তিনটি কলকাতা
প্যান্ট অল্টার হয়নি। পেতে পেতে
বিকেল চার-পাঁচটা। এখন কী করা? বাড়ি ফেরাই ভালো। শিয়ালদা তো বেশি
দূরে না। দোকানটার উল্টো ফুটে দাঁড়ালাম। ফেরার ট্রাম ধরব। সামনে দিয়ে একটা ট্রাম যাচ্ছিল। তার গায়ে কাঠের
ছোট্ট প্লেটে লেখা, 'গড়িয়াহাট রোড।' প্রায় দৌড়ে উঠে পড়ি। মলয়দের বাড়ির ঠিকানা, গড়িয়াহাট রোড। ফাঁকা। জানালার ধার পেয়ে যাই, বাম পাশের জানালা। কলকাতা আবিষ্কার করতে হবে। আজ আমার
জীবনের রেড লেটার ডে। রাস্তার ধার ঘেষে নানা দোকান। সাহেবী টুপির দোকানটা আমাকে
আকর্ষণ করল। কোমরে রিভলভর গুঁজে পাছাটা 'দ'
করে বাঁকিয়ে
দাঁড়াবার সখ আমার বহুদিনের। আমি আর সামাদ মডার্ণ সিনেমায় সকালের শোতে যেতাম। প্রতি
রবিবার। সামাদ বাড়ির আদুরে ছোট ভাই, ওদের ওষুধের দোকানের ড্রয়ার থেকে
খাবলা মেরে পয়সা তুলে নিলে কেউ আপত্তি করত না। আমরা টেক্সাসের লড়াই দেখতে যেতাম।
কলকাতাকে কি খুব আলাদা পেয়েছিলাম
সেদিন? ৫২ বছর পরে অতটা ডিটেলে মনে পড়ার কথা
না। কিন্তু প্রথম বিস্ময় তো রক্ত বেয়ে ছোটে সারাটা জীবন। সেই বিস্ময়টাও ছুঁতে
পারছে না আমার স্মৃতি। সেটা কি ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘুরেছি বলে? নাকি দিনাজপুরের মাড়োয়ারি পট্টির দু'পাশে এমনই দোকানের সারি দেখে দেখে ওই বয়সেই বুড়িয়ে
গিয়েছিলাম? ট্রামের অবাক অস্তিত্বের ঘোর কেটে
গেছে। গিজগিজ মানুষের ভীড় আর সার সার দোকান ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।
পাড়া নেই সারাটা পথে। তাহলে কোথায় কলকাতার জীবন?
কলকাতার
হারজিৎ? কলকাতার রাস্তা তো শুধু খোয়া ওঠা, এবড়ো খেবড়ো না? কোথাও কনক্রিট। কোথাও পিচ ঢালা। মসৃণ
অথবা হোঁচট খাওয়ার রাস্তা । কলকাতার জীবন মানে কি শুধু এই? তা তো হতে পারে না। লক্ষ লক্ষ মানুষ তো শুধু এজন্যেই কলকাতা
কলকাতা করে মরে না। এখানেই তো শুনেছি গাড়ি ধোয়া মোছার ছেলেটা আশুতোষ মুখার্জীর মত
গোঁফ-ভারি অন্যমনস্ক কমল মিত্রের পকেট ফস্কে পড়ে যাওয়া মনি ব্যাগ দেখতে পায়, তা ফিরিয়ে দেবার জন্য সেই কমল মিত্রের গাড়ির পিছু পিছু
সারাটা পথ দুদ্দাড় ছুটে হাঁফাতে হাঁফাতে কমল মিত্রের হাতে মনি ব্যাগটা বাড়িয়ে দেয়। কমল মিত্র ব্যাগ
খুলে টাকাগুলো দেখে গুণে খুশি, বাড়িয়ে দেন পাঁচ টাকার নোট। 'আমি বকশিস চাই না। দান নিই না।' 'কী নাও তবে?' 'কিছু না', ঘুরে দাঁড়ায় ছোট ছেলের বিক্তিত্ব, দরজার দিকে। 'আরে! দাঁড়াও দাঁড়াও। চাকরি করবে?' চাকরি হল মালিক কমল মিত্রের কারখানায়, বাড়িতে সমবয়সী সুচিত্রা সেন। শেষটায় উত্তমকুমার কারখানার
