আমাদের মা
আমাদের মা ছিলেন অধুনা বাংলাদেশের যমুনাপারের
মানুষ। সাত্তিক ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে পাঁচ বোন দুই ভাই। ছোট্ট জমি আর বাড়ি। যজমানি
উপায় সম্বল। মাটি বুরবুরি কাটলেই বাক্স পেঁটরা নিয়ে দৌড়। পিছনে নদীর পেটে তলিয়ে
যেত সাধের টেম্পোরারি সংসার। আবার যুদ্ধ। বাবা মা'র পাশাপাশি সব হাত জোট বাঁধত। এহেন পরিবারের মেয়ে আশালতা, তৃতীয় কন্যা, ১১ বছর বয়স, পাড়ি দিলেন দিনাজপুর। আত্মীয়সম পড়শির বাড়ি। সেখানে এমএ পাশ করা বর আসবে বিয়ে
করতে। একই পাড়ার ২২ বছরী টগবগে যুবক, বরদাভূষণ। ছেলেটা পাগল প্রায়। স্বাধীনতা
স্বাধীনতা লড়াই লড়াই ছাড়া কিছুই বোঝে না। লোহার মত শক্ত জিদ। কৃচ্ছতায় ক্ষোভ নেই, দান ধ্যানে নেই কৃপণতা।
আশালতার কাছে এ সব কোন নতুন জীবন নয়। সংগ্রাম তো তার কচি
বয়সেরই সঙ্গী! কিছুদিনের মধ্যে ওই অল্প বয়সেই আশালতা জড়িয়ে
গেলেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে। প্রথমটায় বরদাভূষণের আড়ালে। সমবয়সী দেবর ও তার বন্ধুদের
সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন সশস্ত্র বিপ্লবে। প্রখ্যাত হিলি মেইল ডাকাতিতে অংশ নিয়ে ব্যার্থ
হয়ে বন্দী হলেন। আলিপুর দেউলি বহরমপুর জেলে বন্দী থাকলেন। সঙ্গীদের কারো হল
আন্দামানে যাবজ্জীবন, কারো দীর্ঘ কারাবাস। ডাকাতিতে সরাসরি যুক্ত
থাকার অপরাধ অপ্রমাণিত হওয়ায় আশালতা মুক্তি পেলেন বটে কিন্তু ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার
অপরাধে স্বামী বরদাভূষণের হল সাত বছরের কারাদন্ড। প্রথম সন্তানকে কোলে নিয়ে আশালতা
এরপর সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সরে এলেন। নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন দিনাজপুরের নানা
রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। কিছুদিনের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন উত্তরবঙ্গের
তেভাগা আন্দোলনে। কৃষক ফ্রন্টের মহিলা সংগঠনের দায়িত্ব পেলেন। আশালতা হয়ে উঠলেন
সবার শ্রদ্ধাভাজন 'আশাদি'।
আমাদের মা'র কথা মনে পড়লে ছোট ছোট স্মৃতি-ছবির মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে। মা
হাঁটছেন ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ মিছিলের পুরোভাগে, সঙ্গে আরো অনেকে। আমি মা'র পাশে পাশে, কখনো মা'র আঙুলে আঙুল আংটা করে, কখনো ছোট্ট প্লয়াকার্ড কাঁধে, কখনো পাশে পাশে দৌড়ে দৌড়ে... সন্ধ্যেয় পুজো মন্ডপে আরতির ধুনুচিতে ছোবড়া
গুঁজতেই ছুটে গিয়ে মাকে খবর দিতাম, 'এখন আরতি শুরু হবে!'. মা দ্রুত বাড়ি থেকে বের হতেন, সপ্তমী-অষ্টমীর মৃদু চাঁদের আলোয় আমরা মা-বেটা দ্রুত পা ফেলে ফেলে বারোয়ারি পুজো মন্ডপে। মাকে নিয়ে
আমার পুজোর স্মৃতি এই একটাই। প্রতি বছরের একই ছবি। মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ধোঁয়া সরিয়ে
সরিয়ে দুর্গার মুখ নিরীক্ষণ করছেন। আজো দুর্গার
