সংশপ্তক
মিতালীর
সাথে আলাপচারিতায়
বিশ্বায়নের
কালে জেনারেশন গ্যাপ
সংশপ্তক: যদিও
আমাদের আলোচনার বিষয়, এই বিশ্বায়নের
যুগে জেনারেশন গ্যাপ, তবুও একথা তো খুবই সত্যি, পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের মানসিকতার ফারাক বলুন,
ধ্যান ধারণার ফারাক বলুন কিংবা আশা আকাঙ্খা বিশ্বাস অবিশ্বাসের বৈপরীত্য
বা দূরত্ব- এই বিষয়গুলি মানুষের সমাজ সংসারে নতুন তো কিছু নয়!
প্রতি যুগেই এক প্রজন্মের সাথে আর এক প্রজন্মের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে
দিয়েই সমাজ বিবর্তিত হয়ে চলেছে কালের পথরেখা ধরে। তাহলে এই জেনারেশন গ্যাপ নিয়ে আমাদের এত মাথা
ব্যাথাই বা কেন?
মিতালী: এই জেনারেশন গ্যাপ কে সঠিক অর্থে বলা যায় , দুই প্রজন্মের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য । আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় , দুই বা একাধিক মানুষের মধ্যে এক অসম্ভব
মানসিকতার মিল , কিন্তু তাদের বয়সের বেশ নজরমূলক তারতম্য। সবসময় যে এক প্রজন্মের
সাথে অন্য প্রজন্মের বৈপরীত্য বা দূরত্ব থাকে
, তাও ঠিক নয় । মূলকথা গ্যাপটা আসে
, দৃষ্টিকোণ থেকে । দ্বন্দ্ব বিজ্ঞান সন্মত , এভাবেই দুটো মত পাশাপাশি থেকে এক যুক্তি ও চলমান সমাজের বাতাবরণ রাখে ।
সংশপ্তক: আবার দেখুন, আমাদের বাল্য কৈশর যৌবনে কিন্তু আমরা এই জেনারেশন গ্যাপ নিয়ে এত
চিন্তিত থাকি না। যত চিন্তা অস্বস্তি সবই শুরু হয় আমাদের সন্তানদের কৈশর থেকে। অর্থাৎ এটা দেখা যাচ্ছে জেনারেশন গ্যাপ
নিয়ে দুশ্চিন্তাটা মূলত অভিভাবকদেরই। কৈশর যৌবনের সময়ের ছেলেময়েদের কিন্তু এই নিয়ে আদৌ বিশেষ মাথা ব্যাথা থাকে না। এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মিতালী: যখন কেউ নিজেকে তাঁর সন্তানের একমাত্র দাবিদার
ভাবতে শুরু করে , তখনই তিনি নিজেকে
অভিভাবকের আসনে বসিয়ে দেন। প্রতিটি মানুষের একটা স্বত্বা আছে , এটা আমরা কতজন অভিভাবক সত্যি স্বীকার
করি , বলুন তো ? আমরা আমাদের অর্থাৎ
অভিভাবকের নিজস্ব মত ইচ্ছা আকাঙ্খ্যা বেশিরভাগ সময়েই সন্তানের উপরে চাপিয়ে দি বলপূর্বক
। এবং তখনই দেখা দেয় মতপার্থক্য অর্থাৎ এই জেনারেশন গ্যাপ নামক
গল্পের সূচনা । আমরা ওদের অভিভাবক হই কিন্তু বন্ধু হতে পারিনা ।
সংশপ্তক: একদিকে সময়ের সাথে চলা আর একদিকে পূর্ববর্তী সময়কে
আঁকড়ে ধরে থাকতে চাওয়া, এই দুই
প্রান্তিক অবস্থানের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও সামঞ্জস্য বিধান কি ভাবে সম্ভব বলে মনে হয়
আপনার?
