(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -১৩
ফুস মন্তর দুনিয়া
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়
ডাঃ গৌতম খুঁজছেন জিনিসটা। অনেকক্ষণ থেকে
খুঁজছেন। শুধু খুঁজেই যাচ্ছেন আর খুঁজেই যাচ্ছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। জিনিসটা আর
কিছুই নয়। টাকার দামে বেশি দামি নয়। তবে এই মুহূর্তে খুব দামি তার কাছে। একটা বই।
অনেক বই পড়ে আছে। টেবিলে স্তুপাকার। কিন্তু যে বইটা দরকার তা নেই। কিংবা আছে চোখের
সামনেই কিন্তু চামড়ার চোখ মনের চোখের সঙ্গে চোখ মেলাতে পারছে না আর তাই সেটা দেখতে
পাচ্ছেন না।
এমন হয় অনেক সময়ই। হয় অনেকের এমন কি প্রায়
সকলের কাছেই। হাসির লেখক শিবরাম একটা গল্পে লিখেছিলেন যেটা দরকার সেটা ছাড়া অন্য
জিনিস এসে হাজির হয় তার সামনে। আবার যখন সেই “অন্য জিনিসটার” খোঁজ করা হয় তখন সেটা
পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় আজকের জিনিসটা। তাঁর গল্পটা হয়ত হাসির। কিন্তু বিষয়টা
হাসির নয়কো মোটেই- মর্মান্তিক সত্য।
ডাঃ গৌতম ভাবতে লাগলেন তাই তো এমন যদি হত যে
বইপত্র বা পড়ার জিনিসগুলো একটু অন্যরকম হত। সেগুলো খোঁজার জন্যে এত পরিশ্রম করতে
হত না। এই ডিজিট্যাল যুগে সব কিছুই তো ডিজিট্যাল হওয়া ঠিক। মন সঙ্গে সঙ্গে বলল আছে
তো। ওয়েব ম্যাগ বা ইন্টারনেট ম্যাগাজিন। যেগুলোর অস্তিত্ব একমাত্র ডিজিট্যাল
জগতেই। কিন্তু সেগুলোর জন্য মানে সেই সফট ডকুমেন্টগুলোর জন্যও লাগে কম্পিউটার,
ল্যাপটপ, মোবাইল বা ট্যাব জাতীয় হার্ড কোনও মাধ্যম মানে যাদের ধরা ছোঁয়া যায় আর
কি।
কিন্তু এবার ডাঃ গৌতম যে আবিস্কারটি করেছেন
তা একেবারে মোক্ষম। সবার প্রথমে সব কিছু দেখান তিনি সাংবাদিকদেরই। এবারেও
ব্যতিক্রম হল না এতটুকু। ডাঃ গৌতমের প্রেস কনফারেন্সে ভিড় একেবারে উপচে পড়ার কথা।
যত দিন যাচ্ছে ভিড় ততই বাড়ছে। কৌতূহলী জনতাও অনেক ঢুকে যাচ্ছে সাংবাদিকদের
ছদ্মবেশে। কারণ আর কিছুই নয় কৌতূহল। আর এই কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারেন বলেই তিনি এত
জনপ্রিয়। এসব তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা। আর তাই নিজের সিন্থেটিক বটগাছতলার পাশে আরও
কাঠা তিনেক ফাকা জমি কিনে নিয়ে সেখানে বানিয়েছেন একটা পার্মানেন্ট প্রেস গ্যালারি।
নির্দিষ্ট দিনে হাজির সবাই। হাসিমুখে হাজির
ডাঃ গৌতমও।
-আজ শুরুতেই আপনাদের একটা ভিডিও দেখাব।
সবাই ওঠার জন্যে উসখুস করতে লাগল। নিশ্চয় এর
পাশে একটা ভিডিও হল করেছেন ডাঃ গৌতম আর যেখানে যাওয়ার জন্যে সাংবাদিকদের মধ্যে
হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। সবাই হুড়মুড় করে উঠতে যাবে এমন সময় ডাঃ গৌতম হাত নেড়ে বসতে
বললেন।
-বসুন বসুন কোথাও যেতে হবে না আপনাদের।
এখানেই দেখবেন যা কিছু।
সবাই তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এখানে কোথায়?
