Art of leaving...
কাদম্বিনী মরিয়া
প্রমান করিয়াছিল সে মরে নাই, আর আমরা বাঁচিয়া থাকিয়া প্রমান করিতে চাই
আমরা মরি নাই। অমিতাভ বচ্চনের সেই বিখ্যাত
ডায়লগটা নিশ্চই মনে আছে – “এয়ে জিনাভী কই জিনা হ্যায় - লাল্লু”, সত্যি একে কী বেঁচে থাকা বলে, এর
চেয়ে হয়তো মরে যাওয়াই ভালো তাই প্রশ্ন জাগে Art of living জানা জরুরী, নাকি Art of leaving জানা বেশি জরুরী। Art of living ওতো জন্মের সাথে সাথেই মানুষ এমনকি জন্তু-জানোয়ারও শিখে ফেলে, কারণ
Struggle for existence and the survival of the fittest
is the law of evolution, তাই
এটা আলাদা করে শেখার তেমন দরকার হয়তো পড়ে না। আর সত্যি বলতে কি, অনেক
সময় অনেকের কাছে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর সেখানে আর্ট আসবে কোথা থেকে। তাই আমার মনে
হয় বেঁচে থাকার আর্টের চেয়ে সায়েন্স জানা বেশি জরুরী। শুধুমাত্র উন্নত সায়েন্সই
পারে আমাদেরকে সুস্থ-সবল ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে। তবে তাতেও যে খুব একটা লাভ হয় তাও নয়, নইলেতো
সবাই অমর হয়ে যেতো। তাছাড়া বেশিদিন বেঁচে থেকেই বা কী লাভ, “বেঁচে
থাকা সাস্থ্যর পক্ষে ক্ষতিকর” - কারণ বেশিদিন বেঁচে থাকলে সাস্থ্য ভেঙ্গে
পড়বে, শরীরের
সবকিছুই শিথিল হয়ে আসবে তারপর নানান রোগ, ব্যাধি দেহের সমস্ত জমি অধিগ্রহন করে বসে
থাকবে, আর
জমি বাঁচাও কমিটির মত কোন সংগঠনও এগিয়ে আসবে না আপনাকে সাহায্য করতে। মাঝে-মধ্যে
পুলিশ-রুপী ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ওনারা শুন্যে কয়েক রাউন্ড গোলাগুলি চালিয়ে জমি
অধিগ্রহন-কারীদেরকে ভাগানোর চেষ্টা করবেন বটে, তবে তাতে সাময়িক কাজ হলেও আখেরে লাভ কিছুই
হবে না, ঐ গোলি খেয়েই সারাটা জীবন কাটাতে হবে। এতো গেলো শারীরিক অসুস্থথতার কথা
সেইসঙ্গে চলবে মানসিক নির্যাতন যা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো আপনাকে জ্বলিয়ে
পুড়িয়ে মারবে, অথচ করার কিছুই নেই আপনি দিনদিন সংসারে অপাংক্তেও হয়ে পড়বেন। আর অন্যের গলগন্ড
হয়ে বেঁচে থাকা যে কতটা কষ্টকর যে ভুক্তভোগী সেই শুধু জানে, তখন
আপনার মনে হবে এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। কিন্তু আপনি চাইলেই যে পেয়ে যাবেন এমনতো
নয়, উপরে
যাওয়ার টিকিট পাওয়া অতো সহজ নয়, লম্বা লাইন প্রচুর ওয়েটিং লিস্ট। ট্রেনের
টিকিটের মতো ওখানেও ততকাল ফেসিলিটি অর্থাৎ অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথের ব্যবস্থা আছে বটে
তবে তার বুকিং ভগবান নিজেই করেন, ইউজারকে এ সুবিধাটা দেননি। কিছু লোক
মাঝে-মধ্যে ভগবানের ওয়েব-সাইট হ্যাক করে নিজেরাই ততকাল বুকিং করে আত্মহত্যা করার
চেষ্টা করেন বটে, তবে সেটা সবাই পারে না, তাই ও নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। তাছাড়া
ঐভাবে হ্যাক করা ততকাল টিকিটে যদি বাই
চান্স ওয়েটিং লিস্ট হয়ে যায় তাহলেতো আরো ঝামেলা, সারাজীবন আধমরা হয়ে রয়ে যেতে হবে। একেক সময়
মনে হয় ভগবান যদি বুকিং ফ্যাসিলিটিটা মানুষের হাতে ছেড়ে দিতেন তাহলে হয়তো ভালো হতো, আমরা
আমাদের ইচ্ছে মতো ফেরার টিকিটটা কেটে নিতে পারতাম। কিন্তু পরক্ষণে ভেবে দেখি সেটা
হলে আর দেখতে হতো না, একটু বুড়ো হলেই ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনরাই
চাঁদা করে টিকিট কেটে উপরে পাঠিয়ে দিতো, ঘটা করে see off ও করে আসতো, তবে তাতে হয়তো আখেরে আমাদের লাভই হতো, বুড়ো
বয়েসে ভোগান্তিটা কম হতো।
বেশ কয়েক বছর আগে
একবার এক জ্ঞানী-গুনী মহারাজের ‘সেলফ ম্যানেজমেন্ট’ সমন্ধে
লেকচার শুনেছিলাম, সেখানে উনি বলেছিলেন নিজেকে সব কিছু থেকে ditach করতে শেখো, জীবনে যা কিছু দুঃখ সবই মাত্রারিক্ত attachment এর
জন্য। নিজেকে attachment আর detachment এর মাঝখানে দেওয়ালের মতো ভাবো, দেওয়াল
কোনো কিছুকে আকর্ষণ করেনা বরং দূরে সরিয়ে রাখে। মনে মনে ভাবলাম কে বললো আকর্ষণ করে
না, প্রাকৃতিক
বেগের সময় বাস-স্টান্ডের ঐ নোনা-ধরা দেওয়াল যে কতটা আকর্ষনীয় তা সব ভুক্তভোগী
জানেন। তাছাড়া ভোটের আগে দেওয়াল সব পার্টিকেই আকর্ষিত করে। পরে ব্যাপারটা একটু
ভেবে দেখলাম যে উনি ঠিকই বলেছেন, দু-ক্ষেত্রেই আমরা দেওয়ালের প্রতি আকর্ষিত হই
বটে কিন্তু দেওয়াল আমাদেরকে আকর্ষণ করে না। সেই দিন থেকেই Art of leaving এর আইডিয়াটা আমার মাথায় জাগে। সেই প্রবচন থেকে এটুকু বুঝেছি যে আমাদের জন্ম হয়
একদম খালি হাতে তারপর স্নেহ-মমতা, কামনা-বাসনা, ভালোবাসা আর মোহোর নানান বন্ধন অর্থাৎ attachment আমাদেরকে
আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে। আমাদের বয়েস যত বাড়তে থাকে attachment আরো
বাড়তে থাকে, শেষপর্যন্ত্য তা এতটাই বেড়ে যায় যে, অপাত্যস্নেহ, টাকা-পয়সা, লোভ-লালসার মোহে আমরা অন্ধ হয়ে পড়ি, আমাদের
স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধিও লোপ পেতে থাকে, আমরা ভুলে যাই - “জন্মিলে
মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে”। আসলে
আমরা সাংসারের যাবতীয় জিনিষ শুধু attach করতে শিখেছি কিন্তু ditach করতে
শিখিনি। কোনো কিছু ধরা খুবই সহজ, কিন্তু ছাড়তে পারাটাই কঠিন কাজ। বয়েসের সাথে
সাথে অনেক কিছুই ছাড়তে হয় বা ছাড়া শিখতে হয়, সেই জন্যেই বোধহয় আগেকার কালে বানপ্রস্থর
ব্যবস্থা ছিল, তারই আধুনিক ও অফিসিয়াল সংস্করণ বোধহয় আজকের এই অবসর গ্রহনের ব্যবস্থা। সব
কিছুরই একটা প্রাইম টাইম থাকে আর সেটা সঠিকভাবে বুঝতে হয় এবং সেইমত নিজেকে ধীরে
ধীরে সরিয়ে নিতে হয়, সবকিছুকে আগের মতো আঁকড়ে ধরে রাখা চলবে না, পুরনোকে
ছেড়ে নতুনকে জায়গা করে দিতেই হবে এটাই জীবনের নিয়ম। আর সেটা করতে হলে আপনাকে art of leaving জানা বেশি দরকার, ঠিক কখন কি ভাবে আপনি নিজেকে সব কিছু থেকে ditach করে
নেবেন সেটাও একধরনের আর্ট, যেটা শেখা খুব জরুরী। আর যারা এটা ঠিকমত করে উঠতে পারবেন না তাদেরকে
নানান ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে। এই যে শাশুড়ি-বৌ-এর চিরাচরিত তিক্ততা তার অন্যতম
কারণ এই art of leaving না জানা।
যেহেতু আমাদের সংসারে অবসরের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই তাই শাশুড়ি কখনই তার
দায়-দায়িত্ব বৌকে হস্তান্তর করার কথা চিন্তাই করেন না যতদিন না তিনি শারীরিক
কিম্বা মানসিক ভাবে অক্ষম হচ্ছেন। আর ওয়ান ফাইন মর্নিং হঠাৎ করে সংসারের সব
গুরু-দায়িত্ব বৌ-এর পক্ষে নিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়, ঝামেলার সূত্রপাত সেখান থেকেই। সুতরাং সার কথা হোল এই যে, মানুষকে
সরে দাঁড়াতে হবে তখন যখন তিনি কোন কিছুর শিখরে থাকবেন, কেলিয়ে
যাওয়ার পর ছেড়ে আর কোন লাভ নেই, তাই মানুষের জীবনে ditachment টা
খুব জরুরি। আবার এটাও ঠিক যে সংসার টিকে
থাকে attachment এর উপর ভর করেই। এতো মহা মুস্কিল attachment ও চাই আবার
ditachment ও জরুরী, তা কি করে সম্ভব, তার
মানে আমাদেরকে এ দুটোর মধ্যে ব্যালান্স করে চলতে হবে। জীবনে চলার পথে নানান রাকমের
attachment আসবে আর সেটাকে কাউন্টার অ্যাটাক করতে হবে ditachment করে, এর জন্য art of leaving জানা খুব জরুরি। কতটা ছাড়বো আর কতটা ধারবো
সেটার কোন সঠিক মাপ নেই, অনকেটা তরী-তরকারিতে নুনের পরিমানের মতো। যে
কোন রান্নার রেসিপিতেই সব কিছুর পরিমান নির্ধারিত থাকে, শুধু
নুনের পরিমানটা বলা হয় স্বাদ অনুযায়ী, যা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের
পছন্দ অপছন্দের উপর, তাইতো পৃথিবীতে এত রকম মানুষের ভিড়।
অতএব মোদ্দা কথা হলো
বৈচিত্র্যময় এই জীবনকে উপভোগ করতে হলে art of living এর চেয়ে art of leaving জানাই বেশি জরুরী, আর
এই art of leaving ই art of giving এরই নামান্তর মাত্র।
[অলোক ভঞ্জ]