সংশপ্তক: মানুষের
জীবনে উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। “মানুষের
জীবনে উৎসব কবে? মানুষ
যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষ ভাবে স্মরণ করে, বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন”।
বলেছিলন
রবীন্দ্রনাথ ‘উৎসবের দিন’ নামক প্রবন্ধে। আবার তাঁর শান্তিনিকেতন
বক্তৃতামালায় বললেন, “সত্য
যেখানে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব”। আমাদের এই আধুনিক নাগরিক জীবন ও তার
দ্রতগতিতে ছুটে চলা প্রতিদিনের সালতামামির প্রেক্ষাপটে কবির এই উপলব্ধি কতটুকু
প্রাসঙ্গিক আজকে?
কেয়া: রবীন্দ্রনাথ সেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যের
বাইরেও জীবনবোধ ও দর্শনে যিনি আমাদের প্রভাবিত করে চলেন অহরহ। উৎসব নিয়ে তাঁর
বক্তব্যও সুগভীর। তাঁর নানা কথার নির্যাসটুকু হল, আমাদের উৎসব তখনই যথার্থ উৎসব
হয়ে উঠবে, যখন আমার ভেতরের ‘ক্ষুদ্র আমি’-টাকে ভুলে গিয়ে, যাবতীয় সঙ্কীর্ণতাকে
ত্যাগ করে সকলের জন্যে হৃদয় উন্মুক্ত করে দিতে পারব। শুধু নিজের জন্যে, নিজের
আত্মীয়-বন্ধুদের জন্যে নয়, আমাদের বাড়ির দরজাটি যেন অনাত্মীয়দের জন্যেও খুলে রাখতে
পারি। অন্য দিনগুলিতে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একা একা জীবন কাটালেও এইদিনের আনন্দ যেন
সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি। ‘প্রতিদিন
মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী--কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ,
সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ!’ আজকের ব্যস্ত
নাগরিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রসঙ্গে তাঁর কথা সব কথাগুলিই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
এভাবে আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারলে তবেই উৎসবের সার্থকতা।
সংশপ্তক: উৎসবের
আরেকটা অর্থ তো মিলন। মানুষের সাথে মানুষের। বর্তমানের এই নিরন্তর প্রতিযোগিতামূলক
জীবনযুদ্ধের আত্মস্বার্থ সর্বস্ব যুগধর্মে সেই মিলনের উৎসব কতটুকু সার্থক হয় বলে
মনে করেন আপনি?
কেয়া: যাবতীয় বিভিন্নতা, সঙ্কীর্ণতা সরিয়ে রেখে
মানুষের কাছাকাছি আসা, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন- তাই হল উৎসব। আজকের
প্রতিযোগিতাসর্বস্ব, আত্মকেন্দ্রিক জীবনে উৎসবের গুরুত্ব আরও বেশি। বিভিন্নতা ভুলে
মিলনের সাধনা। অন্তত কয়েকটা দিনের জন্যেও বিভেদের বদলে মিলনের শিক্ষা দেয় উৎসব।
সেখানেই এর সার্থকতা।
সংশপ্তক: প্রত্যেকের
জীবনের পরিধিতেই উৎসবের সেকাল ও একালের মধ্যে একটা বিবর্তনের রূপরেখা দেখা দেয়।
আপনার জীবনের পরিধিতে সেই বিবর্তনের সম্বন্ধে যদি একটু বিস্তৃত ভাবে আলোকপাত করেন ।
কেয়া: জীবন বহমান। সভ্যতা, সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখাতে
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আসবেই। তাই যেকোন উৎসবের সনাতন বা সেকালের রূপটির
সঙ্গে একালের নব্য রূপটির পার্থক্য হবে বলাই বাহুল্য। না হওয়াটাই আশ্চর্যের।
শারদোৎসব সমাগত। বাঙলার সবচেয়ে বড় উৎসব, প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। যদি এই উৎসবটিকে
নিয়েই কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বদল ঘটেছে উৎসবের
চালচিত্রে। আগে কলকাতার পুজোগুলো সেটা সর্ব অর্থেই ছিল সর্বজনীন। স্থানীয়
মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, আড্ডা, আলোচনা,
গল্পগুজব হত। পাড়ার সব পরিবারের পাঁচদিন একটাই উঠোন, পুজোপ্রাঙ্গন।
এখনও পাড়াকেন্দ্রিক পুজোই বেশি। দিনে দিনে উৎসব ব্যাপারটি যেন সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে।
সর্বজনীন অর্থ সকলের হিতের জন্য বা মঙ্গলের জন্য। আমাদের কলকাতার বাড়ি থেকে একটু
দূরেই বাগবাজার সর্বজনীনের উৎসব প্রাঙ্গন। কি আশ্চর্য সুন্দর এক পুজো। পাড়ার
গর্বেরও। বেশ অনেক বছর প্রবাসে আমি। এর মধ্যে যখনই ফিরেছি পুজোতে, ছোটবেলার সেই
‘প্রায় বাড়ির পুজো’ ব্যাপারটা সেভাবে খুঁজে পাইনি আর। এখনো এই পুজো ঐতিহ্যের হাত
ধরে চলে। কিন্তু যেসব দাদু, জেঠু, কাকুরা গভীর ভালোবাসায় আর আন্তরিকতায় পুজোর কদিন
পুজোর মাঠটাকেই বাড়ি করে তুলে দিন-রাত আয়োজনে ব্যস্ত থাকতেন, তাঁরা আর নেই। নতুন
প্রজন্মের হাতে ব্যাটন চলে গেছে। আন্তরিকতার বদলে এখন প্রতিযোগিতাই মুখ্য। সব
পুজোরই বিনয়াবনত মঙ্গলসাধন ব্যাপারটি ক্রমশ আড়ম্বর দেখানোর প্রতিযোগিতা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। পুজোটা যেন একটা দ্রষ্টব্য বা একজিবিশন। সবাই লাইন দিয়ে সেই একজিবিশনে
ঢুকছেন। ঘোষণা হচ্ছে ‘দেখে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যান’। মানুষ সারি দিয়ে দেখে
বেরিয়ে যাচ্ছেন। এখানে মনের টান কোথায়? পুজোকে ঘিরে কত প্রতিযোগিতা,
অজস্র পুরস্কার! ঘরোয়া ইমেজ ছেড়ে ‘থিম পুজোর’
বাৎসরিক উৎসব, যার প্রস্তুতি শুরু কয়েক মাস আগে থেকেই। বদলে গেছি আমরাও। আজও দেখি,
সারা বছরের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ ভিড় করে দোকানে-দোকানে। খোঁজে উৎসবের
নতুন সাজ। কিন্তু মধ্যবিত্তের পছন্দের দোকান এখন সব ঠান্ডা শপিং মলগুলোতে। দক্ষিণে
গড়িয়াহাট কি উত্তরে হাতিবাগানের মত জায়গায় ঘুরে ঘুরে পুজোর বাজার ক্রমশ মধ্যবিত্তের
লিস্ট থেকে মুছে যাচ্ছে। বাড়ির সাবেক খাওয়া বাদই দিলাম। পুরনো রেস্তোরাঁর বদলে
পছন্দের তালিকায় এখন জায়গা করে নিয়েছে নতুন রেস্তোরাঁ আর তাঁদের পুজো-স্পেশ্যাল
অফার। হারিয়ে যাচ্ছে পাড়ার জলসা, নাটকের ঐতিহ্য। আসলে একটা ছোট গণ্ডিতে আটকে পড়ছি
আমরা। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “এখন
আমাদের হৃদয় সংকুচিত, আমাদের
দ্বার রুদ্ধ। এখন কেবল বন্ধুবান্ধব এবং ধনী-মানী ছাড়া মঙ্গলকর্মের দিনে আমাদের ঘরে
আর কাহারও স্থান হয় না। আজ আমরা মানবসাধারণকে দূর করিয়া নিজেকে বিচ্ছিন্ন-ক্ষুদ্র
করিয়া, ঈশ্বরের বাধাহীন পবিত্রপ্রকাশ হইতে বঞ্চিত করিয়া বড়ো
হইলাম বলিয়া কল্পনা করি”।
শুধু একটা মাত্র ব্যাপার এত
পরিবর্তনের মধ্যে ভালো লাগে। আজকাল প্রতিটি পুজো কমিটি পরিবেশ সুন্দর, স্বাস্থ্যকর
রাখায় নজর দেন। কয়েকটা দিনের জন্যে হলেও।
সংশপ্তক: প্রসঙ্গত
মনে হয় উৎসবের সেকালে আড়ম্বর কম থাকলেও প্রাণের স্পর্শ প্রচুর ছিল। কিন্তু উৎসবের
একালে আড়ম্বরের আতিশয্যে প্রাণের ভৈববে যেন টান পড়েছে অনেকটাই। নাকি এক একটি যুগে
উৎসবের প্রকরণ ও দিগন্ত সময়ের সাথে সাথে নিয়ত পরিবর্তনশীল হয়ে ওঠাটিই স্বাভাবিক
বলে মনে করেন আপনি?
কেয়া: ঠিক, সেই কথাটাই আগের প্রশ্নের উত্তরে এল।
আগেকার সেই আন্তরিকতা, প্রাণের স্পর্শ আজকাল আড়ম্বরের আতিশয্যে যেন ঢাকা পড়ে গেছে।
প্রবহমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনে যেমন, উৎসবের আঙ্গিকেও তেমনি পরিবর্তন আসবেই।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখনকার পুজো বা উৎসবের আনন্দ ক্রমশ সমষ্টি থেকে সরে এসে
ছোট্ট পরিবারের গণ্ডিতে আটকে গেছে। অথচ, উৎসব মানে মিলন। বহু মানুষের মিলন। উৎসব
কখনো একলার নয়। এইজন্যেই মনে হয় প্রাণের বৈভবে যেন টান পড়েছে!
সংশপ্তক: উৎসবের
এই যে দুইটি দিক আয়োজন ও উপলব্ধি, যেখানে
আয়োজনের সাথে আড়ম্বরের সংযোগ আর উপলব্ধির সাথে তৃপ্তির সংযোগ; সেখানে আপনার কাছে কোন দিকটি বেশী মূল্যবান?
কেয়া: আয়োজনের আড়ম্বর থাক বা না-থাক, শেষ অবধি সে
আয়োজন তৃপ্তির উপলব্ধি দিল কিনা সেটাই বড় কথা। আমার কাছে অন্তরের উপলব্ধিটুকুই
বেশি মূল্যবান।
সংশপ্তক: সাধারণ
ভাবে এই যে সমষ্টির সাথে মিলনের আনন্দেই উৎসবের মূল সার্থকতা, আজকের যুগে আমাদের ব্যক্তিজীবনের ও পারিবারিক
জীবনের পরিসরে সেই সার্থকতা পূরণের শর্ত্তগুলি কি কি বলে আপনার মনে হয়?
কেয়া: উৎসব
আনন্দ প্রকাশ ও লাভের মাধ্যম। উৎসব পরিবারকেন্দ্রিক হতে পারে,
আবার ব্যাপকভাবে সমাজকেন্দ্রিকও হতে পারে।
সমষ্টির সাথে মিলনের আনন্দেই বোধহয় উৎসবের মূল সার্থকতার সুরটি ধরা আছে।
প্রতিদিনের যে একক যাপন বা ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে ওঠাবসার
নিত্যনৈমিত্তিকতা- তার থেকে মুক্তি পেতেই তো উৎসব। পরিবারের মধ্যে উৎসব হল আংশিক,
আর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশী – সকলকে মিলিয়ে নিয়ে যে উৎসব তা হল
সামগ্রিক। সামগ্রিক উৎসবই হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে। মনের ব্যাপারে শর্ত খাটে না। তবু বলতে গেলে এই সামগ্রিকতাকেই আমার সার্থক উৎসবের ভিত্তি
বলে মনে হয়।
সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে দেখা যায় মানুষের সমাজ সভ্যতায়
এক একটি গোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত প্রকাশের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে এক একটি
উৎসব! সেই অর্থে তো অধিকাংশ উৎসবই সাম্প্রদায়িক? অর্থাৎ
সেই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ফলে একজনের উৎসব আরেকজনের
আনন্দে সামিল হতে পারে না। ফলে সেইক্ষেত্রে উৎসবগুলি কি বিশ্ব মানবতার মিলনের
পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায় না কার্যত? এই
বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই বিশদে।
কেয়া: আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির মূল মন্ত্রটি কিন্ত
সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, ধর্ম নির্বিশেষে সকল্কে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ উৎসবে সামিল হওয়া।
সেটি করতে পারলেই তা আর মানবতার পরিপন্থী থাকে না। রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন। তাঁর
বিজয়া সম্মিলনের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়ঃ
“হে
বন্ধুগণ,
আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের
সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল
পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর
পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে
ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে
এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত
দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের
দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো। আজ সায়াহ্নে
গঙ্গার শাখা-প্রশাখা বাহিয়া ব্রহ্মপুত্রের কুল-উপকুল দিয়া একবার বাংলাদেশের পূর্বে
পশ্চিমে আপন অন্তরের আলিঙ্গন বিস্তার করিয়া দাও, আজ
বাংলাদেশের সমস্ত ছায়াতরুনিবিড় গ্রামগুলির উপরে এতক্ষণে যে শারদ আকাশে একাদশীর
চন্দ্রমা জ্যোৎস্নাধারা অজস্র ঢালিয়া দিয়াছে সেই নিস্তব্ধ শুচি রুচির সন্ধ্যাকাশে
তোমাদের সম্মিলিত হৃদয়ের "বন্দেমাতরম্' গীতধ্বনি এক
প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্তে পরিব্যপ্ত হইয়া যাক-...”
আমাদের
পথ দেখিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। সেই পথে চলতে হবে। একের উৎসবে, আনন্দে অন্যকে সাদরে
বরণ করে নিতে হবে। তাহলেই সার্থক হবে বিশ্বজনীন মিলন উৎসব।
সংশপ্তক: সব
ধর্মীয় উৎসবই সামাজিক। কিন্তু সব সামাজিক উৎসবই হয়তো ধর্মীয় নয়। একবিংশ শতকের
প্রথম ভাগে দাঁড়িয়ে আপনার কি মনে হয় না, আমাদের
ধর্মীয় উৎসবগুলিকে তুলনামূলক ভাবে কম গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক উৎসবগুলিকেই বেশি করে
গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ?
কেয়া: আমাদের সামাজিক উৎসবের সংখ্যাও বড় কম নয়। এখন
দুই বাংলায় বিকশিত হচ্ছে একটি উৎসব যার সঙ্গে ধর্মের
কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলা নববর্ষ। বাংলা বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় দেশ-বিদেশ থেকে আসেন মানুষ। বইয়ের উৎসব বা বইমেলার
মত সাহিত্য-উৎসব আর কটা হয়? এগুলির গুরুত্ব আছেই। তবে এখনো বাংলায় শরৎকালের
উৎসবটির গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। কাউকে বাদ
না দিয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মীয় উৎসব করতে পারলে সেটিও বাস্তবিকই সামাজিক উৎসব
হয়ে উঠবে। আর সামাজিক উৎসবগুলিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিলে আমাদের পারস্পরিক বিভেদ
হয়তো একটু কমবে।
সংশপ্তক: বিশেষ
করে কাঁটাতার ঘেরা আমাদের খণ্ড বিখণ্ড এই দুই বাংলার সাম্প্রদায়িক বিভেদজনিত
সামাজিক বিন্যাসে, ধর্মীয়
উৎসবগুলির আড়ম্বরের আতিশয্য পারস্পরিক সংহতি ও সম্প্রীতির পক্ষে অন্যতম এক অন্তরায়
বলেই তো মনে হয়। এই বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই একটু বিস্তৃত ভাবেই।
কেয়া: কাঁটাতার সীমানা চিহ্নিত করে দিয়েছিল। এ-পার
থেকে ও-পার বা উল্টোটা- সেভাবে অজানা, অচেনা, অদেখা ভূখণ্ডে পাড়ি দিয়েছে মানুষ।
তবে কাঁটাতার তো শুধু ভূখণ্ডকে আলাদা করে। অন্তরাত্মাকে আলাদা করতে পারে কি?
শুনেছি বাংলাদেশে পুজোর আনন্দ শেষ না হতেই ঈদের আনন্দ এসে পড়ে। দুটিতেই তারা মাতোয়ারা। শারদীয় দুর্গাপূজা এবং ঈদুল আজহা বাংলাদেশের
অর্থনীতিতে দুটিরই ব্যাপক প্রভাব আছে। বাংলাদেশে যে মুহররম পালিত হয় তাতে বিভিন্ন
সময়ে সেখানকার হিন্দু ও লোকায়ত আচার যুক্ত হয়েছে। সেখানে মুহররমে শুধু মুসলমানরাই নয়,
এক সময় হিন্দুরাও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতেন।
একসময়, যখন ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের ওপর ততটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি এবং হিন্দু
ও মুসলমানের পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠেনি,
তখন বাংলার গ্রামাঞ্চলে দুর্গাপূজায় যোগ
দিতেন আপামর পল্লীবাসী। তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ বর্তমানের মতো প্রখর না থাকায় তাতে
উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন সবাই। এ উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া এবং থিয়েটারসহ নানা
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত এবং সকলে আপনবোধে, মনের টানে সেসব উপভোগ করতেন। ওইসব দিনে গ্রামীণ সমাজের একঘেয়ে জীবনযাপনে আসত বৈচিত্র্য। বাংলাদেশের,
বিশেষ করে ঢাকাবাসীরা একসময়ে আকুল আগ্রহে
অপেক্ষা করতেন জন্মাষ্টমীর মিছিলের জন্য। হিন্দু-মুসলমান সকলেই অংশ নিতেন।
পাকিস্তান আমলে সরকারি আদেশে এইধরণের পারস্পরিক সৌহার্দ্যের অনেক উৎসব বন্ধ হয়ে
যায়। পরে আবারো শুরু হয় নানা ধর্মীয় উৎসব পালন। তবে এক সময় যেমন সব সম্প্রদায়ের
মানুষই যোগ দিতেন, এখনও দিলেও আগের মতো নয়। ধর্মীয়
আড়ম্বরের আতিশয্য পারস্পরিক সংহতি ও সম্প্রীতির পক্ষে অন্যতম বাধা আর সেগুলি বাদ
দিলেই সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হবে নচেৎ নয়, এমনটা আমার মনে হয় না। পরমতসহিষ্ণুতা
জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ভালোবাসা ও পারস্পরিক সহমর্মিতাই বিভেদ দূর
করতে পারে। ফাঁক যদি কোথাও থাকে- তা সেখানেই আছে। ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যের সেই
ফাঁকটুকু ভরিয়ে নিতে পারলেই ধর্মীয় আচার-আচরণ আর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
সংশপ্তক: উৎসব
ধর্মীয়ই হোক আর সামাজিক, উৎসবের
আঙ্গিক কিন্তু বস্তুত আঞ্চলিক। অর্থাৎ ভৌগলিক অঞ্চল ভেদে উৎসবের আড়ম্বর ও প্রকরণ
ভিন্ন ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। যার ফলে প্রতিটি উৎসবের অন্তরেই একটি আঞ্চলিক ঐতিহ্য ও
উত্তরাধিকার বহমান থাকে। কিন্তু বর্তমানের বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদ সেই আঞ্চলিক
সংস্কৃতির উপর যে প্রভাব ফেলছে, তাতে
উৎসবের আঞ্চলিক ঐতিহ্যগুলি কি বিলুপ্তির পথেই অগ্রসর হবে ক্রমশ? কি মনে হয় আপনার?
কেয়া: আসলে পুজো হোক কিংবা পুজোকে ঘিরে কোনও উৎসব, এর
কোনটাই বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। একেক ধর্মের, একেক গোষ্ঠীর পুজো একেক রকম। কোথাও
কেউ গাছ পুজো করে, কেউ
আবার পাথর। এভাবে ভাবতে পারি যে আসলে পুজো বা ধর্মীয় উৎসব একটা অছিলা।
আমরা
যে সাধারণ, আমাদের
থেকেও বড় কিছু আছে, মানুষ
এই অনুভূতির মাধ্যমে তা প্রমাণ করে। তাই গুহার মধ্যে শিলা হয়ে যায় দেবতা। আর
সামাজিক উৎসবের মূল সুরটি ধরা আছে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনে। ভৌগোলিক অঞ্চল
ভেদে সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসবের আঙ্গিকের প্রকার প্রকরণ আলাদা হয় অনেকসময়। কিন্তু
অঞ্চলগুলি বহু বছর ধরেই সেই বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছে। আঞ্চলিক ঐতিহ্যের
উত্তরাধিকারের প্রবহমান ধারায় ভাঁটা পড়েছে- এমন শুনিনি। উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গায়
মা দুর্গাকে বরণের লোকাচার আলাদা। তাঁরা বুনো ফুল দিয়ে বরণ করেন, মা-র আবাহন করেন।
উত্তর আর দক্ষিণবঙ্গের অনেক জায়গায় ঢাকের বোলের সঙ্গে মিলেমিশে বাজে ধামসা-মাদল।
দশেরা বা রাবণ বধ মূলত উত্তরভারতে পালিত হলেও আমাদের বাংলার মেদিনীপুর আর
পুরুলিয়ার কিছু অঞ্চলে দশমীর দিন রাবণ পোড়ানো হয় উৎসবের মত করে আর আঞ্চলিকতা
নির্বিশেষে তাতে অংশ নেন সব মানুষ। এগুলি কিন্তু বহু বছর ধরে চলে আসা প্রথা। কেউ
কোথাও বাধা দেননি, বাধা পাননি, যতটুকু জানি। আবারও রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলতে
হয়, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে’- এটিই আমাদের ঐতিহ্যের সনাতন সুর।
সব গ্রহণ করে আরও সমৃদ্ধ হবারই সম্ভাবনা। উৎসবের আঞ্চলিক ঐতিহ্যগুলি অবলুপ্ত হয়ে
যাবে- এমন মনে হয় না।
সংশপ্তক: উৎসব
ধর্মীয়ই হোক আর সামাজিক; উৎসব
যখনই হোক আর যেখানেই হোক, বস্তুতু
সব উৎসবের সাথেই প্রকৃতির একটা অন্তর্লীন যোগ থাকেই। এইটি আপনাকে কতটা আলোড়িত করে?
কেয়া: উৎসব আর প্রকৃতির অচ্ছেদ্য বন্ধন। শরত্কালের
প্রকৃতিই আমাদের বলে দেয় শারদোৎসব আসছে। শরৎ এলেই ধূসর, গোমড়া মুখটা পাল্টে গিয়ে কি রকম ঝকঝকে নীল
হয়ে ওঠে আকাশ।
সেই
নীল-জুড়ে ভিড় করে তুলোর মতো
সাদা মেঘেরা। রোদ্দুরটাও কেমন যেন মায়ামাখা, সোনা-রঙা। প্রকৃতিই বলে দেয়, পুজোর ছুটি এল কাছে!
এই দূর প্রবাসেও আকাশটা ঝকঝকে নীল। মায়াবী উজ্জ্বল রোদ। বুঝতে পারি, শরৎ এসেছে।
‘তোমার ছুটির খেয়া বেয়ে
শরৎ এল মাঝি।
শিউলি-কানন সাজায় তোমার
শুভ্র ছুটির সাজি।’
এভাবেই শুধু শরৎ আর দুর্গাপুজো নয়, বর্ষায় রথযাত্রা, শীতে পৌষমেলা, সব যেন প্রকৃতির হাত ধরে আসে আর মন ভরিয়ে দেয়। উৎসবের সঙ্গে প্রকৃতির এই নিবিড় যোগ আমাকে মুগ্ধ করে।
শরৎ এল মাঝি।
শিউলি-কানন সাজায় তোমার
শুভ্র ছুটির সাজি।’
এভাবেই শুধু শরৎ আর দুর্গাপুজো নয়, বর্ষায় রথযাত্রা, শীতে পৌষমেলা, সব যেন প্রকৃতির হাত ধরে আসে আর মন ভরিয়ে দেয়। উৎসবের সঙ্গে প্রকৃতির এই নিবিড় যোগ আমাকে মুগ্ধ করে।
সংশপ্তক: উৎসবের
এই মূহুর্ত্তে উৎসব নিয়ে এই একান্ত আলাপচারিতায় আপনাকে সংশপ্তকের পক্ষ থেকে
আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবশেষে জানতে চাইব, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে উৎসবের বিবর্তন আবিশ্ব
মানুষকে সপ্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধনে এক
করতে পারবে বলে কতটা আশাবাদী আপনি?
কেয়া:
উৎসবের সেই ক্ষমতা অবশ্যই আছে। আর ভুবণীকরণের এর দুনিয়ায় আ-বিশ্ব মানুষ, আমরা অনেক
কাছাকাছি আজ। কিন্তু আজকের পৃথিবী-জোড়া বিভিন্নতা, দ্বন্দ্ব, দ্বেষ, একই আকাশের
তলায় থেকেও এক টুকরো বাসস্থানের জন্যে মানুষের হাহাকার, নিরাপদে আশ্রয়ের জন্যে
জীবন-পণ করে এদেশ-ওদেশ হাতড়ে ফেরা- এসব দেখতে দেখতে আশার চেয়ে আশঙ্কা হয় অনেক
বেশি! তবে স্বপ্ন দেখা যায় নিশ্চয়ই। এমন একদিন আসবে যখন উৎসবই পারবে আবিশ্ব
মানুষকে সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের বন্ধনে বেঁধে দিতে।
সংশপ্তক-কে
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
[কেয়া মুখোপাধ্যায়]