"ও দি এদিকে আয়" সরু গলার
পরিচিত ডাকটা শুনে আধা অন্ধকারে সেই দিকে ছুটে গেল অষ্টমী; প্রথম ট্রেন
ধরে শহরে আসে কাজ করতে। দক্ষিন চব্বিশ পরগণার লক্ষ্মীকান্তপুর লাইনের মথুরাপুর
স্টেশনের থেকে ট্রেন ধরে সে। প্রান্তিক স্টেশন লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে যারা ওঠে তারা
এইভাবেই ডেকে নেয় অষ্টমীদের। সে অবশ্য একা না, আরো অনেকেই ওঠে মথুরাপুর থেকে ওই একই ট্রেনে।
প্রত্যেকেরই নিজের
নিজের গ্রুপ আছে, আবার
পরের পরের স্টেশনগুলোর থেকে ঠিক একই ভাবে নিজেদের গ্রুপের লোকজনকে ডেকে নেয় ওরা।
গ্রুপ বলতে কোনো সংগঠন টংগঠন নয় কিন্তু, এটা নিতান্তই ডেইলি প্যাসেঞ্জারীর গ্রুপ, এইভাবে একসাথে
গেলে বেশ সুখদুঃখের গল্প করতে করতে যাওয়া যায় তাই। আধা
অন্ধকার ভোরে এরা সব ট্রেন ধরে শহরে আসে লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করতে, মোটামুটি
ধাক্কাধাক্কি করে হয় সিট পায় নয়তো মাটিতেই বসে পড়ে ওরা। গোচারণ, ধপধপি থেকে
শুরু হয় সবার ঝিমোনো। মানে প্রথম পাঁচ ছটা স্টেশন হয়
ঘরের লোকের নিন্দে মন্দ নয়তো কাজের বাড়ির এই করেই কাটে তারপর ক্লান্তিতে ঘুম আসে
আবার। দু'চারজন
নামে বারুইপুর; আজকাল
সেখানেও কিছু কিছু ফ্ল্যাট তৈরী হচ্ছে, বেশ ভালো টাকাই পাওয়া যায়, আবার দূরত্বও কম, কিন্তু সবাই তো
আর সেখানে কাজ পায়না। যদিও প্রত্যেকের আগ্রহ আছে।
অষ্টমী এখনো শিয়ালদা যায় কাজে, সবাইকে বলে রেখেছে যারা বারুইপুর, গড়িয়া, যাদবপুর কাজ
করে; যে কোনোখানে
কাজ নিতে রাজি সে। যদিও তার শাশুড়ি খুবই ভালো, মাঝে মাঝে অষ্টমী ভুলেই যায় যে বুড়ি তার
শাশুড়ি,না মা।
অষ্টমীকে তো ভালবাসেই জোৎস্না, তারচেয়ও বুঝি নাতনি মঙ্গলাকে ভালবাসে। ছোট্ট অবস্থা থেকেই
মেয়েটাকে তার ঠাকুমার জিম্মায় দিয়ে বেড়িয়ে পরে কাজে, তবু মেয়েটা বড়
হচ্ছে, মায়ের
মন তো, সে তার
মেয়ের বড় হবার অনেকটা অংশই উপভোগ করতে পারলনা। শাশুড়িরও বয়স হচ্ছে, কাজের বাড়ির
দূরত্ব কমিয়ে আনলে অষ্টমী আরও একটু পরের ট্রেনে কাজে বেরোতে পারে, বা এত সকালে
গেলেও বিকেল সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে আসতে পারবে।
মথুরাপুর নেমে একটু হেঁটে অটো ধরতে হয়; অটোতে প্রায় মিনিট কুড়ি পঁচিশ কি আরও বেশিই লাগে বাড়ি
পৌঁছতে। রাস্তা এখন দারুন ভালো, প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা, হু হু করে ছোটে
অটো, তাতেও
অতোটা সময় লেগে যায়। বিকাশ তার বর অটো চালায় তাই ঘরে ফেরার
সময় বর থাকলে তো কথাই নেই,
না থাকলেও লাইনের অন্য অটো চালকরা বেশ সমীহ করে অষ্টমীকে। ঘরে জোৎস্না বুড়ি
মঙ্গলাকে নাইয়ে খাইয়ে ইস্কুল পাঠায়। কেমন সুন্দর নতুন নতুন রান্না করে, মাটির ঘর নিকিযয়ে
পয় পরিস্কার, পালা
পার্বনে কেমন আলপনা দিয়ে রাখে ঘরের উঠোনে; আবার অবসর সময়ে শাড়িতে জরির কাজ করে, স্থানীয় ভাষায়
যা নাকি ঢাড্ডার কাজ। ফলে বাড়িতে চারটে মানুষ, তিনজনে উপার্জন করে কম বেশি। অতদূর কাজে না
গেলে অষ্টমী আরও কিছু শিখতে পারত বুড়ির থেকে, যেমন সে বিয়ের পর পর শিখতো আর এখন মঙ্গলা
শিখছে। বাড়ি ফেরার পথে বাজার আনে অষ্টমী, শিয়্যালদায় কত ভালো ভালো সব্জি, মাছ, সেসব আসে প্রায়
তাদের গ্রামের দিক থেকেই। একটু মুখ চেনা বা ঠিক মত দরদাম করতে পারলে তো কথাই নেই।
দুপুরে বাজার বন্ধের ঠিক মুখে মুখে কাজের বাড়ির থেকে একচক্কর বেরিয়ে বাজার করে নেয়
