খোদ
গুরু
রাতের কলেজে ক্লাশ শুরু হতেই
বিকেলের ট্যুশানি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সকালে একটা ট্যুশান, তারপর দিনের
বেলায় এখানে ওখানে। বিকেল হতেই কলেজ মুখো। এবার রাতের কলেজ শেষ। আর দমবন্ধ করা
রাতের কলেজে না। দিনের কলেজে ভর্তি হতেই হবে। প্রস্তুতি নিতে থাকি। একই সঙ্গে লেগে
থাকি সাংবাদিকতার প্রস্তুতিতে। কি করে সাংবাদিক হতে হয়? সাংবাদিকরা
কী করে? কী
ভাবে সারা পৃথিবীর খবর পৌঁছে যায় তাঁদের হাতে? এ সব অনুমান করতে পারলেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে
পারি না। বুঝি,এজন্যেই যুগান্তরের সেই নিউজ এডিটর বলেছিলেন,খবরের কাগজের
অফিসের চারপাশে দেখে দেখেও নিজের ভেতরে একটা প্রস্তুতি তৈরি করা যায়। যুগান্তরে
এরপর গেছি কয়েকবার,কিন্তু ওভাবে হয় নাকি? নিউজ এডিটর
আমাকে খুব আদর করে বসতে টসতে দিতেন তা তো নয়। চোখের পাশে মণি টেনে এক দুবার
দেখেছেন,এই
যা। যুগান্তরে যাবার আগ্রহটা এভাবেই একসময় কমে যায়,তবে সাংবাদিক হবার আগ্রহটা এসব থেকে বেড়ে যায়,জিদ ধরে নেয়
যেন। স্টেটসম্যান ছাড়া কোন কাগজ পড়ি না। ছোটবেলায় দাদা বলতেন,ইংরেজি শিখতে
হলে স্টেটসম্যান পড়তেই হবে। জানি না কেন,আমাদের ছোটবেলায় এই কথাটা খুব চালু ছিল।
অন্যদের মুখেও শুনতাম। স্টেটসম্যানের
প্রতি আমার দুর্বলতা সে কারণেও হতে পারে।
আমি এস্প্লানেডে ইউএসআইএস
(আমেরিকার তথ্য সংস্কৃতির) লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলাম। এখন
মেট্রপোপলিটান বিল্ডিঙ্গসের একতলায় যেখানে কটেজ ইন্ডাস্ট্রির এম্পরিয়াম সেইখানে
ছিল লাইব্রেরিটা। সুরেন ব্যানার্জী ড়োডের দিকে পুরোটা কাঁচের দেয়াল। পাশ দিয়ে
প্রবেশ। ঝকঝক করত ভেতরের সুসজ্জিত লাইব্রেরি,রিডিং কর্নার। বাইরে থেকে দেখলেই ইচ্ছে করত
ঢুকে পড়ি। লাইব্রেরির সুন্দর এয়ারকন্ডিশন্ড পরিবেশটাও আকর্ষণ করত আলাদাভাবে। ওখানে
গেলে নিজেকে এক অন্য পরিবেশে পেতাম। সাংবাদিকতার ওপর প্রচুর বই। আমেরিকার নানা
কাগজও থাকত সেখানে। আমেরিকায় তখন চলছে হিপ্পি সমস্যা। তা নিয়েও কত বই। কী করে এই
সমস্যার মোকাবিলা করা যায় সেই সবের আলোচনা। আমার অবশ্য আগ্রহ ছিল জার্নালিজমের
র্যাকগুলোর চারপাশে। কত ঘটনা পড়তাম। উৎসাহিত হতাম। নিজে থেকেই একটা খবর নিয়ে খবরের
কাগজের অফিসে ঢুকে পড়েছিল একটি ছেলে,তাঁর 'নোজ অফ নিউজ'টের পেয়ে বিখ্যাত সেই কাগজ তাকে রিপোর্টারের
চাকরিতে জুড়ে দেয়। চাকরি পেয়ে যায়।পরে বড় সাংবাদিকও হয় সে। আমিও ভাবতাম,একদিন আমিও
এভাবেই হয়ে যাব এক মস্ত সাংবাদিক।
ইউএসআইএস লাইব্রেরি থেকে দুটি
মন্ত্র শিখে ফেললাম,যা আজো আমার লেখালেখির জীবনমন্ত্র হয়ে আছে।
এক,একজন
সাংবাদিক পৃথিবীর সবকিছুর ৫% জানবে,আর জানবে বাকি ৯৫%তথ্য কী করে সংগ্রহ করতে হয়,এবং দুই,পৃথিবীর
যেকোন ঘটনা,এমন কি কেনেডি হত্যাও,৩০০ শব্দের
মধ্যে পরিপূর্ণভাবে রিপর্ট করা সম্ভব। আমি ক্লাশ টেনে পড়ার সময় থেকেই ডায়রি লিখতাম।
এপারে এসেও আমার ডায়রি লেখা চলছিল। বছর ঘুরতেই একটা ডায়রি কেনা ছিল আমার প্রথম
প্রেফারেনস। এই দুই মন্ত্র আমার দিনপঞ্জী লেখাকে আমূল পাল্টে দিল। আমার দিনপঞ্জী
ধীরে ধীরে পাল্টে গেল দিনমনোপঞ্জীতে। অনেকটা আজকালকার ফেসবুকের পোস্টের মত। আমার
ডায়েরিতে শুধু ঘটনা না,জায়গা পেতে থাকল,ঘটনার পটভূমি,কখনো সখনো
পটভূমির পটভূমি। কিন্তু সব সীমিত শব্দের মধ্যে। ডায়রির একটি মাত্র পাতায়। তা দুটোই
হোক বা চারটে বা একটি মাত্র ঘটনা। আমার পড়াশুনো,আমার মেলামেশা,আমার সন্ধান সব এভাবেই হয়ে উঠল ক্যাপশ্যুল।
ফাটলেই তা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাইকোন নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের গভীরে ঢুকে
নিজেকে খোশমেজাজে পাচ্ছিলাম না। এক নয় বহুতে প্রবেশ করে আমার তখন দিশাহারা অবস্থা।
আমার তো গুরু নেই,নিজেকেই গুরু মেনে শাসন করতে থাকি নিজের
ইচ্ছারই আতিশয্যকে। এভাবে মাসখানেক যেতে না যেতে নিজেকে রীতিমত একজন তৈরি মানুষ
বলে মনে করতে লাগলাম।
বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় তখন
টেবিলে ঝুঁকে একটা লেখা পড়ছিলেন। সেই কিংবদন্তী সম্পাদক, নিতাইদা
ভারতে আসার প্রথম দিনেই যাঁর কথা বলেছিলেন,সেই বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। আমি এতদিনে
তাঁকে জেনেছি,চিনেও ফেলেছি কিছুটা। জেনে গেছি,সাংবাদিকতার
এক মহীরূহ তিনি। যুগান্তর ছেড়ে দিয়েছেন। এখন বসুমতীর সম্পাদক। বউবাজারের বসুমতী
সাহিত্য মন্দিরের কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে,ভেতরে,ডানদিকে সম্পাদকের ঘর। বাধা দেবার মত কোন
পিওন টিওন ছিল বলে এখন মনে পড়ছে না। মাথা তুলে আমাকে নীরিক্ষণ করলেন,'বলো? কী জন্যে
আসা?''আমাকে
যদি বসুমতীতে কোন কাজ দেন।'আমাকে আবার নীরিক্ষণ করলেন,এবার
আপাদমস্তক। ঘাবড়ে যাই। বেঁটেখাট মানুষ। শ্যামলা গায়ের রঙ। চোখে চশমা ছিল? মনে পড়ছে না।
চোখ দুটো ছোট, কিন্তু তীক্ষণ,জ্বলজ্বলে। 'ওঁর সঙ্গে কথা বলো। মুৎসুদ্দি, দেখো তো। কথা
বলো।'দরজার
পর্দার ভেতর-পাশেই,একটা টেবিল চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন মুৎসুদ্দি।
কি কথা হল,ডিটেইল মনে নেই। এর মধ্যে একজন সুপুরুষ মানুষ
ঢুকলেন। আকর্ষণীয় মানুষ। টুকটুকে গায়ের রঙ,কাটা কাটা মুখাবয়ব,ঝাকড়া চুল,সদাহাস্য।
মুৎসুদ্দি আমাকে বললেন,'তুমি, জীবনের সঙ্গে কথা বলো।' বলে
বিবেকানন্দবাবুর টেবিলের দিকে তাকালেন। সুপুরুষ আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। কাঠের
সিঁড়ির মুখে। দুদ্দাড় শব্দে লোক ওঠানামা করছে,তারই মধ্যে সব শুনে বললেন,'অরুণ,প্রি-ইউনিভার্সিটি
ইজ নট এনাফ। কম করে গ্রাজুয়েট হতেই হবে। সেটা করে আমার সঙ্গে দেখা কোর। প্রমিস।
তোমাকে নেয়া হবে।'আমি ততদিনে একই রকম বোকা নই আর। গ্রাজুয়েট
মানে আরো তিন বছর। মনে মনে বলি,'আপনি তখন থাকবেন তো এখানে, জীবনদা?' বুঝি,সবখানের বাংলা
সাংবাদিকতা এক অলক্ষ সুতোয় গাঁথা। আমেরিক্যান লাইব্রেরি থেকে শিখেছি,এই গ্রাজুয়েট ফ্রাজুয়েট সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে
কোনই প্রয়োজনের ব্যাপার না। 'চলি' বলে আমি দুদ্দাড় শব্দ তুলে বসুমতীর বাইরে এসে
দাঁড়াই। তখন বউবাজার স্ট্রিটে জনস্রোত,উল্টো স্রোত। গলগল করে ছুটছে ডালহৌসি টু
শিয়ালদা। আমিও শিয়ালদামুখো স্রোতটায় জড়িয়ে যাই। সোজা আমজাদীয়ায়।
আমজাদীয়া আমার ভাবনার ঘর। আমার ঐ
ছোট্ট ইউরিন্যাল-কাম-বেড-কাম-টি রুমে পড়াশুনা চলে,
ধ্যান-ভাবনা চলে না। কয়েকদিন ধরেই
দিশাহারা লাগছিল। আমজাদীয়ায় টেবিল-সারির শেষ প্রান্তে,কেবিনের গা
ঘেঁষে ছিল তিন চেয়ারের একটা টেবিল। আমি বসতাম সিঙ্গলে,লম্বা
রেস্ট্যুরেন্টার এনট্রানসের দিকে মুখ করে। রেস্ট্যুরেন্টের সবাই জানত,ওটাই আমার
বসার জায়গা। খালিও পেতাম প্রায়ই। এক কাপ বা বেয়ারা ফরিদের বরাদ্দের অর্ধেক কাপ চা
নিয়ে কাটাতাম যতক্ষণ খুশি সময়। ওরা সবাই আমাকে কেন যেন ভালোবাসত। বিশেষ করে ফরিদ।
ওর কথা নানা জায়গায় লিখেছি,এখানে আবার লিখব এক সময়। জীবনলাল
বন্দ্যোপাধ্যের সঙ্গে কথা বলার পর কেন যেন মুখটা তেতো হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে একটা
জিদের শিং-নাড়া টের পাচ্ছি। একদিন চায়ের কাপটা এগিয়ে কাঁধের গামছায় হাত মুছতে
মুছতে ফরিদ বলে,'কই দিন সে হারুণবাবুকো দুঃখী দেখনে মিল রহা
হ্যাঁয়। খরিয়ত হ্যায় না সাহাব?'বলি,'দুঃখী না ফরিদ মিঞা, বহত উলঝন মেঁ
ফাঁস গয়া।'ফরিদ এরকম সময় কথা বাড়ায় না সাধারণত। অন্য
টেবিলে অর্ডার নিতে চলে যায়।
সত্যি,মহা উলঝনে
ফেঁসেছি আমি। একটা কাজ পেলে,চারপাশটা ঠিক হয়ে যায়। আমার স্বপ্নের জীবন
কাছে আসে,শঙ্কর্দা
মুক্তি পান,আমি নিজেকে আরো পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠাও
দিতে পারব এই মহানগরীতে। মা'কে লিখতে পারব,'মা আমি পারি। আমি পেরেছি।'সেই পারাটাই
হচ্ছে না। চাকরি কি আর পেতে পারি না একটা?পেতেই পারি। রেলে,ব্যাঙ্কে,সরকারি দফতরে,কোন প্রাইভেট
ফার্মে। পারি। আমাকে তো অফিসার করবে না কেউ। নিজেকে টেনে ছড়িয়ে তো নিয়ে যেতে পারব!
কিন্ত্রু সে কথা ভাবতেই ভয়ের স্রোত তিরতির বইতে শুরু করে। তা করব কেন? আমার
সাংবাদিকতার কী হবে তবে? আমি জীবন-লোভী মানুষ,ছোটবেলা
থেকেই। অল্প বয়স থেকেই যতই মঞ্চে মঞ্চে গান গাই,নাচি,আবৃত্তি করি,নাটক করি,দলবেঁধে ফাংশন ভন্ডুল করি, মারামারি
করি-- সবই একটি দারুণ জীবনের লোভে। এখুনই যে-কোন চাকরি নিলে আমার সব হবে একদিন,জানি। কিন্তু
কোনদিন সাংবাদিক হওয়া হবে না, তাও জানি।
একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে
ইংরেজিতে ডায়রি লিখতে শুরু করি। গুলি মারো বাংলা সাংবাদিকতাকে! আমেরিক্যান
লাইব্রেরিতে সকাল সকাল পৌঁছ যাই। টিফিন টাইমের পরে অন্য কাজ। এস্প্লয়ানেড থেকে
ফেরার পথে প্রতি সোমবার কিনে আনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রবিবারের দিল্লি এডিশন।
সাংবাদিক আমাকে হতেই হবে। বাংলা না হোক ইংরেজিতেই। এবং গ্রাজুয়েশনের আগেই।
সাংবাদিক হওয়ার অপেক্ষায় তিনটি বছর বইয়ে দেবার মত সময় তো আমার হাতে নেই...
-----------------------
(চলবে)
[অবুণ চক্রবর্তী]