রঞ্জনী পোলাও
আমি তখন দক্ষিণ
দিনাজপুরের S.P. একদিন বালুরঘাটে গেছি অফিশিয়াল জেল
পরিদর্শনে। Under trial prisoner দের একটা সেলের সামনে
এসে পা দুটো আটকে গেল। সেলের ভিতরে বসে যে ছবি আঁকছে তাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছি।
“অগ্নিদেব না?”
গলা শুনে চমকে তাকাল অগ্নিদেবও - “স্যার? ভালো আছেন?” বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়েছে অগ্নিদেব। তড়িঘড়ি উঠতে গিয়ে ওর পায়ের ধাক্কায় রঙের
কৌটো পড়ে গেল দু- একটা। ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোপ ছোপ হলুদ রঙের পাহাড়ের ওপর দিয়ে একটা সিঁদুরে লাল নদী বয়ে যেতে থাকল। আমি
জিজ্ঞেস করলাম “অগ্নিদেব আপনি এখানে কেন?
কি হয়েছে?" অগ্নিদেব আগে আমার আন্ডারে কাজ করেছেন বিষ্ণুপুরে। তখন ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর। শুনেছিলাম পরে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি হয়েছিল। বহুকাল যোগাযোগ নেই।
"কৃত কর্মের সাজা ভুগছি স্যার"
"মানে?"
" সে অনেক লম্বা গল্প। বলব একদিন।”
“না না আজই শুনব। একটু দাঁড়ান।”
জেলার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম - “কি সাহেব অসুবিধে নেই তো?”
জেলার সাহেব বললেন - “না না অসুবিধের কি আছে স্যার! আমার অফিসে বসেই শুনবেন। চলুন।” লাল রঙের কৌটোটা গড়াতে গড়াতে আমার পায়ের কাছে এসে গেছিল। আমি ওটা তুলে
অগ্নিদেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। অগ্নিদেব
ক্যানভাস,
রং সব একপাশে সরাতে সরাতে আমাকে জিজ্ঞেস করল –
“স্যার আপনি
এখনো ছবি আঁকেন?”
“হ্যাঁ। আঁকি তো!”
সিঁদুরে লাল রঙটা শুকিয়ে যেতে যেতে কালচে লাল হয়ে যাচ্ছে - জমাট বাঁধা রক্তের মত। অগ্নিদেব ক্যানভাসটা ঘরের কোনায় ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর পর
ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে যেন হলুদ কাঁচুলির আবরণে এক পীনোদ্ধত বক্ষের ওপর দিয়ে বয়ে
যাচ্ছে রক্তের নদী। জেলার সাহেব চা আর গরম সিঙ্গারার
অর্ডার দিয়ে আমাদের নিয়ে গিয়ে বসালেন তার ঘরে। অগ্নিদেবও এল।
অগ্নিদেব বলতে শুরু করলো, "সেবার কোর্ট থেকে একটা কেস
reinvestigation এর আদেশ এলো। দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। এটা ঠিক আর পাঁচটা কেসের মতো ছিল না স্যার। আচ্ছা স্যার আপনার বিষ্ণুপুরের অনির্বাণকে মনে আছে? শিল্পী অনির্বাণ?”
“শাঁখারিপাড়ার অনির্বাণ? ওর করা শোলার ঠাকুর প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিল না
একবার?”