না আছে কমিপিউটার, ল্যাপটপ, এল-সি-ডি বা দেওয়াল জোড়া ভিডিও মনিটর। শুধু ডাঃ
সাহেবের হাতের ফাঁকে একটা ছোট্ট রিমোট ঠিক একটা মোবাইলের মত। কিন্তু ডাঃ গৌতম এখন
হলেন বিশ্ববন্ধু। তাঁর কথা তো আর বাজে কথা হতে পারে না। হাতের মোবাইলের মত রিমোটটা
দেওয়ালের দিকে টিপতেই সবাই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল যেখানে দেওয়াল ছিল সেখানে একটা
ভিডিও মনিটর এসে গেছে। ডাঃ গৌতম নাকি সুকুমার রায় পড়তে খুব ভালবাসেন। তাই এ যেন
সেই হযবরল। ছিল রুমাল হয়ে গেল কাঠবেড়ালি। পেছনে তাকিয়ে ভাল করে তাকিয়ে নিয়ে আবার
রিমোট টিপলেন ডাঃ গৌতম। এবার মনিটর ঠিক মাপমত মানে সারা ঘরের শেষ প্রান্তে বসা
লোকের দেখার উপযুক্ত হল। আবার বাটন টিপলেন ডাঃ গৌতম। এবার চলে এল একটা সার্চ
ক্যাটালগ। দ্রুত স্ক্রল করে একটা ফাইল সিলেক্ট করে বাটন টিপলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রীনে
ফুটে উঠল চেন্নাইয়ের সাম্প্রতিক বন্যার ছবি। খানিকটা দেখার পর আবার বাটন টেপা। সব
ভ্যানিস। দেওয়াল আবার সেই দেওয়ালে ফিরে গেল। সবাই হৈ হৈ করে উঠল। থ্রী চিয়ার্স
দিতে লাগল। এ কি আবিস্কার। আবার একটা বাটন টিপলেন ডাঃ গৌতম। এবার কোনও ভিডিও
স্ক্রীন নয়। একেবারে একটা নিউজ পেপার চলে এল। কাগজটা আজকের - একেবারে টাটকা। পাতার
পর পাতা উলটে চললেন রিমোটের বাটন টিপে। রিপোর্ট, ছবি বিজ্ঞাপন সব। পাশেই আজকের সেই
সংবাদপত্র পড়েছিল কয়েকজন সেটা খুলে মিলিয়ে নিল। সব ঠিক আছে। তার মানে হার্ড কপিরই
এটা সফট। তারপর বাটন টিপে আবার কাগজ হাওয়া।
এরপর আবার বাটন টেপা হল। দেওয়ালে চলে এল একটা
টিভি স্ক্রীন। একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাতে লাগলেন শুধু রিমোটের সাহায্যে। সবাই
তো যার-পর-নাই অবাক। সারা জগতটাই চলে এসেছে ডাঃ গৌতমের একটা হাতের ছোট্ট মুঠির
মধ্যে। সীমাহীন ডিজিট্যাল জগতের মধ্যে হার্ড কেবল একটাই। ছোট্ট রিমোটটা।
আবার বাটন টিপলেন ডাঃ গৌতম। দেওয়ালে চলে এল
শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’। পাতার পর পাতা উলটে চললেন। এরপর এল রবীঠাকুরের সঞ্চয়িতা,
গীতবিতান, বিভুতি ভূষণের “পথের পাঁচালি”, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি
আরও কত কি। গোটা একটা লাইব্রেরী- বাটন টিপলেই সব ভোঁ ভা।
সবাই বিস্মিত, বিমুগ্ধ। সারা জগৎ আক্ষরিক
অর্থেই একটা মুঠোর মধ্যে। “কর লো দুনিয়া মুঠঠি মে” স্লোগান অভূতভাবে সার্থক। ভারত
আজ সারা দুনিয়াকে এক করল। সারা দুনিয়া মানে শুধু পৃথিবীই নয়। মঙ্গল চাঁদ এমন কি
সৌরজগতের আরও অনেক খবর।
ডাঃ গৌতম বললেন, এখন থেকে আর সংবাদপত্রের
দপ্তরে এত জায়গা লাগবে না। কারণ কোনও হার্ড কপি ছাপা হবে না। রিমোটের বাটন টিপলেই
আপনি যোগাযোগ করতে পারবেন কাগজের অফিসের সঙ্গে। তারা দাম জানাবে। প্রিপেড বা পোষ্ট
পেড সব রকমই থাকছে। কাউকে হার্ড ক্যাশ একটি পয়সা ব্যয় করতে হবে না। সব নেট
ব্যাংকিং-এ হবে।
বইয়ের ক্ষেত্রেও এক। কোনও পাবলিশারকে হার্ড
বই ছাপাতে হবে না। পয়সা ফেললে ভার্চুয়াল বই চলে আসবে। বই কিনতেও পারেন বা ধার
করতেও পারেন। সেক্ষেত্রে ঘন্টা প্রতি চাঁদা ধার্য হবে। এই ডিজিট্যাল বই সুদূর
ভবিষ্যতে যেমন লক্ষ লক্ষ কোটী কোটী বছর পরেও অবিকৃত থাকবে। কোনও বই নষ্ট হয়ে গেলে
রিকভারি সফটওয়্যার দিয়ে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে।
টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও তাই। কেবল অপারেটরদের
দয়া দাক্ষিন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না এতটুকু। কোন চ্যানেল কতটা দেখছেন তা নিয়ে
মাসের শেষে বিল হয়ে যাবে। এই বিল ডিজিট্যাল অর্থাৎ রাখার কোনও ঝামেলা নেই। আপনার
সম্মতি থাকলে এই বিলের টাকা ই-ব্যাংকিং-এর সাহায্যে চলে যাবে চ্যানেলের অফিসে।
-এত বড় ডিজিট্যাল ওয়ার্ল্ডে হার্ড শুধু
একটাই, বললেন ডাঃ গৌতম, শুধু আমার মুঠোর এই রিমোটটা।
- আর দেওয়ালটা? সেটাও তো হার্ড নাকি?
যুক্তিসঙ্গত তার্কিকের প্রশ্নে মৃদু হাসলেন
ডাঃ গৌতম। আবার টিপলেন হাতের রিমোটের বাটন। এবার মারাত্মক এক চমক অপেক্ষা করছিল
সকলের জন্যে। দেওয়ালে নয় সম্পূর্ণ হাওয়াতে ভাসছে একটা টিভির প্রোগ্রাম। একটা নিউজ
চ্যানেলের খবর আর বিভুতি ভূষণের আরণ্যক। হ্যাঁ এইবার মনে হচ্ছে আমরা সত্যি সত্যি
ডিজিট্যাল বিজ্ঞানের সাহায্য পাচ্ছি। আমরা সত্যি উন্নত হচ্ছি। বলতে ভুলে যাচ্ছি
এবার থেকে একটা ডিজিট্যাল বিশ্বমিত্র পুরস্কার চালু হচ্ছে। আর তার প্রথম প্রাপক
আমাদের সুপরিচিত ডাঃ গৌতম ছাড়া আর কেই বা হতে পারে বলুন?
৪/১২/২০১৫
ডঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়