জয়ী (৭ম পর্ব)
মলে
ঘুরতে কোনদিনই ঠিক স্বস্তি বোধ করে না মঙ্গলা। আর বিশেষ করে এই মলটায় সে আসতেই
চায় না। তার মা বেঁচে থাকতে বার কয়েক ঢুকেছিল,
এমনিই
ঘুর ঘুর করেছিল মা বেটিতে। কি করে মানুষে মুদির জিনিস, আনাজপত্র মলের দোকান থেকে কেনে, বোঝেনি মঙ্গলা। তখনতো সে ওই জবর দখল কলোনিতে থাকত, তাদের কলোনিরও কাউকে কাউকে দেখত, এখান থেকে শ্যাম্পুর পাউচ,
বিস্কুট
এমন সব কিনতে। আজ আপত্তি জানানো সত্ত্বেও তার ক্লাসমেটরা ছাড়েনি। টানতে টানতে
নিয়ে এসেছে; কি করে বোঝায় মঙ্গলা সে একসময়ে এই মলের
কাছে মিসেস মজুমদারের বাড়িতে থাকত। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসব এলাকায় এলে তার ওই
দিনগুলো মনেপড়ে। মনেপড়ে জ্যেঠুর কথা, শুভ কে ও। আর ভয় হয় পাছে
ধরা পড়ে যায় ওদের কারোর কাছে। আজকাল অবশ্য আর বিশেষ কাউকে অতশত বলেনা, সে কে, তার মা কি করে তাকে এই
জায়গায় এনেছেন। এখনের বন্ধুরা শুধু জানে যে মঙ্গলা অনাথ আর অনেক কষ্ট করে
লেখাপড়া চালাচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি বৃহন্নলাদের জন্যও কি যেন করে মঙ্গলা, ওঁরাও মঙ্গলার লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কি জানি হেল্প করেন।
কাজেই পার্টিক্যুলার এই মলটায় না আসতে চাওয়ার কারণ সে বোঝাতে পারেনি বন্ধুদেরকে।
ওরা মোটামুটি উদ্দেশ্যহীন ভাবেই ঢুকেছে মলে; একটা নামী কাপড়জামার
দোকানে ঢুকে সেলের জিনিস ঘাঁটতে লাগল। আর মঙ্গলা টুকটুক করে ঘুরে ঘুরে রিঙয়ে
টাঙ্গানো শাড়ীগুলো দেখছে। হঠাতই পিঠের ওপর ট্যাপ করলো কেউ। পিছন ফিরে দেখে
উজ্জ্বল হাসি নিয়ে দাঁড়ানো ইমন। একটু ভারিক্কি হয়ে বোধহয় আরো রূপসী হয়েছে; লক্ষ্য করলো ইমন মা হতে চলেছে।
"চিনতে পারছ না?" একটু
ম্লান হলো হাসি ইমনের,
"হ্যাঁ, ওমা!! চিনব না? ইমন তো" প্রমাদ গনলো মঙ্গলা, এই অবস্থায় ইমনকে কি একা আসতে দেবে? হয় শুভ নয় অলকেন্দু বা সর্বানী কেউ না কেউ তো থাকবেই সঙ্গে।
কপাল থেকে ঘাম ফেলার অভিনয় করে ইমন বলল,
"ফিউ!! বাব্বাহ বাঁচালে, এই কয় বছরে যে এক্কেবারে ভুলে মেরে দাওনি" বলে হাগ
করল মঙ্গলাকে; আরো প্রাণবন্ত হয়েছে বোধহয় মেয়েটা।
"শোনো না,
তুমি
কি একা? নাকি কারোর সাথে এসেছো?"
"না, একা না আমার___" মঙ্গলার কথা শেষ হবার আগেই ইমন চোখ টিপে বলে
"স্পেশ্যাল কেউ?" একটু
অপ্রস্তুত মঙ্গলা,
"না না আমার ক্লাসের বন্ধুরা"
"ওঃ, তবে তো আমার প্রায়োরিটি; আমি পুরনো বন্ধু। আমার বলে কত কথা জমে আছে। চলো ফুডকোর্টে
যাই" বলেই হাত ধরে টানতে টানতে চলল। মঙ্গলা বুঝল ছাড়ান নেই; এই ভয়েই তো এখানে আসতে আপত্তি ছিল
"ইমন আমি না একটু ওদের বলেনি, কেমন?"
"ওক্কে" বন্ধুদের বলে নিয়ে চলল ইমনের
সাথে; প্রচন্ড এক্সাইটেড ইমন এক তরফা বকবক করতে
করতে এসকালেটরে উঠে ওপর তলায় ফুডকোর্টের পানে চলল
"জানতো এখন না খামোখা কেমন ক্ষিধে ক্ষিধে পায়
আমার, ভাবছিলাম শপিং করব সেলে, তার বদলে ক্ষিধে পেয়ে গেল। তোমায় পেয়ে গিয়ে খুব ভালো
হলো। বল না তুমি এখন কি করছো? মাস্টার্স? আচ্ছা অমন কাউকে কিছু না বলে কোথায় উবে গেলে বল তো? আমরা কতো খুঁজেছি তোমায়"
"আমরা মানে?"
"আমরা মানে মেইনলি আমি আর___" বলতেই মোবাইল বাজছে ইমনের;
মোবাইলের
দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে কথাটা শেষ করলো "শুভ"।
"হ্যাঁ, বল, আমি ফুডকোর্টে। কেন মানে?
ফুডকোর্টে
কি করতে আসে মানুষে? এখন আসবি না এখানে, কেন মানে? আমি বারণ করছি তাই আসবি না, কি? কোথায়? পিছনে?" বলে পিছন ঘুরল; দারুণ স্মার্ট, অসম্ভব প্রাণচঞ্চল, সুদর্শন একটি ছেলে হাসতে হাসতে এসে উপস্থিত।
"তুই না জানিয়ে ফুড কোর্টে এলি যে বড়? শপিং শেষ?"
"শেষ? শুরুই করতে পারিনি; দেখ না ওর সাথে কতো বছর বাদে দেখা, আর তুই তো জানিস আমার এখন কেমন ক্ষিধে ক্ষিধে পায়
সবসময়" বলে একটু ঠোঁট ফোলায় ইমন। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ছেলেটি।
"মাই গুডনেস,
এতো
সময় ধরে শপিং শুরুই করতে পারিসনি? ঠিক আছে শোন কি খাবি খা, খেয়ে বাড়ি চল, আজ আর শপিং করে কাজ নেই, এই অবস্থায় আর ঘুরতে দেব না" বলে এতক্ষণ পর মঙ্গলার
দিকে তাকাল, তাকিয়ে ইমনকে জিজ্ঞেস করল "কে?"
"আরেহ, ওই ই তো মঙ্গলা, বলেছিলাম না তোকে? দেখ না আজ খুঁজে পেলাম, প্লিজ তুই যা, আমি ওর সাথে কথা বলেনি; বেশি দেরী করব না, প্রমিস"
"ইসস, কি মিস্"
"কিসের?"
"নাহ আর কটা দিন আগে খুঁজে পেলে আর ___ বিয়েটা করতাম না" বলতেই ঠাস ঠাস করে মারতে লাগলো ইমন।
"কি বললি?
কি
বললি? আরেকবার বল?"
হো
হো করে হাসছে ছেলেটি
"অ্যাই দ্যাখ মারিস না এটা পাবলিক প্লেস; বাই দ্য ওয়ে আমি কল্যাণ,
ইমনের
ওয়ার্সার হাফ" বলে হাসতে হাসতে শেক হ্যান্ডের জন্য হাত বাড়ালো মঙ্গলার
দিকে। মঙ্গলা এত সময়ে ওদের এই খুনসুটি উপভোগ করলেও কল্যাণের এই পরিচয়ের জন্য একে
বারেই প্রস্তুত ছিল না; থতমত হয়ে হ্যান্ড শেক করল। ইমন এবারে ঠেলে
ঠুলে ভাগাল কল্যাণকে, যাবার আগে অবশ্য ওরা যা অর্ডার করেছিল সেগুলো
কাউন্টার থেকে ট্রে করে এনে দিয়েও গেল। খেতে খেতে প্রসঙ্গে ফেরে ইমন,
"বললে না?"
"কি?"
"ওই যে তুমি কোথায় চলে গেছিলে?"
"বলছি, তার আগে তুমি বলতো, আমার তো ধারণা ছিল তোমার আর শুভর বিয়ে হয়েছে, তাহলে কল্যাণ কোত্থেকে?
আমার
তো সব গুলিয়ে যাচ্ছে"
"এই চিনলে তুমি শুভকে?"
"মানে?"
"মানে বোঝাতে হবে? তুমি কি ভেবেছিলে? তুমি চলে গেলেই শুভ তোমায়
ভুলে গিয়ে আমায় বিয়ে করে নেবে? ওর ভালবাসার প্রতি এই
তোমার ভরসা?"
"কিন্তু ইমন আমায় যে যেতেই হতো"
"সেটাই তো জানতে চাইছি কেন?"
"সেবারে শুভ এসে ঘুরে চলে যাবার পর প্রায় রোজ
এবেলা ওবেলা করে ল্যান্ডলাইনে ফোন করতো শুধু আমার সাথে কথা বলার জন্য। তখনও আমার
জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা হয়নি; আন্টি হঠাৎ করেই লক্ষ্য
করেন এই ব্যাপারটা, আর তুমুল অশান্তি শুরু হয়। আমি যে ভয়টা
পেতাম সেটাই হয়েছিল, আন্টির ধারণা ছিল আমায় থাকতে দিয়ে উনি খুব
ভুল করেছেন। আমার মতো মেয়েরা নাকি আলটিমেটলি এটাই করবে এটা আন্টি জানতেন। ওই রকম
আরামের জীবন কন্টিনিউ করতে চাই বলেই, প্লাস শুভর মতো দারুণ একটা
ছেলেকে সামনে পেলে আমাদের মতো মেয়েরা যে লোভ করবেই এটাই তো স্বাভাবিক। আমি যদি
এরপরেও চলে না যেতাম____" গলা আটকে যায় মঙ্গলার
"বেশ, কিন্তু তুমি তো জ্যেঠুকে
জানাতে পারতে কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো জানতে শুভ ফিরলে
তোমায় না পেলে কতো কষ্ট পাবে?"
"নাঃ, খানিকটা ইচ্ছে করেই কাউকে
জানাইনি, আর খানিকটা অনিশ্চয়তাও ছিল। কোথায় থাকব
তারই তো ঠিক ছিল না। আমার বন্ধু সুচেতা, ও সব কথা জানত, ইনফ্যাক্ট ওদের বাড়ির সবাই ই জানতেন; ওঁরা আমায় অসম্ভব ভালোবাসেন, ওঁরাই
আমায় থাকতে দেন, যাতে জয়েন্ট ঠিক মতো দিতে পারি তার ব্যবস্থা
করেন"
"তুমি তাহলে এখন কি পড়ছ?"
"মেডিক্যালে চান্স পেয়েছি জয়েন্টে, র্যাঙ্ক খুবই ভালো ছিল,
এটা
পুরোপুরি জ্যেঠুর কৃতিত্ত্ব; উনি যেই ভাবে আমায় রেডি
করেছিলেন যে ওই মানসিক অবস্থার মধ্যেও আমি ভালো রেজাল্ট করি।"
"জ্যেঠু জানেন?"
"নাহ" চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না, সেই টপ্ টপিয়ে গাল বেয়ে নেমে এল।
"একদিন কল করেছিলাম, কিন্তু বলতে আর পারিনি,
জ্যেঠুর
আওয়াজ শুনেই খুব কষ্ট হচ্ছিল"
"তুমি জানো,
সেবারে
ওই যে সর্বানী আন্টি আর মা পর পর দুদিন পার্টি দিলেন, মনে আছে?" মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
"আমাদের পার্টিতে গিয়ে শুভ আমার কাছে কনফেস
করে ওর একজন পার্মানেন্ট গার্ল ফ্রেন্ড আছে, এদিকে আমি আর কল্যাণ
ততদিনে চুটিয়ে প্রেম করি; আমি বলে সেই কথাটাই শুভকে
বলব ভাবছি, এর মধ্যে ও ই দেখি জানাল। যদিও মেয়েটা যে
তুমি এটা জানতাম না; তখন জিজ্ঞেসও করিনি। কারণ তখন এত্ত খুশি
হয়েছিলাম যে শুভকে বিয়ে করতে হবে না; ওই পার্টিতে ঝুমা আন্টি
মানে কল্যাণরাও নিমন্ত্রিত ছিল। কল্যাণের সাথে পরিচয় করে শুভ আমাদের দু'জনকে
বলে যে ও তখন ওর জিএফ কে মিট করতে পার্টি থেকে কাটবে, আমরা যেন একটু ম্যানেজ করি। তারপর আমি স্যুর ও তোমার কাছেই
যায় তাই না?" আবার মাথা নেড়ে উত্তর দেয় মঙ্গলা, চোখ ঝাপসা কিছুতেই কাটে না।
"তোমায় মনেহয় বলে গেছিলো যে সিক্স মান্থস
বাদে ফিরবে? ঠিকই ফিরে ছিল, ততোদিনে
তুমি চলে গেছ। প্রথমে সবাই ভেবেছিল যে আমার টানেই ফিরেছে শুভ। পরে তো তোমায় না
পেয়ে কি কি না করেছে, তখন সবাই জানল আসল খবর। তোমায় খুঁজতে জানো
আমি আর শুভ তোমার গ্রামের বাড়ি খুঁজে খুঁজে সেখান অবধি গেছিলাম, ওনারা তো কিছুই জানেন না। শুভ তো পুলিশেও খবর করতে চেয়েছিল
জ্যেঠুই মানা করেন; তোমার চিঠিতে বুঝি কি লিখেছিলে, তাই। মাঝের থেকে আমাদের খুব উপকার হলো, আমার মা এমনিতে কল্যাণের থেকে শুভকে বেশি নম্বর দিতো, যেই তোমাদের খবরটা বেরল অমনি মা তড়িঘড়ি আমাদের বিয়ে
দিয়ে দিলো" বলে খুব একচোট হেসে নিলো ইমন।
(পরবর্তী সংখ্যায়)
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী