************************
হঠাৎ করে আমার transfer হয়ে গেল ৷ ছিলাম উত্তরবঙ্গের একটি জেলার
S.P. চলে এলাম কলকাতার অফিসে ৷ একদম অসময়ে বিনা মেঘে বজ্রপাত ৷ মাসখানেকের মধ্যে জেলার বাংলো ছেড়ে সপরিবারে চলে আসতে হবে কলকাতায় ৷ কপাল ভালো শহরতলীতে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কেনা ছিলো ৷ কেনার পর থেকে যদিও সেখানে কোনোদিন পদধূলি পরেনি। স্ত্রীর দাবি ওই
Flat এ উঠতে হলে তাকে আপাদমস্তক Remodel করতে হব ৷
Make over আর কি
! নবরূপায়ন ৷ ঘরের ব্যাপারে ঘরণীই শেষ কথা - এই আপ্ত বাক্যটি মনে
রেখে, সহবাসিনীকে (religion এর খোপটা শূন্য রাখি বরাবর - তাই সহধর্মিনী বলতে পারি না বোধহয়) নিয়ে এলাম নতুন flat-এ ৷
Flat এর দরজা খুলেই শুরু
হলো মহীয়সীর নির্দেশনা। "এই দেওয়ালটা ভেঙে ফেলতে হবে ৷ ওখানে একটা দরজা বসাতে হবে। এখানে এক সেট তাক করতে হবে ৷ তোমার ওই কয়েকশো বই কোথায় রাখবে বলো তো!
ব্যালকনিতে কাঁচ বসাতে হবে ৷"
আমি পেছন পেছন একটা ছোটো নোটবুকে নোট নিতে থাকি
বাজার-সরকারের মতো ৷
বাথরুমের দরজা খুলে কালীপটকার মতো ফেটে উঠলেন তিনি , "এটা বাথরুম ? এর চেয়ে তো ট্রেনের টয়লেট বড়ো হয় ! "
"কেন
? বাথরুমে তো একসাথে দুজন যাব না মনে হয়
" -- আমি একটু কৌতুকী হবার চেষ্টা করি ৷
"না
, না , চলবে না ৷ বাথরুমটা Extend করতে হবে ৷ দরকারে passage টা সরু করতে হবে ৷
"Passage সরু করা যেতেই পারে ৷ তবে তোমার ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যোন্নতি আশংকার কারণ হ'তে পারে ৷"
বারুদে আগুন পড়ার মতো জ্বলে উঠে তিনি বললেন "বাজে বোকো না ৷ তাহলে তোমার ফেসবুকের তন্বী বান্ধবীদের নিয়েই থাকো ৷ সরু
passage এ দিব্যি গলে যাবে ৷ আর ঘুলঘুলি মার্কা বাথরুমেও অসুবিধা হবে না ৷"
ফেসবুক নিয়ে খোঁটা আমি "মুখে
- বুকে" মাখি না ৷ দার্শনিকের মুখ করে হজম করলাম ৷
প্রসঙ্গ পরিবর্তনের আশায় বললাম "রান্নাঘর দেখবে না
?"
"আরে
হ্যাঁ ! কিচেন ! কিচেন তো দেখতেই হবে ৷ কিচেনেই তো আমার অর্ধেকটা সময় কাটে ৷”
কিচেনে অবশ্য ঢুকতে হল না - বাইরে থেকে দেখেই
এক্কেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন প্রিয়তমা!
“এটা কিচেন ? না ইঁদুরের গর্ত ?"
"Flat তো তোমার আটশো স্কোয়ার ফুটের ৷ তাতে আর কত বড় রান্নাঘর হবে ?"
"দেখো
, কিচেন নিয়ে তুমি কিচিরমিচির ক'রো না বলে দিচ্ছি ৷ এখন কিচেনের concept বদলে গেছে ৷ আমার কিন্তু open kitchen চাই"
- আহা - গলায় তার মধুচন্দ্রিমার আবদার!
