>

অরূণ চট্টোপাধ্যায়

SongSoptok | 2/15/2016 |


(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -১৫
দূষণহীন বিশ্ব
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়

আজকের দুনিয়ায় দূষণ শব্দটি অপরিচিত নয় এমন কি একটা বাচ্চা ছেলের কাছেও। কারণ পরিবেশের দূষণ ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যাতে এই শব্দটাও পৌঁছে গেছে চর্চার মূলবিন্দুতে। ডাঃ গৌতম ভেবে দেখেছেন দূষণ জিনিসটা প্রধানত ঘটে বা বেড়ে চলে বাতাসে উপস্থিত ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া জলীয় বাষ্প আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি আর বৃদ্ধির জন্যে। ক্রমাগত বেড়ে চলা লোকসংখ্যা আর কলকারখানাই বাড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে। আর উত্তাপের ক্রমশ বৃদ্ধিই সাগরের জল ক্রমশ বাষ্পে পরিণত হচ্ছে আর বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি করে চলেছে।

ডাঃ গৌতম জানেন বাতাসের এই সি-ও টু বৃদ্ধির অর্থ হল বাতাসের অক্সিজেন বা ও-টুর সংকোচন। শ্বাস চালানোর মত যথেষ্ট পরিমান ও-টু মানুষ আজ পাচ্ছে না এই জন্যে। আসছে নানা শ্বাস যন্ত্রের রোগ অর্থাৎ রেস্পিরেটরি অরগ্যান ডিজিজ। বাতাসে জলীয় বাষ্পের বৃদ্ধি বাতাসের আপেক্ষিক আদ্রতা বাড়াচ্ছে। বাড়াচ্ছে গায়ের ঘাম না শুকোনোর প্রবণতা। গরম বেড়ে যাচ্ছে আর সেই সঙ্গে ভ্যাপসা ভাব। শুধু তাই নয়, ক্রমাগত এই জলীয় বাষ্প আর বাতাসের ধুলো ধোঁয়া বৃদ্ধিতে কুয়াশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কালবৈশাখী ও অন্যান্য ঝড়ের সম্ভাবনা। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা খুব চিন্তিত পরিবেশের এই দূষণ আর আসন্ন পরিবর্তন নিয়ে। তাঁরা তো আগামী একশ বছরের এক কালো ভবিষ্যৎ বাণী দিয়েই রেখেছেন। সুতরাং পরিবেশকে দূষণ মুক্ত করতেই হবে আর তা খুব তাড়াতাড়ি। ডাঃ গৌতমের মাথায় চিন্তা কি করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। সবাই জানে গভীর চিন্তা আর তার ফলের জন্য ডাঃ গৌতম চান মাত্র কটা জিনিস। তাঁর বিখ্যাত সিন্থেটিক বটগাছ তলা আর ছটা মাসের ব্যবধান।