“অনির্বাণ তো দারুণ ছবি আঁকত। ষ্টেজ-ফেজ সাজাত। একবার একটা ফাংশানে ওর সাথে আলাপ হল মনীষার। মনীষা দারুণ গান গাইত জানেন স্যার।
ওর বাবা-ঠাকুর্দা বিষ্ণুপুরি ঘরানার বেশ বিখ্যাত গাইয়ে ছিলেন। মনীষা অবশ্য ক্ল্যাসিকাল, রবীন্দ্র সংগীত, ফোক - সবই গাইত। একদম গান পাগল মেয়ে ছিল। মনীষার দিদি বিদিশাও ভাল সেতার বাজাত - তবে ও গান
বাজনাকে নিজের প্রোফেশান করেনি। কলেজে পড়াত। মনীষা থাকত ওর দিদির সাথেই। ওদের বাবা
মা গত হয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। আদি বাড়ী বিক্রি করে দুই বোন গোপেশ্বর পল্লীতে
একটা ফ্ল্যাট কিনে থাকত। অনির্বান আর মনীষা ভেসে গেল গভীর ভালবাসায়। অনির্বাণের সব ছবিতেই মনীষা আসতে থাকলো অনিবার্য ভাবেই। ওর বানানো মূর্তিতেও মনীষার আদল। অনির্বাণ ওকে বাড়িতেও নিয়ে গেল। মিষ্টি মেয়েটি অচিরেই অনির্বাণের বাবা মায়েরও বড় আদরের হয়ে উঠলো।
একদিন দুপুরে মনীষা এলো অনির্বাণের ষ্টুডিওতে। পরণে সেদিন ওর কালচে লাল সালোয়ার-কুর্তা। কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরে আসা কালো এক ঢাল চুল বুকের ওপর। অন্য কাঁধ থেকে পাহাড়ি জলপ্রপাতের মত নেমে এসে সাদা ওড়না চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মাটি ছুঁয়েছে - মনীষাকে সেদিন অদ্ভূত আকর্ষনীয় লাগছিল। কালো-সাদা-লালের এই erotic কম্বিনেশন অনির্বাণের ভীষণ প্রিয়। ওর ছবিতে এই তিন রং প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে। মনীষা আর ওর নিজের মানসী-মূর্তি একাকার হয়ে যায় অনির্বাণের মাথায়। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে অনির্বাণ জড়িয়ে ধরল মনীষাকে। মনীষা কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে কাঠের মত শক্ত হয়ে গেল। খানিক চেষ্টা করে যখন নিজেকে অনির্বাণের কাছ থেকে ছাড়াতে পারল না - তখন সজোরে ধাক্কা মারল অনির্বাণকে। অনির্বাণ ছিটকে যেতে যেতেই নিজেকে সামলে
নিল মনীষা। বলল - সরি অনির্বাণ। সারাটা জীবন তো পড়ে আছে। তাড়া কিসের? অনির্বাণ সংকোচে কুঁকড়ে গেল।
পরের দিন থেকে মনীষা কিন্তু আবার একদম সহজ স্বাভাবিক। সেই কাঁচভাঙ্গা হাসি, সেই আদরের মেসেজ, সেই উচ্ছ্বলতা।”
প্রথম রাঊণ্ডের চা আর সিঙ্গারা শেষ হয়ে গেছিল অনেকক্ষণ। জেলার সাহেব মাঝখানে
উঠে গেছিলেন কোন একটা তলবে। আর্দালির হাতে আরেক রাঊণ্ড চা সহ ফিরে এসে বসলেন আমার পাশে।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, "বলতে থাকুন অগ্নিদেব।"
অগ্নিদেব শুরু করলেন,
"বলছি স্যার। এই ঘটনার কয়েক দিন পর মনীষা একদিন অনির্বাণকে ওর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল। দুপুরে। বিদিশা তখন কলেজে। অস্থির অনির্বাণ একটু তাড়াতাড়িই চলে গেছিল। সাড়ে এগারোটা নাগাদ পোঁছে অনির্বাণ
দেখল ওর জন্যে রান্না করছে মনীষা।”
এই অবধি বলে হঠাৎ চুপ করে গেলেন অগ্নিদেব।
আমি অস্থির হয়ে বললাম - “তারপর? কি হল - চুপ করে গেলেন কেন অগ্নিদেব?”