"Open kitchen ? কোথায় হবে সেটা
? terrace এ ? না কি
balcony তে ? "
তিনি আমার মুখের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যে মনে হ'লো এ সুগভীর মুর্খতার এক অংশও টের পেলে আমায় বিয়ে করে জীবন জলাঞ্জলি দিতেন না ৷
আমার মনে পড়লো ছোটোবেলায় দুর্গাপুরে আমাদের single bedroom quarter এর আট বাই আট ছোটো রান্নাঘর ৷ একদিকের দেয়ালে ছিলো কয়েকটা তাক ৷ একটা জাল ঘেরা জানলা ৷ রান্নাঘরের ভেতরে একটা সরু তারের জালঘেরা মিটসেফ ছিলো ৷ আর একটা তোলা উনুন কয়লার ৷ পাশে তার দোসর জনতাস্টোভ ৷
Open kitchen? দরজা খোলা রাখলেই open নইলে closed.
আমার ভাবনার জাল ছিঁড়ে গিন্নী বলে উঠলেন
, "রান্নাঘরের এই সামনের দেওয়ালটা ভেঙে দাও ৷"
"সে আবার কি?
Drawing -cum-dining space টার থেকে
kitchen এর কোনো আড়াল থাকবে না ? "
"কিসের আড়াল? আমি রাঁধতে রাঁধতেই T.V. দেখবো ৷ Guest দের সাথে আড্ডা মারবো৷ এই ওভেন থেকে শুরু করে ওই ফ্রীজ যেখানে থাকবে সবটা জুড়েই আমার রান্নাঘর, মল্লিকার রান্নাঘর ৷"
" বাঃ
! মন্দ নয় ৷ কিন্তু আমার guest এলে বসবে কোথায়
? তোমার এই
extended kitchen - এ ? "
" মোটেই না ৷ তোমার study তে। সবদিন তো আর লোক আসবে না ৷ আর যখন আসবে তুমি তো তখন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকবে না ৷ "
জোরালো যুক্তি ৷ বউ তো নয়, হাইকোর্টের উকিল ৷
তবু মিনমিন করে বললাম , " এতবড় কিচেন ? এরপর তো আর লোককে বলতে পারবো না আমাদের ঘরে আসুন
, বলতে হবে আমাদের রান্নাঘরে আসুন ৷"
" কথাটা মন্দ বলোনি এস.পি. সাহেব ৷ শুনেছো তো রবি ঠাকুরের কথাটা
, জেনো বাসনার সেরা বাসা রসনায় ! তা তোমার রসনার বাসনাকে তৄপ্ত করতে হলে একটা জম্পেশ কিচেন দরকার - এটা মানো তো ?"
আমি একটা জুত্সই জবাব খোঁজার আগেই তিনি হর্ষ ভোগলের মতো হুড়হুড় করে বলতে থাকলেন - "Kitchen
gives character to your home. রান্নাঘর দেখেই বোঝা যায় ঘরের মানুষের রুচি, সংস্কৄতি, পছন্দ ৷ তুমি হুসেন পছন্দ করো না গনেশ পাইন?
তোমার রান্নাঘরের tiles - এই বোঝা যাবে ৷ তুমি কতটা নান্দনিক তা তোমার চামচের হাতলের ডিজাইনেই বোঝা যায় ৷ তোমার লবনদানি থেকে শুধু লবন বেরোবে না , সেটা জানান দেবে যে তুমি সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসে ওটা নিয়ে এসেছো ৷ আচ্ছা শোনো এই ঘরটার কোন দিকটা কোন দিক
?"
মরেছে
!! প্রশ্নটা বুঝতেই কয়েক সেকেন্ড লাগলো ৷ তারপর কয়েক সেকেন্ড লাগলো প্রশ্নটা করার কারণ বুঝতে ৷ উত্তর তো জানা ৷কিন্তু উত্তরটা দেবো কি না সেটা বুঝে নিতে
আরো কয়েক সেকেন্ড সময় নিলাম ৷ এই ক্রমপর্যায়ে ভাবনা চিন্তা ক'রে উত্তর দেবার অভ্যেসটা আমি বিয়ের পরেপরেই রপ্ত করেছি ৷
বললাম "জানলার দিকটা দক্ষিন ৷ "
" বাঃ
! দক্ষিন-পূর্ব দিকে গ্যস ওভেন বসবে ৷ জানো তো ফেংশুই বলে অগ্নি থাকবেন দক্ষিন-পূর্বে?"