সুতরাং ডাঃ গৌতম সিন্থেটিক বটগাছ তলায় ধ্যানে বসার পর থেকেই লোকের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা আবার কবে একটা একান্ত ব্যক্তিগত বেরিয়ে আসে তার অপেক্ষায়। ছমাস পরে আবার সবাই ছুটল তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে। নিশ্চয় তার মাথা থেকে বেরিয়েছে আর একটা ‘একান্ত ব্যক্তিগত’। বিরাট বড় কনফারেন্স রুমের একপাশে তখন যেন একটা ছোট গবেষণাগার। একটা কাঁচের জারের ভেতর সবুজ সবুজ কিছু পদার্থ রাখা আছে। তার একপাশ দিয়ে একটা নল আর অন্য পাশ দিয়ে আর একটা। সেই বিরাট জারের সামনে দাঁড়িয়ে ডাঃ গৌতম তখন শুরু করেছেন ভরাট গলায় তাঁর বক্তৃতা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছে। প্রশ্ন করতে হয় না তাঁকে। নিজে থেকেই সম্ভাব্য সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন এটা তাঁর মস্ত বড় গুণ। শ্বাস ফেলারও যেন সময় নেই কারও। কারণ সেই সময়ের মধ্যে বলা কথাগুলো যদি কান দিয়ে বেরিয়ে যায়?  সেই শ্বাস নিয়েই বললেন ডাঃ গৌতম। বললেন, পরিবেশ দূষণের কথা আপনারা সবাই জানেন। আর নতুন করে কিছু বলার নেই। আপনারা সবাই জানেন বাতাসে বেড়ে চলা সি-ও-টু আর উত্তাপের জন্য বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ক্রমশ কমছে আর জলীয় বাস্পের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। অক্সিজেনকে খেয়ে নিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড হয়। বেশী মাত্রায় উৎপন্ন হওয়া সি-ও-টু বেশী করে অক্সিজেন খেয়ে নিয়েই তৈরি হয়। বিষয়টা আপনাদের একটু ভাল করে বুঝিয়ে বলি। একটা আয়নার সামনে একটা জিনিস ধরলে তার একটা ইমেজ বা প্রতিবিম্ব আমরা পাই। কিন্তু ঠিক মুখে মুখে ধরুন তো আর একটা আয়না। দেখবেন প্রতিবিম্বের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কারণ প্রতিবিম্বের মধ্যে তৈরি হচ্ছে আবার একটা প্রতিবিম্ব। আর এমনি করে বহু। বাতাসের এই দূষণের সমস্যাও ঠিক একই। একটার বৃদ্ধি আর একটার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে চক্রাকারে। তাই উত্তাপ না কমালে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা জলীয় বাস্প কমে না আর এদের না কমালে উত্তাপ কমে না।

-আপনারা জানেন গাছ একটা মস্ত বড় কাজ করে। অবশ্য এ কাজ সে করে একমাত্র তার নিজেরই স্বার্থে। কিন্তু সেই কাজের ফল পরিবেশও পেয়ে থাকে খুব ভালভাবেই। কাজটা হল সালোক সংশ্লেষ বা ফোটো সিন্থেসিস। এ কাজে তিনটি জিনিস লাগে। সূর্যের আলো, বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর গাছের সবুজ অংশ অর্থাৎ ক্লোরোফিল।

সবাই মনে দিয়ে শুনছে। ডাঃ গৌতম যখন কিছু বলেন তখন কেউ কোথাও কোনও কথা বলে না। এটাই রেওয়াজ। তার বলার মাঝখানে কিছু বলাকে তাঁর অসম্মান বলে বিবেচনা করে। তাই একেবারে পিন পতনের নিস্তব্ধতা।

-ক্লোরোফিল আর সূর্যের আলোর সাহায্যে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভেঙ্গে ফেলে কার্বন আর অক্সিজেন করে ফেলে এই পদ্ধতি। তারপর  বাতাসের জলীয় বাস্প ওই কার্বনের সঙ্গে রাসায়নিকভাবে যুক্ত হয়ে তৈরি করে কার্বোহাইড্রেট বা সুগার। এটি গাছের খাদ্য। খাদ্য তৈরির এই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নিজের খাদ্য তৈরির সঙ্গে সঙ্গে গাছ কিন্তু না জেনেই প্রকৃতির আরও দুটো উল্লেখযোগ্য কাজ করে ফেলে। সেগুলো হল বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর জলীয় বাস্পকে কমানো আর অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ান।

-আজ তাই সারা বিশ্বে ‘গাছ লাগাও প্রাণ বাঁচাও’ আন্দোলন চলছে। কিন্তু যেভাবে উত্তাপ আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে চলেছে তাতে একটা গাছ আর কত প্রাণ বাঁচাতে পারে? আবার এই রকম হাজার হাজার গাছ পুঁততে পুঁততে পৃথিবীটাকে জঙ্গলে পরিণত করাও সম্ভব নয়। তাহলে তো সভ্যতাই হাঁটবে ক্রমশ পেছন দিকে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে সভ্যতার খাতিরে বাসযোগ্য জমি তো অবশ্যই থাকতে হবে। মানুষের সংখ্যাও যে বেড়ে চলেছে ক্রমশ। তাই বাড়বে বাসযোগ্য জমির চাহিদাও। শুধু তাই নয় তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে কলকারখানার সংখ্যাও।

