>

সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য

SongSoptok | 5/09/2014 |
ডায়েরীর ছেঁড়া পাতা  ধারাবাহিক











১  
আজ পয়লা বৈশাখ।নিদাঘ।রূপনারায়ণে দুপুরে জোয়ার এলো।সেই ভোর থেকে সেজমামার দেওয়া জামাটা পরে বসে আছি।নতুন জামা।নীল।ওরা সবাই খেলছে।পিয়া,বুলবুল,ঝুমা,কাজল,স্বপন দা। সামনের মাঠে।পেয়ারাতলায় রান্না বসেছে।কাঠ বয়ে আনছে সুরেন।ডাক্তার দাদুদের কাজের লোক।পাড়ার বন্ধুদের রাতের ফিস্ট হবে।দুরন্ত ফুটবল খেলা হচ্ছে।সঙ্গে মাইক।আমিও বসে আছি পেয়ারা তলায়।শিরিষ গাছ থেকে হাওয়া গড়িয়ে নামছে।ঝিরঝির ঝিরঝির।একটা টিয়া উড়ে গেল জলের দিকে।আমার মনটাও টিয়ার পিছুপিছু।ডিপোর মাঠের ধারে শাপলা পুকুরটা একটূ একটু করে টেনে নিচ্ছে কাঠের উনুনের ধোঁয়া।মা ডাকছে মুন্না মুন্না আ আ আ আ আ আ...............................................
কী গরম পড়েছে।শুক্রবার বাড়ি এসেছি।কেউ ভাল বাসে না,মাগো।হস্টেলের ঘরে বার বার চোখ জ্বালা করে আমার।বাংলায় একাত্ত র পেয়েছি বলে গীতাঞ্জলি মিস গাল টিপে দেওয়ার পর থেকে খালি চোখে জ...ল আসছে।আর আমি হস্টেলের বেগম বাহার গাছটার কাছে ঝুম হয়ে বসে থেকেছি।কাকলি ক ত বার বললো তোর চুলটা বেঁধে নে না প্রেয়ারের আগে।আমি মনে মনে আর ও একা হয়ে গিয়ে ফড়িংটার কথা ভাবছি।যাতে ওর একটা কথাও আমার কানে না ঢোকে।কাকলি আমাকে ভালবাসে।কিন্তু আমার মাঝে মাঝে ভারি রাগ হ য় ওর ওপর।যখনই আমি পাকুড় তলায় বসে পাতাগুলোর মধ্যে জমে থাকা অন্ধকার দেখি ও ডাকতে আসে। আবার যখন কুল গাছ ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাকিয়ে যাই ও ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে।কিম্বা যেই আমি কুয়োতলায় চুপিসাড়ে শালিখের খুনসুটি দেখতে যাই ও আমার পিছু নেয়।আমি রেগে যাই ভীষণ রাগ।ভেতরে ভেতরে রাগ টাকে গড়িয়ে যেতে দিই।ওপরে শান্ত বাতাস হা হা করে টানতে থাকি।তাতে ও কিছু বুঝতে পারে না।শুধু বলে সুরঙ্গমা, তুই আমাকে খুব ভালবাসিস না রে আমিও না তোকে.........
