।।এক।।
হাসি, স্বপ্ন ও ভালবাসার ভিতর দিয়ে বাঁচার আশা জড়িয়ে নিজের
প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালবাসেন আবদুল মান্নান সাহেব। কারো সাথে মতবিরোধ দেখা
দিলেই, একা একা হেঁটে চলে যান হাসপাতালে। গত তিন বছর ধরে
এটা নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের সামনে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ
হাঁটাহাঁটি করলে তার মন ভালো হয়ে যায়। তার জন্যই গত তিন বছর
হলো বাসা পরিবর্তন করেননি। এখনকার বাসাটা হাসপাতালের একেবারে কাছেই। এই নিয়ে স্ত্রীর
সাথে রোজই কথা কাটাকাটি চলে। মান্নান সাহেবের স্ত্রী পাপিয়া
শহরের একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার ছিলেন একসময়। এখন চব্বিশ ঘন্টা বাসাতেই
কাটান। দুজনের বয়সের ব্যবধান এত বেশি যে,
মাঝে মাঝে নিজেরাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করেন। এমনিতে তাঁর স্ত্রী পাপিয়া খুবই শান্ত
প্রকৃতির হলেও এই হাসপাতালের কাছে বাসা নেওয়াকে কেন্দ্র করে, নিজের স্বামীর দিকে যত ক্ষোভ। কিন্তু মান্নান সাহেব স্ত্রীর সবকথা শুনলেও এটা শোনেন না। শুধু এই জন্যই জীবনের কিছুটা সুখ হারিয়ে
গেছে। দিনের পর দিন নানারকম জটিলতা সংসারজীবনে বেড়েই চলছে। কোথাও যদি একটু শান্তির দেখা
না পায় তবেই চলে যায় হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে। একবার এক
শিশু বিশেষজ্ঞ তো রোজ তাঁকে দেখে, বলেছিলেন মানসিক কাউন্সেলিং করিয়ে নিতে। সেই থেকে মান্নান
সাহেবের শিশু বিশেষজ্ঞদের ওপর খুব রাগ। ডাক্তারদের
দেখলেই পাশ কাটিয়ে দ্রুত অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করেন। কে জানে কোন ডাক্তার আবার কিছু বলে
বসে নাকি! আজ শনিবার। সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। চৌধুরিপাড়ার
গলিটা যেন পানিতে ভেসে যাচ্ছে। চেনাই যাচ্ছে না। এই গলিতেই মান্নান সাহেবের বসবাস।
দুই রুমের একটি ছোট বাসায় নানারকম স্বপ্নের সাথে দিন
কোনভাবে চলে যাচ্ছে তার। আশপাশের কয়েক বাসার কিছু ছোট ছোট বাচ্চা পানিতে লাফালাফি
করছে। এইসব দেখে মান্নান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর মনে মনে
একচোট গালিগালাজ করে ওদের মায়েদের! আর বকেই কী লাভ। মান্নান সাহেব ভাল করেই জানেন,
এদের মায়েরা এই
শহরের বড়লোকদের বাসায় খুব সকালেই কাজে বেরিয়ে
যায়। তবুও কেন নিজের সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখে না তারা এটা ভেবেও হতাশ।
বাচ্চাদের দিকে একটু এগিয়ে গেল কিছু বলার জন্য কিন্তু কিছু না বলেই বড় রাস্তার
দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। এটাও মান্নান সাহেবের আর
প্রতিদিনকার একটি অভ্যাস। অনেকের কাছেই কিছু বলবে বলে কাছে গিয়েও,
কিছু না বলেই চলে আসেন তিনি।
।।দুই।।
এই অভ্যাসের জন্যই পাপিয়া নামের একজন
বহুগুণের মানুষকে কাছে পেয়েছেন। যেদিন মান্নান সাহেবের বিয়ে ঠিক করেছিলেন তাঁর বাবা,
সেদিন খুব সাহস নিয়ে
নিজের বাপের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন কিছু বলবে
বলেই। সেদিন বলা হয়নি, ফিরোজার
কথা। যে নারীর জন্য আম কাঁঠালের মৌসুমে,
কাঁচা আম বা কাঠালের বিচি ভাজা লুকিয়ে লুকিয়ে পকেটে করে স্কুলের পেছনের দিকে,
ফিরোজার হাতে দিয়ে দিতেন। দেখতে স্ত্রী পাপিয়ার মতন এতটা ফর্সা না হলেও,
আলাদা একটা সুন্দরের আভা ছিল। একবার তো ওঁর বিল্লাল চাচার বেশ বড় একটা
গমখেতের মাঝখানটায় বসে যখন, ডাব খাচ্ছিলেন চাচা এসে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন। সেই দিনের
কথা মনে পড়তেই মনের অজান্তে হেসে ফেললেন মান্নান
সাহেব।
-কি গো মান্নান রাস্তায় দাঁড়াইয়া এইভাবে কী
ভাবতাছ? মান্নান সাহেব হঠাত্ থমকে তাকিয়ে দেখে,
নিজের বাসার বাড়িওয়ালা। বুড়ো হয়ে গেলেও এখনো নিজের হাতেই রোজকার বাজারটা সেরে
নেন এই মানুষটি। কোন ক্লান্তির দেখা নেই মুখে। বেশ ভাল একটা সম্পর্ক রয়েছে তার
সাথে অন্য ভাড়াটিয়াদের তুলনায়।
-না চাচা, কিছু না। বাজার করে ফিরলেন? বললো মান্নান সাহেব।
-আর বইলো না,আজকাল কাঁচা বাজারের যেভাবে দাম বাড়তেছে,
এই দেশের ভবিষ্যত
যে কোন জায়গায় দাঁড়াইবে তাই ভাবতাছি। কোন
সরকারই দ্রব্যমূল্য ঠিকঠাক ধরে রাখতে পারল না।
-তবুও তো চাচা, এই সরকার বেশ বাজারদর সবার হাতের নাগালের
কাছেই রেখেছেন বিগত সময়ের তুলনায়।
-আরে না গো কিছুদিন ঠিকঠাক ছিল আবার যেই সেই।
কিছুদিন আগে পাঁচটাকার কাঁচামরিচ আর এখন বিশটাকায় ঐটুকু পাওয়া যায়। এখন ভাবো আমার
কথাটা। ঠিক আছে যাও।
এই লোকের সাথে কথায় পারা যাবে না তা ভালো
করেই জানে মান্নান সাহেব। যে যারে দেখতে পারে না, তার হাজার গুণের কথা সবাই বললেও সে মানতে চায় না। মান্নান সাহেবের বাড়িওয়ালাও ঐরকম। এই সরকার
ক্ষমতায় আছে বলেই নাকি উনার ছেলের আয় রোজগার কমে গেছে। রোজ এই কথা শুনতে শুনতে কান
ঝালাপালা হয়ে গেছে মান্নান সাহেবের।
।।তিন।।
-হ্যালো
-কোথায় তুমি? খবরদার হাসপাতালের দিকে যেন যাওয়া না হয় আজ।
মান্নান সাহেবের স্ত্রীর ফোন। বেশ রাগের সুরে পাপিয়া।
-এই তো গলির মোড়ে। কোনো দরকার?
বললেন মান্নান সাহেব।
-হু, বাসায় আসো এখনি(এইবার বেশ শান্ত সুরে বললেন পাপিয়া)
নিজের স্ত্রীর কোন কথায় না রাখার মানুষ নন
মান্নান সাহেব। চুপচাপ আবার বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। ভালবাসার গভীরতম ইঙ্গিতে নেই
কোন প্রকৃত সূত্র। কিছু নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সাথে
জীবনের নেপথ্য সঙ্গীত আর সুখের আওয়াজ ঘোরে ফেরে বারবার আসে, এইসব কুড়িয়ে কুড়িয়েই যে পথ চলছেন দীর্ঘ দিন ধরে মান্নান সাহেব,
সেখানে প্রায়ই নড়ে ওঠে এক সবুজ পাতা। যে
পাতার গল্প মনে পড়লেও রোজ স্ত্রী
পাপিয়া তা ভুলিয়ে দিতে চায়। আর সেটা করার জন্যই
যখন তখন ডেকে নেয় মান্নান সাহেবকে। ঠিক তখনি
শুরু হয় মতবিরোধ। মান্নানসাহেব চুপ করে চলে যান হাসপাতালের
শিশু ওয়ার্ডের সামনে আর স্ত্রী ফোনের পর ফোন করতে থাকেন বাসায় চলে আসার জন্য। আজও কি সেই
জন্যই ডেকেছে? কে জানে ! এইসব ভাবতে ভাবতেই বাসার কলিংবেলে
হাত রাখলেন মান্নান সাহেব।
।।৪।।
দরজা খোলেই স্ত্রী পাপিয়া শুরু করলেন গল্প।
যা ভেবেছিল তাই।
-এইবার একটু থামবে?
এইসব আর কতো? বললেন মান্নান সাহেব।
-থেমেই তো আছি। ঠিকঠাক বলতে পারছি কই?
এই বলার স্বাধীনতা কি আমার আছে?
-সারাদিন তো তুমিই বলো। তারপরেও যদি ভেবে থাক
তোমার বলার স্বাধীনতা নেই তবে আমার কিছু করার নেই!
এই বলে মান্নানসাহেব দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন।
পেছন থেকে কিছু শব্দ পিছুটানের মতন কানে আসছে...
-খবরদার হাসপাতালে যেওনা। ঐখানে কি আমাদের
বাচ্চাকে আর খোঁজে পাবে? যেওনা।