একটি
নারী ও দুটি পুরুষের গল্প।যেমন চিরাচরিত হয় আর কি। সুদর্শন
পড়াশোনায় চৌকস। দেখতে শুনতে নিতান্তই সাধারণ। লম্বাটে। শীর্ণ । কিন্তু
উজ্জ্বল বড় বড় চোখ দুটি দেখলেই মনে হয় শানিত ছুরির মতো বুদ্ধি যেন ভেতর পর্যন্ত সব
দেখতে পাচ্ছে। বিনয়ী। কিন্তু সব
ব্যাপারেই একটা নিজস্ব মতামত আছে। শান্ত কিন্তু স্পষ্টবাদী। এতটাই
বিশ্বাসের সাথে বলে যে শুনতে হয় চুপ করে এবং মানতেও হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। আর তাই ভীষণ
অপ্রিয় অনেকের কাছেই। কার আর নিজের বিরুদ্ধ মত মানতে
ভালো লাগে?
সৌজন্য
এক সাথেই পড়ে। বিষয় আলাদা। ও পাস্
কোর্স এ । কলেজে আসে মোটরসাইকেলে। মাঝে মাঝেই
একে তাকে পিছনে বসিয়ে সিসিডি যায় । ক্লাস কেটে। ইউনিয়নের
নেতাও বটে। সরকারি দলের বলে একটু সমঝে চলে সবাই। ওর বাবা
নামজাদা প্রোমোটার। পয়সার অভাব নেই বাপের, ছেলের ও তাই
ফুটুনির শেষ নেই। তবে মনটা ভালো।
নীপা
সুন্দরী। কিন্তু আধুনিকা। পোশাকে শুধু
নয় । চিন্তায় ও ভাবনাতেও। সুদর্শনের
সহপাঠিনী। অক্লেশে সুদর্শনের নোট চেয়ে নেয়। আর সৌজন্যের
বাইকে চেপে সোজা আইনক্স। তবে হলে ঢোকার আগে নীপার
সোজাসাপ্টা সতর্কবার্তা,"শালা,তোর হাত যদি
নিশপিশ করেছে এক্কেবারে মোটকে দেব। সাবধান।"
ছটফটে
নীপা সহজেই সুদর্শনের মনে ছাপ ফেলে। সুদর্শনের মনে হয় এই মেয়েটাকে
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝানোর দায়টা তার। কিন্তু ওকে
তো ক্লাসে পাওয়াই যায় না। যা উড়নচন্ডী। বুঝিয়ে বলতে
গেলে বলে,"মাজাকি করিস
না তো। কাল ভদকা টা পুরো মাথায় উঠে গেছিলো। আজ ও ঘাড়ে
কি ব্যাথা,মনে হচ্ছে
কেউ বিরাশি সিক্কার রদ্দা মেরেছে। এই, বিল্টু,একটা র চা দে
তো। চিনিছাড়া।" অনেক
চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সুদর্শন ঠিক করলো রবিবার রবিবার নীপার বাড়ি গিয়ে পড়াবে। প্রথম
রবিবার তো আলাপেই কেটে গেলো। পরের রবিবার সুদর্শন নীপাদের
বাড়ি পৌঁছে দেখলো সৌজন্য আগেই ইঁট পেতে রেখেছে। ওর সামনেই
সৌজন্যের বাইকের পিছনে বসে নীপা বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে
বলে গেলো,"সাউথ সিটি।।।।।।।ডবল ফেলুদা। পরের রবিবার
পড়ব।"
বছর
দুয়েক পরে নীপা একসাথে দুজনের প্রপোজাল পেলো। সুদর্শনের
কাছ থেকে একটা চিঠি। ওর দেওয়া নোটের মধ্যে ভাঁজ করা
কাগজ। খুলে দেখে সুদর্শন লিখছে,"নীপার যোগ্য
আমি কোনো দিকেই নোই। আমি কি করে ওকে বলি যে ওকে
ভালোবাসি। রাতের পর রাত জেগে থাকতে থাকতে এন্টাসিডের
নিত্য খরিদ্দার হয়ে গেলাম। এমনিতেই পিলে মোটা বরাবর। আর এই বামন
হয়ে চাঁদে হাত দেবার বাসনা কি করে যে বলি নীপাকে।।।।।।।" নীপা
যে খুব একটা সিরিয়াসলি নিলো ব্যাপারটা তা নয়। তবে নীপার
মা মাঝেই মাঝেই নীপাকে সিগন্যাল দিতে লাগলেন যে তাঁর ভোট সুদর্শনের দিকে। নীপার বাবা
জীবনে শেষ সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছিলেন যখন নীপার মাকে বিয়ের কন্যা হিসাবে পছন্দ
করেছিলেন। তারপর থেকে নীপার মায়ের সিদ্ধান্তে উনি শুধু
মুন্ডি হেলান! দিব্যি চলছিল। কিন্তু।।।।।।
সৌজন্য
এক সন্ধ্যেতে নীপার পয়সায় কফি খেতে খেতে বললো,"এই নীপা,ওই শালা ম্যাদামারা সুদু টা তোর দিকে ঢুলু ঢুলু চোখে তাকায়
কেন রে? কিস্যাটা কি
বস? লাইনে কিন্তু
আমি আগে আছি। দি মোস্ট এডিবল ব্যাচেলর,হা হা হা
"
নীপা
হেসে ফেলে বললো,"ছাড় তো,ওর সাহস আছে
এই নীপাকে প্রপোজ করে?"
তবু
বিধাতার অদৃশ্য খেলায় এই গল্পে লাগলো মোচড়। সুদর্শন
ফটাফট একটা দারুন চাকরি বাগিয়ে নিলো। WBCS। নীপার মা তো এরপর হাতের তাস টেবিলে ফেলে
খেলতে লাগলেন। " এমন ছেলে কোথায় পাবো। পুরুষের
আবার রূপ দেখে কেউ? রূপ কি ধুয়ে
খাবি? বিদ্যে
বুদ্ধি আর চাকরি। কোনটায় কমতি সুদর্শনের? আর ওই গুলি
দেখানো কলার তোলা বখাটেটা।।।।।দেখলে গা জ্বলে যায়। সম্বল তো ওই
একটা বাইক। তাও তেলের পয়সার জন্য বাপের পকেট কাটে। কফি খায় তোর
পয়সায়। আর জানিস,সেদিন সকালে দেখলাম বাইকের পেছনে বসে কেল্টুস
একটা মেয়ে। বিলা কেস কিন্তু। বলে
দিলাম"
নীপা
কিন্তু বেশ শান্ত। ছোট ছোট ট্যাকেলগুলো সাবধানে ডজ করে এগোতে
লাগলো। সুদর্শন রইলো। রবিবার রইলো। লুচি কুমড়োর
ছক্কায় গদগদ নীপার মা রইলো। ওদিকে বাইক থাকলো, সিসিডি রইলো। মাঝ রাত
পর্যন্ত ডবল চ্যাট থাকলো। একদিকে শ্রীজাত,অন্যদিকে "গুরু দেব " আর "হট মাল মিমি"। পুজোয় ষষ্ঠী
,অষ্টমী
সুদর্শনের সাথে দেবীদর্শন,আর সপ্তমীতে
বাইকে ডায়মন্ডহারবার ,নবমীতে
কোলাঘাট। দশমীতে বেরিয়েছিল সুদর্শনের সাথে,কিন্তু মাঝ
রাস্তায় হাইজ্যাক করে নিলো সৌজন্য। অবশ্য যথেষ্ট সৌজন্যের সাথে
সৌজন্য সুদর্শনকে বললো,"তুই ও
চল" । সুদর্শন ভয়ে বললো,"না রে,তিনজন চাপবো
না বড্ডো ধরপাকড়
চলছে।"
দেখতে
দেখতে ডিসেম্বর। দেখতে দেখতে মাসের শেষ। নীপা এক
রবিবারে সুদর্শনকে বললো,
" তোর নিউ ইয়ার রেজোলুশন কি?"
" সারপ্রাইজ। ফার্স্ট
জানুয়ারি বলবো।" সুদর্শনের উত্তর
বাইকের
পিছনে বসে একই প্রশ্ন করলো নীপা সৌজন্যকে।
" সারপ্রাইজ। ফার্স্ট
জানুয়ারি বলবো"
সৌজন্যের
উত্তর।
বছরের
শেষ দিনে নীপা সুদর্শন আর সৌজন্যকে নিয়ে ডিনার খাওয়াতে এলো। আর্সলান। ই এম বাইপাস। নীপা আজ
এসেছে ওলা ক্যাব করে। সৌজন্য বাইকে। সুদর্শন
অটোতে। খেতে খেতে সুদর্শন উঠে গেলো একবার। একটু পরেই
চলে এলো। গল্পে গল্পে খাওয়া শেষ হলো।
নীপা
জিজ্ঞেস করলো,"এবার তোরা বল
নিউ ইয়ার রেজোলুশন।"
সুদর্শন
বললো,"I decided to formally propose to you, nipa।"
সৌজন্য
বললো,"শালা,বাংলা বল না। আমি ঠিক
করেছি নীপা চাইলে এ বছরেই বিয়ে করবো। বাবাটা একটু ভোগাতে পারে,তবে ওটা
সামলে নেবো।"
এবার
নীপার বলার পালা। নীপা আস্তে আস্তে বললো,"প্রথমে তোদের
মোবাইল বন্ধ কর।" ওরা মোবাইল সুইচ অফ করার পর নীপা দুটো
মেসেজ পাঠিয়ে বললো,"মেসেঞ্জারে
লিখে পাঠালাম। রাত বারোটার আগে খুলবি না। আমি লিখেছি
কাকে বিয়ে করবো। বারোটার আগে খুললে আমি রেজোলুশন চেঞ্জ করে
দেব।"
তারপর
সৌজন্যের দিকে তাকিয়ে নীপা বললো,"আমি এখন সুদর্শনের সঙ্গে বাড়ি ফিরবো। তুই বাইকে
ফিরে যা।"
সৌজন্য
গটমট করে বেরিয়ে গেলো। একবার ও পিছনে তাকালো না। নীপা বেরিয়ে
সুদর্শনের হাত ধরলো। এই প্রথম বার । আস্তে
আস্তে হাঁটতে লাগলো। অনেকটাই
এগিয়ে এসেছে। দুজনে। নীপার মাথা
সুদর্শনের কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একটা অদ্ভুত জোরালো শব্দ
নীপার কানে এলো। ও পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো প্রচন্ড বেগে
একটা বাইক ওদের দিকে তেড়ে আসছে। নীপা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়
সুদর্শনকে টেনে রাস্তার বাইরে গড়িয়ে পরে
গেলো। আর তক্ষুনি বাইকটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা
মিডিয়ান ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে দুমড়ে মুচড়ে গেলো। বাইক আরোহী
ছিটকে রাস্তায় পড়লো। ওরই মাঝে নীপা দেখলো বাইক আরোহীর
সোয়েটার সৌজন্যের।
সৌজন্য
মারা গেলো। পুলিশ এবং হাসপাতাল বাঁচাতে পারলো না। এই কেসের
তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেলো, সৌজন্যের
বাইকের ব্রেক খোলা ছিল। মানে পরিকল্পিত খুন !!
আর
পাওয়া গেলো অতনুকে। অতনু সৌজন্যের বন্ধু। এই ঘটনার
একটু আগে অতনুর সাথে সৌজন্যের দেখা হয় আর্সলান এর সামনে। সৌজন্য
চিবিয়ে চিবিয়ে অতনুকে বলে,"দেখ, সুদর্শনের
হাত ধরে কেমন যাচ্ছে নীপা! আমি জানি নীপা রেজোলুশন এ কি লিখবে। ওটা আমি হতে
দেব না। আজ শালা সুদর্শনের শেষ রাত। " বলেই
সৌজন্য বীভৎস স্পিডে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়।
প্রথমে
বোঝা যাচ্ছিলো না। কিন্তু আর্সলানের সি সি টিভি ক্যামেরা হদিস
দিলো। একজনকে দেখা গেলো সৌজন্যের বাইকে কিছু করছে
যখন ওর খাচ্ছিলো। লোকটিকে
সহজেই ট্রাফিক পুলিশ চিনে ফেললো । মুর্শেদ। পাশেই
গ্যারাজ মিস্ত্রি। মুর্শেদকে ধরতেই হুড়হুড় করে বলে দিলো সব। সুদর্শন ওকে
বাইকটা চিনিয়ে দিতেই খেতে খেতে উঠে গিয়েছিলো। সুদর্শনকে
ক্যামেরাতে দেখাও গেলো মুর্শেদের সাথে কথা বলতে।
হ্যাঁ,যে কথাটা বলা
হয় নি। নীপার রেজোলুশন মেসেজ ছিল,"আমি
সৌজন্যকেই বিয়ে করবো"
কল্যাণ
মুখোপাধ্যায়