অগ্নিদেব প্রায় স্বগতোক্তির মত করে বলল - “ঘন্টা দুয়েক বাদে অনির্বাণ একা হেঁটে হেঁটে থানায় গিয়ে শান্তভাবে জানাল - আমি মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুন করেছি।
পুলিশ অনির্বাণকে নিয়ে মনীষার বাড়ি গিয়ে দেখল মনীষা পড়ে আছে কিচেনে, মৃত।"
আমি অগ্নিদেবকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পোস্ট মর্টেম এ কি পাওয়া গেল?"
"Murder by throttling, স্যার। মুখে হাত চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। No signs of sexual assault."
নীরবতা ভেঙ্গে জেলর সাহেব বললেন,
“Strange! "
আমি জিজ্ঞেস করলাম - "পুলিশ চার্জশীট করেনি?”
অগ্নিদেব বলল - “করেছিল স্যার। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই পুলিশ চার্জশিট দিয়েছিল অনির্বাণের বিরুদ্ধে।”
“তবে আবার
reinvestigation কেন?” - আমি একটু অবাক হলাম।
"সেটা একটা অদ্ভূত কারণে স্যার। অনির্বাণ মনীষাকে খুন করার কথা স্বীকার করলেও কেন করেছে, খুনের আগে ও পরে ঘটনা পরম্পরা কি ছিল কিছুই বলেনি। শত জিজ্ঞাসাবাদেও মুখ খোলেনি। তাই ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছিলেন আরো একবার তদন্ত হোক, আর সেই তদন্তের ভার পড়ল আমার ওপর।"
অগ্নিদেব বলে চললেন
- "আমি বুঝলাম অনির্বাণের স্বীকারোক্তির বড় প্রয়োজন। গেলাম জেলে। দেখা হলো অনির্বাণের সঙ্গে। দোহারা চেহারা। এক গাল দাড়ি। চোখে এক অদ্ভূত প্রশান্তি। অনির্বাণ কিন্তু একটি কথাও বলল না আমার সঙ্গে। আমি বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেলাম। দুদিন পরে আবার জেলে গেলাম। এবার জেলারের সাহায্যে সোজা অনির্বাণের সেলে। অনির্বাণ তখন মগ্ন হয়ে ছবি আঁকছিল। দুধ সাদা ক্যানভাসে গড়িয়ে পড়ছিল রক্তলাল রং - কালো অমানিশার গর্ভে। আমি বলে উঠলাম - মরণের চুলে জীবনের রক্ত! অনির্বাণ মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো - আপনিও ছবি আঁকেন স্যার?
আমি বললাম - আঁকি, তবে তোমার মত এত সুন্দর নয়।
অনির্বাণ তুলিটা জলে ধুতে ধুতে বলল - স্যার আজ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেব। আপনি শিল্পী মানুষ্, বুঝবেন।"
এই অবধি বলে অগ্নিদেব থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "স্যার,
একটা অনুরোধ করব?
যদি কিছু না মনে করেন।"
" বলুন না" আমি বললাম।
" স্যার,
অনির্বাণ তো এই জেলেই আছে.
ওকে ডেকে ওর মুখেই শুনুন না কি হয়েছিল সেদিন।"
" কি জেলারসাহেব, সেটা কি সম্ভব
?" আমি একটু দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করি।
"এ আর এমন কি ব্যাপার স্যার। আমি ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।" জেলার তড়িঘরি ডেকে পাঠালেন অনির্বাণকে।
অনির্বাণ এলো। মাথা ভরতি বাবরি চুল। দু’চোখে গভীর প্রশান্তি। আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, "আপনি ছবি আঁকেন?"
" ওই একটু আধটু আঁকি। কি করে বুঝলেন?"
