সংশপ্তক: আপনি কি মনে করেন সাহিত্য আমাদের জীবনের এক
অপরিহার্য্য অঙ্গ? কেন? আপনার মতে সাহিত্যের সাথে
জীবনের সম্পর্কটা ঠিক কী? এ বিষয়ে আপানার নিজের
অভিজ্ঞতা কী?
আর
সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসি বা কি বলে এই বিষয়ে?
কল্যাণ: ও
মা। এ আবার কেমন কথা। সাহিত্য ছাড়া মননশীল মানুষ বাঁচে নাকি? সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘুমন্ত স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাববো
না,
" সোনা রোদ,
তুই
প্রতিদিন ওর চোখে আঁকবিই চুমোর আল্পনা ? / আমার কি হিংসে হয় না রে,
হিংসে
হয় না ?"
এ
আবার হয় নাকি !
জীবন
নিত্যদিনের ব্যবহারে মলিন হয়ে ওঠে। আর
তখনি সাহিত্য আসে দখিনা বাতাস নিয়ে, সব ধুলো আবর্জনা ঝেড়ে ঝুড়ে
আবার হৈ হৈ করে বাঁচার রসদ যোগায়।।।।।।।।মনে পড়ে
" জীবনে জীবন যোগ করা,
নহিলে
ব্যর্থ হয় গানের পসরা।।।"
সাহিত্য
এই জীবনে জীবন যোগ করে।
সাহিত্য
আর জীবন অনেকটা পুরুষ আর নারীর মতো। একে ছাড়া ওর চলে না, ওকে ছাড়া তার।
আমি কিন্তু কেবল বেঁচে থাকাকে জীবন বলছি না। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাহিত্য। আর সাহিত্য তো জীবনের প্রতিচ্ছবি। সাহস দেন তো বলি, রসগোল্লা আর রসের যা সম্পর্ক, জীবন
আর সাহিত্য ও তাই।
মানুষের
ইতিহাস তো সাহিত্যে প্রতিফলিত।
সেই যে,
চর্যাপদের
" কায়া তরুবর পঞ্চবী ডাল,।।।।।।।।"
আর
ভাঁড়ু দত্তের বেসাতি। সাহিত্যের ইতিহাস তো
জীবনের ইতিহাস। এতে সন্দেহ আছে?
সংশপ্তক: শুরু থেকেই শুরু করা যাক তবে - আপনার বড় হয়ে
ওঠার প্রক্রিয়ায় সাহিত্যের অবদান কতটা? কারা ছিলেন আপনার প্রিয়
সাহিত্যিক? তাদের লেখা কি ছায়া ফেলেছিল আপনার বড় হয়ে
ওঠায়?
কল্যাণ: মরেছে। আমায় আপনারা সাহিত্যিক ঠাউরে ফেলেছেন নাকি? এটা কি এই ইন্টারভিউয়ের পূর্ব শর্ত নাকি? আমি বাপু সাহিত্যিক
নই মোটেই। তবে হ্যাঁ আমার ছোটবেলা
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে সম্পৃক্ত ছিল।
কোন ছোটবেলায় পড়েছি,
"ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো,
রাখো
রাখো খুলে রাখো
শিয়রের
ওই জানলা দুটো,
গায়ে
লাগুক হাওয়া।
ওষুধ
? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া।"
আর
পড়তে পড়তে মনে ছবি আঁকা হয়ে গেছে সেই নারীর চিরন্তন অপেক্ষার।
সঙ্গে
ছিলেন বিভূতিবাবু । পথের পাঁচালি। দুর্গার মৃত্যু, হরিহর, সর্বজয়া, অরোরা বোরিয়ালিস।।।।।।।।আমি বারবার অপু হয়ে ঘুরে বেড়াতাম আমার
মামাবাড়ির অজ পাড়াগাঁ বেলান গ্রামে।
সহজ করে লিখতে শিখতে গেলাম যদিও মনে রয়ে গেলো,
" সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে
সহজ
কথা যায় না বলা সহজে।"
আর
ছিল আবোলতাবোল। সেই কবে থেকে আকাশের গায়ে
টক টক গন্ধ পাচ্ছি। এখনো পাই। বেশি বেশি পাই ইদানিং।
সংশপ্তক: আপনার কি মনে হয় সাহিত্য মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন
গোড়ে তোলে? অথবা মানুষের সাথে তার পারপার্শ্বিকের?