জেনেরাল ম্যানেজার। হয় না? এই কলকাতাতেই হয়। জানি তেমন মানুষও
ঘুরপাক খাচ্ছে এই মস্ত শহরের রাজপথ গলিপথ বেয়ে। কারো পিঠে উত্তমকুমারের সততার
পুঁটুলি। কারো হাতে বিকাশ রায়ের তালাবন্ধ
ব্রিফকেস। মজা পেয়ে যাই এই সব ভাবতে ভাবতে। রাস্তার ধারে ধারে উত্তম কুমার বিকাশ
রায় কমল মিত্রদের খুঁজতে থাকি। দু'চারটে বিকাশ রায় ছাড়া আর কাউকে খুঁজে
পেলাম না। ট্রাম এক সময় বাঁ দিকে বাঁক নিতেই অন্য জগত। অন্য শহর। এখানে বাঙালি কম।
সুসজ্জিত নানা ধরনের দোকান। ক্রেতারাও অন্য রকম,
সাহেব
মেমসাহেব। বুঝলাম, অনেক দিনের পুরানো বৃটিশ এরা। গায়ের
রং মুখশ্রী পাল্টে গেছে। পাল্টায় নি শুধু স্বভাব,
হাঁটাচলা বা
বেশবাস। বয়স যা-ই হোক, মেয়েদের পরনে শর্ট আর স্কার্ট, পুরুষদের প্যান্ট শার্ট,
কারো কারো
মাথায় হ্যাট বা ক্যাপ। বাড়িগুলোও ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। ফুটপাথ ঝকঝকে। দু'পাশের দালানগুলোর কিছু কিছু জানালায় পাশে ঝুলছে নানা রঙের
ফুলের ঝাড়। জানালায় ধব্ধবে টানটান পর্দা। এই তো কলকাতা! ক্যালকাটা। আমি নিজেকে
খুঁজে পাই। আমার সারা শরীর জুড়ে অজানা অচেনা এক সাফল্যের মাছ সাঁতার কাটতে শুরু
করে দেয়।
একসময় ট্রামটা শিয়ালদা স্টেশনের মত
একটা শেডওয়ালা স্টেশনের সামনে থেমে গেল। সবাই নেমে গেল, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর যাত্রী সবাই। সবার শেষে
আমিও। 'এটা গড়িয়াহাট?' 'হ্যাঁ গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো।'
গড়িয়াহাট
রোডটা কোনদিকে?' স্টেশন থাকলে সে স্টেশনের নামে একটা
স্টেশন রোডও থাকবে, অনুমান করলাম। সে তো আরো ওদিকে। এটা
আসলে বালিগঞ্জ। ট্রাম ডিপোর নাম গড়িয়াহাট।' যত বড় শহর, তত তার বৈচিত্র্য। হয়েই থাকে, হাঁটতে
থাকি। দেখি, দু'পাশে আর এক কলকাতা। একদিনে তিন
কলকাতা দেখা? আমার অভিযান সার্থক। চওড়া ডবল
ক্যারেজ রাস্তা। দু'পাশে সুদৃশ্য ঝকঝকে দালানকোঠা। নানা
ডিজাইনের। বোঝাই গেল, অভিজাত পাড়া। সিনেমার কলকাতা তো
এটাই। চিনে ফেলি মুহূর্তে। শিয়ালদার কলকাতায় মানুষজন, দালানকোঠা, দোকানপাট, গাড়ি বাস ট্রাম সবাই যেন হুড়মুড়িয়ে একে ওকে গুঁতিয়ে কনুই
মেরে ছুটছে, এখানে আসার সময়, ট্রাম থেকে দেখলাম, সাহেব কলকাতা, আর এই। উচ্চবিত্তের কলকাতা। পৌঁছে যাই গন্তব্যে। সাইনবোর্ডে লেখা--
গড়িয়াহাট জংশন। চার মাথার জংশন। চারটে গড়িয়াহাট রোড নাকি? তা তো হয় না। জিজ্ঞেস করলাম। দক্ষিণের রাস্তাটার নাম
গড়িয়াহাট রোড। বাড়ির নাম্বার গুণে গুণে এগুতে থাকি। ৩২/১এ, আমার মুখস্ত। অনেকদিন থেকেই চিঠি লিখতে আমার মহা আনন্দ। দূর
দূর আত্মীয়ের ঠিকানা জোগাড় করে করে পোস্টকার্ড পাঠাই। এক লাইন থেকে ২৫ লাইন। ওই
পোস্টকার্ডেই। মলয় তো স্পেশ্যাল। আমার ক্লাশ থ্রির বন্ধু। কিন্তু না। এই নম্বর
এখানে নেই। রাস্তার ডান পাশে দোকানের সার। বামপাশে বাড়ি। উঁচু উঁচু। ১৮, ২০, ২৬... কিন্তু ৩২/১এ নেই। 'আর একটু এগোও।' এবারে গোল পার্ক। একটা গোলাকার
পার্ককে ঘিরে আছে পাঁচটা রাস্তা। গড়িয়াহাট রোড তাহলে এখানেই শেষ? পাশেই একটা মিষ্টির দোকান। গাঙ্গুরামের। জুনের গরম। এতটা পথ
হেঁটে হতাশায় ক্লান্ত লাগছে। এদের জিজ্ঞেস করাই শ্রেয়। দোকানটা ঝকঝকে। মাছি ভনভন
না। দোকানীরাও খালি গায়ে বা লুঙ্গি-পরা বা গামছা-পরা না। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে ইতস্তত
করছি।
এই সময় দোকানের মুখে একটা সাদা
এম্বাসাডর গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ওপাশের দরজা খুলে আমার চেয়ে বছর তিন চার বড় একজন, টি শার্ট আর প্যান্ট পরনে,
সুস্বাস্থ্য, একমাথা কালো চুল। নামল। ধীরে খুব ধীরে দরজা লক করল। আরো
ধীরে এক এক পা সুখী পা ফেলে দোকানে উঠে গেল। পায়ে স্যান্ডেল। কে এই যুবক? কার সন্তান? কী করে এর বাবা? এর মা? ভাবতে থাকি, আমি এরকম নই কেন? ঈর্ষা না, শুধু প্রশ্নটাই ধেয়ে এল। আমরা পাকিস্তানে আছি বলে? আমার বাবা যখন তখন জেল বন্দী হন বলে? আমাদের মা তাঁর আট সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খান বলে? আমরা বালতি ভরে সাবানের ফ্যাক্টরি থেকে সাবান জল এনে মা'কে কাপড় কাঁচতে সাহায্য করি বলে? মনে আছে, এ সবের একটাও আমার না-হবার কারণ বলে
মনে হয় নি। নিজেকে অসমর্থ মনে হয় নি একবারও। শুধু মনে হল, আমি সুযোগ পাই নি। এখোন এই শহর আমাকে সেই সুযোগ দেবে। আমিও
গাড়ি চালিয়ে এসে দই কিনে নিয়ে যাব এই গাঙ্গুরাম থেকে। গড়িয়াহাট রোড আরো খানিকটা
এগিয়ে, একটা রেল লাইন, সেই পর্যন্ত। 'তোমাকে বাম পাশ ধরেই খুঁজতে হবে।
রাস্তার সব জোড় নম্বর বাম দিকে।' এক সহৃদয় যুবক বুঝিয়ে বলল। তাই
মানলাম। কিন্তু ৩২/১এ নেই। আছে তো বটেই। আমি তো রেগুলার চিঠি লিখি মলয়কে! মনে মনে ভরসাকে