" যারা ছবি আঁকে তাদের চোখ
ভালবাসার জলে ভিজে থাকে।"
" বোসো অনির্বাণ। তোমার কাছে শুনতে চাই কি হয়েছিল সেদিন।"
“ আমি তো সব বলেছি স্যারকে," অনির্বাণ অগ্নিদেবকে দেখাল।
"আমি যে তোমার কাছে শুনতে চাই অনির্বাণ।"
জানি না আমার গলায় কি ছিল - অনির্বাণ বলতে শুরু করলো
- "সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। মনীষা আমায় ডেকেছিল ওর বাড়িতে। উচ্ছ্বল খুশিতে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি। মনীষাদের বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন কোথা থেকে কে জানে একটা পুরুষ কোকিল একা একা ডেকে যাচ্ছিল। মনীষা দরজা খুলে দিল। ওর পরনে সেদিন কামরাঙ্গা লাল তাঁতের শাড়ি - আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে রাখা। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। চুলে এলো খোঁপা। আমি গিয়ে ওদের ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমের সোফাতে বসলাম। ওখান থেকে ওদের কিচেনটা পরিষ্কার দেখা যায়। মনীষা রান্না করতে করতে কথা বলছিল। দিদি বাড়ি না থাকায় ও খুব স্বচ্ছন্দে বকে যাচ্ছিল। ওকে বেশ গিন্নি গিন্নি লাগছিল। বলল আমার জন্যে নাকি একটা নতুন ধরনের পোলাও রাঁধছে - চিকেন দিয়ে। একটা কড়াইতে গোল গোল করে কাটা পেয়াঁজ সোনালী করে ভেজে তুলল। সেই কড়াইতেই ঘি দিয়ে চিকেনগুলো দিয়ে দিল। মনীষার লম্বা সরু ফর্সা আঙ্গুলগুলো খুন্তিটাকে নাড়ছে
- মনে হচ্ছে যেন শিল্পীর তুলির মত চলছে খুন্তি। এক কাপ জল ঢেলে এটা ওটা কি সব
মশলা দিতে লাগল কড়াইতে। সুগন্ধে ভরে উঠছে চারিদিক। তারপর আধসেদ্ধ বাসমতি চাল ঢেলে দিল কড়াইতে। আরো খানিক নাড়াচাড়া করে একসময় তুলে নিল পাশে রাখা দুধে গোলা জাফরান। বাসমতী চালের ওপর ওটা ঢেলে দিতেই আগুনের মত কমলা রং ছড়িয়ে গেল। জাফরান লেগে কমলা ছোপ ধরেছে ওর
আঙ্গুলেও। চতুর্দিকে একটা অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ। মনীষা হঠাৎ বলল - জানো অনির্বাণ - জাফরান কিন্তু ভীষণ প্রেম-জাগানিয়া! রানী ক্লিওপেট্রা জাফরান দিয়ে স্নান করতেন তার প্রেমিকদের মোহাবিষ্ট করতে! আমি বললাম জানি। আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। মনীষা তখন জায়ফল-জয়ত্রী আরো আরো কি সব মেশাচ্ছে পোলাওতে। একটা ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ আমার সারা শরীর জুড়ে আহ্বান করছে “এসো এসো।” মনীষা আমার দিকে একটা অদ্ভূত মোহময়ী হাসি ছুঁড়ে দিয়ে একমুঠো আমন্ড নিয়ে ছড়াতে থাকল পোলাওয়ের ওপর। আমি শুকনো জিভে,
শুকনো গলায় বললাম,
জানো মনীষা - প্রাচীন গ্রীসে কুমারী মেয়েরা বালিশের তলায় আমন্ড নিয়ে শুত আর সারারাত নাকি হবু স্বামীর স্বপ্নের আদরে বিভোর থাকত। মনীষা হাঁসের মত ঘাড় বেঁকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল - জানি। আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করে বসে থাকলাম সোফায়।” এই পর্যন্ত বলে অনির্বাণ বোধ হয় দম নেবার জন্য থামল।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, "তারপর?"