" ওঃ ৷ তোমার সেই লাফিং বুদ্ধ ? "
" বুদ্ধ নয় , বুড্ঢা , বুড্ঢা , কতবার বলেছি ৷ শোনো ওভেন বসবে ওদিকে। Induction cooker
নয় কিন্তু ৷ ওটা আগুন নয় ৷ "
" ওটা তবে কি
? "
" তুমি না বাংলায় পন্ডিত ? ওটা তাপ ৷ আগুন কিন্তু দর্শনধারী ৷ আহা
! Jackman কে দেখেছো ? আগুন একেবারে ! আমাদের রণবীরটাও কম যায় না ৷
"
পঞ্চাশোর্ধ আমার গতযৌবন চেহারা, সাদাকালো পাতলা চুল ৷ তবু আঁতে ঘা লাগলো ৷
"আমি কি ফেলনা?
"
" না গো , আমার মাইক্রোওয়েভ তো তুমি ৷
নাই বা হলে আগুন , গরম করতে জুড়ি নেই ৷ By the way , মাইক্রোওয়েভ টা এই কোনায় বসবে
, হাতের নাগালে ৷ ওভেনের ওপরের দেওয়ালে টালি দিতে হবে ৷
"
" বেশ। লাল রংয়ের ৷"
" লাল
? রংটা বড্ড
passionate হয়ে যাবে না?
বছর কুড়ি আগে হলে চলত ৷ "
" তবে সাদা ? "
" না ৷ অতটা শান্ত এখনো হই নি গো ৷ ওটা নাহয় বছর দশেক বাদে দিও ৷ "
" তবে
? হালকা বেগুনী ? "
" Purple ? Not bad. একদিকে fade হয়ে ivory white
হয়ে যাচ্ছে - এমন একটা কিছু লাগিও ৷ মেজাজটা ধরা যাবে ৷ আর এই cabinet কিন্তু change করতে হবে ৷ Modular kitchen cabinet লাগবে ৷ "
" কেন?
এতে বুঝি জিনিস রাখা যাবে না? আমার মায়ের তো শুধু কটা তাক ছিলো ৷ তবু রান্না কেমন হ'তো বলো ? "
" শোনো,
ওসব কালিদাসের কাল গেছে ৷ সে তো এককালে রান্নাঘর বলেও কিছু ছিলো না ৷ মাঠে ঘাটে রান্না হ'তো ৷
"
" মায়ের রান্নাঘরে একটা তোলা উনুন আর
জনতা স্টোভ ছিলো ৷
"
" স্টোভ
?? খাবে তো
? খাবে স্টোভে করা কেরোসিনের গন্ধওয়ালা রুটি
? মুখে রুচবে তো ? "
জানি শাশুড়ির প্রশংসা বউ সহ্য করতে পারে না - তবু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল - "যাই বলো , তোমার microwave ,
air frier , induction , convection , fridge , ice maker , coffee maker
.... উহ্ , এতো যন্ত্রীর চেয়ে যন্ত্র বেশী ৷ "
" তুমি এসবের কি বুঝবে! একবার TLC দেখো ৷ যদি কিছু মাথায় ঢোকে ৷ রান্না এখন একটা শিল্প ৷ না
, চপ - শিল্প নয় ৷
art .. art .. কিচেন এখন একটা artist's den ৷ আমি এখন শিল্পী ৷ যখন মটন ডাকবাংলো করে সাজিয়ে এনে দেবো না , তুলতুলে খরগোশের মতো মটন,
তখন বুঝবে গো এস.পি.সাহেব
!! শোনো আমায় আরো দু একটা জিনিস কিনতে হবে কিন্তু ৷
"
" তা কেনো , হাতের দক্ষতার অভাব যন্ত্রের কেরামতিতে ঢাকতে হবে ৷ রান্নাঘর তো নয়,
যেন কারখানা একটা ৷ তুমি বরং একটা হেলমেট প'রে বসে থেকো তোমার কিচেনে ৷ "
আমি
বিড়বিড় করি
, " পিলার , কাটার
, মিক্সার , কুকার .... আমার আয়ের অর্ধেক কিচেনেই ঢুকে
যায়। এত আয়োজন তবু মায়ের
হাতের মতো শুক্তো, টকডাল আর আলুপোস্তো কোথায় !
"
[কল্যাণ মুখোপাধ্যায়]
anando pelam.
ReplyDeletethank u
ReplyDeleteVishon valo laglo.....
ReplyDeletethank u
DeleteVishon valo laglo.....
ReplyDelete