সারাটাদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে
চলেছে। এমন দিনে তিতিরের বড় মন কেমন করে!! কেমন একটা গোঙানো কান্না যেন ছিটকে
বেরিয়ে আসতে চায় বুক চিরে। রোজ সকালের মত আজও ভোর বেলা রেওয়াজে বসেছিল তিতির।
কিন্তু আজ কিছুতেই গলা দিয়ে ভৈরবীর আলাপ গাইতে ইচ্ছেই করল না। হঠাৎ সকালে বাগেশ্রী
টানল তাকে বড় বেশি। রেওয়াজের এই সময়টা এখনও মা'কে বড্ড মিস করে তিতির। এককাপ চা নিয়ে চুপ
করে চোখ বুজে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তিতিরের রেওয়াজ শুনে তবে দিনের শুরু হত মায়ের। গানের
প্রতিটি সুর,প্রতিটি কথা মাএর যে কি আশ্চর্য ভাবে মুখস্থ
থাকত!!
যখন কোনো মীরে খুব মিষ্টি করে
মোচড় দিত তিতির সুর নিয়ে খেলতে খেলতে মা একগাল স্নেহের হাসি হেসে,বলে উঠত
"ওহ আহা,আহা"!! তিতিরের চোখ চকচক করে উঠত আনন্দে,আহ্লাদে, আর তারপরেই
আরো সুরকে সাজিয়ে নিত সে...এমনি কাটত প্রতিটি সকাল। বিষ্ণুপুর ঘরানায় নাড়া বেঁধে
তাও প্রায় দশ বছর তো হলই গান শিখছে তিতির। গুরুজী অত ছাত্র-ছাত্রীর ভেতরেও শুধু
তিতিরকেই রোজ তানপুরা ধরতে দেন। সেদিন ক্লাশে তারানার বোল টা শেষ হতে না হতেই গুরুজী যখন মাথায় হাত রেখে বললেন,"অনেক
দূর ওই আকাশ ছুঁবি তুই..." গুরুজীর বিশ্বাস ভরা আবেগী চোখ দুটির দিকে চেয়ে
তিতিরের মনে হচ্ছিল,তার সুরের ডানায় বুঝি চিকচিকে রোদ্দুর খেলা
করছে।
খুব আহ্লাদী হয়ে ঠক করে একটা
প্রণাম করতেই গুরুজী তিতিরের মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে বলল "ভূতনী শোন,এবারের
সর্বভারতীয় প্রতিযোগীতাটা জয় করে আসতে হবে,পারবি তো??"
তিতির এত বিশ্বাস এত ভালবাসা এত
স্নেহে কেমন আবেগ সামলাতে না পেরে,টলটলে দুটো কাঁচের মত স্বচ্ছ চোখ তুলে বলল,"হুম"
গুরুজী তিতিরের মাথাটা নিজের
কোলের কাছাকাছি টেনে এনে বলল,"তোকে যে পারতেই হবে রে,মা এর স্বপ্ন
তোকে পূরণ করতেই হবে,কি হবে তো?"
এবার তিতিরের চোখ ছাপিয়ে অভিমানী গাল
বেয়ে জল গড়াচ্ছে...
টুক টুক করে মাথা নেড়ে সম্মতি
জানাল।
এমনই সম্পর্ক গুরুজীর সাথে
তিতিরের।গত এই দেড় বছরে মা মারা যাবার পর বিশেষ করে গুরুজী কেমন আরো বেশি করে
তিতির কে নিজের সন্তানের মত বুকে টেনে নিয়েছেন। বড় মায়াবী মুখখানা তিতিরের।ওর ওই
টানাটানা কালো ভ্রমরের মত চোখ দুটোই যেন ওর হয়ে সব কথা বলে দেয়। গুরুজীর একটিই
ছেলে,কখনো
আলাপ হয়নি তিতিরের সাথে,ক্লাশের সিনিয়র দিদি রা সব বিক্রম দা বলতে
পাগল! বিক্রম এর নিজস্ব ব্যান্ড আছে। ক্লাসিকাল ও মডার্ন দুই ধরনের সঙ্গীতের
তালমেল ঘটিয়ে অদ্ভুত সব কম্পোসিজন করে ওরা। দলের নাম "আলাদিন"।
সত্যিই অপূর্ব ! শুনেছে তিতির লাস্ট দুটি এলবাম। অসম্ভব এক্সপেরিমেন্টাল কাজ। দু
-ধরনের মিউজিক সম্পর্কেই খুব গভীর জ্ঞান না থাকলে এমন কাজ করা যায় না। গুরুজী
নিজের হাতে তৈরি করেছেন বিক্রমকে। বাবার কাছে ছাড়াও সমকালীন আরো অন্য উস্তাদ দের
কাছে তালিম নিয়েছে বিক্রম। আধুনিক,ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল এসব ও নানাধরনের গান
দিনের পর দিন তালিম নিয়ে শিখেছে বিক্রম।দু-বছর তো স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ থেকেও অনেক
নতুন ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিকের উপর পড়াশুনা করে এসেছে। সত্যিই ছেলেটা অসম্ভব গুণী।
এই তো সেদিন ও ক্লাশের পর তিতির তানপুরাটা
তুলে রাখছে,অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে,মোহনজী
গুরুজীকে বলছিলেন,"আপনার ছেলে হীরে স্যার,হীরে। কি
জ্ঞান ওর। এবারের এলবাম টা আমি ওকে দিয়েই করাতে চাই। "
মোহন জী 'রাজ অডিও'এর মালিক।
বিখ্যাত লোক। প্রায়ই দেখেছে তিতির এরকম অনেক নামী দামী মানুষ কে গুরুজীর কাছে আসতে, গুরুজীর
পায়ের কাছে বসে গান শুনতে, শিখতে।
বিক্রমদা কে নিয়ে যে গুরুজীরও খুব
গর্ব তা ভালই টের পায়,ক্লাশের ছেলে মেয়েরা। বিক্রম কে যেতে আসতে
দেখেছে তিতির কয়েকবার,কিন্তু কখনো তেমন আলাপও হয় নি,কথাও বলেনি। ক্লাশে
এর ওর মুখে শুনেছে সায়াহ্না দি'র সাথে নাকি বিক্রম দা'র বিশেষ
সম্পর্ক আছে। সায়াহ্না তিতিরের থেকে চার
বছরের সিনিয়র। সায়াহ্নার যাতায়াত গুরুজীর ক্লাশরুম ছাড়িয়ে অন্দরমহল অবধি,সে কথা সবাই
জানে ক্লাশে। বিক্রম,সায়াহ্না এরা একসাথে ক্লাশ করেছে গুরুজির
কাছে। বিক্রম সায়াহ্নার থেকে দু- বছরের সিনিয়র। ইউনিভার্সিটির লাস্ট ইয়ারের ছাত্রী
সায়াহ্না যে বিক্রমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু,তাতে তার বন্ধু মহলে কদরই আলাদা। সায়াহ্না 'আলাদিন'এর প্রায় সবক'টি এলবামেই
উপস্থিত। অসম্ভব ভাল গায়। নি:সন্দেহে। তিতির
দূর থেকে দাঁড়িয়ে কতবার দেখেছে,বিক্রম আর সায়াহ্না খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে নতুন
সুর সৃষ্টি করছে বা হয়ত কখনো ঘরের দরজা বন্ধ,ভিতরে দুজনে। অমনি ক্লাশে গুনগুন শুরু হয়ে
গেছে,সায়াহ্না
দি কে যা লাগছে না! দুজনকে দারুণ মানায়! আরো হাজার কাল্পনিক দৃশ্যপট ভেবে নেওয়া
বন্ধ দরজার ওপারে কি কি ঘটছে... তিতির শুধুই শোনে এসব,কিন্তু এসবে
তার আগ্রহ বিন্দুমাত্র নেই। বিক্রমের উপর যে ক্লাশের প্রায় সব মেয়েই ফিদা, তা বলাই
বাহুল্য।অমন প্রোফাইল,তার ওপর তেমন হ্যান্ডসাম দেখতে।
এই তো দুদিন আগেই হঠাৎ ই দরজা
দিয়ে বেরোতে যাবে ক্লাশ শেষে,সিঁড়ির নীচের লাইট টা কেটে গেছে। তিতির সবার
শেষেই বের হয়,বরাবরই,সেদিন আর একটু বেশি দেরি হল,সেদিন
তিতিরের মাএর জন্মদিন ছিল। এরকম দিনে মনটা বেশি ভারি হয়,গুরুজী মুখ
দেখেই জিগ্যেস করেছিল ক্লাশের শুরুতেই,"কি রে,কি হয়েছে?"..
তিতির গুরুজীর চোখে চোখ রাখতেই, গুরুজী
পড়ে ফেলে তিতিরের মন,"মন খারাপ? মা এর জন্য?"