মুখে চোখ পড়লেই কখনো সখনো সেখানে বদলে ভেসে ওঠে মা'র মুখ। মা'র স্বভাব কোমলতা আমাকে দুর্বল করে রাখত সব
সময় এসব নানা কারণে। কিন্তু মা কি সত্যি খুব কোমল ছিলেন? সব সময় হয়ত না। একটা ঘটনা বলি।
মা’র সঙ্গী সাথীরা
সমাজ সচেতনতা আর সংসার সচেতনতার মিশেল মা'র চরিত্রে কোমলতা আর কঠোরতার বৈপরীত্য এনে থাকবে। আমি তখন
ছোট। মা'র আঁচল ধরা অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী থাকে যে ছোটরা, তাদের মত আমি বরাবর। একদিন সারাদিন ধরে বাড়িতে অনেক মহিলার
আনাগোণার পর সন্ধ্যার সময় মা বললেন, 'চলত আমার সঙ্গে!' আমি খালি পায়েই, যেমন থাকি, মা'র সঙ্গে পায়ে পায়ে। পাড়াতেই এক গোয়ালা পরিবার থাকতেন, গরু বাছুর ছোটবড় বালতি আর বাড়ি জুড়ে মজার দুধ দুধ গন্ধ। আমি
অনেক দিন ওদের কাঁসার ঢাউস গ্লাসে করে দুধ খেয়েছি। মাগনায়। ওরা আমাদের পরিবারকে
খুব সমীহ করত। এখন অত ডিটেইল মনে নেই। মা ওদের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন, বাড়ির মাসীমাকে বললেন, 'দিদি, অমুককে (নাম মনে নেই) ওদের বাড়ি থেকে ডেকে আনতে পারেন?' দুটো বাড়ি দূরে ওই দাদাদের বাড়ি। দাদাটি ঘরে ঢুকতেই মা
বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে যান, কাছে গিয়েই সেই বড়দার বয়সী দাদাটার দু'গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষালেন। মা রেগে কাঁই। 'এ পাড়ায় কোনরকম বাঁদরামো চলবে না। আর একটিবার যদি এসব কথা
কানে আসে তোমার বাবা-মা'র সামনে আমি সব ফয়সালা করব।' ছেলেটি হাঁ. আমি থতমত। গোয়ালিনী মাসীমাকে দেখে মনে হল তিনি সব জানতেন। শুধু সেই
দাদাটাকে বললেন, 'তুই এখন বাড়ি যা। ভালো ছেলে হবার চেষ্টা কর।'
মা'র বন্ধু বলব না, সঙ্গী ছিলেন অনেকে। সবাই সাধারণ মানুষ। মা'কে খুব স্নেহ আর সম্মান করতেন তাঁরা। মা'র এই সব সঙ্গীদের কারণেই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে নিজেদের কেউ
কেটা ভাবার মানসিকতার ছায়াটুকুও পড়েনি। আমার মনে কোনদিন প্রশ্ন ওঠেনি আমাদের
পরিবারের মত সারা শহরে পরিচিত পরিবারের গৃহবঁধূ, ডাক্সাঁইটে উকিল এবং একজন স্বীকৃত পন্ডিত ব্যাক্তির স্ত্রী হয়ে অমন মানুষদের
সঙ্গে মা মিশতেন কেন। এই এত বড় বয়সেও আমার সে কথা মনে হয় নি কখনো। গোটা পাড়াটাই
ছিল আমাদের যৌথ পরিবার। মা ছিলেন ঘুঁটে কুড়ুনি দিদিমার কাছে 'ঠাকুর্ঝি', রিকশাওয়ালা পূণ্যদার 'বৌদি', কলেজ কেরানীর স্ত্রীর কাছে 'ননো মা', স্কুল মাস্টারের ছেলেমেয়েরা মাকে ডাকত, 'পিসিমা', অন্যদের কাছে কাকিমা জ্যেঠিমা তো ছিলেনই।
স্বামী পরিতক্তাকে মা ডাকতেন 'বৌদি' বলে, স্কুল মাস্টারকে দাদা, মা ভাদুড়িবাড়ির দিদিমাকে 'মা'
বলে ডাকতেন, কোমর ভাঙ্গা হতদরিদ্র দিদিমাকে ডাকতেন 'মাসিমা' বলে... মনে আছে মা এদের কারো কারো সঙ্গে মাইল খানেক
দূরের লিলি টকিজে হেঁটে হেঁটে সিনেমা দেখতে যেতেন। মা চলতেন, পিছনে পাড়া পড়শির মিছিল। একবার হাত পা ছুঁড়ে
