এমন বন্ধু আর কে আছে!
সে অনেকদিন আগেকার কথা, আমার এক পিসি
বলতেন, মানুষের
জীবনে গাছের থেকে বড় বন্ধু আর হয়না, দেখবি কোনো কাজেই ওরা আমাদের বাঁধা দেয় না, সাত চড়ে রা
নেই, ।
ওদের মতো বড় বন্ধু আর কে আছে!
আমাদের পুরানো বাড়িতে একটা মস্ত বড় বাগান ছিলো। আম,
জাম, পেয়ারা, কাঁঠাল, বেল, সুপুরি, নারকেল গাছের
সাথে ছিলো একটা কামরাঙ্গা গাছ। আর এরাই ছিল আমাদের সেই ছোট্ট বেলার বন্ধু।
গ্রীষ্মকালে রোদ-ছায়া গায়ে গায়ে মেখে ভাই বোনেরা কত রকমের খেলা খেলেছি সেই গাছেদের
সাথে। আবার শীতকালে আত্বীয় স্বজন মিলে সেই গাছের ছায়ায় বসে হতো চুড়ুইভাতি। সঙ্গী
ছিলো কতো রকমের পাখির ডাক, ঝির ঝির করে বয়ে যাওয়া বাতাস, আর গাছের
পাতায় উঁকি দেওয়া সোনা ঝলমলে রোদ।
আমার যতদূর মনে পড়ে সমস্থ
গাছগুলোর একটা করে নামও রেখেছিলাম আমরা । কালবৈশাখির ঝড়ের সন্ধ্যেয়, আমরা ভাই
বোনেরা হৈ হৈ ছুটো ছুটি ফেলে দিতাম বাগানে, কোচড় ভর্তি করে তুলে আনতাম কাঁচা আম। কবে ঠিক
মনে নেই, একবার
কাল বৈশাখীর ঝড়ে আমাদের সব থেকে পুরানো আম গাছটা একেবারে ভেঙ্গে পড়বার উপক্রম।
বাড়ির সক্কলের তা নিয়ে কি ভীষণ চিন্তা। ঝড় থামতে বাইরে গিয়ে দেখা গেলো, না! সে গাছের
কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু কটি ডাল পালা ভেঙ্গে পড়েছে মাত্র। এই
রকম আরো কত আনন্দ আর খেলাধুলোর ভিতর দিয়ে কেটেছে আমাদের শৈশব ওই গাছেদের সাথে।
বাড়ির নারকোল গাছ থেকে নারকোল পেড়ে মা, পিসিরা তৈরী করতেন পুজোর জন্য নারকোল নাড়ু।
আজকাল প্রায়ই শুনি দেশের মানুষ নারকোল নাড়ু কিনে খান। আমরা ভাবতেই পারতাম না, নারকোল নাড়ুও
আবার কিনতে পাওয়া যায়। নাড়ু মানেই তো, মা, কাকিমা আর পিসিরদের নিজে হাতে কোড়ানো সাদা
ধবধবে নারকোল কোড়া, আর তাতে মিষ্টি গুড়ের পাক । সেই নারকোল আবার
পাটিসাপটা পুর হিসাবে ব্যবহার হয়েছে কতবার। মনে হয় যেন এই সেই দিনকার কথা। আমার মা, কাঁঠাল খেতে
খুব ভালবাসতেন, গরমের দিনে তীর্থের কাকের মত বসে থাকতেন, কখন গাছে
কাঁঠাল পাকবে। কাঁটাল যখন ভাঙ্গা হত, গন্ধে পাড়া প্রতিবেশী সব এসে হাজির হতেন ।
আমার ঠাকুমা বাটি ভর্তি করে কাঁঠাল পাঠাতেন বাড়ি বাড়ি। নিজের বাড়ির গাছের কাঁঠাল
এর স্বাদ চাখাতে চাইতেন সকলকে ।
সব থেকে মজার গল্প আছে, বাড়ির এক
কোনায় সেই মস্ত বড় কামরাঙ্গা গাছটাকে নিয়ে। সারা বছর কামরাঙ্গা ভরে থাকতো গাছটাতে।
লাল, সবুজ, হলুদ নানা
রঙের। আমার পিসির খুব গাছের শখ ছিলো। রথের মেলায় গেলেই গাছ কিনে আনতেন। ওই
কামরাঙ্গা গাছটিও কোনো এক সময় কিনে এনেছিলেন। আবার ওর উপরই দ্বায়িত্ব ছিলো গাছটাকে
ঠিকঠাক মতো বড় করবার। পিসি খুব যত্ন করতেন গাছ গুলোকে। গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে
তাকিয়ে আমাদের বলতেন, "জানিস গাছ মানুষের কতো বড় বন্ধু, ওরাতো কথা
বলতে পারে না, নিজেদের অনুভুতি গুলো বোঝাতেও পারেনা, তাই ওদের
ভালবাসতে হয়, যত্ন করতে হয়।" গাছ গুলোর উপর কি ভীষণ
রকম টান ছিল বাড়ির বড়দের কি বলব। আমার বাবা ছুটির দিনে সারা দুপুর পাহারা দিতেন
গাছ গুলোকে, কত কত বার পাড়ার ছেলেরা এসে ভিড় করত
কামরাঙ্গা চুরি করবে বলে। আর কত বার যে তারা ধরা পড়েছে, সে এক কান্ড
বটে। পাড়ার লোকেরা বলতেন ওদের বাড়িটা এক্কেবারে বৃন্দাবন, ঢুকতে না
ঢুকতেই চারিদিকে তুলসী গাছ ছড়ানো । ঠাকুমাপূর্নিমার দিন সন্ধ্যে বেলায় তুলসী তলায়
বসে বাতাসা হরির লুট দিতেন। আমরা ভাই বোনেরা বাতাসার লোভে চুপটি করে বসে থাকতাম।
খুব মনে পড়ে আমাদের বাড়ির কাটটগর গাছটার কথা। আমার পড়ার ঘরের জানলায় একে বারে
সামনে ছিলো তার জায়গা । সকালে জানলা খুললেই ধবধবে সাদা ফুলের তোড়া নিয়ে সে
উপস্থিতি। মা সেই শিশির ভেজা ফুল তুলে ঠাকুরের আসন ভরিয়ে দিতেন। সে আজ থেকে কতদিন
আগেকার কথা।
আপসোস হয় এই সময়গুলোকে ধরে রাখা
যেতো, তাহলে
আমাদের পরের প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করা যেত। কিন্তু পরিবর্তন কে আটকাবে? "অনলি
চেঞ্জ ইস কনস্ট্যান্ট। " দেখতে দেখতে আমাদের আসে পাসে তখন কত রদ বদল। সেই
বদলে যাওয়া থেকে আমরা কেউই বাদ ছিলাম না। বয়স বারবার সাথে সাথে গাছেদের বন্ধু
হিসেবে পরিচয় দিতে বড্ড কিন্তু কিন্তু লাগলো! বাড়িতে এত গাছ? কলেজের
বন্ধুরা এসে হাসি ঠাট্টা করে, বলে "তোদের বাড়িতে এলে মনে হয় কেমন
গ্রাম গ্রাম।" আমরা বললাম, "ইস! বাগান থাকলেই বুঝি গ্রাম হয় ? কিন্তু তারাই
বা আমাদের ছাড়বে কেন ? তারা সব্বাই তখন সদ্দ্য ওঠা বিলাস বহুল ফ্লাট
এর বাসিন্দা।
এই রকম কিছুদিন চলবার পর, আমরা ভাই
বোনেরা বেশ চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম বাড়িটাকে প্রমোটারের তুলে দেওয়াটাই সব থেকে
বুদ্দিমানের কাজ। মা,কাকিমারা আমাদের প্রস্তাবে এক কথায় রাজি। বাদ
সাজলেন,বাবা, কাকু, আর পিসিরা।
বেশ কিছুদিন বাদ বিবাদের পর, সিধান্ত আসা গেলো, আমাদের
বাড়িটা এইবার ফ্লাটের রূপ নেবে। বাবা, কাকু, পিসিদেরকে আমাদের জেদের কাছে হার মানতেই হলো।
আমরা ও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। শুরু হলো বাড়ির কাজ। ধীরে ধীরে গাছ বন্ধুরা এক এক করে
কাঁটা পড়লো, যেদিন শুনলাম কামরাঙ্গা গাছটা কাঁটা হবে, বুকটা কেমন
কেঁপে উঠেছিল। মনে পড়ে , বাবা খবরের কাগজের আড়ালে চোখের জল লুকিয়ে
ছিলেন সেইদিন। আমার সেই বুড়ি পিসিটা রোজ পুরানো বাড়ি হালচাল দেখতে যেতেন। বাড়ি
ফিরে আমাদের কাছে গল্প করতেন। কিন্তু আমরা সক্কলে যে, একটা আধুনিক
জীবন পাবার জন্য কি ভীষণ ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলাম, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারতেন না । এই ভাবে কেটে
গেল অনেক গুলো দিন। ফ্লাট হলো, নতুন করে গৃহপ্রবেশ। অনুষ্ঠান করে বন্ধু
বান্ধবদের ভুরিভোজ । দেখতে দেখতে আসে পাসে সব বাড়ি গুলোই ফ্লাট বাড়ি হয়ে গেলো।
আমরাও বাস্ত্য হয়ে উঠলাম রোজকার জীবনে। সুপাত্রে বিয়ে, সংসার হলো।
ঐদিকে ওই গাছগুলোর মতই ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল ওদের কে প্রাণ দিয়ে ভালবাসার
মানুষগুলোও, বাবা, পিসি, কাকু। আজ এই সব কিছুই স্মৃতি।কিন্তু আজও কি
প্রচন্ড ভাবে মন কে নাড়া দেয় প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ , মায়ের হাতের
নারকোল নাড়ু, চড়ুইভাতি আর কুড়িয়ে আনা কাঁচা আমের স্বাদ,যা চাপা পড়ে
গেছে আমাদের সেই মস্ত ফ্লাট বাড়িটার নীচে।
কিন্তু এতো আধুনিক আর শহুরে হয়ে উঠবার পরও কেনো
জানি না আজকাল নিজেকে ভীষণ একা লাগে, ক্লান্ত লাগে । কিন্তু এ রকমটা তো হবার ছিল
না। কথা ছিল, আধুনিক জীবন যাপনে অভস্থ্য হয়ে উঠলে আমাদের
আরো ভালো বন্ধু হবে। কিন্তু কোথায়? এই এতো লোকের ভীড়ে কোনো বন্ধুকেই আজ খুঁজে
পাই না। শুধু দেখি সক্কলের ভিতর এক রাশ বাস্ত্যতা আর ক্লান্তি। বিরামহীন প্রচেষ্টা
শুধু একে অপরের কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবার ।
আসলে কি জানেন বন্ধুরা, আসলে
মুখোশধারী বন্ধুদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের সেই প্রকৃত বন্ধুরা। ছায়া ফুল, ফল নয় তারা
আমাদের জীবনে এনেছে ক্লান্তি আর অবিশ্বাস। সেটা আজ এখন বুঝতে পারি।
সংঘমিত্রা ভট্টাচার্য্য
ফিলাডেলফিয়া