>

বিনু মাহবুবা





সংশপ্তক: মানুষের জীবনে উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। “মানুষের জীবনে উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষ ভাবে স্মরণ করে, বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন”। বলেছিলন রবীন্দ্রনাথ ‘উৎসবের দিন’ নামক প্রবন্ধে। আবার তাঁর শান্তিনিকেতন বক্তৃতামালায় বললেন, “সত্য যেখানে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব”।  আমাদের এই আধুনিক নাগরিক জীবন ও তার দ্রতগতিতে ছুটে চলা প্রতিদিনের সালতামামির প্রেক্ষাপটে কবির এই উপলব্ধি কতটুকু প্রাসঙ্গিক আজকে?

বিনু:সত্য যেখানে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব সত্যই তো কোথাও খুঁজে পাইনা ।  এমনকি নিজের ভেতরেও খুঁজে চলেছি কিন্তু দুঃখ এই যে তাকে ছুঁতে পারছিনা ।  চারপাশেই সব মিথ্যে জগতের হাতছানি মহামারীর মতো গ্রাস করে ফেলছে।

সংশপ্তক: উৎসবের আরেকটা অর্থ তো মিলন। মানুষের সাথে মানুষের। বর্তমানের এই নিরন্তর প্রতিযোগিতামূলক জীবনযুদ্ধের আত্মস্বার্থ সর্বস্ব যুগধর্মে সেই মিলনের উৎসব কতটুকু সার্থক হয় বলে মনে করেন আপনি?

বিনু:  সব লোক দেখানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। কেউ কারো কষ্ট বেদনা স্পর্শ করতে চায়ো না পারেওনা। কিসের উৎসব আনন্দ ? ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মখুশীর আনন্দ এখন উতসবে। উৎসব এখন প্রভাবশালীদের ফ্যাশন শো'য়ের মতো। মতো।

সংশপ্তক: প্রত্যেকের জীবনের পরিধিতেই উৎসবের সেকাল ও একালের মধ্যে একটা বিবর্তনের রূপরেখা দেখা দেয়। আপনার জীবনের পরিধিতে সেই বিবর্তনের সম্বন্ধে যদি একটু বিস্তৃত ভাবে আলোকপাত করেন

বিনু:  আমি যে সময় পার করে এসেছে তখন ঈদ মানেই সকালবেলায় ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম মা বড় হাড়িতে গরুর খাঁটি দুধে সেমাই রান্না শেষে পাড়ার সবাই এসে সালাম করছে আর খেয়ে যাচ্ছে। আর এখন যার যার বাড়িতে আমি তুমি সে মোরগ পোলাও, কোর্মা বিরিয়ানী এসব চলছে। আমার ছোটবেলায় মনে আছে ,দূর্গা পুজো এলে ঢোলের শব্দ আর প্রসাদ খেতে চলে যেতাম পূজা মন্ডপে। এখন সেখানেও প্রতিযোগীতা। কোন মন্ডপ কতো সুন্দর কতো খরচে এগিয়ে আছে !

সংশপ্তক: প্রসঙ্গত মনে হয় উৎসবের সেকালে আড়ম্বর কম থাকলেও প্রাণের স্পর্শ প্রচুর ছিল। কিন্তু উৎসবের একালে আড়ম্বরের আতিশয্যে প্রাণের ভৈববে যেন টান পড়েছে অনেকটাই। নাকি এক একটি যুগে উৎসবের প্রকরণ ও দিগন্ত সময়ের সাথে সাথে নিয়ত পরিবর্তনশীল হয়ে ওঠাটিই স্বাভাবিক বলে মনে করেন আপনি?

বিনু:  একদম ঠিক, আগে প্রাচুর্য কম ছিলো কিন্তু আন্তরিকতা প্রব্ল ছিলো। যা এখন কেবলি দেখানো ছল।

সংশপ্তক: উৎসবের এই যে দুইটি দিক আয়োজন ও উপলব্ধি, যেখানে আয়োজনের সাথে আড়ম্বরের সংযোগ আর উপলব্ধির সাথে তৃপ্তির সংযোগ; সেখানে আপনার কাছে কোন দিকটি বেশী মূল্যবান?

বিনু:  উপলব্ধি আর তৃপ্তি খুঁজি । উৎসব মানে আনন্দ আর সে আনন্দের কোনো সীমারেখা টানা থাকবে না , থাকবেনা লোক দেখানো জৌলস । অন্তরের টান সে হোক যতোই অপ্রাচুর্যে ভরা সে টান উপেক্ষা করা যায় না।

সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে এই যে সমষ্টির সাথে মিলনের আনন্দেই উৎসবের মূল সার্থকতা, আজকের যুগে আমাদের ব্যক্তিজীবনের ও পারিবারিক জীবনের পরিসরে সেই সার্থকতা পূরণের শর্ত্তগুলি কি কি বলে আপনার মনে হয়?

বিনু:  প্রথম শর্ত বিশ্বাস। একে অপরের প্রতি। যার এখন খুবই অভাব। পারিবারিক জীবন এখন সিনেমার মতো দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমেই। আয়োজন করে বসতে হয়, কথা বলতে হয়, পেতে চাইতে হয় যা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়, আর সেলফি তোলায় ব্যস্ত তখন সবাই পরিবারের সময়গুলো বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে টুকরো খন্ডে।

সংশপ্তক:  সাধারণ ভাবে দেখা যায় মানুষের সমাজ সভ্যতায় এক একটি গোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত প্রকাশের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে এক একটি উৎসব! সেই অর্থে তো অধিকাংশ উৎসবই সাম্প্রদায়িক? অর্থাৎ সেই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ফলে একজনের উৎসব আরেকজনের আনন্দে সামিল হতে পারে না। ফলে সেইক্ষেত্রে উৎসবগুলি কি বিশ্ব মানবতার মিলনের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায় না কার্যত? এই বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই বিশদে।

বিনু:  একজনের উৎসব আরেকজনের আনন্দে সামিল হতে পারে না। ফলে সেইক্ষেত্রে উৎসবগুলি কি বিশ্ব মানবতার মিলনের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায় না কার্যত? দেখুন কম করে হলেও হাজার হাজার বছর চলে গেছে এর সুরাহা কেউ করতে পারেনি। কোনো ধর্মই করতে পারেনি যেমন আবার সব উৎসবকে সবার জন্য উন্মুক্ত করতেও পারেনি। আগে নিজেকে মুক্ত করতে হবে তারপর সমষ্টিগত মুক্তি।

সংশপ্তক: সব ধর্মীয় উৎসবই সামাজিক। কিন্তু সব সামাজিক উৎসবই হয়তো ধর্মীয় নয়। একবিংশ শতকের প্রথম ভাগে দাঁড়িয়ে আপনার কি মনে হয় না, আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলিকে তুলনামূলক ভাবে কম গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক উৎসবগুলিকেই বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ?

বিনু:  সব ধর্মীয় উৎসবই সামাজিক। আমি তা মনে করি না। কারণ সামাজিক মাধ্যম থেকে ধর্মের উৎপত্তি একথা সত্য কিন্তু সেই ধর্মকে বহন করে চলে কিন্তু এককদৃষ্টি সম্পন্ন কোনো অতি ধার্মিক কিছু মানুষ, তারা হতে পারেন মুসলিম, হতে পারেন হিন্দু, হতে পারেন বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের। ধর্মীয় উৎসবগুলোই বিভক্তি এনেছে বরঞ্চ আমি একথাই বলবো। আর সামাজিক উৎসব আমাদের মিলনের জন্যে এখনো উপযোগী। অবশ্যই একান্ত আমার মত।

সংশপ্তক: বিশেষ করে কাঁটাতার ঘেরা আমাদের খণ্ড বিখণ্ড এই দুই বাংলার সাম্প্রদায়িক বিভেদজনিত সামাজিক বিন্যাসে, ধর্মীয় উৎসবগুলির আড়ম্বরের আতিশয্য পারস্পরিক সংহতি ও সম্প্রীতির পক্ষে অন্যতম এক অন্তরায় বলেই তো মনে হয়। এই বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই একটু বিস্তৃত ভাবেই।

বিনু:  আমি চাই সারা প্ররথিবী আমার হোক, আমি চাই পৃথিবী জুড়ে একটাই দেশ হোক। কাঁটাতারের বেড়া যারা দিয়েছে এসব তাদের সবার্থে করেছে এসবে জনগণের মত অংশগ্রহণ খুব কমই ছিলো। এভাবে অল্প কিছু

সংশপ্তক: উৎসব ধর্মীয়ই হোক আর সামাজিক, উৎসবের আঙ্গিক কিন্তু বস্তুত আঞ্চলিক। অর্থাৎ ভৌগলিক অঞ্চল ভেদে উৎসবের আড়ম্বর ও প্রকরণ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। যার ফলে প্রতিটি উৎসবের অন্তরেই একটি আঞ্চলিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহমান থাকে। কিন্তু বর্তমানের বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদ সেই আঞ্চলিক সংস্কৃতির উপর যে প্রভাব ফেলছে, তাতে উৎসবের আঞ্চলিক ঐতিহ্যগুলি কি বিলুপ্তির পথেই অগ্রসর হবে ক্রমশ? কি মনে হয় আপনার?

বিনু:  ঐতিহ্যগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে । জীবনের উৎসব বিজ্ঞাপনী প্রচারের মতো হয়ে যাচ্ছে, ঢাকা পরে যাচ্ছে আন্তরিকতা প্রভাব পরছে সাজসজ্জার অতিরিক্ত প্রভাব। যে কারণে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ ছাড়া বাঙ্গালীর এখন চলেই না। বাতাসা কেউ খোঁজে না।

সংশপ্তক: উৎসব ধর্মীয়ই হোক আর সামাজিক; উৎসব যখনই হোক আর যেখানেই হোক, বস্তুতু সব উৎসবের সাথেই প্রকৃতির একটা অন্তর্লীন যোগ থাকেই। এইটি আপনাকে কতটা আলোড়িত করে?

বিনু:  দেখুন আমি মনে করি যারা রবীন্দ্রনাথের আসে-পাশে দু'একবার চক্কর কেটেছে তাদের কাছে যে কোনো বাংলার উৎসব শরীরের ভেতরে নরে ওঠে, জানান দেয় আমি এসে গেছি ...

সংশপ্তক: উৎসবের এই মূহুর্ত্তে উৎসব নিয়ে এই একান্ত আলাপচারিতায় আপনাকে সংশপ্তকের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবশেষে জানতে চাইব, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে উৎসবের বিবর্তন আবিশ্ব মানুষকে সপ্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধনে  এক করতে পারবে বলে কতটা আশাবাদী আপনি?

বিনু:   আবিশ্ব পৃথিবী হোক মনে প্রাণে আমার এই কামনা রইলো। আমি বা য়ামার সন্তানেরা না দেখে যাক তবুও ওদের সন্তানেরা দেশ মানে এক পৃথিবী পাক। আপনাদের ও অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা রইলো"সংশপ্তকের" জন্য।

বিনু মাহবুবা। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। অনুষ্ঠান ঘোষক- বাংলাদেশ বেতার।



Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.