এবার একটা রিমোট টিপলেন ডাঃ গৌতম। দেখা গেল মাঝের বিরাট সবুজ পদার্থ ভরা গ্যাসজারে কিছু গ্যাস ঢুকছে। ঢোকার রাস্তায় একটা জলের জারের মধ্যে দিয়ে তাকে আসতে হচ্ছে বলে জলে বুড়বুড়ি কাটছে। গ্যাস যে চেম্বারে ঢুকছে এটা তার প্রমাণ। আবার একটা পাইপ দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে। সেটাকেও রাখা হয়েছে একটা জলের পাত্রের ভেতর। জলের বুড়বুড়ি প্রমাণ করছে বেরিয়ে যাওয়া গ্যাসের অস্তিত্ব। আর মাঝের সেই বড় জারটার নিচে অন্য একটা পাত্রে জমছে এক রকম সাদা সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো পদার্থ।

-এই বড় যে পাত্র দেখছেন এটা হল রিয়াকশন চেম্বার। এখানে ফোটো সিন্থেসিস হচ্ছে। এই সবুজ পদার্থগুলো হল ক্লোরোফিল যা গাছের পাতায় থাকে। এগুলো কৃত্রিম ভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে।

-এই পাশ দিয়ে আসছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। আর ওই যে দেখেছেন ওখান দিয়ে পড়ছে রোদের আলো বা সানলাইট। ক্লোরোফিল আর সানলাইটের সাহায্যে কার্বন-ডাই -অক্সাইড ভেঙ্গে যাচ্ছে আর অক্সিজেন তৈরি করছে। সেই অক্সিজেন বেরিয়ে যাচ্ছে ওই পথে।

-হ্যাঁ বলতে ভুলে যাচ্ছি ওই আর একটা নল দিয়ে রিয়াকশন চেম্বারে পাঠানো হচ্ছে জলীয় বাস্প। এই জলীর বাষ্পের উপস্থিতি ছাড়া কিন্তু ফোটো সিন্থেসিস হতে পারে না। কার্বন আর জলীয় বাস্পের রাসায়নিক যোগে তৈরি হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট বা সুগার। ওই যে সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো জিনিস গুলো দেখেছেন ওগুলো হচ্ছে তাই। সবাই তো একেবারে চমৎকৃত। কি সহজ করে বোঝান ডাঃ গৌতম। শেষে বললেন, এটা একটা ছোট মডেল। বড় বড় মডেলে বাতাস ঢুকবে আর বেরিয়ে যাবে অক্সিজেন। যাকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হবে এই বাতাসেই। কিন্তু লাভের লাভ একটা তো হলই। আর সেটা হল-

-সুগার সুগার। সবাই সমস্বরে উঠল চেঁচিয়ে।

-হ্যাঁ সুগার বা কার্বোহাইড্রেট। একে আমাদের যে কোনও খাদ্য বা ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে।

সবাই অবাক হয়ে ভাবছে কই এমন সহজ জিনিস নিয়ে তো কেউ ভাবে না? সত্যিই তো গাছ লাগাতে লাগাতে আবার সেই জঙ্গলের যুগে ফিরে যাওয়াটা কি সত্যিকারের সমাধান হতে পারে?

ডাঃ গৌতম বলেন সমস্যাকে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে নয় লড়াই করতে হবে তার সামনে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে। সেটাই হবে বিজ্ঞানের সত্যিকারের লড়াই। এগোতে হবে। এগিয়েই যেতে হবে ক্রমশ। পেছনোটা সভ্য মানুষের ধর্ম হতে পারে না।  


[অরুণ চট্টোপাধ্যায়]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.