বাঙালির রান্নাঘর একটা ঐতিহ্য। শুরু করি সেকালের রান্না ঘরের কথা দিয়ে যদিও আমিই এখন প্রায় সেকাল ঠেকেছি ,আমি একজন সিনিয়র সিটিজেন
I ছোটবেলায় বাড়িতে রান্নাঘর মানে বেশ বড় একটা ঘর, দুটো উনুন,জিনিসপত্রে ঠাসা I
এক দিকে আমিষ একদিকে নিরামিস কোনকিছু মেশামেশি নেই।
সম্পূর্ণ বাড়ি সাদা ঝক ঝকে কিন্তু রান্নাঘরে হলুদ রং, কারণ উনুনের ধোঁয়া, কালী,
ঝুলি দেখা যাবে না I নানা রকম মশলাপাতি নানা আকারের কৌটোতে থাকত, যেমন ডালডার কৌটো ,
বেবি ফুডএর , কাঁচের বয়াম, নানা আকারের , আরো কত রকম ছোট, বড়, মাঝারি কৌটো। কৌটো বাটা একদিকে, তার পাসে
শিলনোড়া,
বাটা মশলার থালা I কিন্তু আমরা
জানতাম কোনটাতে আচার,
কোনটাতে ছড়া তেঁতুল, নারকেল তক্তি, খইয়ের মোয়া, মুড়ির মোয়া আছে,
কারণ ঐসব দিয়ে দুপুরে বিশাল ভোজ হত আমাদের I শ্রী শ্রী মা সারদার বইতে পড়েছি ন্যাতা কাঁথার হাঁড়ি। সব বাড়িতেই তখন ওই ন্যাতা কাঁথার হাঁড়ি থাকত, তাতে হেন জিনিস (প্রয়োজনীয়)নেই যে পাওয়া যাবেনা I
পুরো বাড়ির হৃদ স্পন্দন যেখানে সেই রান্নাঘর কিন্তু অন্ত্যজ, কেউ ভিসিটর আসলে রান্নাঘরে আনা চলবে না Iকিন্তু সকাল থেকেই রান্না ঘর সরগরম
Iখুব ভোরবেলা উনুনে আঁচ দেওয়া হত I ঠাকুমা র গলা শোনা যেত "বৌমা আজ কি রান্না হবে?" ছেলেমেয়েরা আর অফিসকরা লোকেরা কি খেয়ে যাবে তার একরকম পদ আর বাড়ির কর্তা ব্যক্তিরা খাবে তার অন্য রকম পদ Iতবে রোজের রান্নার পদের মধ্যে চার থেকে পাঁচ রকম পদ তো থাকবেই সাধারণত সুক্ত,ডাল , চচ্চড়ি ,
মাছ আর চাটনি তো থাকতেই হবে
,ছাড়া সকালের জলখাবার রুটি পরটা। রবিবারে পুরো মেনু অন্য রকম সকালে জলখাবার লুচি আলু চচ্চড়ি দুপুরে অবশ্যই মাংস, পাঁঠার। সকাল থেকে মাকে দেখতাম স্নান্করে রান্না ঘরে ঢুকতে
I সব শেষ হতে হতে বেলা দুটো। এরমধ্যে আমিষ নিরামিষ দুই রকমের রান্না। বেলা হতে উনুনের আগুনের মায়ের মুখটা টক টকে লাল হয়ে যেত। প্রতিদিন রান্নাঘরের সামনে ঠাকুমা বসে থাকতেন জপের মালা নিয়ে কিন্তু সমানে কমেন্টারি করতেন বৌমা চচ্চড়িতে পাঁচ ফোরণ দিও,সুক্ততে রাঁধুনি যেন দিতে ভুলে যেও না। বড় খোকা ঝাল খায় না,
ওর জন্য আলাদা মাছ রেখো Iমা নীরবে কাজ করে যেত Iআবার রাতে আগুনের আঁচের তাতে কম করেও পঞ্চাশটা রুটি তৈরী করত। ঠাকুমার কল্যানে আমরা সেইজন্য খুব ছোটবেলাতেই রুটি বেলা শিখে গিয়েছিলাম I বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে মা, কাকিমারা মিলে নানা রকম পদ মাছ, মাংস,পায়েস ,মিষ্টি সবই ঘরে তৈরী করত I তখন রান্নাঘর এক বিশাল কর্ম ক্ষেত্র হয়ে উঠত
Iআনন্দের বন্যা বইতো। বাড়িতে বিয়ে লাগলে তো কথাই নেই I