মিতালী: প্রতিটি মানুষই একজায়গায় বেশ চিন্তায় আধুনিক আবার অন্য একটি ব্যাপারে চরম সঙ্কুচিত
। এটাই মানুষের চরিত্রের বৈচিত্র্য । এই অবস্থানের মধ্যে থেকে , কেউ যদি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে
, সেটাই হচ্ছে আমার ধারণায় সহনশীলতা । দুই প্রান্তিকের মধ্যে
অবস্থান করে শুধুমাত্র নিজের মতকে কেবল আঁকড়ে না ধরে , অন্যের মতকেও সন্মান দেখান ।
সংশপ্তক: এখানে
একটি কথা আমরা প্রায়শই বিস্মৃত হই, সময়ের ধারা সবসময়ে সামনের দিকেই চলতে থাকে, থাকবে। আমরা কিছুতেই তার অভিমুখ বদলাতে পারবো
না। সেইখানে দাঁড়িয়ে আমরা
প্রথমেই যেটা মস্ত বড়ো ভুল করে বসি; সেটা হল আমাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠার যুগটিকে বা তাদের কর্মজীবনের পর্বের যুগটিকে
আমরা নিজেদেরও যুগ ভাবতেই পারি না। কারণ তখনও আমরা আমাদের চিন্তা চেতনায় আমাদের ফেলে আসা সময়েই
পড়ে থাকি। অথচ কিছুতেই ভেবে দেখি না আমাদের সন্তান সন্ততিদের যুগটিও আমাদেরও যুগ। কারণ আমরা যে এই যুগটিতেও জীবিত। মৃত বা অবসৃত নই। আমাদের বয়সের সাথে চিন্তা চেতনার এই
দূ্র্বলতা বা দৈন্যতার কারণ কি বলে মনে হয় আপনার? না কি এই ভাবে ভাবনা করাটা আদৌ মানসিক দূর্বলতা বা দৈন্য কোনোটাই
নয় বলই মনে করেন আপনি?
মিতালী: মানসিক দুর্বলতা বলে আমি মনে করি না , এই ভাবনাটা আসা স্বাভাবিক । কারণ আমাদের প্রতিটি যুগে বা সময়ে সমাজের চিন্তা চেতনার ছাপ থেকে যায় সেই প্রজন্মের
উপর। এর ব্যতিক্রম ও যে নেই , তা নয় । যেমন ধরুন উদাহরণ হিসেবে এই ডিজিটাল ব্যবস্থা
, যা আমরা ছোটবেলায় হাতে পায়নি । এখন এই সুযোগ আমরা দুই প্রজন্ম এমনকি
তিন প্রজন্ম ব্যবহার করছি । এখন অনেক কিছুই আমাদের কমন হয়ে গেছে ।
সংশপ্তক: জেনারেশন গ্যাপের আর একটি বড়ো দিকই হচ্ছে মূল্যবোধের
পরিবর্তন। অধিকাংশ অভিভাবকদেরই অভিযোগ বর্তমান প্রজন্ম মূল্যবোধগুলি হারিয়ে ফেলছে দ্রুত, কিংবা পরিচিতই হচ্ছে না সুস্থ সুন্দর মূল্যবোধগুলির
সাথে, যেগুলির সাথে পারিবারিক বংশ কৌলিন্য শিক্ষা সংস্কৃতি যুক্ত
থাকে উত্তরাধিকার সূত্রে। এই বিষয়টি আপনি ঠিক কি ভাবে দেখে থাকেন? এই সমস্যা আপনার পরিবারে উদ্ভুত হলে কি ভাবেই বা করবেন তার সমাধান?