কল্যাণ: এ আবার কেমন কথা। সাহিত্যই তো সেতু। জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির।
" তোমায় দেব চুমুর আগুন, ঝলসানো দুপুর-জীবন,
তারপর
আদর ঝরবে বৃষ্টি হয়ে,
তুমি
গর্ভিনী হবে বর্ষার ভরা-নদী ,
অজস্র
সম্ভাবনা অনিমেষের মতো খেলা করবে
পৃথিবীর
গভীর গর্ভে।"
বলুন, প্রকৃতি জীবন সব একাকার হয়ে যায় না সাহিত্যে?
আর
বর্তমান জীবনের প্রতিফলন? হয় না? একটু পিছনের উদাহরণ টানি?
রবীন্দ্রনাথ, কামু, মানিক, তারাশঙ্কর।।।।।।।অজস্র।
সংশপ্তক: আপনার মতে কোন কোন ঘটনা এযুগের সাহিত্যকে
সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে?
কল্যাণ: বাহ রে। এতো সাহিত্যের ইতিহাসের লোকেদের প্রশ্ন হয়ে
গেলো। আমি একটা কথাই বলবো, সাম্প্রতিক সাহিত্য বলতে কবে থেকে ধরছেন? যাই ধরুন একটা কথা আমার কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মনে কিলবিল
করছে। এই যে একটা ভার্চুয়াল
পৃথিবী আমাদের চারপাশে দিব্যি বিরাজ করছে, এই যে সেই মায়ালোকে আমরা
ইচ্ছে হলেই টুক করে ঘুরে আসছি, দুঃখ ভাগ করে আসছি, সুখে স্নান করে আসছি।।।।।।।অথচ যার কোনো অস্তিত্ব নেই, নেই কিন্তু আছে। এই
মায়ালোক আর বাস্তবের দ্বন্দ্বই হতে চলেছে ভবিষ্যৎ সাহিত্যের বিষয়। এই মানুষের অনস্তিত্বের মধ্যে অস্তিত্ব
খুঁজে পাওয়া, স্বপ্নকে সত্যি আর সত্যিকে মায়া ভাবা এই হবে
ভবিষ্যতের সাহিত্য কারণ সমস্ত সম্পর্ক এই দুই জগতের মধ্যে আসা যাওয়া করতে থাকবে।
সংশপ্তক: আপনার কি মনে হয় Information
Technology সাহিত্যকে
বা সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে তার সাবেকি পথ থেকে টলিয়ে দিয়েছে? কবি, লেখক অথবা সৃষ্টিশীল
সত্ত্বা হিসেবে আপনি কি ভাবে সাড়া দেন এই পরিবর্তনে?
কল্যাণ: এতো কঠিন করে বলা কেন? সাহিত্য যুগে যুগে প্রকাশ
পেয়েছে যেভাবে মানুষ ভাব প্রকাশ করেছে।
বালিতে লিখতো, পাথরে লিখতো,
পাতায়
লিখতো।।।।।।।সেখান থেকে প্যাপিরাস , তারপর টাইপ ।।।।।।।এখন ফেসবুক, ওয়ার্ডপ্রেস , ব্লগ, ই-বুক।
আমি তো সাহিত্যিক নই কিন্তু সাহিত্যিককে মানুষের ভাবপ্রকাশের মাধ্যমকে স্বীকার
করতেই হবে। করছেন ও।
সংশপ্তক: আপনার কি মনে হয় সাহিত্যের আধুনিক ও পুরাতন
ধারার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে পারে কবিতা? এ ব্যাপারে কবিদের কোন
ভূমিকা আছে বলে আপনার মনে হয়?
কল্যাণ: কবির
ভূমিকা? মরেছে। ভূমিকা ভেবে সাহিত্যিক সাহিত্য লিখবে? শিল্পী ছবি আঁকবে? কবি কবিতা লিখবে এই ভেবে
ভেবে যে কিভাবে আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন করা যাবে? স্বতঃস্ফূর্ততা ছাড়া সাহিত্য হয় নাকি? আর ট্রাডিশনাল কি? মডার্নিজম ই বা কি? আজ যা মডার্ন কাল তা ট্রাডিশনাল নয় ? কে জানে বাবা, প্রশ্নটা মোটে বুঝলাম না
বোধ হয়। ক্ষমা করুন।
সংশপ্তক: আপনার কি মনে হয় একজন সাহিত্যিককে সবচেয়ে
বেশি প্রভাবিত করে তার সমাজ? আপনার নিজের দেশে এই
প্রভাব দেখেন কি? দেশ, কাল, সমাজ কিভাবে একজন সাহিত্যিককে প্রভাবিত করে বলে আপনার মনে
হয়? কিভাবেই বা একজন সাহিত্যিক এই বেড়াগুলি টপকে
আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেন - আপনার কি মনে হয় বলুন?
