>

অরুণ চট্টোপাধ্যায়

SongSoptok | 10/15/2015 |




(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -১১
প্রাণিহত্যার বিকল্প
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ইচ্ছাবৃষ্টি বর পেয়ে তো খুব খুশি ডাঃ গৌতম। অবশ্য এ বর তিনি দেবতাদের কাছ থেকে পান নি। পেয়েছেন বিজ্ঞানের কাছ থেকে। পেয়ে শুধু নিজের দেশকে নয়, খুশি রেখেছেন সারা বিশ্বকে। সারা বিশ্ব তাই তাঁকে বিশ্বরত্ন পুরস্কার দিয়েছে। সরকারের তৈরি ‘রেন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কন্ট্রোল’ বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তা হয়েছেন। কাজ আর দায়িত্ব সব বেড়েছে। বিভিন্ন দেশকে তাদের প্রয়োজন মত মেঘ ও বৃষ্টি সরবরাহ করে সবাইকে সুজলা সুফলা করে রেখেছেন। এসব কথা যারা আমার ‘একান্ত ব্যক্তিগত ১০’ পড়েছেন তারা বিস্তারিত জানেন। না জানলে সেটা পড়ে জেনে নিন। বিপত্নীক হওয়ার পর নিজেই রান্না করে খান তিনি। অবশ্য আগে একজন লোক ছিল কিন্তু কিছুদিন ধরে সে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তাই নিজেই রান্না করেন দুবেলা। এখন অবশ্য অফিসে বেশিক্ষন থাকতে হয় না তাঁকে। টেলিফোন আর ভিডিও কনফারেন্সেই সারা হয়ে যায়।

বেরিয়েছেন বাজারে। ভাবছেন আজ একটু ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন রাঁধবেন। সেইমত থলিহাতে দাঁড়ালেন মুরগীর মাংসের দোকানে। চকচকে টিনে মোড়ান টেবিলের সঙ্গে আটকানো একটা বঁটি দিয়ে কাটা হচ্ছে মাংস ঠিক তাঁর আগেই ছাড়ানো সব মাংস শেষ হয়ে গেল। দোকানি তখন নিচের জালে ঘেরা আলমারি থেকে একটা মুরগীকে ধরে ঘ্যাচাং করে তার মুন্ডুটা বঁটি দিয়ে কেটে দিয়ে ধড়টা আবার খাঁচায় ভরে খাঁচার দরজা আটকে দিল। আর যা হবার তাই হল। প্রচন্ড শব্দ করে প্রচন্ডভাবে ছটফট করতে লাগল মাথাকাটা মুরগীটা। খাঁচাটা ঝপাং ঝপাং করে কাঁপতে লাগল। এমনভাবে বঁটি দিয়ে মুরগীর মাথাটা কাটল দোকানি যেন সে একটা লাউ কি বেগুন কাটছে। আশপাশে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলেন গৌতমবাবু। কারোর কোনও প্রতিক্রিয়া লক্ষ পড়ল না। যেন এ অতি সাধারণ ঘটনা। কারোর কোনও হেলদোল নেই। খুব কষ্ট হতে লাগল তাঁর। যত যাই হোক একটা প্রাণি বলে কথা। দোকানিকে একটু ধমকে বলল, মুরগী কাটার কাজ একটু আড়ালে করতে পার না? লোকের চোখের ওপর করতে হবে? একটুও মায়া লাগে না?

দোকানি হয়ত তাঁর বিশ্বরত্ন প্রাপ্তির কথা জানে না। তবে তিনি যে খুব দামি মানুষ তা জানে। একটু সম্ভ্রম রেখেই বলল, এই দোকানের মধ্যে আর আড়াল কোথায় পাব?
- তাই বলে সকলের সামনে?

এবার লোকটা বেশ রেগে গেল। বলল, এখন তো দরদ উথলে উঠছে। চিলি চিকেন কি চিকেন বিরিয়ানি খাবার সময় মনে থাকে না? যত্তোসব!