কান্নাকাটি জুড়ে মায়েদের সঙ্গ নিয়েছিলাম। ঘুঁটে কুড়ুনি দিদিমা বললেন, 'ওকে সঙ্গে নেন ঠাকুর্ঝি। ও অত শত বুঝবে না।' মনে আছে, সিনেমাটির নাম ছিল 'দাসীপুত্র'. ফেরার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দিদিমার হ্যাঁচকা
টান সামলাতে সামলাতে অতি কষ্টে বাড়ি ফিরি। মা'র কি এই বৃহৎ পরিবারের দায়িত্ব নেবার কোন প্রয়োজন ছিল? আমাদের খোলা মনের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে তো এসবের দরকার
ছিল না। তবে? প্রশ্নগুলো এখন মাথায় আসছে বটে এর আগে কখনো
আসেনি। কারণটা জেনেছি মা'র মৃত্যুর বছর ষোল-সতের পরে। এই কিছুদিন আগে।
তেভাগা আন্দোলনে দিনাজপুরের ভূমিকা নিয়ে
গবেষণা করছেন এখন কলকাতাবাসী শ্যামল সেন। তিনিই আমাকে একদিন এক হোমিও ডাক্তারের স্ত্রীর সঙ্গে মা'র সম্পর্কের ডিটেইল জানতে চাইলেন। আমি তো
তাঁকে আমাদের পাড়ার জ্যেঠিমা বলে জানি, তার বেশি না। তিনি বললেন, ' এই সাধারণ মানুষগুলো আপনার মা'র কাছে ছিলেন তাঁর বিপ্লবী সময়ের এজেন্ট। কেউ বিপ্লবীদের
সঙ্গে চিঠিপত্র চালাচালি করতেন। কেউ বা অস্ত্র, কেউ বা বোমা এই সব। লুকিয়ে।
পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে এই পন্থা নেয়া হত। পুলিশের গোপন নথিতে এঁদের কয়েকজনের
নাম পেয়েছি, যাঁরা আপনার মা'র আন্ডার্গ্রাউন্ড কানেক্টরের কাজ করতেন... আমি আজো থ হয়ে আছি। আমরা ভাইবোনরা কেউ কোনদিন জানতাম না! বাবা কি জানতেন? বোধয় না।
আট সন্তানের সংগ্রামী জননী
আমরা ছিলাম আট ভাই-বোন। বড়দা, মেজদা, বাচ্চু
তারপরেই আমি। আমার পরে বোন, আবার ভাই, আবার বোন, আবার ভাই। এই আট। বাবাকে
আমি জেলখানার বাইরে দেখেছি খুব কম। অখন পাকিস্তান হল, তখন আমার বয়স দুই। যখন আমি
পাকিস্তান থেকে পালালাম তখন আমি সতেরো। পরে , বাবাকে আইয়ুব খানের সরকার যখন বিনা
বিচারে, মানে সরকারি দলের মিটিং-এ গাড়ি না-দেবার অপরাধে ধরে নিয়ে গেল, মা হাই
কোর্টে হেবিয়াস করপাস আবেদন করেছিলেন। সরকারী পক্ষ এই সময় আদালতে যে চার্জশিট
দিয়েছিল। তার কপি আমার কাছে আছে। দেখছি পাকিস্তান স্বধীন হবার পরের বছর থেকে ১৯৭১
সাল, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া অবধি বাবা একাধারে দেড় দু বছরের বেশি জেলের বাইরে
ছিলেন না। এমন কি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জেল গেটেই নিরপ্ততা আইনে আবার গ্রেফতার
হচ্ছেন। মূলত হিন্দু বলেই বাবাকে ‘দেশের
নিরপত্তার জন্য’ গ্রেফতার করতে সরকারের পক্ষে মোটেই কাঠখড় পোড়াতে হ’ত না। আমাদের মা, ক্লাশ সিক্স-সেভেন অবধি পড়া মহিলা,
এই অবস্থায় আট সন্তানকে মানুষ করলেন কী করে? বড়দা ডাক্তারি পাশ করে ডাক্তারি করতে নামেন
১৯৬০ সালে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে বিতাড়িত করতে করতে মেজদা হয়েছেন চার্টার্ড
একাউন্ট্যান্ট, বাচ্চু ডাক্তার, আমার ছোটদের মধ্যে এক বোন ডাক্তার, ভাই চার্টার্ড
পড়ুয়া, ছোটবোন কলেজ ছাত্রী। কী করে সম্ভব করলেন মা এমন কান্ড?
মা’ জীবন সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামেরই অংশ
বলে ভাবতেন, আর সেখানেই ছিল আমাদের পরিবারের গৌরব। বাবা দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে
সফল করতে জেলের ভেতরে, আমরা জেলের বাইরে সেই একই সংগ্রামে নানা ভাবে নিয়োজিত, এমনটাই
ভাবতাম। সম্ভবত এজন্যেই মা’র প্রশ্রয়ে আমরা প্রত্যেকে ছিলােক একে ধরণের সংগ্রামে
জড়িয়ে। এজন্যেই স্কুলের ছাত্র মেজদা এসডিও অফিসের পাইপ বেয়ে জানালা গলে এসডিও
কোর্টে ঢুকে বন্দীমুক্তি দাবীতে স্লোগান দিত পারত, বাচ্চু ঢাকার জগন্নাথ হলের
দরজার কাঁচ ঘুষিতে ভেঙে সেই রক্তাক্ত হাতে মুস্লিম লীগের ছাত্রদের সঙ্গে লড়াইয়ে
জড়িয়ে পড়তে পারত, আমি নানা বিপ্লবী নাটক, আবৃত্তি, গান, নৃত্যনাট্যে অংশ নিতে
পারতাম। ছোটরা পারত নজরুল-সুকান্ত আবৃত্তি করতে, একই সঙ্গে আমাওরা সবাই যে যার
পড়াশুনাও চালিয়ে যেতে পারতাম। মনে আছে, বাবা জেলে থাকলে, আমার একটা ডিউটি বেড়ে
যেত, মাস ফুরোবার আগেই কোর্ট চত্বরের পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্টাল সার্টিফিকেট ভাঙিয়ে
টাকা নিয়ে আসা।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কোন ঝি-চাকর দেখিনি।
মা রান্নাও করতেন, বাসনও মাজতেন, সারা বাড়ি ঝাঁট দিতেন, নানা ফুকের গাছের যত্ন
নিতেন, আমাদের জামা কাপড়ও কাঁচতেন। সময়ে আমরাও মা’র নানা কাজে হাত দিতাম, অবশ্যই,
স্কুলের শেষে বা দিনের পড়াশুনোর ফাঁকে।
মনে পড়ে, আমি আর বাচ্চু একটা ছোট বাঁশ আর
বালতি নিয়ে মাড়োয়ারি পট্টির এক সাবানের ফাক্টরিতে প্রায়ই হাজির হতাম। বালতি ভর্তি
করে আমরা সাবানের জল আনতাম, বালতি ঝুলত আমাদের দু’জনের দু’ কাঁধে
ধরা বাঁশের টুকরো থেকে। মা বাড়ির সবার জামা-কাপড় কাঁচতেন সেই সাবান জল
দিয়ে। পাড়ার সবাই আমাদের দেখে আমাদের বাবা- মা দু’জনেরই প্রশংসা করতেন, আর সেটাই
জ্বল জ্বল করত আমাদের সব ভাইবোনের বুকে মেডেল হয়ে।
মা আমাদের কোন যাদুবলে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন
যে কোন সংগ্রামে নির্ভয়তা, সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে একাত্মতা, বৃহত্তর ক্ষেত্রে সামাজিক
ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা (মা বলতেন, এটাই
রাজনীতি) এবং, সর্বোপর্ নিজের প্রতি নিজের বিনম্রতা।
আমাদের
প্রত্যেক ভাইবোনকে নানা সামাজিক পরিবেশে সচেতন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বাবার
মৃত্যুর ২১ বছর পর মা তাঁর পরিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন
১৯৯৫ সালে।
……………………এর পর পরবর্তী সংখ্যায়
অরুণ
চক্রবর্তী