মিতালী: মূল্যবোধের পরিবর্তন নয় ,ওটা আসলে হারিয়ে গেছে । এখানে অভিভাবকদের হাহুতাশ
কোন কাজে লাগবেনা বা লাগছেনা কারণ এখন শিশুদের উপর বাজার অর্থনীতির প্রভাব অনেক বেশি
অভিভাবকের পুরনো মূল্যবোধের থেকে । বিজ্ঞাপনের যুগ চাহিদা সংস্কৃতিকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে ,এখন এই চাহিদার ঘোড়দৌড়ে ক্রয়ক্ষম মানুষকে থামতে
দিচ্ছেনা । শিশু কিশোর মহিলা পুরুষ নতুন নতুন চাহিদা নিয়ে নিজেকে সমাজে পৃথক করে দেখে
ফেলছে ।কাদের কেনার ক্ষমতা আছে আর কাদের নেই । এই চাহিদা এখন সমাজে
চরম শ্রেণী বৈষম্যকে ন্যক্কারজনক ভাবে তুলে ধরছে । বংশ কৌলীন্য , উত্তারাধিকার সূত্র এই শব্দমালা আমার
কাছে কোন অর্থ বহন করেনা । এগুলো মনে হয়
, মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের
আরও বেশি অন্তরায় ।
সংশপ্তক: সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি সবসময়েই ধারাবাহিক বিবর্তনের
মধ্যে দিয়ে চলেছে। সেই চলাটাকে কেউ বলছে এগিয়ে চলা, আবার কেউ বলছে উচ্ছন্নে যাওয়া। দুই পক্ষই ভুল বা দুই পক্ষই যে ঠিক তেমনটা নাও
হতে পারে। কিন্তু কোথাও কি একটা বোঝাপড়ার ভুল হতে পারে না এই দুই দৃষ্টিভণ্গীর মধ্যে? এই বিষয়ে আমরা আপনার সুচিন্তিত অভিমত জানতে
আগ্রহী। যদি সম্ভব হয় একটু বিস্তৃত ভাবেই।
মিতালী: বিবর্তনকে মানতেই হবে সেটা সদর্থক কিম্বা নঞর্থক
। কিভাবে আমি বিচার করব
অন্যকে , আমারটা কি আদৌ সঠিক
? কে বিচার করবে সেটা ? সবারই নিজের কাজের পিছনে যুক্তি থাকে , সেটাই স্বাভাবিক। কোন কোন কাজের অনেক সময় সঠিক মূল্যায়ন হয় কয়েক বছর অথবা কয়েক যুগ পর , সেক্ষেত্রে বুঝব আমরা ভাবনায় পিছিয়ে ছিলাম । অথবা সেই ব্যক্তি অনেক
দূরদর্শী ছিলেন । এই এগিয়ে থাকা মানুষকে আমরা বেশির ভাগ সময়েই ছোট বা হেয় প্রতিপন্ন
করে থাকি । এই বোঝার ভুল অনেকসময় বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি করে । যেমন ধরুন রবি ঠাকুরের
গান
,কত কত স্বত্ত
সীমানার বলয় অতিক্রম করে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে
, সেটা পঞ্চাশ বছর আগেও কেউ ভাবতে পেরে ছিল । পক্ষে বিপক্ষে মতামত অবশ্যই আছে
এবং থাকবে ।
সংশপ্তক: এবারে আসি বিশ্বায়নের এই বিশেষ যুগে। কেউ বলছে এ এক অভূতপূর্ব সময়। মানুষের হাতের মুঠোয় পৃথিবী। আবার কেউ বলছে এ এক মহা গণ্ডোগোলের
সময়। নেপোয় দই মারার মতো
এমন যুগ এর আগে আর আসেনি কোন দিন। আবিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির হাতে ধরে জেনারেশন গ্যাপ কি বেড়ে গিয়েছে এই যুগে? না কি জেনারেশন গ্যাপকে অনেকটাই কমিয়ে আনারও
এক বিরাট সুযোগ নিয়ে হাজির এই বিশ্বায়ন। যেখানে নাতির সাথেও স্বচ্ছন্দে নেটে বসে চ্যাট
করতে পারেন দাদু দিদিমা?
মিতালী: এই বিশ্বায়ন আমদের দ্রুত কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে
এসেছে । সত্যি
হাতের মুঠোয় পৃথিবী , নিয়ে এসেছে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য অনেক , বিপরীতে
এক অফুরান চাহিদার মন । এই অতি আধুনিক পরিস্থিতির সাথে অনেকেই ঠিক ভাবে তাল মেলাতে
অক্ষম হয়ে পড়ছে । কতটা আমার জন্য অথবা কোথায় আমি থামব ? আমরা বেশির ভাগই বুঝতে পারছিনা ।
সংশপ্তক: বিতর্ক যতই থাকুক, একথা খুবই সত্যি যে বিশ্বায়ন প্রযুক্তিকে সাধারণ
মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে এনে দিতে পেরেছে। এখন প্রশ্ন সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে গিয়ে বর্তমান
প্রজন্ম যত বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়বে, তত বেশিই কি পারিবারিক মূল্যবোধ, সাংসারিক আবেগ,
পারস্পরিক আত্মীয়তার ঐতিহ্য থেকে বড়ো বেশি দ্রুত হারে দূরে সরে যেতে
থাকবে বলে আশঙ্কা হয় আপনার?
মিতালী: অবশ্যই নতুন প্রযুক্তি এই প্রজন্মকে একমুখী
করে ফেলছে অনেকাংশে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
শুধুই যে শারীরিক ক্ষতি অর্থাৎ একই জায়গায় বসে থাকছে
, শরীরের নড়াচড়া কম হচ্ছে এবং চোখ খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হচ্ছে ,শুধু তাই নয় মানসিক ভাবেও । সমাজ ও পরিবারের সাথে ওঠাবসা , মত বিনিময় কম হয়ে , বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমরা । মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে
দিনে দিনে ।
সংশপ্তক: আমাদের মনে হয়, জেনারেশন গ্যাপের সমস্যাটি সৃষ্টি হয় মূলত অভিভাবকদের অভিভাবকত্বের
ত্রুটি বা দৈনতা থেকেই। যে সব পরিবারের অভিভাবকরা সন্তান সন্ততিদের চিন্তা ভাবনা আশা আকাঙ্খার সাথে যত
বেশি আত্মিক যোগ রাখতে পারেন, সেই
সব পরিবারে দুই প্রজন্মের মানসিকতার ফারাক তত কম হয় বা পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব ঘটার
সম্ভাবনা থাকে অনেক কম। এই বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাইছি আমরা। ঠিক কি ভাবে দেখেন আপনি এই বিষয়টি।
মিতালী: আমার মতে এই জেনারেশন গ্যাপ আগে আরও বেশি কঠিন ছিল , অর্থাৎ মধু কবির সময় , এক ভয়ংকর অবস্থা ছিল । এখন এটা আর কোন সমস্যাই নয় । অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন
আসছে বা এসেছে ।
সংশপ্তক: সবশেষে জানতে চাইবো এই জেনারেশন গ্যাপ; তা সে, যে যুগেরই হোক
না কেন, মানুষের নান্দনিক সৃষ্টির কাজে, সাংস্কৃতিক দিগন্তের বিস্তারের ক্ষেত্রে, জ্ঞান বিজ্ঞান
চর্চার জগতে কতটা অনুপ্রেরণার সঞ্চার করতে পারে বলে মনে করেন আপনি। নাকি আদৌ বিষয়টি সেই রকম নয়? এই প্রেরণার সাথে জেনারেশন গ্যাপের কোন সংযোগ
নেই? থাকে না?
মিতালী: একটা আক্ষেপ প্রায়ই অভিভাবকদের কাছ থেকে শোনা
যায় , ওকে বুঝিনা অর্থাৎ নিজের
সন্তান সম্পর্কে এক অভিযোগ , যা হতাশার মত শোনায় । ছেলেটি বা মেয়েটি যা
বই পড়ে কিম্বা যা গান শোনে , তা অভিভাবকের পছন্দের বা রুচির বাইরে । বিশেষ করে এখন পোশাকের কথাও উঠে আসে এ প্রসঙ্গে। সেক্ষেত্রে লেখাপড়া
বা ডিগ্রি নেওয়ার পর , অন্যদিকটা নান্দনিক সৃষ্টি , সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল
অনেকটাই পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ব্যতিক্রম ও যে নেই তা নয় , বাবা ছেলে একই সঙ্গে নাটক গ্রুপে বা গান বাজনার জগতে কিম্বা
একই রাজনৈতিক মতাদর্শে । এখন দেখা যাচ্ছে অভিভাবকরা এক সন্তানের জন্য অনেক ধৈর্য ও
সহনশীলতা দেখাতে পারে , আগের প্রজন্মের ব্যাপারে যেটা সম্ভব হয়ে উঠত না ।
মিতালী মুখোপাধ্যায়:
যারা ভাবে বেশি,তারা একটু কম কথা বলে হয়ত , আমিও অনেকটাই তাই । চাহিদার জায়গাটা
নিজের আয়ত্তে থাকায় , বেশি হতাশ কোন সময় হই না ।প্রশংসা শুনলে লজ্জা পাই । তবে মানুষের ভালোবাসা আমার বড় প্রিয় । সবার সাথে থাকতে চাই । মানবতা আমার ধর্ম
।
We sincerely thank you
for your time and hope we shall have your continued support.
Aparajita
Sen
(Editor:
Songsoptok)