর যাই না।
পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বের হল। আমি হতভম্ব। বাকি তিনজনের
মুখ কালো। ওরা তিনজনেই ফেল করেছে। কী করে হল? অত্যন্ত বুদ্ধিমান এক একজন। তবু? বাড়ির সংস্কৃতিও
ওদের অনুকুল। কলেজ, ভাইবোন, বাবা মা
সবই অনুকুল। তবু ফেল? কী করে হতে পারে? আমরা কি বেশি আড্ডা দিয়েছি, একেবারেই পড়াশুনো করিনি?
কারো কাছে উত্তর নেই। সবাই সেদিন গিয়ে বসলাম অর্জুনদের বাড়ির কাছে
বেলেঘাটা লেকের সবুজ ঘাসে। লেকের জলে মাছেদের ঘাই নেই। আমাদের মধ্যেও কোন কথা নেই।
নিস্তরঙ্গ জলস্তরকে ছাপিয়ে তোলপাড় হচ্ছিল এক একজনের বুকের ভেতরটা। এক সময় আমি রেগে
যাই। 'অভী, তুই কী করে মাসিমার সামনে
দাঁড়াবি, ভেবেছিস?... অর্জুন, পারবি তো বাড়ির বড় দাদা হয়ে মানা আর তানার সামনে মুখ উ'চু করে তাকাতে?... সত্য, তুই?
শিবানী কিছু জানতে না চাইলেও, বোবা ইন্দ্রাণীর
চোখ কি প্রশ্ন করবে না তোকে? আমি নির্মম হয়ে ওদের বুকে মাথায়
হাতুড়ি পিটতেই থাকি। থামি না। 'তোরা যাই বল, আমি পরীক্ষা দিলে কম মারক্স হয়ত পেতাম, কিন্তু ফেল
করতাম না কখনই।' সত্যি কী হত জানি না। আমি নিজেও যেন ওদের এই
অবস্থায় দিশাহারা। ভয় হচ্ছিল, এই পার্ট ওয়ান আমাদের বন্ধু
বিচ্ছেদ ঘটাবে না তো?
ওদের ফেল করাটা আমার ভেতরটা অনুশোচনায় তোলপাড় করে দিল।
ওরা প্রত্যেকে নিজেদের পরিবারের শিক্ষা সংস্কৃতি আর ভালোবাসার পরিমন্ডলে বাস করে।
একমাত্র আমি না। আমার পারিবারিক মন্ডল নেই, না পারিবারিক শিক্ষা বা সংস্কৃতিতে। আমার ছোঁয়ায় ওরা, মনে হল, নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আমার সময় কাটাবার তাগিদে
ওদের ঘর থেকে বাইরে এনে আড্ডার গাড্ডায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। ওরা ধীরে ধীরে
কূয়োর জলে ডুবে ডুবে গেছে। আমি জলে নামি নি। কেননা, আমি
ছিলাম ঐ অন্ধকূপের মালিক। নইলে ওরা কেউ আমার চেয়ে কম মেধাবী বা বুদ্ধিমান তো নয়,
আমি জানি, তবু এমনটা হয় কী করে? আমার ভাবনা সমর্থন পায় অর্জুনের বাবার কথায়। আমি কোন বন্ধুর বাড়িতেই
যাচ্ছিলাম না ক'দিন। আমজাদীয়ার বাইরে যেতাম না। ওরা আসত
আড্ডা দিতে। একদিন অর্জুন বলল, 'তুই আমাদের বাড়ি অনেকদিন
যাচ্ছিস না বাবা খেয়াল করেছে। বাবা কি বলল জানিস? 'অরুণ আসবে
কি? সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তাদের পড়ার সময় বরবাদ
করে পরে রাত জেগে পড়াশুনো করে নিজের ঘর গুছিয়েছে। এখন কোন মুখে আসবে?' সবাই মেশমশয়ের কথাটা হাসাহাসি করে উড়িয়ে দিল বটে, আমি
পারলাম না। মেশমশয় দূর্দ্রষ্টা। তিনি একশ ভাগ ঠিক মনে হতে থাকে সেদিন থেকে। আমি
নিজেকে সতর্ক করতে থাকি, সতর্ক থাকতে শুরু করি...
প্রথম খণ্ড সমাপ্ত
অরুণ চক্রবর্তী