একটা মেয়ে ছিল,
তার নাম রূপী। বয়স খুব বেশীও না খুব কম না, এই ধর তোমার মতন। রূপীর চেহারা ছোট্টখাট্ট, রোগাসোগা,
রাস্তায় বেরোলে লোকে তাকে 'বাবু'
বলে ডাকত যদিও বয়স তার নিদেন খুব কমও নয়।
রূপীর বাপের হয়েছিল অসুখ। রোজ রাতে, সেই কোন ছোটবেলা থেকে রূপীকে ওর বাবা গল্প
শোনায়। ছেলেবেলায়, যখন রূপীর বাবার বয়স কম ছিল,
তখন একদল বাউণ্ডুলে মিলে এক আশ্চর্য প্ল্যান
করেছিল তারা। একটা বিশাল বড় করাত আর অনেকগুলো মই নিয়ে মাঝরাতে যখন সবাই ঘুমায় আর
বাড়ির ছাদগুলো শিশিরে ভিজে মিইয়ে আসে তখন সবার বাড়ির ছাদ গুলো এক এক কোপে নামিয়ে
দেওয়ার আশ্চর্য প্ল্যান। যাতে সমস্ত শিশুদের খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জ্যোৎস্না
মাখার ইচ্ছে পূরণ হয়। কিন্তু যথারীতি সেসব কিছুই হয়নি,
অতবড় করাতই পাওয়া যায়নি, তাছাড়া মইয়ে চড়লে অনেকের আবার মাথা ঘোরে। আর
অত গুলো ছাদ ফেলাই বা হত কোথায়? রূপীর মত এত বুদ্ধি রূপীর বাপের ছিল না- রূপীর বাপ সেকথা নিজেই বলে।
এই একই গল্প প্রতিদিন রূপী চোখ গোলগোল করে
শুনত। এখন তোমরা বলতে পারো, ধ্যাত, নিশ্চয়ই গল্প পালটে যেত প্রতিদিন,
একই গল্প বলা যায় নাকি? গল্প তো মানুষের মত দিনকে দিন পালটায়, বড় হয়,
বুড়ো হয় নতুন নতুন বন্ধু বানায়। তা তোমরা ঠিকই বলেছ,
গল্পটা মানুষেরই মত ছিল, পাল্টে পাল্টে গিয়েও একই থাকত।
কিন্তু রুপীর বাবার অসুখ, সেই থেকে তার গলার আওয়াজ দিনকে দিন হালকা হয়ে
উঠছে। লোকে বলে একদিন, যেদিন আর ফিসফিসে আওয়াজও বেরোবে না সেদিন কীসব জানি হবে।
রূপী বিশেষ কান দেয় না।
ওর একটা পুরনো বাড়ি ছিল। সেখানে একটা অন্ধকার
বারান্দা ছিল আর ছিল দুইখানা ঘর -বড় আর ছোট। সে বাড়ির দেওয়ালগুলো ছিল খুব মোটা আর খুব পুরনো।
দেওয়ালগুলোর ভেতরে আরশুলা টিকটিকিদের সঙ্গে থাকতছোট ছোট মজাদার সব মানুষ আর
পশুপাখিরা। মাঝে মধ্যে তারা দেওয়াল ফুঁড়ে মুখ বের করে রূপীদের দেখত মুখ ভ্যাঙ্গাত।
দেওয়ালের চুন সুরকি খসে পড়ত আর তাদের মুখের ছাপ রয়ে যেত। রাত হলেই তারা নিজের
রান্নাবান্না কাজকর্ম শুরু করত। রূপী চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পেত- সরসর খুটখুট টুংটাং। বাথরুমের সামনে ছিল
একচিলতে উঠোন। এখনো রূপী মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙ্গে ভাবে চোখ খুললেই দেখবে সামনের জানলা
দিয়ে হালকা হলদে রোদ তার পায়ের উপর পড়ে আছে আর উঠোনে কেউ একটা পিঁড়ি পেতে একগামলা
জল নিয়ে বাসন ধুচ্ছে। তখন রূপীর আর চোখ খুলতেই ইচ্ছে করে না।
এই নতুন যে বাড়িটায় ওরা আছে সেখানে ওর মনোমত
কত কী! নিজের একটা ঘর আছে,
সামনে বাগানে লেবু গাছ, বাথরুমে ঝাঁঝরিকল,
যা যা ওর ইচ্ছে ছিল সব। তবে মাটিতে খোঁদল নেই, গা থেকে ঝুলে পড়া গাছ নেই, কড়িবরগায় লুকানো চড়ুইয়ের বাসা নেই, বাথরুমে টিনের ছাদ নেই যে চান করতে করতে টের
পাওয়া যাবে মাথার উপরে কাকগুলো কী করছে। গেল বর্ষায় ওদের বাড়িটা ভেঙ্গে পড়েছিল।
এখন সুখের দিন শেষ। রুপীকে কাজে যেতে হয়
সকালবেলা শাড়ি পরে। অনেকদিনকার বন্ধুরা সব শহর ছেড়ে চলে গেছে কিংবা রূপীকে ছেড়ে।
রাস্তায় দেখা হলে কেউকেউ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রূপীও নেয়।
রূপী তো দুঃখী মেয়ে সেকথা ও নিজেও জানে
কিন্তু যথেষ্ট দুঃখ কেন যে ওর হয় না! নাকি ও টের পায় না?