একটু অপমানিত বোধ করলেন বটে কিন্তু ভাবলেন কথাটা তো ভুল নয়। দোকানি লোকের সামনেই কাটুক বা আড়ালে, ব্যাপারটা তো সেই একই। অর্থাৎ প্রাণিহত্যা। হাঁস, মুরগী, পাঁঠা, খাসি, গরু, মোষ ইত্যাদি কত নিরীহ প্রাণিদের প্রাণ যাচ্ছে মানুষের ছুরিতে নিত্য। এই যে এত এত ডিম আসছে রোজ বাজারে। এর থেকে তো কত হাঁস বা মুরগী হতে পারত। কিন্তু খাদ্য-খাদক সম্পর্ক তো মানুষ মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ খাদ্যের প্রয়োজনে প্রাণিহত্যা করা যাবে। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসলেন ডাঃ গৌতম। সেই প্রাচীন কালে গাছের ডাল বা পাথর ছুঁড়ে বন্য জন্তু শিকার করত মানুষ তার খাবার জন্যে। কিন্তু তারপর তো কেটে গেছে কোটি কোটি বছর। কত সভ্যতা কত আবিস্কার তবু মানুষ কেন এখনও চালিয়ে যাবে এই বর্বর প্রথা? কেন নিরীহ প্রাণিগুলি প্রাণ খোয়াবে বুভুক্ষু মানুষের ধারালো ছুরির ফলায়?

মানুষ মাংসাশী। তাই তারা প্রাণিহত্যা করে। যারা অহিংস মানুষ তারা হয় নিরামিষভোজী। তারা সবজি খায়, ফল খায়, দুধ খায়কিন্তু বাংলার বিজ্ঞানী ডাঃ জগদীশচন্দ্র যে বলে গেছেন গাছেরও প্রাণ আছে? তাদেরও আঘাত লাগে। মৃত্যুর যন্ত্রণা হয়? তবে তো ভাতডাল তরি তরকারি খাওয়াটাও সমান হিংসা। আর ধরা যাক দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা? একটি শিশু ছাগল বা বাছুরকে বঞ্চিত করে দুধ দোয় মানুষ। এটা সরাসরি প্রাণিহত্যা না হলেও প্রাণিকে কষ্ট দেওয়া তো বটেই। একটা চ্যানেলে সেদিন শিক কাবাব তৈরি করা দেখাচ্ছিল। ডাঃ গৌতমের চোখে ভাসছিল আদিম যুগের দিনগুলি যখন মানুষ শিকার করা কাঁচা মাংস আগুনে ঝলসে খাচ্ছে। তার মানে মানুষ সেই আগের মতই রয়ে গেছে? কোটি কোটি বছর ধরে অর্জিত সভ্যতার উন্নতি কোনও ফলই ফলালো না? এদিক থেকে মানুষ সেই অসভ্য বর্বর রয়ে গেল?  

কিন্তু তাহলে মানুষ খাবে কি। না এবার বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে ডাঃ গৌতমকে। সরকারের কাছে ছুটি চাইলেন ছ’মাসের। সরকার বুঝলেন এই ছুটির অর্থ নিশ্চয় ডাঃ গৌতমের আবার এক আবিস্কার। আবার কোনও ‘একান্ত ব্যক্তিগত’। সেই শান বাঁধানো সিন্থেটিক বটগাছের তলা আবার পরিস্কার করা হল। আবার ধ্যানে বসলেন ডাঃ গৌতম। আবার সেই আমাদের চেনা ছয়মাসের ব্যবধান। ছমাসের পরে ধ্যানভঙ্গ আর সাংবাদিক সম্মেলন।

- সমবেত ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গন, ডাঃ গৌতম শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতা, কোটি কোটি বছর আগে মানুষ অসভ্য আর বর্বর ছিল। বুভুক্ষু মানুষের কাছে প্রাণিহত্যা করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প কিছু ছিল না। তাই তারা গাছের ডাল বা পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে জন্তুদের নিষ্ঠুর আর নৃশংসভাবে খুন করত। তাদের মাংস প্রথমে কাঁচা আর আগুন আবিস্কারের পরে আগুনে ঝলসে খেত। অথচ দীর্ঘ সভ্যতায় আমরা কম জিনিস তো পাই নি। প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে দিয়েছে। তাছাড়াও আমরা কৃত্রিম উপায়ে বানিয়ে নিয়েছি। আজ আমরা আমাদের দেহের যন্ত্রগুলোও খারাপ হলে কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে প্রতিস্থাপন করছি। যারা সভ্যতায় এতদূর এগিয়ে এসেছে তারা কিনা সামান্য খাবারের জন্যে সেই আদিম যুগের বুনো পদ্ধতি অনুসরণ করবে? ভাবা যায়? কথা বন্ধ করলেন তিনি। এবার একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সবাই তো অবাক। বাবা ডাঃ গৌতম সকলের জন্যে এত এলাহি খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছে? মন্ত্রী, সান্ত্রী, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, গায়ক, অভিনেতা কে নেই সেখানে? সবাই তো খুব খুশি। এ তো দারুন এক মহাভোজ। পেট একেবারে ফেটে গেল যেন। কিন্তু বোঝা গেল না এই সাংবাদিক সম্মেলনের উদ্দেশ্য। নিছক একটা পার্টি দেওয়া নাকি কোনও আবিস্কারের গল্প শোনানো তা তো জানা গেল না এখনও। রান্না দারুন হয়েছে। সকলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা একেবারে। চিকেন কারি, মাটন বিরিয়ানি, ভেজিটেবল ফ্রায়েড রাইস, পনির, শুক্তো আরও কত কত কি