ছুঁয়ে থাকি। ইতিমধ্যেই মাইল দুয়েক হাঁটা হয়ে গেছে বোধয়। চলো, আরো খানিক না হয়। রেল গেটে পৌঁছ গেলাম। একজন বলল, 'আমার মনে হয় এটা গড়িয়াহাট রোড সাউথ।' আরের তাই তো? গড়িয়াহাট রোড সাউথই তো হবে! ভুলেগুলে
বসেছিলাম। উনি বললেন, লাইনের ওপার থেকে গড়িয়াহাট রোড সাউথ, এপারটা শুধুই গড়িয়াহাট রোড। হাঁফ ছাড়লাম। আরো আধঘন্টা হেঁটে
ঘেঁটে পেয়ে গেলাম মলয়কে। বাড়িতেই ছিল। বাড়ি ভর্তি লোক। মলয়ের দাদা, বৌদি, ছোট ছোট দুই ভাইপো ভাইঝি, এক ভাগ্নে। দেখি, সবাই আমাকে চেনে। বৌদি বললেন, ' সুশীল, এই তোমার অরুণ? রোগা লিকলিকে। ঢ্যাঙ্গা।
আমি ভাবলাম না জানি কোন প্রেমেন মিত্তির!'
কিন্তু সবাই
আমাকে চিনল কী করে? মলয় বলল, 'তোর পোস্টকার্ড। সবাই পড়ে,
তাতে তোর আঁকা
দিনাজপুরের ছবি দেখে.. দাদা, দাদার বন্ধুরাও। চিনবে না?'
খাওয়া থাকার পরিবর্তে ছাত্র পড়াইব
শঙ্করদা আমার ছোট পিসির বড় ছেলে। আগে
মাত্র একবার তাঁকে দেখেছি। দিনাজপুরে। আমি তখন আরো ছোট। এখানে এসে কয়েকদিনের
মধ্যেই বুঝতে পারি, মানুষটির দুটি আশ্চর্য অনমনীয় সত্তা
আছে। এক, সবকিছুর সঙ্গে যে-কোন মূল্যে সমঝোতা
করা আর দুই, অনমনীয় আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয়, যাকে বলে লৌহ চরিত্র। আমার বাবার মত।
তবে বাবার মধ্যে শঙ্করদার প্রথম গুণটি ছিল না। এক্কেবারে জিরো। তাহলে নরানাং
মাতুলঃক্রম কী করে? পিসেমশয় মারা যাওয়ার পরপরই দেশভাগ
হয়ে যায়। পিসেমশয়রা থাকতেন সিরাজগঞ্জে। পিসিমার পাশে তখন পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে শঙ্করদার বয়স ১৮. বাড়ির বাক্স পেঁটরা
বেঁধেছেদে বললেন, 'চল,
আমরা কলকাতায়
চলে যাই।' উপায়ই বা কী। শঙ্করদাও ক'দিন থেকে মা'কে এটাই বোঝাতে চাইছিলেন। পিসিমার
তিন ছোট ভাইয়ের এক, সেও সিরাজগঞ্জে, স্কুল টীচার, রাজী না। 'আমাকে তো সেখানেও টুশ্যানি করে সংসার চালাতে হবে, দিদি। সেখানে সবাই অচেনা। এখানে তবু অনেকে চেনে আমাকে....' পিসিমা ট্রেনে উঠলেন। বসার জায়গা পেলেন মেয়েকে নিয়ে। বাকিরা
ভীড়ে দাঁড়িয়ে ঢুলে ঢলে রাত পার করে শিয়ালদায়। অসংখ্য ছিন্নমূলের সাগর সঙ্গমে
দাঁড়িয়ে পিসিমা মত বদলালেন, বললেন, 'বেহালায়
চল, তোদের কাকাদের বাড়ি। ওদের বাড়িটা নাকি বড়, তোদের বাবা বলতেন।' বেশিদিন না। কাকাদের উশখুশ বাড়তেই
শঙ্করদা টের পেয়ে যান। বুঝে ফেলেন, যা কিছু সঞ্চয়, তা ভেঙেই চলতে হবে। পিসিমাও তাতে সায় দিলেন। সপ্তাহ ঘুরতে
না ঘুরতেই কাকার দুপা ছুঁয়ে প্রণাম করে, মা আর ভাইবোনদের নিয়ে কলকাতা থেকে
পাঁচটা রেল স্টেশন দূরে, ২৪ পরগণার আড়িয়াদহে, খুব শস্তায় দুটো ঘর ভাড়া করে চলে গেলেন শঙ্করদা। বয়স তখন এই
আমার মতই। পরদিন থেকেই চাকরির সন্ধান। মেলে না। বুঝলেন, এই হট্টমালার সময়ে একটা টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট হাতে থাকলে, চারপাশের প্রতিযোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। শিয়ালদার জর্জ
টেলিগ্রাফ থেকে পাশ করলেন টেলিগ্রাফি। চাকরিও জুটে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। রেলের
শিয়ালদা ডিভিশনের এক অফিসে। সেই সময় কলকাতায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি এক সামাজিক
কালচার। আমার প্রবেশ এই লড়াইয়ের ১৫ বছর পরে। বুঝতে পারি, বদলায় নি কিছুই। সংগ্রামের পথটা দীর্ঘ হয়েছে শুধু। মানুষ
বদলেছে। সমাজ থেকেছে স্থির। বাবা বলতেন, এপার বলো, ওপার বলো-- দেশ দুভাগ করলেই সমাজ বা মানুষ ভালোর পথে হাঁটে
না। আমি মানি নি। তাই সীমান্তের এপারে। কিন্তু বাবা কি ভুল? বাড়ির আর সবাই? এখনো বুঝে ওঠার সময় হয় নি।
বাড়িতে আনন্দবাজার। যুগান্তরের
ঠিকানা সঙ্গে ছিলই। একদিন বাগবাজারে যুগান্তর অফিসে পৌঁছে যাই। একটা গলির ভেতরে, বিশাল বাক্স বিল্ডিং। একপাশের সারা আকাশের দখল নিয়েছে।
প্রবেশ পথ পিছনে। কাছে যেতেই বিকট ঘড়র ঘড়র আওয়াজ। আরও একটু ভেতরে গিয়ে দেখি, বিশাল বিশাল কয়েকটা মেশিন দৈত্যের মত হা করে গলগল করে
খবেরের কাগজ উগলে দিচ্ছে, একটা লোক তড়িঘড়ি সেগুলো সাজিয়ে পাশে
রাখছে আর একজন নিয়ে চলে যাচ্ছে। 'ওপরে যাওয়ার রাস্তা কোনটা?'-- জিজ্ঞেস করি একজনকে। কোমর ভেঙ্গে কাগজ গোছাতে গোছাতেই হাত
তুলে বললেন, 'ওই দিকে লিফট'. কিন্তু কী কোথায়? অন্ধকার। দিনের বেলায় ইতি উতি কয়েকটা
ন্যাংটো বালব। ঠাহর করতে পারি না। একসময় পেয়ে যাই। গ্রিলওয়ালা লিফট। ঘটাং খট।
কিন্তু এখানে না। বিজ্ঞাপনের অফিস রাস্তা পেরিয়ে। এটা আনন্দ বসু লেন। বিজ্ঞাপনের
অফিস, বাগবাজার স্ট্রিটে।
ফিরে আসি। খবরের কাগজের সাংবাদিক হব, কলকাতায় আসার সময় স্বপ্নের যে পুঁটুলি কাঁধে নিয়েছি, সাংবাদিকতা তাতেও আছে, অনেক স্বপনের একটি। খবরের কাগজের
অফিসেও এলাম। নিতাইদার পরামর্শ মত, 'প্রথমেই যুগান্তরে যাবি', সেই যুগান্তরেই। কিন্তু সাংবাদিকতার কথা মাথায় নেই সেদিন।
উত্তেজনাও না। আজকাল শঙ্করদার মুখটা মনে পড়ে প্রায়ই। সর্বদা হাসছেন। পরিবারে
বিব্রত মানুষটা, আমার মতই একলা। খাবারের থালা,
সংসারের নানা আয়োজনের
দিকে তাকালে বাস্তব আড়াল থাকে না। তাই আগে বিজ্ঞাপন। পরে সাংবাদিকতা। কাগজের অফিস
তো চেনা হয়েই গেল। বিবেকানন্দবাবুর কাছে যাওয়ার লিফটটাও।
'থাকা খাওয়ার পরিবর্তে ছাত্র পড়াইব'. বক্স নাম্বারে বিজ্ঞাপন। ৬ টাকা। সাতদিন পরে দেখে যেতে হবে, আমার নম্বরে কোন উত্তর এসেছে কিনা। কাউকে বললাম না।
শঙ্করদাকে তো নয়ই। এখন দমবন্ধ অপেক্ষা।
এদিকে জুন মাস শেষ হয়ে গেল, কলেজে কলেজে ভর্তির মরশুম অনেক আগেই শুরু হয়েছে। একদিন আমহার্সট স্ট্রিটের রাতের সিটি কলেজে গেলাম
ভর্তি হতে। আইএসসি পড়েছি দু'বছর। গোপন করলাম। ফাইন্যাল পরীক্ষার
সাত-আট দিন আগে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার,
আইবি'র কারসাজিতে, পরীক্ষা দেয়া হল না। স্কুলের
ম্যাট্রিকুলেশনের মার্কশিট নিয়েই এপারে আসা। প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব। 'ট্রানস্ফার সার্টিফিকেট লাগবে।' বললেন হেড ক্লার্ক। আমার হাতে জ্বলজ্বল করছে দিনাজপুর জেলা
স্কুলের সাদা মার্কশিট। প্রায় হাতে পায়ে ধরি মানুষটার। আমি জানতাম হবে, মানুষের হৃদয়ে জল নেই, আমি মানি নি কোনদিন। বললাম, ' আপনি প্রভিশন্যাল এডমিশন দিন, আমি
ট্রানস্ফার আনিয়ে আপনার কাছেই জমা দেব।' আমার ফর্মে, লাল কালিতে লিখে দিলেন,
'এডমিট প্রভিশন্যালি'. আমি আর কোনদিন তাঁর সম্মুখীন হই নি, হলেও লুকিয়ে নিয়েছি নিজেকে।
যুগান্তরের বিজ্ঞাপনের অফিসে গিয়ে
দেখি, জবাব এসেছে। একটি। পরদিন সকালে সটান সেই
বাড়িতে। মানিকতলা মেইন রোডের খাল পুলের ডান পাশে নেমে ইউ টার্ন, তারপর বস্তির পাশ দিয়ে হেলে,
খালের ধারে
একটা একতলা দালান। দেয়ালে নীল রঙের কাঠের দরজা। কড়া নাড়তেই এক মধ্য বয়স্কার
জিজ্ঞাসু চোখ। সব শুনে-- 'আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।' হল ঘরের প্যাটার্নের একটা ছোটখাট ঘর। এক পাশে একটি টেবিল, দুটো চেয়ার। বুঝলাম, এখানে বসেই চলবে পড়াশুনা। আমাকে
বসিয়ে বললেন, 'উনি এখুনি আসবেন। চানে গেছেন।' সারা ঘরটা খালি। চার দেয়ালে চারটে মা কালীর ছবি। তিনটি
মুখশ্রীর। একটি করাল জিহ্বা খড়্গহস্ত, পূর্ণাঙ্গ। সাদা পুরানো দেয়াল। একই
হাইটে প্রতিটা দেয়াল জুড়ে কালো ছোপছোপ দাগ। ধরতে পারলাম না কেন। তবে হাতের ঘষায় হয়
নি, তাহলে দরজা বা জানালার পাশে হত। ছোপছোপ দাগ
