কত্থক
নৃত্যের ইতিকথা
আমাদের
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের জড় ছড়িয়ে আছে সুবিস্তৃত উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। শাস্ত্রীয় নৃত্যে আট প্রকারের নৃত্য
(যা আমাদের সকলেরই হয়ত চেনা) সরকারী স্বীকৃতি পেয়েছে। সেগুলি হল ভারতনাট্যম, কত্থক, কুচিপুরি, ওড়িশী, কথাকলি, সত্ৰীয়া, মণিপুরি, মোহিনীঅট্টম। এর মধ্যে কত্থক নৃত্যটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের
মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রধানত উত্তর ভারতের এক যাযাবর সম্প্রদায় থেকে এটির
উদ্ভব।
"কত্থক" কথাটির উৎপত্তি বৈদিক
সংস্কৃত শব্দ "কথা" থেকে, আর "কথক"
মানে যিনি কথার মাধ্যমে গল্প বলে শোনান।
প্রাচীনকালে কয়েকটি সম্প্রদায় বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্য বর্ণনা নৃত্য ও গীত দ্বারা পরিবেশন করত। এসব
সম্প্রদায়গুলি কথক, গ্রন্থিক,
পাঠক
ইত্যাদি। সবকটির মধ্যে কথক একটি বিশেষ স্থান আজও অধিকার করে রয়েছে। কত্থক নৃত্যে
প্রধানত রাধা কৃষ্ণের লীলা কাহিনীই রূপায়িত হয়। এছাড়াও দেবাদিদেব শিবেরও রুদ্র
মূর্তির প্রকাশ পায় এই নৃত্যে। কত্থক দুটি
প্রকার - একটি তাণ্ডব ও দ্বিতীয়টি লাস্য। তাণ্ডব অংশটিতে ভাগবান শিবের রুদ্র রুপের
প্রকাশ ও তাঁর ধ্বংসলীলা ব্যাখা করা হয়। আর
লাস্য হল শান্ত প্রকৃতির, যেখানে অভিনয় ও বিভিন্ন
অঙ্গ-ভঙ্গিমার মাধ্যমে কাহিনীর ভাবকে ব্যক্ত করা হয়।
কত্থক নৃত্যে মোট বারোটি পর্যায়। তবলা বা
পাখোয়াজের লহরায় তাল নির্ভর নৃত্য পদ্ধতিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বারোটি পর্যায়ে
রয়েছে সেলামি বা প্রণাম, আমদ, ঠাট, নটবরী, পরমেলু, পরণ, ক্রমলয়, কবিতা, তোড়া ও টুকরা, সংগীত ও প্রাধান।
প্রারম্ভিক পর্যায়ে থাকে গণেশ বন্দনা ও আমদ। নটবরী অংশে তাল সহযোগে নৃত্য
পরিবেশিত হয়। পরমেলু অংশে বাদ্যধ্বনীর সাথে নৃত্য পরিবেশিত হয়।পরণ অংশে বাদক বোল
উচ্চারণ করে ও নৃত্যশিলপী পায়ের তালে তার জবাব দেয়। এরপর তবলা বা পাখোয়াজের
সাথে নৃত্য পরিবেশিত হয়। ক্রমানবয়ে বিলম্বিত ও পরে দ্রুত তালের সাথে নৃত্য
পরিবেশিত হয়। করতালি দিয়ে তাল নির্দেশ করাকে বলে প্রাধান।
কত্থক নৃত্যশৈলটি তিনটি ঘারানার মধ্যে বিস্তৃত-
জয়পুর, বেনারাস ও লখনউ। এই নৃত্যটি বিশেষত গড়ে
উঠেছে বোল, তৎকার (পায়ের কাজ), অভিনয়, মুদ্রা, মুখের ভঙ্গিমা ও শরীর -হাত -পা চালনার মধ্যে দিয়ে। জয়পুর
ঘরানায় দেখা যায় দ্রুতপদসঞ্চালন বা পায়ের কাজ আর লখনউ ঘারানায় পরিস্ফুট
হয় চেহারার অভিব্যক্তি। এছাড়া আরও
একটি ঘরানা যেটি এই তিন ঘরানারই সংকুচিত রূপ যা রায়গড় ঘরানা নামে পরিচিত। কিন্তু
এই ঘরানাটি সেভাবে পরিচিতি পায়নি। কত্থক নৃত্যের প্রধান পোশাক গোড়ালী পর্যন্ত পেশোয়াজ নামক এক ধরণের
সিল্কের জামা ও চুড়িদার পাজামা। জনপ্রিয় এই নৃত্যটি হিন্দু ও মুসলিম, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই সমান ভাবে জনপ্রিয় আর তাই এর
পোশাকেও কিছু বৈচিত্র্য দেখা গেছে। প্রথমটিতে একটি ব্লাউজ ও ঘাগরা জাতীয় স্কার্ট
(যা গোড়ালির উপর পর্যন্ত থাকে - যাতে পদ-সঞ্চালন সহজে দেখা যায়) ব্যবহৃত হয়, আর তার সাথে একটি ওড়না যা বাঁ কাঁধ ও মাথার উপর দিয়ে সামনে
আসে। দ্বিতীয় ধরনটিতে দেখা যায় সালওয়ার
কামিজ সহযোগে ওড়নার ব্যবহার। উজ্জল
প্রসাধন এবং অলংকার ও ব্যবহৃত হয়। আর এর সাথে থাকে ঘুঙরু, যা সমস্ত নৃত্যটি কে এক অভিনব মাত্রা দেয়।
যাঁদের
হাত ধরে এই নৃত্যশৈলটি আজকের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, সেরকম
বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিত্ব হলেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ,
যিনি
শ্রী অচ্যুত মহারাজ এর একমাত্র পুত্র ও শিষ্য। বিরজুজী লখনউ ঘরানায় নৃত্যের জন্য
বিখ্যাত। সম্প্রতি তিনি “বাজীরাও মাস্তানি” নামে হিন্দি সিনেমাটিতেও নৃত্য পরিচালনা করেছেন । এছাড়াও
কুমুদিনি লাখিয়া, মালাবিকা মিত্র, মনিশা গুল্যানি, শোভনা নারায়ণ, সিতারা দেবী এনাদের নাম ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আমাদের এই শাস্ত্রীয় নৃত্যের খ্যাতি যে শুধু
ভারতবর্ষের মধ্যে সীমিত তা নয়, সারা বিশ্বের মানুষই এর
কদর করেন। তাই আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ এর জনপ্রিয়তা কে অক্ষুন্ন রাখা ও
ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অগ্রগতির পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
[পৃথা লাহা]