এখনো তুমি আমার,
তবে পরের বার
আরও একটু বেশী আমার থেকো।
কম্পিউটারের পর্দায় তোমার
মুখ হাসবে না,
পরের বার তোমার ঠোঁট
আমায় ঠোঁট ছুঁয়ে কথা বলবে,
তোমার হাসির প্রতিবিম্ব
আমার চোখে ধরা দেবে,
কথা দাও, পরের বার পুরোটা আমার
হবে।
আমরা একসাথে সকাল দেখবো,
একসাথে রাতের তারার হাত
ধরে
নতুন পথ আঁকবো।
বাগানে, চার হাতে বীজ পুঁতে
সবুজ খনি গড়বো…পরের বার,
পুরোটাই আমার হয়ে থেকো।
কোন একবার ছিলে হয়তো,
জানো...
আবছা চোখে ভাসে,
খাগের কলম, তালপাতা,
প্রদীপের আলোর পাশে,
স্থির দৃষ্টি তোমার,
কালির দোয়াতে কলম চুবিয়ে
সৃষ্টির নেশায় বুঁদ।
আর আমার দুচখের পাতা
পড়েনা,
সম্মোহিত হয়ে শুধুই তোমায়
দেখে,
আদরে, আবেগে তোমায় ঘিরে রাখে,
এই সব আবার আসবে পরের
বার,
তুমি যখন পুরোটাই আমার
হয়ে থাকবে।
এতটা লিখে পরী থামল। সকাল সাতটা বাজে। রান্নাঘরে ঢুকতে হবে
এবার। আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছে। তাড়াতাড়ি সব জানলা বন্ধ
করে দিল পরী। শুধু রান্নাঘরের জানলা
খুলে রাখল। জলখাবারের ফল কাটতে কাটতে
হাতের আঙ্গুল, ছুরি, ঘাড়ের কাছটা, কপালের কোনাটা,
সব ভিজতে লাগল। এই বৃষ্টির
আওয়াজ ছাপিয়েও গান ভেসে এলো, ‘‘লগি আজ সাওয়ান কি ফির উও ঝরি হ্যায়...’’ ওপরের তলার সমরেশ কাকু
সারা সকাল সেভেন্টিস আর এইট্টিসের গান চালিয়ে রাখেন। কাজ করতে করতে রোজই শোনে পরী। চাঁদনি প্রথম দেখা সিনেমা
অপূর্বর সাথে। মনে আছে ১৯৮৯, পরী তখন সবে কলেজে
পা দিয়েছে। সবাই মিলে হইহই করে সিনেমা
দেখতে যাওয়া। অপূর্বই পরী ডাকটা কলেজে
চালু করেছিল। বলেছিল, ‘‘পরিমিতা বলতে পারবনা,
পরী বলব, সাড়া দিবি তো?’’ দু বছরের বড় অপূর্ব কলেজের জি এস। সারা কলেজ ওর ফ্যান। শুধু বোধহয় পরীই ওর ফ্যান
হয়নি। তাই ও পরীর ফ্যান হয়ে
গিয়েছিল।
‘‘পরী, আমার চা রেডি?’’ অমলের চিৎকার কানে
এলো। ‘‘তাড়াতাড়ি দাও, আজ এ জি এম আছে। বলেছিলাম ডেকে দিও, তোমার তো কিছুই মনে
থাকেনা।’’
অমল – নামটা পরীর ভাল লেগেছিল। ডাকঘরে পরী অমল হয়েছিল বেশ ছোটবেলায়। রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে আর পাঁচটা সাদামাটা বাঙালির মতই বড় হয়েছিল
পরী। অপূর্বর সাথে এইখানেই
বড় নিবিড় ভাবে জুড়ে গিয়েছিল সে। পরীর তখন
বেশ একটা সুন্দর খোঁপা হত। একদিন অপূর্ব একটা গন্ধরাজ ফুল কলেজেরই বাগান থেকে তুলে
এনে গুঁজে দিয়েছিল খোঁপায়, আর বলেছিল, ‘‘সমস্ত দিন তো কেবল কাজ করি, তার মধ্যে
একটু সময় চুরি করে তোর জন্য ফুল আনতে পারলে বেঁচে যাই।’’ পরীর গায়ে কাঁটা দিয়েছিল।
রক্তকরবী তার মুখস্ত, তাই এমন করে কেউ যখন বলেছিল তখন ও শিউড়ে উঠেছিল। বয়সটাও
তেমনই ছিল। সেই শুরু।
‘‘পরী ব্রেকফাস্ট দাও। তোমার
ডাকঘরে তো ঘণ্টা তোমার ইচ্ছেতে বাজে। আমার তো আর তা নয়।’’ এমন অকারণ খোঁটা অমল
দিতেই থাকে। আগে চোখদুটো কট কট করত। এখন আর করেনা। বিয়ের পরেই পরী বুঝেছিল এ বাড়িতে অত রবি ভালবাসা নেই। তাই যখন ও
প্রথম অমল নামটা বলে কিছু বলতে গেছিল, তখনই অমল ধমকের স্বরে বলে উঠেছিল, ‘‘পাবলো
নেরুদা পড়েছ? কীটস পড়েছ? ব্লেক, বায়রন... না খালি ঠাকুরেই আটকে আছ?’’ খুব অবাক হয়ে ছিল পরী, এত বিদ্বেষ কেন, বুঝতে পারেনি। আজও