ভয় লাগে। কথায় বলে 'দুঃখে মানুষ পাথর হয়ে যায়'। ওরও সেরকম হচ্ছে নাকি? আর যাই হোক বাবা ও পাথর হতে চায় না! ভারী,
গুরুগম্ভীর,
শক্ত-
পাথর খুব বিতিকিচ্ছিরি জিনিস। রূপী যদি বা
পাথর হয়ও ও নিশ্চয়ই ওরকম হবে না। ও হবে ঝর্ণাতলার গোল রঙ্গিন পাথর। দুঃখে রূপী
সুন্দর গোল রঙ্গিন পাথর হয়ে যাবে, সবাই হাসবে। খুব বুড়িরা সাজলে যেমন লোকে হাসে তেমনই, দুঃখের সাথে রঙ একেবারে বেমানান কিনা।
রূপী তাই সব বলে। কিছুই বলে না।
ও সব শোনে। কিছুই শোনে না।
ওর গায়ে রোদ বৃষ্টির গন্ধ ও জমিয়ে রাখে, সাবান মাখা বন্ধ করে দেয়।
মাঝেমধ্যে বিকেলবেলা মামুলি বোতলের থেকে
ম্যাজিক তরল গলায় ঢালে ও। তারপর সবাই ওর কথা মতন নাচে সবাই ওর কথা মন দিয়ে শোনে
ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। দুই হাত নাড়িয়ে সবাইকে গান গাইতে বলে ও। আর বাড়িতে ঢুকে
বলে 'মদ তো বোকা চোয়াড়ে ছেলেপুলেরা খায়। ঠিকঠাক
শব্দ ব্যবহার করতে পার না? এরপর কোনদিন শুনব তোমার বকুলফুলকে ডেকে বলছ মাগী।'
এইভাবে দিন যায়।
একদিন শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিল রূপী।
ভেবেছিলাম এমনভাবে বলব যে কেউ টেরই পাবে না এই গল্পে এটা একটা স্বপ্ন দৃশ্য। একদম
শেষ লাইনে গিয়ে বলব -এই যে এতক্ষণ ধরে যা শুনলে তা আসলে স্বপ্ন সত্যি নয় মোটেই।
তখন তোমরা সবাই অবাক হবে। কিন্তু তোমরা যা সেয়ানা সে তো আমি জানি। সব জেনে বুঝে
বসে আছো তাই অবাকই হও না আর কিছুতেই।
যাক গে রূপী দেখছে ওর পুরনো বাড়ির উঠোনে একটা
মস্ত ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আর একজন লোক ওকে উপরে আসতে ইশারা করছে। একটা একটা করে
সিঁড়ি ভেঙ্গে ও ওঠে। দেখে এক বিশাল মন্দির। এত উঁচু এত বড় যে একবার ঢুকলে নিজেকে
ছাড়া আর কাউকে ঠাহর করাই যাবে না। ঠাণ্ডা শ্যাওলা ধরা দালানের ওপর বাবু হয়ে বসে
পড়ে ও। পেছনে রংবেরঙের ঘষা কাঁচের জানলা। লোকটা ওকে বলে-
এসেই যখন পড়েছ তখন একটা গল্প শোনো। হুহাফা আর
লুফাফা ছিল বর আর বউ। হুহাফা কাঠ কাটত যেমন সব গরীব মানুষেরাই কাটে। আর লুফাফা সেই
কাঠ দিয়ে প্রতি রাতে আগুণ জ্বালত। তৈরি হত গরম জাউ,
ওম হত তাদের শরীর। তারপর একদিন হুহাফার পায়ে
ফুটল অশোক গাছের কাঁটা। কাঁটায় বড় বিষ। পা ফুলে ঢোল হল। লুফাফা কতই না কাঁদল- চুন দিল,
হলুদ দিল,
দিল নদীর ধারের মাটি।
পা তো সারল কিন্তু হুহাফার চোখে সেই যে সবুজ
রঙ ধরল, তা আর পাল্টাল না। হুহাফা কাঠ কাটতে যাওয়া
বন্ধ করে দিল। তার বদলে প্রতি রাতে ও হানা দিতে শুরু করল ঘুমন্ত মানুষদের ঘরে।
ঘুমিয়ে পড়া মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন তার মাথার খুপরি থেকে স্কাইলাইটের আলোর মত