অষ্টমী; ওই সময়ে
ভাঙ্গা হাটে সব কিছুই বেশ সস্তা, অথচ বেছে নিতে পারলে তেমন ঝরতি পরতিও না। বাজার কাজের বাড়ির
ফ্রিজে রেখে দেয়, ঘরে ফেরার
সময় বের করে নেয়। তবে এত পরিশ্রম করে অষ্টমী এত বুঝে চলে তার
ফলেই তো তার স্বামী অটো কিনে চালাতে পারছে। মঙ্গলা ইস্কুল যেতে পারছে বা ঘরেও এত
স্বচ্ছলতা; সেটা
অবশ্য আর কেউ বলুক না বলুক জোৎস্না বলে।
আধা তন্দ্রায় মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখে অষ্টমী কত দূর পৌঁছলো সে। তাদের গ্রুপের
মোটামুটি সে একাই এখনো শেয়্যালদা যায় কাজে; পার্কসার্কাসের পর ট্রেন প্রায় ফাঁকা, কিছু মাছের
ভেন্ডার থাকে তাদের কামরাতেও। ভেন্ডারদের জন্য নির্দিষ্ট কামরা ছাড়াও যেখানে পারে
ওঠে ওরা; বড়
বড় হাঁড়ি ভর্তি মাছ নিয়ে। হাঁড়ি গুলোর মুখে গামছা চাপা, আর গামছার নীচ
দিয়ে হাত ভরে দিয়ে সমানে জলে চাপড় দিয়ে মাছগুলোকে জিইয়ে রাখে; কন্টিনুয়াস এই
ছপ ছপ শব্দ যেন ঘুমপাড়ানি গানের মত কানে বাজে। যদিও বিশ্রী আঁশটে গন্ধ বাতাস ভারী
করে রাখে।
শেয়্যালদায় নেমে সাউথ থেকে নর্থের দিকে দৌড় দৌড় করে যেতে হয় তাকে; খুব একটা যে
কষ্ট করে দৌড়োতে হয় তাও না,
এমন ভীড় নামে ট্রেন থেকে যে তার সাথে হেঁটে যাবার জো থাকেনা। আর সাথে কাজের
বাড়ি যাবার তাড়া কিছুটা তো থাকেই। সেখানে গিযয়ে শাড়ী কাপড় পাল্টে নিয়ে সকালের
চা জলখাবার বানানো দিয়ে কাজ শুরু হয় তার। তারপর দুপুরের রান্না, রাতের রান্না, কাপড়জামা
ধোওয়া বাসন
ধোওয়া সব করতে হয় একা হাতে;
কাজেই যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় সেখানে। আবার সবার স্কুল অফিসের টিফিন গুছিয়ে
দেয় ছেলেমেয়ে
দুটোকে ইস্কুলের বাস ধরিয়ে দেয় নিয়েও আসতে হয় বিকেলে। একদিন যদি সে না থাকে এদের যে কি
হাল হবে ভেবেও পায়না অষ্টমী। সব কিছু তো সে ই করে সব সব। তারও
কেমন মায়া পড়ে গেছে, তবুও
তার নিজের সুবিধাও তো দেখতে হয়। এতটা দূর যাওয়া আসা করা, কোনদিন ট্রেনের
গণ্ডগোল হলে খুবই অসুবিধা হয় তার। আর তার মেয়েও তো এই বাচ্চা দুটোর মতই মাকে
কাছে পাচ্ছেনা, অন্য
একজন বিশ্বাসী মানুষের কাছে বড় হচ্ছে। মেয়ের হয়ত
অভিমান আছে, অষ্টমীতো
সেসব খোঁজ নেবারও ফুরসত পায়নি কোনোদিন। সে মন দিয়ে কাজ করে, তাদের বিশ্বাস
অর্জন করে, যাতে
হুট বলতে কাজ চলে না যায় আবার টাকাও ঠিকঠাক পায়।
একটা মনমতো কাজ পেলেই সে শেয়্যালদা আসা ছেড়ে দেবে। অনেকদিন থেকেই নিজেও ভেবে রেখেছে
বলেও রেখেছিল অন্যদের; এতদিনে
বোধহয় ওপরওয়ালা তার মনের কথা শুনলেন। শেয়্যালদার কাজের বাড়ির এরা ট্রান্সফার
হয়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। অতএব অষ্টমীর মন খারাপ লাগলেও কাজ ছেড়ে যেতে হচ্ছেনা
এটাই সান্ত্বনা। এবারে সে নতুন কাজ খুঁজে নিতেই পারে। যেদিন
জানলো কথাটা সেদিনই ফেরার পথে গ্রুপের যাদের যাদের সাথে দেখা হলো প্রত্যেককে বলতে
লাগলো "ও দি, এবারে আমার
জন্যি কাজ দেখরে, আমার
কাজের বাড়ি টেনাস্ফার হইছে"
পরদিন সকালেও একই আর্জি। দু' চারটে দিন লাগলো নতুন কাজ পেতে, ততদিনে ওদের জিনিসপত্র
গুছিয়ে চোখের জলে বিদায় দিলো। ওদেরও মন খারাপ সেই কবের থেকে কাজ করেছে অষ্টমী এত
বিশ্বাসী সে, সারাদিন
বাড়ি ওর হাতেই থাকতো তাতেও কোনো দিন একটা কোনো জিনিস এদিক থেকে ওদিক হয়নি।
(চলবে)
[মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী]