কত যে প্রেম বিবাহ বন্ধুত্ব আত্মীয়তা
ভেঙ্গে যায় স্রেফ বিশ্বাসের ধাক্কায় ! আমরা জন্মাই মন নিয়ে , তাতে আঁকিবুকি কাটে পরিবেশ ঘর পিতা মাতা শিক্ষা সমাজ চাহিদা
রুচি বিবেক সাহস আত্মবিশ্বাস অহংকার ইচ্ছে আর চেতনা । এর মধ্যে থেকেই আমাদের
নিজেদের চেনা অন্যকেও । এর ভেতর দিয়েই নিজেরা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা এবং অন্ধজনে আলো
দানের প্রয়াস । ‘যত মত , তত পথ’ বলে সেই কবে পরমহংসদেব দুহাত তুলে
দিয়েছিলেন, আমরা কি আর সেই বান্দা ? আমরা চাই দল ভারী
করতে , আমার মতটা তোমার ওপর না চাপাতে পারলে
শান্তি নেই, প্রভুত্ব বিস্তার , ভালোবাসা প্রদর্শন , সাম্রাজ্য বিস্তার যাই বলনা কেন সেই
তো আমার মতে তোমার হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সং হয়ে থাকার ইচ্ছা । মুখে সব্বাই পলিটিক্যালি
কারেক্ট , শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রপাগন্ডা
আউড়াই , কিন্তু ভেতরে ভেতরে উদগ্র ইচ্ছা পোষণ
করি স্বমতে স্বধর্মে অন্যকে নিয়ে এসে আমার ইগো স্যাটিসফাই করতে । আর মাথা না
মুড়োলেই বিপদ । তখন শুরু হয় বল প্রয়োগের নীতি । সহিষ্ণুতা সমানাধিকার ইত্যাদি
ধূলায় গড়াগড়ি দিয়ে আমরা এক একটা বলদর্পী রাবণ হয়ে উঠি । মত তাই , যা আমার মত , বাকি সব গন্ধ পচা । ধর্ম হোক রাজনীতি
হোক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা তার মজ্জাগত , তবেই তো মান্যতা , তবেই তো সম্ভ্রম , তবেই তো সংখ্যালঘুর চোখে উৎপন্ন হবে
ভয় , তবেই তো সে পদতলে নয় পতাকাতলে আশ্রয় নেবে , তার দেখাদেখি আরো পাঁচজন অধীনতা স্বীকার করবে , নিরাপদ থাকার জন্য , নিরুপদ্রব থাকার জন্য , শান্তিতে থাকার জন্য । কেউ কেউ বলেন , মত ব্যাপারটা শালগ্রাম শিলা নয় । এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে
পাক খায় । এপাং ওপাং ঝপাং । ভিন্ন ভিন্ন অবয়ব ধরে । দশচক্রে ভগবান যেমন ভূত হন আর
কি ! কিন্তু এখানেও লক্ষ্যণীয় , সেই মত আদৌ প্রয়োজনীয় মাত্রায় নমনীয়
কিনা , দশের চাহিদা ও কল্যাণে সেটা কতটা
ইলাস্টিক । একবগ্গা কঠিন কঠোর হয়ে সে দানবিক আকার ধারণ করছে কিনা । প্রকৃত অর্থে
স্বাধীনতা বড় বেশি দাবী করে , বড় ঝড় ঝাপ্টা সামলাতে হয় , বড় কলিজা লাগে বিরোধিতা করতে গেলে । কোনটা ঠিক কোনটা ভুল এই
ব্যাপারটাও তো পুরোপুরি আপেক্ষিক এবং মহাকালই এর একমাত্র বিচারক । অল্প বুদ্ধি
নিয়ে আমরাও সবসময় পেরে উঠি না । এর চেয়ে কিছু
ক্ষেত্রে আত্মসম্মান আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে প্রভাবশালীর পথই আমার পথ, মহাজন গতঃ স পন্থা , বলাটা অনেক সস্তা এবং সহজ উপায় বটে কম্বোজী জীবেদের কাছে ।
মেরুদন্ড ব্যাপারটা সবাই একরকমভাবে হ্যান্ডেল করে না । কখন কি প্রেক্ষিতে ওটা
গজিয়ে উঠবে এবং কখন আবার পুরোই ঝুলে যাবে তা ঠিক করার মালিক যেমন আমরাই , তেমনি ওই সম্পর্কিত আলোচনা সমালোচনা করবার অধিকারও আম
পাবলিকের । ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও , আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’… মুখে কপচাই , আর নিরন্তর নাক গলাই অন্য জানালায় , আমার সব ভালো , অন্যে যা করে ভাবে বলে সবেতেই চিড়বিড়
করে চিত্ত , এই রোগের টীকা নেই , ওষুধও । ফলত , মহামারী । এই মনোবিকলনের জন্য
শান্তিও নেই মনে । নিজেকে সবসময় প্রতারিত বঞ্চিতের দলে ফেলে করুণা করতে থাকা এক
সুমহান দ্বায়িত্ব কর্তব্য বটে । আবার সবাই তো সবজান্তা , কারুরই দরকার পড়ে না অন্য মত ধৈর্য ধরে শুনবার , সবাই সবার ওপরে গলা চড়াচ্ছে , কলরবে
ঢাকা পড়ে যাচ্ছে যুক্তি তর্ক । বাকি রইলো কেবল গপ্পোটুকু , সে যে যার মনের আপন মাধুরী মিশিয়ে রচনা করলে যা হয় , একটি বিশৃঙ্খল সমাজ , অবাধ্য সন্তান , হাম্বাগ প্রৌঢ় , আমাদের আমলে সবকিছু অন্যরকম ভালোছিল
এই নষ্ট নস্ট্যালজিয়া , বর্তমানকে হেয় করে দেখবার , গুরুত্ব না দেবার , হাল্কাচালে উড়িয়ে দেবার সর্বজনীন
স্পৃহা , এই নিয়ে স্বমতে স্বদলে স্বধর্মে
অবিচল আমরা যেযার মত এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ,
বাতিঘরের আলোয়
একাকী নিশিযাপন , দিনমান বহুজনের মধ্যে বসে স্বভাবদোষে
একলা । এখানে পার্টটাইম বসন্তবায় আসে , মন উচাটন হয় , প্রেম প্রেম জৈব আববিকারের কিছু ভূমিরূপ অদলবদল হয় , তারপর অনন্ত হিমযুগ , ‘তুমি কার , কে তোমার’ এই অধীত দর্শনে ভবিতব্য মেনে নেওয়া ।
অথচ , একটু মন বাহু হৃদি প্রসারিত করলেই কত আলো
জ্বলে ওঠে , কত ফুল ফোটে , কত পাখি গায় । ‘মন রে কৃষি্কাজ জানো না , এমন মানব জমিন রইলো পতিত ,
আবাদ করলে
ফলতো সোনা’। আমরা এমন সব এলিমেন্ট , অনুঘটক ছাড়া কোনো মহৎ রাসায়ণিক বিক্রিয়া ঘটাতেই জানি না , তাই যুগে যুগে আমাদের অপেক্ষা সেই মুর্শিদ দরবেশ অবতার
মিশায়ায় জন্য , যে এসে কলকাঠি নেড়ে দেবে , জেগে উঠবে পাতালপুরীর ঘুমন্ত বিবেক চেতনা মনুষ্যত্ব , আমরা আবার মানুষ হব । ততদিন , রয়ে
যাওয়া পরাজিত হতাশের দলে সয়ে যাওয়া আত্মপ্রবঞ্চনা করে যাওয়া আত্মবিলাপ । কেউ বলুক
না , ‘আত্মদীপো ভবঃ’,
কতদিন ধরে যে
বসে আছি পথ চেয়ে আর কাল গুনে …
[শর্মিষ্ঠা ঘোষ]