আলো বের হয়। সেই আলো ধরে হুহাফা ঢুকে পড়ত তাদের মাথার ভেতরে স্বপ্নটার মধ্যে।
তারপর সেখান থেকে চুরি করে আনত এলুমিনিয়ামের বাটি,
বড়বড় রিভলবার বা সোনার বাউটি। সেসব জিনিস
লুফাফা যত্ন করে তুলে রাখত আলমারির ভেতর, কাউকে দেখাত না। স্বপ্নের জিনিস তো আর সকলের
নয়, স্বপ্নের জিনিস তো ওইপারের যেখানে নিয়মরীতি
আলাদা। সেই আশ্চর্য বাটিতে তারা ঢেলে রাখত সময়। আশ্চর্য রিভলভারে ঠোঁট লাগিয়ে বাজাত সুর, যেন বাঁশি।
এমন করতে করতে একদিন হুহাফা একটা বাচ্চা
ছেলেকে চুরি করে আনল। স্বপ্নের দেশের সেই ছেলে না নড়ে না চরে না আছে মুখে রা।
দুজনেরই পেট চলে না, আবার তিন! লুফাফা খুব বকাবকি করল হুহাফাকে। সে রাতেই- হ্যাঁ ঠিক ধরেছ খুবই ঝড়-বাদলের রাত ছিল সেটা-
হুহাফা যেদিকে দুচোখ যায় চলে গেল।
লুফাফা দিন গুনতে লাগল আর ছেলে মানুষ করতে
লাগল। ছেলে বড় হয় কিন্তু কথা কয় না। সারাদিন এই বিরাট মন্দিরের বন্ধ খুপরিতে বসে
থাকে। মাস কাটে, বছর কাটে। লুফাফা রোজ দুইবেলা ছেলেকে খাবার
দিয়ে আসে। আর ভাবে আহারে ছেলেটা আমার বোধহয় ভাবতেও পারে না। কই হাসে না তো, কাঁদে পর্যন্ত না!
গায়ে ঝুল জমে যায়,
পিঁপড়ে ওঠে।
তারপর হঠাৎই একদিন ফিরে আসে বুড়ো থুত্থুরে
হুহাফা। হাঁফাতে হাঁফাতে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে চিৎকার করতে থাকে -সময় হয়ে গেছে,
কেউ ওকে একটা গান শোনাও! অবাক লুফাফার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে
নিয়ে যায় মন্দিরের খুপরিতে। কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছিল। ঘরে তখন আর কেউ নেই,
জানলা খোলা,
একটা পালক পর্যন্ত পড়ে নেই, আছে শুধু পাথরে খোদাই এই মূর্তিটা......
এই অবধি শুনতেই রূপীর মাথা ঘুলিয়ে ওঠে। চোখের
সামনে মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই এক ছুটে ও বাইরে চলে আসে। নিজের স্বপ্নে
কেউ নিজেই আটকা পড়ে নাকি। তারপর বৃষ্টি আর ঝড়। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে
রূপীর মাথা ঘোরে। দুই রেলিং জুরে বসে থাকে ইজের পড়া কালোকোলো বহুকাল আগের হারিয়ে
যাওয়া ছেলেরা। তাদের হাত ধরে একেক লাফে সাত-আট ধাপ সিঁড়ি লাফিয়ে নামে রূপী। যেন তার পেটে
রয়েছে এক সমুদ্র ম্যাজিক তরল। পা টলে মাথা ঘোরে টিনের ছাদের তেলাকুচো লতায় পা
জড়িয়ে যায়। হুমড়ি খেয়ে উঠোনে পরে ও। মাকে ডাকে। তারপর গুটিগুটি পায়ে সারা গায়ে
কাদা মেখে ও ঘুমিয়ে পড়ে।
কাল লুচি খাবে ও। সঙ্গে সাদা আলুর তরকারি আর
একটু ঘি দেওয়া মোহন ভোগ ।
[চুর্ণি
ভৌমিক]