চারটি শূণ্য দেয়াল জুড়েই। খানিক পরে আমার থেকে হাইটে সামান্য খাটো, কর্তা, এলেন। আমার থেকে খুব বেশি বয়স, তা না। দুধে আলতা গায়ের রঙ। পরনে লাল রঙের ধুতি। সেটাই কোচা
দিয়ে পাক খেয়ে বুক কাঁধ বেয়ে পিঠে ঝুলছে। মুখ ভর্তি কালো কুচকুচে দাঁড়ি। গোঁফের
আলাদা অস্তিত্ব নেই। আমার কাছে এসে হাসলেন। কালো ঘুটঘুটে জঙ্গল ফুঁড়ে দারুণ ধবধবে
শক্ত পোক্ত দাঁতের সারি, 'একটু বসুন ভাই, পুজোটা সেরে নি।' ঘরের মাঝখানে দাঁড়ালেন। চারদিকের
চারটি ছবির উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন। বেশ জোরেই। স্পষ্ট গম্ভীর গমগম
করে সেই মন্ত্র সারা ঘরটায় ছেয়ে গেল, ভরে গেল। ঘরের পরিবেশটা মুহূর্তে যেন
পালটে গেল। আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল।
লোকটা একটা দেয়ালের কাছে গেলেন। মাথাটাকে ছাগলের মত উঁচু করে পেছেনে টেনে, 'জয় মা! জয় মা! জয় মা! বলে দরাম! দরাম! দরাম! তিনবার দেয়ালে
সজোরে মারলেন। কপালটা থেৎলে ফেললেন। খানিক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার দিকে এগিয়ে
এলেন। এবার এত ভয় পেলাম, চেয়ার ছেড়ে সটান উঠে দাঁড়াই। 'বসুন বসুন। কপাল বেয়ে এক ছোট্ট রক্ত রেখা তাঁর ভ্রূ ছুঁয়ে
নাকের পাহাড়তলি ছুঁতেই লাল ধুতির খুঁট দিয়ে তা মুছে বললেন, 'আপনার এটাই ঘর। একটা খাট দেব। আমার ভাইপো, ক্লাশ সিক্স। ওকে পড়াতে হবে। সকাল আর রাতে। স্কুল থাকলে
দুপুরে স্কুল ফেরার পরে আর রাতে। ভেতরে কল পাড় আছে। পায়খানা, খাটা অবশ্য, সকলের সঙ্গে, মানে, কমন। আমরা যা খাব আপনিও তাই খাবেন।
আমরা মাছ খাই, মাংস,
খিচুরি, লাবড়া সব...' বহুদিন আমি এর বাইরে আর কিছুই মনে
রাখতে পারিনি। আমি উত্তরে কী বলেছিলেম, কী ভাবে ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, কিচ্ছুটি মেনে পড়ে না।
শুধু এটুকু মনে আছে, খালপুলে দাঁড়িয়ে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। নানা কথা ভেবে।
যাবার সময় পিসিমা দিয়েছিলেন ৫ টাকা। তুফুদা ১০ টাকা, বৈজুদার
৫০ টাকার বাকিটা, আর সেদিন কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন
শঙ্করদা দিয়েছেন ১০ টাকা... আমাকে রোজগার করতেই হবে। শঙ্কর্দাকে মুক্তি দিতেই হবে।
কিন্তু কী ভাবে, কী করে? এই শহরে আর কি কি উপায় আছে,
তার সন্ধানে
নামতে হবে এখন থেকেই... হেঁটে হেঁটে শিয়ালদা ফেরার সারা পথটায় ভাবতে ভাবতে নানা
সম্ভাবনার কথা মাথায় এক এক করে ঢুকতে লাগল...
পরবর্তী সংখ্যায়………
[অরুণ চক্রবর্তী]