কল্যাণ: সাহিত্যিক নই। তবে হ্যাঁ আমি তো আমার দেশের প্রোডাক্ট। চিন্তনে,
মননে, জাগরণে, স্বপনে আমার সমাজ, আমার দেশ। সে
ভালো ভাবলেও, আর খারাপ ভাবলেও। সাহিত্যিকদের ও তাই হয় বলেই মনে হয়। তার সাহিত্যে তার গল্পে, তার কবিতায় তার দেশ ধরা পড়ে। ইতিহাস পড়ে ,
তথ্য
ঘেঁটে অন্য দেশের গল্প লিখতে পারলেও সাহিত্যিক কিন্তু যেদেশের মানুষ সে দেশেরই
থাকেন। গুন্টার গ্রাসের কালী কি
আর রামপ্রসাদের কালী হন?
সংশপ্তক: আপনার কি মনে হয় ঝড়-ঝঞ্ঝা-যন্ত্রণা সৃষ্টির সহায়ক?
কল্যাণ: মানুষ বেদনাতেই বেশি সৃষ্টিশীল। অন্তত সাহিত্যে তো একথা ভীষণ সত্যি। যুদ্ধ কত অমর রচনার জন্ম দিয়েছে। আর প্রোটাগোনিস্ট কিনা জানি না। এইটুকু প্রার্থনা করি, কবিকে যা খুশি লিখতে দাও,
সাহিত্যিককে
যা খুশি রচনা করতে দাও। স্বাধীনতা একমাত্র
স্বাধীনতায় সুন্দর সৃষ্টি সম্ভব।
দ্বায়িত্বের বন্ধনে বেঁধোনা সাহিত্যকে, শিল্পকে।
সংশপ্তক: আপনার কি মনে হয় সাধারণ মানুষ সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামায়? মনে হয় এই ভোগবাদী সময়ে মানুষ সাহিত্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে
নিচ্ছে? মনে হয় কবিতার কোন অর্থপূর্ণ ভূমিকা আছে
সমাজে?
কল্যাণ: ঠিক
ওভাবে আমি ভাবি না। মানুষের আজ বড্ডো সময়ের
অভাব। চারিদিকে বড্ডো অসহিষ্ণু তাড়া রয়েছে
চটপট কোথাও পৌঁছোবার। ভোগবাদ আছে। কিন্তু তাই শেষ কথা নয়। এখনো বই বিক্রি হয়। এখনো বিশ থেকে ত্রিশ বছর সাহিত্যে বিচরণ করে। আঁধার চেরা আলো আছে। কবিতা আছে। কবিতা পড়ছে মানুষ। কবিতা লিখছে মানুষ। সাহিত্য আছে,
থাকবে। কবিতা আর সাহিত্য ওষুধ নয়। কোনো সমস্যার সমাধান ও নয়। সাহিত্য বরং একটা বোধের জন্ম দেয় যা মানুষকে
সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। সংগ্রাম মানে কিন্তু শুধু
লড়াই নয়। সাহিত্যের মধ্যে মানুষ
খুঁজে পায় আনন্দ, শান্তি।।।।।।।।জীবনে এগিয়ে যাবার রসদ।
সংশপ্তক: আপনি কি নারীবাদী? নারীবাদে সাহিত্যের কোন
ভূমিকা আছে? জীবনকে উন্নত করতে সাহিত্যের আদৌ কোন ভূমিকা
আছে কি?
কল্যাণ: না তো। আমি নারীবাদী নই। এবং মনে করি যে পুরুষতন্ত্রেও বিশ্বাস করি
না। কোনো ইজমকে সাহিত্য
প্রতিষ্ঠিত করে না, যদিও ইজম সমাজের মধ্যে থেকে সাহিত্যকে
প্রভাবিত করতেই পারে।
আগেই
বললাম যে সাহিত্য আমাদের তাই দেয় যা আমরা পেতে চাই।
সংশপ্তক: আপনি কোনটাতে বিশ্বাসী - খুব শীঘ্রই
সাহিত্যের আকাল ঘনিয়ে আসছে না সাহিত্য এক নতুন দিশা দেখাবে জীবনকে?
কল্যাণ: দেখুন - আমি একটু অন্যভাবে ভাবি। জীবন এসেছিলো আগে। সাহিত্য এলো জীবনের সৃষ্টি থেকে। জীবন নিজের তাগিদেই সাহিত্যকে নিয়ে এলো। যুগে যুগে সাহিত্যের গঠন ও বিষয়ের যে উত্তরণ
তা কিন্তু জীবনের যাত্রার প্রয়োজনেই।
ভবিষ্যতেও জীবন সাহিত্যকে সঙ্গে রাখবে, তার মতো করে, তার জন্যেই।