অনির্বাণ আবার বলতে শুরু করলো,
"এরপর মনীষা পোলাওয়ের ওপর ছড়াতে থাকলো রক্তলাল ডালিমের দানা - মনীষার ঠোঁটের মতই রস টুবটুবে। আমাকে বলল - দেখ এই সেই ডালিম ফল - যার গাছ স্বয়ং আফ্রোদিতি লাগিয়েছিল।
আগুনের তাপে রক্তের মত লাল ডালিমের দানাগুলো দেখে আমার রক্তে যেন বান ডাকতে শুরু করলো। রান্না যখন প্রায় শেষ মনীষা তখন একটা অদ্ভূত দেখতে শিশি বার করে বলল
- জানো, কাকু ইস্তাম্বুলের ইজিপ্সিয়ান স্পাইস মার্কেট থেকে এই মশলাটা এনে দিয়েছেন -Mystery Spice. দেখো কি সুন্দর গন্ধ! বলতে বলতে ও পোলাওয়ের ওপর ছড়াতে থাকল একটা রূপোলী রঙের দানা দানা মসলা। একটা অদ্ভূত গন্ধে সারা ঘর ভরে গেল। গন্ধটা আমার ভিতরে যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মত ঢুকে যাচ্ছিল। আমার শিরায় শিরায় লাভাস্রোত বইতে শুরু করলো। আমি জানতাম মনীষা চায় না আমি ওকে ছুঁই। কিন্তু ওর লাল শাড়ী, রান্না ঘরের সাদা টাইলস - খুলে যাওয়া এলো খোঁপার উপুরঝুপুর কালো চুল আর ওই তীব্র আসক্তি ভরা গন্ধ আমায় প্রবল আকর্ষণে মনীষার দিকে টানতে থাকলো। আমি শ্বাপদের মত নীরবে এবং সাপের মত মসৃণতায় এগিয়ে গেলাম মনীষার দিকে। রান্নাঘরে গন্ধটা আরো ঝাঁঝালো - আরো তীব্র। আমি মনীষাকে জড়িয়ে ধরলাম। মনীষা নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে ছটফট করতে লাগলো। মনীষার সারা গায়ে ওই তীব্র নেশাধরানো গন্ধটা ওর নিজস্ব গন্ধের সাথে মিশে আমার সারা
শরীরে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ওর হাতের আঙ্গুলে, গলায়, বুকে,
ঘাড়ে.....সর্বত্র ওই গন্ধ। আমি প্রবল আশ্লেষে গন্ধ নিতে লাগলাম মনীষার সর্বাঙ্গে। মনীষা চীৎকার করতে শুরু করলো ছাড়ো ছাড়ো বলে। আমি ওর মুখ চেপে ধরে থামাতে চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে ও থেমে গেল,
একেবারে। আমার হাতের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে গেল। আমি রান্না ঘরের মেঝেতে ওকে ঘাড় ভাঙ্গা ধবল বকের মত শুইয়ে রেখে থানায় গেলাম।"
কথা শেষ করেই অনির্বাণ উঠে টলতে টলতে চলে গেল। জেলার ডাকতে গেলেন,
আমি ইশারায় বললাম,
যেতে দিন ওকে। কিছুক্ষণ পরে বিহ্বলতা কাটিয়ে আমি বললাম, " কিন্তু অগ্নিদেব আপনি এখানে কেন?"