শীলাদির কাছে আজ পড়া আছে।ম্যাথস,ইংরেজি আর ভূগোল।মাঝে মাঝে ভাবি শীলাদি এত্তগুলো সাবজেক্ট এক সঙ্গে কী করে এত্ত ভাল করে শিখল।কী করে এত্ত নমবর পেয়ে পাশ করলো কে জানে!আমি যখন হষ্টেল থেকে বাড়ী আসি তখন শীলাদির কাছে পড়তে যাই । শীলাদি প্রফুল্ল জেঠুর মেয়ে।আমার মা খুব ভালবাসেন শীলাদিকে।রূপনারাণের ধারে পুরোনো বাজারের কাছে একটা ক্লাবে পড়ায় শীলাদি।শীলাদিদের বাড়িতে জায়গা নেই বলে এখানেই পড়তে আসি আমরা।নদের ওপর ঝুলন্ত ক্লাবটি।পাশেই একটা বড় বট গাছ।মৌ, ভবেশ আর স্বপ্না আমরা চারজন পড়ি।ওই বটগাছটার ওপর উঠে নদের জল ছুঁয়ে দেখতে আমার বেশ লাগে।যেদিন পড়া থাকে আমি সেদিন একটু আগে আগে যাই।ওরা আসার আগে বট গাছে দোল খাই দোল খাই দোল খাই।তিতির পাখি গুলো কিচকিচ করে।বকগুলো উড়ে উড়ে চলে যায় একটু দূরে।পাশ থেকে একটা খাল বেরিয়েছে।কয়েকটা জেলে ডিঙি ওই দুপুরে বিশ্রাম নেয়।আমি ওদের খাওয়া দেখি।মাঝিদের।ওরা বুঝতেও পারেনা। বেশিরভাগ দিন ওরা পান্তাভাত আর বটের পাতায় করে মাছ পুড়িয়ে খায়।আমারও খুব খেতে ইচ্ছে করে।ওরা শুকনো লঙ্কা পোড়ায়।আমার মাথায় কষ্ট হয়।টুপ টুপ করে বট ফল জলের মধ্যে ঝরে পড়ে।আমার চোখ জলে ভরে যায়।রেল ব্রীজটার ওপর দিয়ে ঝম ঝম ক রে চলে যায় ট্রেন।৩টে বাজে।রাজুদার তেলেভাজার দোকানে চুল্লিতে আগুন দিচ্ছেন ওর মা।ধোঁয়ার আগুনে মাসীমার চোখ জলে ভেসে যায়।আমি চুপিচুপি সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠি।আর মাত্র পনেরো দিন পরেই চলে যেতে হবে হষ্টেলে।ছুটি শেষ।মাসীমার মত আমার চোখ ও জলে ভরে উঠবে রোজ।একাকিত্...
আসা যাওয়ার প থের ধারে...ক্লাশ টেন এর স্বর্ণাদি গাইছিল রবিবারে।খুব ভাল গান করে দিদিটা। সান্তাদি কাঁদছিল।সবার ভিসিটররা দেখা করতে আসছে।বেশির ভাগচই বাড়ির লোক।আসছে।চলে যাচ্ছে।কিন্তু সান্তাদির বাড়িতে কি যেন একটা হয়েছে তিনমাস হয়ে গেল কেউ আসে না ওর সঙ্গে দেখা করতে।স্বর্ণাদি ওর বন্ধু।ওরা আলাদা আলাদা হয়ে খুব গল্প করে।আমাকে দেখলেই চুল নেড়ে দেয় না হলে গাল টিপে দেয়।সান্তাদির কান্না দেখে আমার বুক কেমন করছিল।জয়ীকে ডাকলাম।লিপিকাকেও।ওরা বলল বড় দের ব্যাপারে না থাকতে।আমি হাঁটতে হাঁটতে কেরি সাহেবের ঘাটে গিয়ে বসলাম।যেখানে এক সময় পুকুর ছিল।সাহেবের বউ নাকি জলে ডুবে মারা গিয়েছিল।এরপর ই সাহেব পুকুরটা বুজিয়ে ফেলেন।আমি মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে বসে থাকি।দুটো বউ কথা কও পাখি সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফেরে ওই ঘাটের মাথার ওপর দিয়ে ডাকতে ডাকতে।আমার মন তখন কোলাঘাটের বাড়িতে চলে যায়।ওই সময় ই পাশের বাড়ির দিদা রোজ তুলসীতলায় সন্ধ্যে দেখায় শাঁখে ফুঁ দেয়।তারপর আমার ভাইকে নকুলদানা, বাতাসা দেয়।আমি বাড়ি গেলে আমাকেও দেয়।কেরি সাহেবের ঘাটে বসে সান্তাদির জন্য প্রভু যীশুর কাছে,মা কালির কাছে খুব প্রার্থনা করেছি।এমন সময় বুড়ীরমা আমাদের কুক ঝুম হয়ে যাওয়া অন্ধকারে আমাকে বসে থাকতে দেখে কি বকুনি কি বকুনি।বিড় বিড় করে বলছে বড়ী দিদিকে কত বার বলেছি ওর মা বাবাকে জানাও সুরোদিদির মাথায় ছিট আছে নইলে এই ভূতের থানে কেউ এ সময় একা বসে থাকে।আমি কী ক রে ওকে বোঝাই চু কিত কিত কিত চু কিত কিত কিত কোলাঘাটের মাঠে এখনও পিয়ালিরা খেলছে...

সন্ধ্যেবেলা আমাদের হষ্টেলে প্রেয়ার হয় রোজ।ছটার সময়।প্রভু যীশুর।আজ বড় মিসের বাইবেল পাঠে্র দিন।বড় মিস কে দেখলে মন ভাল লাগে।একধরনের বিনুনি করে ঝুলিয়ে খোঁপা বাঁধেন।আর কাঁটা গুঁজে দেন।রূপোর ।সাদা শাড়ি পরেন।সুর করে থেমে থেমে কথা বলেন মিস।আমার মামাতো দিদি দেখে বলে ছিল ব্রাহ্ম।আমাদের হষ্টেলের পাশেই কোয়ার্টার।সকাল দশটা পনেরোয় হষ্টেলের মেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে যান রোজ।স্কুলের সবুজ মাঠে একটাও কাগজ যদি পড়ে থাকে নিজে হাতে তুলে ডাস্টবিনে ফেলেন।আমরাও ওঁর দেখাদেখি হাত লাগাই।টিচার্স হষ্টেলের মিস রাও হাত লাগান।স্কুলের দুধ সাদা বাড়িটার সঙ্গে বড় মিসের কোথায় যেন বড় মিল আছে একটা।আমি বড় মিস কে খুব ভালবাসি।মিস জানতেও পারেন না।আমি দূর থেকে কাছ থেকে ওনাকে দেখি।যেদিন ওনার হষ্টেলে বাইবেল পাঠ থাকে আমি সামনের সারিতে বসে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকি।মনে হয় একটা রাজহাঁস মাঝে মাঝেই গলাটা উঁচু করছে।আর গা থেকে আলো ছড়াচ্ছে।বড় মিসের ভেতরে আলো আছে।আমি ওই আলোটা খুঁজতে থাকি।উনি যীশুর গান করেন। আমরাও গাই।প্রভু আমার ও প্রিয় আমার ও।ছোটোদের গাল টিপে দেন মিস।আদর করেন।ক্লাশ এইটের মিঠুদি বড় মিস কে খুব ভয় পায়।বড়মিস ওকে কাছে ডাকলেই ও প্রায় কাঁপতে থাকে।একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি এত বড়মিস কে ভয় পাও কেন?বড়মিস তো মা।মা কে কেউ ভয় পায়?ও চোখ বড় বড় করে রাগ রাগ গলায় বলেছিল,'তুইখুব পাকা।বড়দের সব ব্যাপারে তোর অত দরকার কিরে? 'মা' দের আমি দুচক্ষে দেখতে পারিনা।সব স্বার্থপর নচ্ছার।' 'নচ্ছার' কথাটা আমি প্রথম শুনলাম।মানে কি?গীতাঞ্জলি মিস কে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে ।তবে মনে হয় এটা খুব একটা ভাল কথা নিশ্চয়ই হবেনা।আমার মন টা বড় মিসের কথা ভেবে খুব খারাপ হয়ে গেল।রাতে স্বপ্ন দেখলাম্ বড় মিসের কোয়ার্টারের ভেতর কৃষ্ণচূড়া গাছটার ডাল পালাগুলো সব মাটিতে নেমে এসেছে।আমগাছটা থেকে সব ছোটোছোটো আম পড়ে ভরে গেছে উঠোন।পঞ্চমীদি হাত তালি দিচ্ছে।দিদিটা সাঁওতাল মেয়ে।বড়মিস নাকি বড় করেছেন।পঞ্চমীদি হাত তালি দিচ্ছে আর বলছে 'ভয় কিরে পাগলি,জানিস না যে গাছ যত বেশি ফ ল দেয় সে তত নুয়ে পড়ে ভূঁয়ে।আয় আয় আম নিয়ে যা আম নিয়ে যা তোরা।'আমি হু হু ক রে কাঁদছি।আমার বড় বেশি কান্না পায় সব সময়।পঞ্চমীদি বলছে,বলেই যাচ্ছে,'ভূঁই কে ভাল বাসবি।ভূঁই তো মা।আমাদের বড়মিস মায়ের মত।'আমি ওকে কিছুতেই বলতে পারছিনা মিঠুদি বড় মিস কে নচ্ছার বলেছে।ভূঁই মানে তো মাটি।মাটী মানেও মা।তবে মাটিওকি নচ্ছার?
তবু বলতে পারছি না।দুচোখ ফেটে জল আসছে আমার।আসলে মনে হয় মিঠুদিকেও ভালবেসেছি আমি।ও ও খুব একা।আমিও ত তাই ই।
অনেকদিন পর আমার মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল।ঘুম ভেঙে ভাবছিলাম এমন মন কেমন করে কেন মা!----মন কি?
আজ খুব বৃষ্টি হচ্ছে।ঝুম্পা আর সোমাদি বৃষ্টি দেখছিল নয় নম্বর ঘরের জানালায় বসে।সুতপাদিরা লুডো খেলছে।জয়শ্রী গান গাইছে।আর মনীষা পাগলি আবৃত্তি করছে।নীচের ডাইনিং থেকে কাকলি দৌড়ে এল।খুশির খবর নিয়ে।আজ রাতের মেনু খিচুড়ী।সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা।আর এখন টিফিনে মুড়ি তেলেভাজা।স্বর্ণাদি লুডোর বোর্ড উলটে দিয়ে ডিগবাজি খেল।ওরা টেনের মেয়ে।এ বছর নতুন ইলেভেন এসেছে হষ্টেলে।খুব ভীড় ব্যালকনিতে ।নিভৃতাদি খুব বিরক্তি ভরে ন'নম্বরে এসে বললো'এই তোমরা একটু চুপ করবে সরযূ আজই প্রথম বড় হল।ছোট্ট একটা মেয়ে পাশের ঘরে শুয়ে ছটফট করছে যন্ত্রনায়, কারও খেয়ালই নেই।রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা।এই কার ও কাছে ন্যাপকিন আছে?'ক্লাশ ফাইভের সরযূর বড় হ ওয়ার সঙ্গে রক্তে বিছানা ভেসে যাওয়ার কি সম্পর্ক কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিনা তো আমি।ওদের দেখাদেখি আমিও আট নম্বরে এলাম ছুট্টে।হাঁ করে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি সব।কাকলিকে ব ললাম এই ন্যাপকিন কি হবেরে ?রক্ত পড়লে তুলো দিয়ে মুছিয়ে দিলেই তো হয়।ও বললো উফ তোকে নিয়ে আর পারা গেল না।আমি ভাবছি ক্লাস ফাইভ বড় না ক্লাশ সেভেন।আমি সেভেন সরযূ ফাইভ।আমি তো ওর থেকেও বড় ক্লাশে পড়ি ও তবে কীভাবে আজই বড় হল?নিভৃতা দিকে বলতে গেলাম।কাকলি মুখ চেপে ধরলো।ঠ্যালা মেরে ফিশফিশ করে বললো এই গাধা চল স্টাডিতে চল।স্টাডিতে ঢূকেই আমি ওকে বললাম...এই কাকলি সরযূ ফাইভে পড়ে ও তবে আমাদের থেকে বড় হল কী করে রে? সবাই কি সব বোঝাচ্ছে ওকে কত্ত ভাল বাসছে দ্যাখ।আর আমাদের কেউ ভাল বাসছে না উলটে তাড়িয়ে দিচ্ছে কেন রে ?ওই স্বর্ণা দি ও তো কত্ত ভাল বাসে আমায়।চুড়ি কিনে দেয়,ছবি এঁকে দেয়।তবে আজ কেন আমাকে বললো এই তোমরা বাইরে যাও।অপমানে চোখে জল এসে গেল আমার।কাকলি আমার চোখ মুছিয়ে দিতে গেল আমি রেগে উঠলাম।আবার রাগ টাকে গড়িয়ে যেতে দিচ্ছি দিচ্ছি দিচ্ছি......আর হা হা করে শ্বাস টান ছি। কাকলি একটু দূ্রে গিয়ে চোখ মটকে ব ললো, 'আমিওতো বড় হই নি দ্যাখ আমি কি কাঁদছি ওই ঘর থেকে চলে আসতে বলাতে?আমি বড় না হলেও জানি কী করে বড় হতে হয়।তোকে পরে আমি বুঝিয়ে দেব।' কাকলি আমাকে ভালবাসে তাই আমি ওকে আর কিচ্ছু বললাম না।ঠীক এই সময়ে ক্লাশ নাইনের মিতুদি স্টাডিতে ঢুকে পড়ায় কাকলি আমাকে চিমটি কাটলো জোরে একটা।মিতুদি বললো এই তোরা এখন একদম আট নম্বরে যাবিনা কেমন।এই বলে হট ওয়াটার ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে চলে গেল ওপরে।আমার মাথায় ক্লাশ ফাইভ আর ক্লাশ সেভেন লাফাচ্ছিল।কাকলি আবার হাত পা নাড়িয়ে কি সব বলেই যাচ্ছিল।কিচ্ছু ঢুকছে না মাথায়।আমার মাথায় তখন রক্ত গড়াচ্ছিল।রক্ত।প্রত্যেকদিনই তো গড়ায়।আমি তবে বড় হইনা কেন?শুধু বিছানায় রক্ত গড়ালেই কি বড় হওয়া যায়?গীতাঞ্জলি মিস কে জিজ্ঞেস করতে হবে অপমানে চোখ দিয়ে গরম বাস্প জল হয়ে ঝরছে।
বৃষ্টি পড়ে শুধু বৃষ্টি পড়ে/মনের থেকে ফুলের গন্ধ ঝরে...বৃষ্টি পড়ে শুধু বৃষ্টি পড়ে...
কুঞ্জ সাহেবের বাংলোতে যে হষ্টেল সেখানে আলো জ্বলে উঠলো সন্ধ্যের।প্রভু আমারও প্রিয় আমারও...প্রেয়ারের সমবেত ধ্বনি ভেসে আসছে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে।
কাকলি চিৎকার করে উঠলো আর বৃষ্টিতে ভিজিস না মুন্না জ্বর এসে যাবে তোর......
মাথার মধ্যে রক্ত পড়ছে, বৃষ্টির জলেও ধুয়ে যাচ্ছে না।আমি তবুও কেন বড় হচ্ছি না?ওরা আমাকে আট নম্বর থেকে বের করে দিল যে।হু হু করে আমার চোখ ফেটে গড়িয়ে নামা জল বৃষ্টিধারায় মিশে যাচ্ছে।ক্লাশ সেভেন ক্লাশ ফাইভের কাছে হেরে যাচ্ছে মা।তুমি যে বল বাচ্চারা কখনও মায়ের কাছে বড় হয় না।সরযূ কী করে ফাইভ হয়েও আমার থেকে বড় হয়ে গেল আজ?ওর মা আসলেও ও কি বড়ই থাকবে?স্বর্ণা দিরা ক্লাশ সেভেন কে বের করে দিয়ে ক্লাশ ফাইভ কেই বড় দেখাবে?আমি কিন্তু ওর থেকেও ভাল ওড়িশি নাচি মা।
আমি ক্লাশ সেভেন...আমেন
আমার বাপি এসেছে দেখা করতে হষ্টেলে।অনেক খাবার দাবার নিয়ে।পুপুদি একদিন বলেছিল, 'আমার তো বাবা নেই তোর বাবাকে দেখলে কেমন বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।'আমি বাপিকে বললাম দাঁড়াও তোমার সঙ্গে এক জনের আলাপ করিয়ে দেব।নতুন এসেছে।পুপুদি।ওর না বাবা নেই।তক্ষুনি বাপি একটা ক্যাডবেরি কিনতে গেল।আমি পুপুদিকে ডাকতে।আমাদের হষ্টেলের গেটের পাশে খুব বড় একটা নিমগাছ একদিকে।আর একদিকে কৃষ্ণচূড়া।তার পাশেই ভিজিটর্স রুম।দুপুরবেলা।রবিবার।ধীরেধীরে ভিজিটর্সদের আসা শুরু হচ্ছে।ভিজিটর্স রুমের সামনে দিয়ে পাস করার সময় এক জন ডেকে বলছেন ,'এই শোন তোমার নাম কি?আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।হষ্টেলের মেয়েদের বাইরে বেরোতে দেওয়া হয় না।শুধুমাত্র ভিজিটর্স এলেই বাইরে আসা যায়।পাশেই দারোয়ানের ঘর।একবার ভাবলাম দৌড় লাগাই।আবার পিছন থেকে ডাক দিল কেউ।আমি সাহস ভরে পিছনে তাকালাম।এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,'সুতপাকে চেন?আমি ওর বাবা ওকে একটু ডেকে দেবে?'আমি ব ললাম দারোয়ান কে বললেই তো সবাইকে ডেকে দেয়, এটাই তো নিয়ম। আপনি জানেন না?আমি ভাবছিলাম সুতপার মত এত বড় একটা মেয়ের এত্ত ছোটো বাবা!উনি বললেন,'আমি আগে কখন ও আসিনি তো তাই জানি না।'আমি ভেতরে ভেতরে বেশ অবাক হচ্ছি ক্রমশঃ।পাঁচ বছর হল সুতপা এখানে থাকে।অনেকবার ই শুনেছি ওর বাবা,মা দেখা করতে এসেছে।তাহলে? লোকটা ছেলে ধরা নয়তো?এমন সময় আমার বাপি এসে গেল আমিও পুপুদিকে ডাকতে ছুটলাম।পুপুদির সঙ্গে কথা বলে আমার বাপি চলে যাওয়ার পর আমরা দুজনে ফিরে আসছি দেখি ভদ্রলোক তখনও দাঁড়িয়ে।আমাদের ডেকে আবার বললেন 'প্লিজ একবার সুতপাকে ডেকে দাও না।আমি তো ওর নতুন বাবা হয়েছি তাই আমার ভিজিটর্স কার্ড নেই।আর ও আমাকে চেনেও না।তাই ভাব করতে এসেছি।'আমার মাথায় তখন হাতুড়ির ঘা।নতুন বাবা মানে কী?এই যে আমার বাবা এল,তিনি কি কখনও নতুন কখনও পুরণো...ওরে বাবা পুপুদি ও পুপুদি লোকটা কী বলছে গো?সুতপার নতুন বাবা মানে কিগো?পুপুদি বললো চল পালাই ও নিশ্চয়ই দুষ্টু লোক।
একদিন মাঝ রাতে সুতপাকে মোম বাতি জ্বালিয়ে একটা কিছু পড়তে দেখে চুপিচুপি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।হঠাৎ আমাকে দেখে ওর কি কান্না।আমাকে বললো ,'জানিস আমার মা না একটা লোকের সঙ্গে চলে গেছে।আর ফিরবে না।ফিরতে পারবে না।দেখ না দেখ এই চিঠিতে সব লেখা আছে।'আশ্চর্য! কারুর মা একটা লোকের সঙ্গে চলে গেলে আর ফিরে আসতে পারে না সেই প্রথম জানলাম।আমার মা তো মিটিঙে যায়।মিছিলে যায়।স্কুলে যায়।আবার বাড়িতে ফেরে।সেও তো অন্য লোকের সঙ্গেই।তাহলে সুতপার মা আর ফিরবে না কেন?কেন এমন করে সুতপাকে চিঠি লিখলেন উনি?কী ভাল হাসিখুশি মা।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম কালই বাচ্চুকাকুর হাতে মাকে একটা চিঠি লিখে পাঠাব যাতে আমার মা সুতপার মায়ের মত আমাকে কোনও চিঠি না লেখে।তাহলে সুতপার মত চুপিচুপি আমাকেও মোম বাতি জ্বালিয়ে চিঠি পড়তে হবে।আর চোখের জল আরও একা করে দেবে আমার এই বার বছরের জীবন টাকে।


খোলো খোলো দ্বার...স্কুলের ফেস্ট।আ ম রা দারুন খুশি।স্কুল উইনিফর্ম পরে লাল ফিতে দিয়ে পনিটেল করে প্রভাত ফেরি করে এসেছি লাল মাটির শহরে।বড় বড় অনেক মানুষ এসেছেন।সি পি আই এর এম।পি কাকলির বাবা নারায়ন চৌবে এসেছে।আমার মুখে ছোটোবেলার মত দাড়ি ঘষে দিয়েছে চৌবে জেঠু।গমগমে বাজখাই গলায় ডেকে হেঁকে স্কুল মাথায় করছে একেবারে।আর যা লম্বা।আমাকে মাথার ওপর তুলে টিচারদের বলছেন,' ছোটোবেলায় এরকম করে কত মিটিঙ মিছিলে নিয়ে গেছি ওকে।ওর মা দেখলেই হা হা করে উঠতো।ভাগ্যিস এখানে নেই আজকে।'আমার সেকশানের বন্ধু সুতনুকা ওর বাড়ী নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমাকে।হস্টেলের মেয়েদের বিনা অনুমতিতে কোথাও যাবার নিয়ম নেই বলে যেতে পারলাম না।খুব মন খারাপ হচ্ছে তাই।ও বাড়ী থেকে খাবার এনে আমাকে খাওয়ায় প্রায় ই।আজ মাংসের চপ এনেছে।স্পেশাল।মাসি মানে ওর মা বানিয়ে দিয়েছেন।
রাতে চিত্রাঙ্গদা হবে।বড় মেয়েরা নাচবে।গাইবে।আমরাও যুদ্ধবিরোধী নৃত্যনাট্য করছি।উত্তেজ্না।উন্মাদনা।খুব টান টান হয়ে আছি।এমন সময় রিনাদি হস্টেলের দিদি এসে বললো,'এই তোদের আজ একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।নূপুরের প্রেমিক।জামশেদপুর থেকে ফেস্ট দেখতে এসেছে।কেউ গোল করবি না।'কাকলিকে বললাম এই প্রেমিক কি করে এলো রে?কোথা থেকে এন্ট্রি নিল স্কুলে?খুব সাহস তো।কনিকা,মিনুকারা বললো ,'আমাদের মাসতুতো দাদা।গার্জিয়ানেরা ফেস্টে অ্যালাউড বলেও এসেছে।নূপুরদির সঙ্গে প্রেম করে।ওরা বিয়েও করবে।'
আমার মাসতুতো দিদির সদ্য বিয়ে হয়েছে।আমরা গিয়েছিলাম।বিয়ে মানে সানাই,অনেক গিফট,লালশাড়ী,হইচই,গল্প,অনেক লোক,আলো,হুড়োহুড়ি।বিয়েটা মন্দ লাগেনি।আমার ও বেশ বিয়ে করতে ইচ্ছে করছিল।বিয়ের দিন সকালে।রাত্রে বরকে দেখে এত ভয় লেগেছিল যে বিয়ে আর ভাল লাগছিল না।অথচ নূপুরদি তো ছেলেটার সঙ্গে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে।আর আমারও তো একদম ভয় লাগছে না ছেলেটাকে।আমি মনে মনে ঠিক করলাম যদি বিয়ে করি এরকম একটা ছেলেকেই বিয়ে করব।লাল শাড়ী পরে।তবে প্রেম ব্যাপারটা কি?এই হেসে হেসে কথা বলা?তাহলে গীতাঞ্জলি মিস কেই বিয়ে করব সবার আগে।কারণ মিস ই সব থেকে বেশি হেসে হেসে কথা বলে আমার সঙ্গে।কাকলিকে কথাটা বললাম আড়ালে ডেকে।ও গম্ভীর হয়ে বললো,'তুই পাকুড় তলায় বসে জমাট অন্ধকার দ্যাখ।না হলে ছুটে ছুটে ফড়িং ধর গিয়ে।আর তাও না পারলে পঞ্চমীর সঙ্গে এক্কা দোক্কাও খেলতে পারিস।
ওঃ তুই না একটা ইম্পসিবল...'
ক্লাশ নাইনে উঠেছি।মাকে রেজাল্ট বেরোনোর দুদিন আগে জিজ্ঞেস করেছি নট্ প্রমোটেড হলে মিনুকার বাবা বলেছেন ওদের জামশেদপুরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।তখন কি হবে মা?ওরা এত ভাল বন্ধু আমার।আবার কষ্ট হবে।বুকের মধ্যে তির তির করবে।প্রথম যেদিন হস্টেলে গিয়েছিলাম সেরকম কষ্ট দলা পাকিয়ে যাবে গলায়।এই ঘরের খাট টার জন্য মন কেমন করত আমার।উঠোনের পেয়ারা গাছটার জন্যও।ভাইয়ের জন্য মন খারাপে মরে যেতে ইচ্ছে করত।দক্ষিনের জানালার পাশে পড়ার টেবিল টার জন্যও।ঠিক সেরকম মিনুকার মাথার লাল ফিতেটার জন্য ও কান্না পাবে আমার খুব।মা ও মা কি হবে মা?মা খুব একটা অস্বস্তি গলায় লুকিয়ে বললো এরকম হবে না দেখবি তোরা সবাই খুব ভাল রেজাল্ট করবি।
রেজাল্ট বেরোনর প র মিনুকা,কাকলি,আমি মণীষা আবার সবাই হই হই করে বেল কাঁটা তুলতে ছুটলাম।ভোরবেলা দাঁত ব্রাশ করতে করতে গাছের ডালে দোল খেলাম।আর যে বাদাম গাছটার ফাঁক দিয়ে প্রথম দিন আমার গায়ে সূর্য ঢলে পড়েছিল সেরকমই একদিন আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষে আমি বড় হয়ে গেলাম।রক্তে ভেসে গেল আমার পৃথিবী।আমি কিন্তু রক্তাক্ত হলাম না।তিন বছর ধরে রোজ প্রতিদিন প্রতিরাত রক্তাক্ত হয়ে হয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।আমি বড় হয়ে গেছি স্বর্নাদি, সরযূর থেকেও।

১০
নাইনে ওঠার পর থেকেই শুরু হয়েছে এক নতুন কাজ।ভোর বেলায় উঠেই দোলতলায় গিয়ে টিয়া পাখির ঝাঁকের হুটোপুটি দেখা।ভীড়ে হারিয়ে যাবার আগে মন টাকে একা একা প্রশ্ন করা।এত একা লাগে কেন?প্রতিদিনকার মন খারাপটাকে একটু একটু করে দিনের কাজের ভেতরে মিশিয়ে দেওয়ার কষ্টটাকে জয় করেছি আমি, ভাবি।এই ভাবনা টা কে প্রতিদিনই আবার মিশিয়ে দি ই আমার প্রতিটি কাজে।আমার ওড়িশি নাচের মুদ্রায়।প্রতিটি মুদ্রায় ঢেলে দিই আমার সর্বস্ব।রোজ।রো ও ও জ।আমার রাগ, বীত রাগ,কান্নার মিশেল।এর থেকেই আবার জাগে আমার মন। উফ ফ মাগো এই মনের হাত থেকে কি আমার নিস্তার নেই!
বড় মিসের কাছে আমি ঋণী।তার শ্বেতশুভ্র অবয়ব আমার ভেতরে ছড়িয়ে দিয়েছে তেজ ,দীপ্তি।একা থেকে আর ও একা হয়ে থাকার শক্তি অর্জন করেছি আমি।অনেকের মধ্যে থেকেও একা।আমের মুকুলের গন্ধ চিনতে শিখেছি।।পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দ।প্রথম বর্ষার হিজল,বকুল আর বসন্তের পলাশ।সর্ষে ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ চিৎকারে সশব্দে ভাঙতে শিখেছি নিজেকে।পালতোলা নৌকোর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে দুপাশের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে কীভাবে এড়িয়ে যেতে হয় তাও।এখন আর মামাবাড়ি থেকে আসার সময় বড় মামীমার জন্য কষ্ট হয় না।গেটের দুপাশের ঝাউগাছ গুলোকে জানাতে হয় না নিজের একাকীত্বের কথা।বেড়াল্ গুলোকেও।ওরা বোঝে।সব বোঝে।আমাকে।আমার একা থাকার সমস্ত সামর্থকে।
হঠাৎ ই একটা চিঠি পেলাম হাতে।'আলাপ করতে চাই।তোমাকে রোজ স্কুলে যেতে দেখি একা।অনেক মেয়েরা এক সঙ্গে দল বেঁধে যায়।তুমি কেন যাও একা?জান আমিও না খুব একা।'
কী করে বুঝল ছেলেটা আমার একাকীত্ব।কোন আড়াল থেকে?
একা থাকলেই বুঝি অন্যের একাকীত্বে ভাগ বসাতে হয়!! ----স্বার্থপর

(ক্রমশ)
Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.