ধীরে ধীরে আমরা বড় হলাম উনুন ছেড়ে এলপিজি গ্যাস এলো বাড়িতে I মায়ের মুখটা এখনো মনে আছে, আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল মুহুর্তে গ্যIস বার্নার জ্বলে উঠা দেখে। কিছুদিন আগেই প্রেসার কুকার এসেছিল I উনুন থেকে মুক্তি সেকালে একটা বিরাট উপলব্ধি। এরপর প্রজন্ম আমরা সবাই চাকুরিজিবি I পরিবারও ছোট I গ্যাস, প্রেসার কুকার খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল I এরপর ক্রান্তি এলো টিভিতে রান্না শেখানো I সেখানে ঝক ঝকে রান্না ঘর Iনিমেষে নানা পদ তৈরী হওয়া দেখে অল্পবয়সী ঘরণী,
চাকুরিরতা মহিলারা নিজেদের আপগ্রেড করলো I রান্না ঘর ছোট, কিন্তু সাজানো গোছানো শুরু করলো I পরিবারের কর্তাদের নিষিদ্ধ জায়গা রান্নাঘর এখন আর নিষিদ্ধ রইলোনা গৃহিনীকে সাহায্য করা আবশ্যক কর্তব্যের মধ্যে সামিল করা হলো
Iএতে বিরাট যোগদান টিভিতে সেফ সঞ্জীব কাপুরের আসা I
বাঙালির ঘরোয়া কিন্তু পুষ্টিকর সব রকম সবজি মেলানো সুক্ত,চচ্চড়ি, ধীরে ধীরে বিদায় নিয়ে ক্যালরি মাপা নতুন ধরনের সহজে রান্না করা যায় এমন পদ খাবারে অঙ্গ হয়ে উঠলো Iবিদেশী কোম্পানিরIও পিছনে রইলোনা টিভিতে প্রচার চালিয়ে সহজে তৈরী করা যায় এমন জিনিসের প্যাকেট বাজারে ভরে দিল, ফলে সদা ব্যIস্ত মহিলারা ওই জিনিস খুবই পছন্দ করতে লাগলো I বাঙালির টেস্ট বদলে গেল ঘরে চাইনিস ,থাই, ইতালিয়ান খাবার বেশি প্রশয় পেল Iছোট শিশুরা ওই খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো
Iরুটি লুচি পরটার বদলে পিজ্জা, পাস্তা ,নুডুল,কেক , পেস্ট্রিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল I দইয়ের ঘোল,বেলের পIনার বদলে বিদেশী কার্বনেটেড পানীয় বেশি পছন্দ হলো I বাঙালির রান্নার মধ্যে ছ্যাচড়া ,অম্বল,
মাছের টক কথা গুলো আর রইলো না।স্বামী স্ত্রী দুজনে ইনকIম করে সংসারের আর্থিক উন্নতি হওয়ার সঙ্গে বাজারের হালচালও বদলে গেল
I প্রচুর রেস্টুরান্ট খুলল যাতে নানা রকমের মেনু। সবকিছু
মিলিয়ে এখন সবার বাড়িতেই প্রায় গ্লোবাল মেনু
Iএখন আর রান্নাঘর,(অনেকের পুরো ঘর নয়) রান্নার জায়গা আর অপাংতেও রইলোনা বরং বন্ধুরা এসে রান্নার জায়গাতেই আসর বসায়। কার রান্নাঘর কত মডার্ন সে নিয়ে গবেষণাও হয় , কাঁসার থালা
বাটির বদলে পলিমারের বাসন ব্যবহার হতে লাগলো। লোহার কালো কড়াই বাতিল হয়ে ননস্টিক বাসনের চল হলো I কুক টপ ,মাইক্রো,
রুটিমেকার, স্যান্দুইচ মেকার,রাইস কুকার আরো কত গ্যাজেটসএ ভর্তি,
রান্নাঘর, যেন একটা মিনি কারখানা I সময় বদলের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেটের যুগে সব কিছুই মুঠোর মধ্যে হয়ে গেল
I
কিছু ঐতিহ্য প্রিয় লোকের জন্য রেস্টুরান্ট তৈরী হলো যেখানে মোচার ঘন্ট ,কচি নারকোলে চিংড়ি ভরে,
কলা পাতায় ভাপা ইলিশ,নানারকম পীঠে,পায়েস ইত্যাদি পাওয়া যেতে লাগলো
I কাজেই পুরনো নতুন সব কিছুই বজায় রইলো
Iকালের গতিতে সব কিছুই বদলে যায় I সেইরকম হয়ত আরও পঞ্চাশ বছর পরে আজকের শিশুরা যখন সিনিয়র সিটিজেন হবে তারাও হয়ত মুখে
খাবারের বদলে ট্যাবলেট ফেলে
, মায়ের তৈরী নুডুল, পাস্তার কথা মনে করে মন খারাপ করবে I
[আলপনা ঘোষ]