অগ্নিদেব আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলেন, "যেদিন অনির্বাণ প্রথম আমার কাছে মুখ খুলল তার পরের দিন আমি কয়েকটা তথ্য যাচাই করে নেবার জন্যে মনীষার দিদি বিদিশার কাছে সময় চাইলাম। বিদিশা আমাকে সন্ধ্যের দিকে যেতে বললেন। আমি বেল বাজাতেই বিদিশা নিজেই দরজা খুলে দিলেন। তার
পরনে লাল সিল্কের শাড়ি। চুল খোলা। কলেজ থেকে ফিরে জামা কাপড় ছাড়ার অবকাশ পাননি
বোধহয়। আমি গিয়ে বসলাম সেই ডাইনিং কাম ড্রয়িংরুমে - সোফাতে। বিদিশা গেল কিচেনে চা করতে। চা নিয়ে এসে বিদিশা আমার পাশেই বসল। বললো - জানেন তো অনির্বাণ মনীষাকে ভীষণ ভালবাসত। ও যে কেন এমন করলো আজও বুঝিনি। আমার যা যা জিজ্ঞেস করার ছিল করছিলাম। বিদিশা উত্তর দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে কাঁদছিল। দেরী হয়ে
যাচ্ছিল। হঠাৎ বিদিশা বলল - খুব তাড়া না থাকলে খেয়ে যান না রাত্রে। কিছু একটা বানাই। একা থাকি তো। রান্না করতে ইচ্ছেই করে না। লাল সিল্কের শাড়ীতে এলোচুল বিদিশাকে ভীষণ মনোলোভা লাগছিল। ওর অনুরোধ না রেখে পারলাম না। ভাবলাম বাকিটা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করব। বিদিশা উঠে গেল রান্না করতে। ওখান থেকেই বলল - আপনি চিকেন খান তো? চিকেন দিয়ে একটা নতুন ধরণের পোলাও বানাচ্ছি। এক্ষুনি হয়ে যাবে! আপনি মিষ্টি-মিষ্টি পোলাও পছন্দ করেন? না ঝাল ঝাল? বকবক করতে করতেই বিদিশা কড়াইতে চিকেন দিল - চাল দিল। দুধে গুলে
রাখা কমলা রঙের জাফরান ঢালতে গিয়ে ওর আঙ্গুলের ডগাগুলো কমলা হয়ে গেল। পোলাও সেজে উঠতে থাকলো জাফরান, জায়ফল, জৈত্রী আরো কি কি সব মসলায়। গোটা ঘর ভরে উঠলো এক অদ্ভুত সুবাসে। বিদিশা তারপর পোলাওতে ছড়িয়ে দিল ডালিমের গোল গোল দানা - প্রবালের মত। কি এক উত্তেজনায় আমি উষ্ণ হতে থাকলাম। পোলাওয়ের ওপর এক মুঠো আমণ্ড ছড়িয়ে দিয়ে একটা অদ্ভূত শিশি বার করে রূপোলী-সাদা বীজের মত কি একটা মশলা ছড়াতে ছড়াতে আমাকে বলল - এই হয়ে এল। একটা অজানা অচেনা গন্ধে পাগল হয়ে যেতে থাকলাম আমি। প্রাণপনে চেয়ারের হাতলটা আঁকড়ে ধরতে চাইলাম। চোখের সামনে থেকে বিদিশা কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সাদা টাইলস দেওয়া দেওয়ালে শুধু গোছা গোছা লাল রক্ত-শিমুল আর ঘন কালো মেঘ। একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ আমায় আকর্ষণ করতে লাগলো রান্নাঘরের দিকে। আমি যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু পারলাম না। আমি শ্বাপদের মত নীরবে এবং সাপের মত মসৃণতায় এগিয়ে গেলাম বিদিশার দিকে......"
অগ্নিদেব থেমে গিয়ে দুহাতে মুখ ঢাকলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আমি উঠে এলাম। বাড়ী ফিরতে সেদিন অনেকটা রাত হল। মৌ দরজা খুলতেই একটা ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ আছড়ে পড়ল। মৌয়ের হাতে
খুন্তি -
আঙ্গুলের ডগায় কমলা ছোপ।
“কি রাঁধছ?”
“চিকেন পোলাও।
জানো আজ কাকু ফিরলেন ইস্তাম্বুল থেকে। একটা মশলা এনেছেন আমার জন্যে ঈজিপশিয়ান
স্পাইস মার্কেট থেকে ...”
মৌকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আমি বললাম - “Mystery spice?”
আমার কথার উত্তর না দিয়ে মৌ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল - “একি
তোমার হাতে রক্ত কেন?”
অগ্নিদেবের লাল রঙটা কখন হাতে লেগে গেছে টের পাইনি।
[কল্যাণ মুখোপাধ্যায়]