তিতির মুখ নিচু করে বসে থাকে,নখ দিয়ে
নিজের আধখোঁটা নেলপালিশ খুঁটতে খুঁটতে শুধু বলে ওঠে,"আজ জন্মদিন মা এর".. গুরুজী হাত বাড়িয়ে
কাছে টেনে নেয়, তিতির আস্তে করে মুখ তুলে তাকায়,দু- চোখে
উপচানো জল।
অন্যমনস্কই ছিল আজ সারা ক্লাশ ই,বেরোতে যাবে,হঠাৎ গলার
ওড়নায় টান,"আহ".. পেছন থেকে এক ঝটকায় দরজার হুকে
আটকে যাওয়া ওড়নাটা ছাড়িয়ে দেয় বিক্রম। খুব কাছাকাছি,মুখোমুখি বিক্রম কে দেখে,তিতির কি যে
বলবে কিছু ভেবে পাওয়ার আগেই, বিক্রমই বলে উঠল,"দেখে
যেতে হয় তো,এখুনি একটা এক্সিডেন্ট হত তো!" কি
অসম্ভব ভাল কন্ঠস্বর বিক্রমের। কি মায়া মাখিয়ে কথা গুলো বলল বিক্রম। তিতির ফ্যাল
ফ্যাল করে চেয়ে দেখছে বিক্রমকে, হঠাৎ ই সম্বিৎ ফিরতে, চোখ নীচু করে,খুব ধীরে,বলল,"থ্যাংকিউ"..
বিক্রম মুচকি হাসল,আর তারপর
তিতিরের ওড়নাটা হাতে গুটিয়ে ওর হাতে দিয়ে বলল,"এত মা মা করলে হবে? আমি তো মা এর
চেহারা টাও ভাল করে মনে করতে পারি না! তুমি তো অনেক লাকি,সেই
তুলনায়।" তিতিরের এবার মনে হল লজ্জায় ডুবে যায়,ছি: ছি: এসব কথা এ জানল কি করে! গুরুজি তার
মানে এসব কথা আলোচনা করে ছেলের সাথে।
সেই কোন ছোটবেলায়,বিক্রমের বছর
তিনেক বয়স হবে হয়ত,গুরুজীর স্ত্রী মারা যান,ক্যান্সার
হয়েছিল,শুনেছে
তিতির।গুরুজী অবশ্য প্রায়ই বলেন,যে সারাদিনের সব কথা ডাইনিং টেবিলে দুজন দুজনের সাথে তারা শেয়ার করেন।ছেলে আর
বাবার এরকমই অসম্ভব একাত্ম সম্পর্ক। তবে কি,সে সব কথার মাঝে তিতিরও থাকে। ভাবতে ভাবতেই
এক অদ্ভুত সংকোচ,ভাল লাগা সব মিলিয়ে,মিশিয়ে তিতির
দরজা দিয়ে বেরোতে যাবে,বিক্রম আবার পেছন থেকে ডাকল,"কাল
বাদে পরশু কম্পিটিশন,সর্ব ভারতীয় স্তর কিন্তু,ভীষণ শক্ত,অনেক ভাল
পার্টিসিপেন্ট। ঠিক করে নিজেকে গুছিয়ে নাও। অল দ্য বেস্ট.."
তিতির পিছন ঘুরে তাকালো,এক অদ্ভুত
ভাল লাগায় ভেতর অবধি যেন কেমন ভরে যাচ্ছে ওর। আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল,"থ্যাংকিউ"..
বিক্রম একগাল হাসল,কি উজ্জ্বল হাসিটা বিক্রমের "আসি"
বলে দরজার বাইরে পা রেখে কখন যে বাড়ির দরজা অবধি পথ,লোক সব ঠেলে পেরিয়ে এলো তিতির,তা যেন আজ
বুঝতেই পারল না সে কেমন একটা ঘোর,অদ্ভুত ঘোর কাজ করছে তিতিরের ভিতর। তারপরই
হঠাৎ সামনে সায়াহ্নার মুখটা ভেসে উঠল তিতিরের। রাতে ঘুম আসছে না আজ। বারবার কেমন
সিনেমার ক্লিপিংসের মত বিক্রমের সাথে কাটানো ওই ক'টি মূহুর্ত চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে বলার
নয়...
আজ ভোর থেকেই কেমন বাপি ছটফট
করছে। মা চলে যাবার পর থেকে ঠাকুর ঘরে ধূপ ধুনো বাপিই দেখায়। আজ বেরোতেই চাইছে না
ঠাকুরঘর থেকে। বারবার ফিরে যাচ্ছে ওই ঘরে।
তিতিরেরও বেশ কেমন অদ্ভুত একটা
চাপা টেনশন হচ্ছে। গুরুজীর সাংঘাতিক সুনাম আছে এই সর্বভারতীয় প্রতিযোগীতার স্তরে।
গত দু বছর সেই সম্মান সায়াহ্না বজায় রেখেছে,লাগাতার প্রথম হয়ে,দুটি আলাদা
আলাদা বিভাগে। এবার আর সায়াহ্নার নাম তাই দেওয়াই গেল না,প্রতিযোগী
হিসাবে। এবার গুরুজীর সম্মান তিতিরের হাতে। পারবে তিতির? কি ভীষণ শব্দ
হচ্ছে বুকের ভিতর।
‘এবারের প্রতিযোগী তোর্সা রায়।'..তিতিরের
ভাল নাম তোর্সা। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের নাম টা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন পা এর
পাতা ঘামছিল তিতিরের।উল্টোদিকের উইংসে চোখ পড়তেই,কেমন অজান্তেই একগাল হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠল
তিতির,'বিক্রম'বুড়ো আঙুল
তুলে, 'অল
দ্য বেস্ট'দেখাচ্ছে। জিন্স আর পাঞ্জাবীতে কি ভীষণ ভাল
লাগছে বিক্রমকে। তিতির মঞ্চে উঠেই দেখল সামনের রোতেই সায়াহ্না গুরুজীর পাশে। কি
গর্বিত। একদিন ক্লাশে একটা ঠুমরির বোল তিতিরের গলায় শুনে গুরুজী বাহ বাহ করে ওঠায়,সায়াহ্না
একটা অদ্ভুত রাগান্বিত স্বরে গুরুজীকে বলেছিল,"আগে গুরুজী এত অল্পে প্রশংসা করতেন না,কারোর,আজকাল বুঝি
এটা নতুন!!" ভাবতে ভাবতে কেমন আরো অবশ হয়ে আসছিল তিতিরের হাতের আঙুল গুলি।
তানপুরা তুলে,সুর ধরে,দু চোখ বুজে ফেলল,তিতির,ওমা,কি অদ্ভুত,সামনে শুধুই
বিক্রমের মুখ। এবার গলার সব মধু ঢেলে দিল উজাড় করে। তার আজকের রাগ,'জয়-জয়ন্তী’।
একে একে বিলম্বিত,আলাপ,দ্রুত,তান সব
সুন্দর করে পরিবেশন করে তিতির যখন চোখ খুলল, মনে হল এক সপ্ত-ডিঙার পথ যেন সাদা ফেনালো
মুক্ত ঢেউ এর উপর দিয়ে বিক্রমের হাত ধরে পেরিয়ে এল সে। করতালির আওয়াজে স্পষ্ট তার
গান ভাল লেগেছে সবার।
অডিয়েন্সে নেমে গুরুজীকে প্রণাম
করছে,এমন
সময় সায়াহ্না বলে উঠল,"দু জায়গায় সুর নড়েছে। গলা এত দুলছিল কেন
তোমার?"
বেশ ঝাঁঝিয়েই বলে উঠল সায়াহ্না।
গুরুজী বেশি কথার লোক নন,আদর যখন
করলেন না,ও
সায়াহ্নার বক্তব্যে অসম্মতিও জানালেন না,তখনই বুঝে নিল তিতির গান তেমন ভাল হয় নি।
খুব কান্না পাচ্ছিল তিতিরের। কেমন
গরম হয়ে আসছিল কানের চারপাশ।
আজই ওবেলা ফলাফল ঘোষণা করে দেবে
ইনারা।
বাপির পাশে গিয়ে চুপটি করে বসে
রইল,তিতির।
বাপি শুধু চেয়ে বলল,"পরে আরো ভাল হবে, কষ্ট পাস
না"..
এবার তিতিরের চোখ থেকে টপ টপ করে
জল পড়তে লাগল। কোলের কাপড় টা কেমন ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ ই পাশের অচেনা মেয়েটি ডাকছে
তিতিরকে,চমকে
তাকালো তিতির,এই রে কান্না বুঝে ফেলেছে বুঝি,তাড়াতাড়ি
ঢোঁক গিলে,তাকাতেই মেয়েটি ইশারায় আঙুল দেখালো দূরে
দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রমের দিকে,বলল,"উনি ডাকছেন,আপনাকে".. বিক্রম দূর থেকে তাকিয়ে আছে,তিতিরের দিকে। মঞ্চে তখনও গান চলছে। বাপিকে বলে অন্ধকারে হাতড়ে বেরিয়ে এলো
তিতির। বিক্রম তিতিরের হাত টা ধরল,সটাং হলের বাইরে। তিতির হতবম্ভ। সব লোকই
প্রায় হলের ভিতর। বাইরের করিডোরে,একপাশে ক'টা চেয়ার পাতা,বিক্রম সেখানে এনে তিতিরকে দাঁড় করালো। এবার
ইশারায় বসতে বলে,নিজেও বসল পাশে।
এক মিনিটের নীরবতা,তারপর বলল,"প্রথম
হবার মত পারফরমেন্স হয় নি,আর এখানে দ্বিতীয় হতে তুমি আসোনি।"
তিতিরের কান্না ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল।
বিক্রম এবার নিজের রুমাল টা এগিয়ে
দিয়ে বলল,"তিতির,এত কাঁদলে,গলা বসে যাবে,কাল সকাল
দশটায় রেকর্ডিং। আলাদিনের এবারের এলবামে তুমি গাইছ। "
তিতিরের চোখের কাজল ঘেঁটে গাল
অব্ধি প্রায়,নাক টানতে টানতে,অদ্ভুত একটা
দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল বিক্রমের দিকে।
বিক্রম বলল,"কি
হল?হুম?"
তিতির অদ্ভুত স্বরে বলল,"সায়াহ্না
দি গাইবে না?"
বিক্রম ঠোঁটের ফাঁকে মুচকি হেসে
বলল,"তো
প্রবলেম টা ওখানে?"
তিতির বলল,"না,তা কেন!
এমনিই জিগ্যেস করছি,আমি তো সায়াহ্না দি'র মত ভাল গাই
না"
বিক্রম খুব কাছে এল তিতিরের তারপর
আলতো করে ওর চোখের জল গুলি মোছাতে মোছাতে বলল,"তুমি তোমার মত গাইবে,বুঝলে পাগলি? সায়াহ্না
গাইতে রাজি নয়,তুমি গাইলে,তাই ও গাইবে না,কারণ তুমি
গাইবেই।" তিতির একটুও বাঁধা দিচ্ছিল না বিক্রম কে,মনে হচ্ছিল
এই মূহুর্ত টা এমনি ঠিক এমনি থাক,কিন্তু শেষ কথাটায় চমকে উঠে বলল,"এমা,না না আমার
জন্য তোমাদের রিলেশন নষ্ট না হয়,বিক্রম দা"..
বিক্রম এবার তিতিরের হাত টা ধরল,তারপর গুছিয়ে
সেটা আরেকটা হাতের মধ্যে নিয়ে বলল," শোনো তিতির,সায়াহ্না আমার ভাল বন্ধু,ও গায় ও খুব
ভাল,ওর
নিজেরই একটা পরিচিতি আছে এখন,আমার সায়াহ্নার আজকের ঔদ্ধত্য টা ভাল লাগে
নি। সি শুড নট স্পিক টু ইউ ইন দ্যাট ম্যানার। এনি ওয়ে,সেটা ওর
রুচি। কিন্তু আমি অন্যায় কে অন্যায় ই বলি। আর তাই মানতে পারি নি। আর বাকি রইল
তোমার কথা। তুমি আমার কে! সেটা না হয় সময় বলুক.."
তিতিরের সমস্ত পরাজয়ের গ্লানি যেন
এক নিমেষে কোথাও উধাও। আর চোখ তুলে চাইতেই পারছে না তিতির,বিক্রমের
দিকে। বিক্রম বলল,"চলো,এবার ওঠা যাক,সেকন্ড প্রাইজ তো বাঁধা। আর সামনের বারের
ফার্স্ট প্রাইজ টাও। কি তাই তো?"বিক্রমের চোখ টপকে যেন এক উজানী ভালবাসার
স্রোত। তিতিরের চোখ ময় হাজার হাজার আলো,ঠোঁট দুটো কেমন অদ্ভুত আদুরে হয়ে উঠছে। উঠতে গিয়ে শাড়ির কুঁচি তে হোঁচট খেয়ে সামনে
পড়তে যাবেই ধরে ফেলল বিক্রম,তিতির আবার বলল,"থ্যাংকিউ"।
বিক্রম তিতিরের ঠোঁটে নিজের আঙুল
টা চেপে ধরল,আর বলল,"এই শব্দটা আর থাকবে না, আমাদের
ভেতর। আজ তুমি ফার্স্ট হলে হয়ত,আমার তিতিরকে
আমার পাওয়া হত না,মাঝে মাঝে হেরে যাওয়া ভাল তিতির"..
তিতির সেকন্ড এর প্রাইজ হাতে
স্টেজ থেকে নেমে আসছে,গুরুজী বলল,"সামনের বার "..
তিতির বলল,"হুম"..
গুরুজী তার পাশে তিতির,তার পাশে
বিক্রম। সায়াহ্না মঞ্চে এবারের প্রথম স্থানাধিকারীকে ব্যাচ পড়াচ্ছে। চোখে মুখে
গর্বের হাসি। তবু সেই হাসি কি ভীষণ ফিকে আজ তিতিরের হাসির কাছে। তিতিরের কষ্ট
হচ্ছে না তো কই ফার্স্ট না হতে পেরে!!
এখনও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে।
বিক্রমই ড্রাইভ করছে। গুরুজী আর বাপি পিছনে। সামনে বিক্রমের পাশে তিতির। সায়াহ্না
কে তিতিরের সামনেই এক গাড়িতেই যাবার জন্য বলেছিল বিক্রম, সায়াহ্না
শুধু বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,"এবারে আলাদিনের এলবাম সুপারহিট হবে তো বিক্রম?"
বিক্রম মুচকি হেসে সায়াহ্নার চোখে
চোখ রেখে বলেছিল,"জানিনা তো! শুধু জানি গাইলে তিতিরই গাইবে।
তাতে যদি সুপারহিট না হয়,আমার খুব দু:খ হবে না সায়াহ্না,যত দু:খ
তিতিরের অপমান মেনে নিতে হবে। আশা করি, বোঝাতে পারলাম।"
সায়াহ্না তিতির কে একবার
আপাদমস্তক মেপে নিয়েছিল শুধু।
এখন রাত প্রায় বারোটা। মোবাইল টা
ধরল তিতির,"ঘুমোও নি?"বিক্রমের গলার স্বরে কি ভীষণ আদর। যেন সোহিনী
রাগ ওর গলায় চুঁইয়ে পড়ছে।
তিতির বলল,"না, আসছে না
ঘুম।"
বিক্রম বলল,"বলেই
দিলাম বুঝলে..."
তিতির খুব উদগ্রীব হয়ে উপুড় হয়ে
শুয়ে,মোবাইল
টা অন্য কানে নিয়ে বলল,"কি?"
বিক্রম বলল,"এই
সায়াহ্না ফোন করেছিল,বলছিল,আমি নাকি তোমার প্রেমে পড়েছি।"
তিতির এবার বেশ রহস্যময়ী সুরে বলল,"কি!!!
তো,তুমি
কি বললে?যা:
উনাকে বলো,এসব কিছু নয়।"
বিক্রম বলল,"সেকি!!
কেন মিথ্যে বলব কেন?আরে ওকে আমি ১০০ তে ১০০ দিয়েছি।"
তিতিরের মনে হচ্ছিল,তাকে যেন
হাজারো শিবরঞ্জনীর আলাপ ঝাঁকে ঝাঁকে ঘিরে ধরছে।
"এবার
ঘুমোতে হবে যে,কাল সকাল ৯টায় হাজির হয়ে যাব,কেমন..."
বিক্রমের চুমুর শব্দ কানের পর্দা ভেদ করে তিতিরের মনের দেওয়াল অনুরণনে তোলপাড় করে
দিতে লাগল।
তিতির বলল,"গুড
নাইট"।
এখন সকালের অপেক্ষা। চোখের সামনে
সুরে সুরে ভেসে আসা বিক্রমের একাকার ভালবাসা। তিতিরের বুকে এক বিশ্বাসী ছায়া শুধু
দুলছে আর দুলছে। কাল ভৈরবী ভোরে তাদের দিগন্ত পথ চলা আরো আরো আরো সুরেলা হয়ে উঠুক
শুধু এই একটিই ছন্দ আজ রাতের বৃষ্টি জুড়ে....
-------------***------------------------------
[সুমনা পাল ভট্টাচার্য্য]
দারুণ 👌
ReplyDeleteঅসাধারণ দারুন লাগলো
ReplyDeleteDurdantoo lekhoni tomar..Onobodyo..mone prane bhoriye dile..
ReplyDeleteভালো লাগলো...
ReplyDeleteভালো লাগলো...
ReplyDelete