বোঝেনা।
জীবনের একটা সময় অপূর্বই সব হয়ে
উঠেছিল। কিন্তু সে যে ধরা পড়তে ভালবাসেনা, সেটা পরী বুঝতে পারেনি। ও কিন্তু বলেছিল
একদিন, ‘‘এমন করে আমায় কেউ পায়নি যেমন তুই পাস। তোর সামনে আমায় মুখোশ আঁটতে হয়না,
তোর সামনে আমি আমি থাকতে পারি। ডাকাবুকো
অপূর্বর চোখে জলও দেখেছিল পরী। সেদিন পরী কাঁদছিল, অপূর্বর অবহেলায় কাঁদছিল,
অপূর্বর ব্যস্ততায় কাঁদছিল। দেখল অপূর্বর চোখ দু’টোও চিকচিক করছে। অবাক হয়ে বলল, ‘‘তুই
কাঁদছিস? তুইও কাঁদিস?’’ অপূর্ব বলেছিল, ‘‘আগে কখনও এমন আবেগ অনুভব করিনি, জানিস।
আজ বুঝলাম, আমার চোখেও এত বাষ্প আছে।’’
অমল অফিসে বেরোবে। এই গাঁটছড়া পরী
ভবিতব্য জেনেই মাথা পেতে ভালবেসে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু অমলের সাথে তার দূরত্ব
শরীরের কাছে আসাও কমাতে পারেনি। পরী যা যা ভালবাসে অমলের কাছে সেই সবই খারাপ।
অমলের সব পছন্দ পরী মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু কোথাও যেন তারটা কাটাই ছিল। বাইরে থেকে
দেখে লোকে হিংসেই করে পরীকে। জীবনে যা আকাঙ্খা করে মানুষ, সেই সবই আছে। ছেলে
বিদেশে পড়ছে, পরী নিজে কলেজে পড়ায়, স্বামীর তো কথাই নেই, মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির
বিগ বস।
মাসখানেক আগে, পরী অমলের সাথে ওর
অফিসের পার্টিতে গেছিল। বেশ লাগে যেতে। অনেক লোক, গল্প, হাসি, আর আরও ভালোলাগার
কারণ, সবাই পরীকে গান গাইতে বলে। অমলের মোটেও ভাললাগেনা এই প্যানপ্যানে
রবীন্দ্রসঙ্গীত, কিন্ত পাবলিক ডিম্যান্ডের সামনে কিছু করতে পারেনা। বাড়ি এসে উশুল
করে নেয় যদিও, কিন্তু পরীর এখন সয়ে গেছে।
তবে কাল পরী গজল গাইল। ‘‘আপকি ইয়াদ আতি রহি,
রাত ভর...’’ করতালিতে হলঘর মুখর হয়ে উঠেছিল। কেবল একটা আওয়াজ আর থামছিলনা। পরীর শরীরটা অবশ হয়ে গেছিল।
অপূর্ব দাঁড়িয়ে চোখের সামনে।
এম. এ. পরীক্ষার শেষ দিন, অপূর্ব
দেখা করতে এল। বলল ‘‘পরিমিতার সাথে শুভ পরিণয়, আমার জীবনে হবার নয়। হবার নয়।’’
অনেক কষ্টে পরী জানতে চেয়েছিল ‘‘কেন?’’
অপূর্ব বলেছিল, ‘‘আমি পাগল বাউণ্ডুলে ছেলে। একটু আধটূ লেখালিখি করি, তোকে রাখব
কোথায়? তুই পরী, আকাশে ওড়। পায়ে বেড়ি পরিসনা। আমার জীবনে তুই মিসফিট।’’
সেই ১৯৯৪-এর পরে এই দেখা। সেদিন
কিন্তু অপূর্ব স্বস্ত্রীক এসেছিল। এক ফাঁকে পরীকে ফোন নম্বরও দিয়ে গেল।
পরের দিন দুপুরে বাড়ির ফোন বাজল।
পরী হ্যালো বলতেই ওপারে থেকে সেই চেনা গলা, পরীর চোখ খালি ঝাপসা হচ্ছে।
তারপর ক’দিন ঝড়ের মত কাটল। কত কথা,
এতদিনের গল্প, কে কোথায়, কিভাবে, সব খবর আদানপ্রদান হল।
ফেসবুকে গল্প, ভিডিও চ্যাট। নিজেকে অষ্টাদশী মনে
হচ্ছিল পরীর।
কেবল কাল রাতে, ফেসবুকে গিয়ে দেখল,
অপূর্ব নেই... কেবল একটা মেসেজ ছেড়ে গেছে...
‘‘পরের বার পুরোটা
তুই আমার, আর আমি তোর,
কথা দিলাম, পালিয়ে
যাবনা,
আমার ওপরেই থাকবে
তোর সকল অধিকার,
সব জোর,
পরের বার পুরোটাই
তুই আমার, আমি তোর।’’
[সংযুক্তা মজুমদার]
দারুণ লাগলো
ReplyDeleteপরেরবার আরও ভালো কিছু আশা করে রইলাম বন্ধু
Bibaswan