খাওয়ার পরে সব হাতমুখ ধুয়ে বসল এসে। একটা বিরাট সামিয়ানা বাঁধা হয়েছে অন্ততঃ শ’দুয়েক লোকের জন্যে। সবাই মশলা চিবুতে চিবুতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে ডাঃ গৌতমের মুখের বাণী শোনার জন্যে।

- আপনারা যা খেলেন, গৌতমবাবু শুরু করেছেন ততক্ষনে, চিকেন, মাটন, পনির, পায়েস, ফ্রায়েড রাইস এসব-

একটু থামলেন তিনি। সমাগত সাংবাদিকদের মুখগুলোর দিকে তাকালেন।
- এসব কিছুই আসল নয়।

সভায় যেন বাজ পড়ল। একটা প্রবল গুঞ্জন। এ সব কি বলছেন ভদ্রলোক? পাগল হয়ে গেল না তো আবিস্কারের ধাক্কায়?

- চিকেন খেলেন বটে – তবে সেটা মুরগী কেটে তার মাংস নয়। মাটন খেলেও সেটা ছাগল কেটে তার মাংস নয়। সব কৃত্রিম – অর্থাৎ প্রাণিহত্যা নয়। এমন কি চাল ডাল আনাজ ফল কিছুই চাষের বা গাছের নয়। আমাদের এই বাংলার শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী বলেছেন গাছেরও প্রাণ আছে। তাই এগুলো খাওয়া মানেও তো সেই প্রাণিহত্যা। এবার সব গুঞ্জন থেমে গেল। পিন পতনের নিস্তব্ধতা।

- আমি দেখেছি, শুরু করলেন ডাঃ গৌতম, মাছ-মাংস, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট আর ফ্যাট আর অন্যান্য কিছু পদার্থ দিয়ে তৈরি। তবে এই উপাদানগুলির সঙ্গে অন্যান্য খনিজ পদার্থ, ধাতু, এসিড, ক্ষার, লবন ইত্যাদি বিভিন্ন খাদ্যে বিভিন্ন অনুপাতে থাকে। যেমন ধরা যাক চিকেন, মাটন বা অন্যান্য সব খাদ্যে উপাদানগুলির অনুপাতের বিভিন্নতা থাকার জন্যে স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ইত্যাদি আলাদা আলাদা হয়।  

সবাই যেন কোনও রোমহর্ষক গল্প শুনছে। চোখের পাতা পড়ছে না।

- চিকেন খাবেন, মাটন খাবেন – তবে মুরগী বা পাঁঠা জবাই করে নয়। ভাত ডাল পায়েস, ডানলা সব খাবেন তবে উদ্ভিদ হত্যা করে নয়। সব নকল মানে কৃত্রিম। আমার রসায়নাগারে তৈরি করা। আমার মন্ত্র- আর হিংসা নয়। মানুষ তুমি সত্যিকারের মানুষ হও। সভার মধ্যে এবার বিরাট চিৎকার। মানে ডাঃ গৌতমের জয়ধ্বনি। ডাঃ গৌতম সেই মানুষ যে মানুষকে সহিংস থেকে সত্যি সত্যি অহিংস করে তুললেন। এতদিনে মানুষ সত্যি সত্যি নিজেকে সভ্য বলে পরিচিত করতে পারবে। জয় ডাঃ গৌতমের জয়। জয় অত্যাধুনিক মানবসভ্যতার জয়।


[অরুণ চট্টোপাধ্যায়]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.