সুবোধবাবুর জীবনে একটা
ট্র্যজেডি আছে। কেন জানি না ভদ্রলোককে প্রথম দেখার দিন থেকেই সেই কথাই মনে হয়েছিল।
ভদ্রলোককে কদাচিৎ হাসতে দেখা যেত। তাও সে হাসি বড়ো বিষন্ন, যেন দুঃখ দিয়ে ঘেরা। অনেকটাই
ভদ্রতার খাতিরে হাসা। প্রায় নিঃসঙ্গ মানুষটিকে নিয়ে আমাদের জুনিয়রদের মধ্যে হাসি
তামাশাও কম হতো না। সে অনেকদিন আগের কথা। তখন মাত্র কবছর হলো সরকারী চাকুরীতে যোগ
দিয়েছি। উঠতি যৌবন। হই হই রই রই করে জীবন কেটে যাচ্ছে। কি অফিসে কি বাড়িতে। যেমনটা
হয় আর কি। সেই সময়েই সুবোধবাবুকে যেন একেবারেই অন্য গ্রহের বাসিন্দা বলে মনে হতো।
আমাদের থেকে অনকটাই সিনিয়র। রিটায়ার্মেন্টেরও খুব বেশি দেরি ছিল না, আমরা তখন নব্য যুবা। তাই যতটা
পারতাম ওনাকে স্বসম্ভ্রমে এড়িয়েই চলতাম। কিন্তু মানুষটি ছিলেন অতি সদাশয়। নিপাট
ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় আর কি। ভদ্র বিনয়ী শান্তিপ্রিয়। এবং সৎ ও একনিষ্ঠ কর্মী।
আর সেই সুবাদেই অফিসের সকলের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। অফিসের বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মী বলে
তাঁর বরাবরই একটা আলাদা সম্মান ছিল। যুগটাও ছিল সেইরকম। ঠিক আজকালকার মতো নয়।
দিন বসে থাকে না। সময়ের চাকায়
সেও এগিয়ে চলতে থাকে যথারীতি। তাই দেখতে দেখতে সুবোধ বাবুরও রিটায়ার্মেন্টের দিন
এসে গেল। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবনের শেষে অফিসের পক্ষ থেকে ওনাকে ফেয়ারওয়েল
দেওয়াও হলো। মানুষটি বরাবরই জাঁকজমক এড়িয়ে চলেন বলে ওনার ফেয়ারওয়েলও খুবই অনাড়ম্বর
কিন্তু আন্তরিক ভাবে সম্পন্ন করা হলো। কিন্তু সেই ফেয়ারওয়েলেই সবাই মিলে তাঁকে
চেপে ধরা হল, তাঁর আজীবন
কৌমার্য ব্রতের নেপথ্যের কাহিনী বলার জন্যে। চিরকুমার মানুষটির এই চির কৌমার্য
নিয়ে অফিসে বিশেষ করে আমাদের জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে বিশেষ কৌতুহল ও রঙ্গরসিকতার
অন্ত ছিল না। সরাসরি তাঁকে উপদ্রপ করার সাহস না থাকলেও আড়ালে আবডালে চাপা
রঙ্গরসিকতার চল একটা ছিলই। কিন্তু ফেয়ারওয়েলের দিনে সেই দূরত্বের চৌকাঠ পেড়িয়ে
আমরাই বেশ জোর করে চেপে ধরলাম সুবোধবাবুকে।
আর কি আশ্চর্য্য আমাদের সেই
অল্প বয়েসের তরলমতির প্রগলোভ আব্দারে অনেকটা পিতৃসুলভ স্নেহেই যেন এত বছরের জমাট
বরফ গল্ল। অফিসের অন্যান্য সিনিয়র কর্মীদের হতবাক করে দিয়ে সুবোধবাবু রাজী হলেন।
কিন্তু একটি শর্ত্তে। পরের রবিবার তাঁর বাড়িতে অফিসের সবাই মিলে ফিস্ট করতে হবে।
খরচ সব তাঁর। কিন্তু ব্যবস্থাদির ভার সব আমাদেরকেই নিতে হবে। আমরা জুনিয়র কর্মীদের
দল তো মহানন্দে এক পায়ে খাড়া। বাকিরাও সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন।
সুবোধবাবুর নাকি তিনকূলে কেউ
ছিল না। নিজেই চাকুরীর সূত্রে শহরের উপকণ্ঠে ছোট একটি বাড়ি করেছেন। সবাই মিলে পরের
রবিবার হইহই করে পৌঁছানো গেল সেই বাড়িতে। সত্যই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। সুবুজে
ঘেরা ছোট একটা মরুদ্যান যেন। শহরের ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও একটি শান্তিনিকেতন।
বাড়ির নামটিও তাই সার্থক। চিরকুমার মানুষ কিন্তু ঘরগেরস্থলিতে লক্ষ্মীশ্রীর ছাপ
সুস্পষ্ট। প্রথমে ঠিক হয়েছিল খাওয়া দাওয়ার পর গল্পগুজব শুরু হবে। কিন্তু আমাদের
তখন তরুণ রক্ত। উত্তেজনার পারদ চড়তে চড়তে ধৈর্য্য রাখাই কঠিন। তাই খেতে বসেই
ডেসপ্যাচের অনিল সমাদ্দারই প্রথম চেপে ধরলো। বয়সে আমাদেরই সমান। একটু বেশি
প্রগলোভও বটে। আর দুনিয়ার মানুষের হাঁড়ির খবর রাখতে সমাদ্দারের জুড়ি ছিল না।
সমাদ্দারের কথায় বাকিরাও সমস্বরে হইহই করে উঠলো। হ্যাঁ আর দেরি নয়। সবাই তখন গল্প
শোনার মুডে। খাওয়া আর গল্পে এমনিতেই বাঙালির জুড়ি মেলা ভার।
সুবোধবাবুর মুখে সেই একচিলতে
সামান্য হাসি। অনেকটাই বিষন্নতায় রাঙানো তলায় তলায়। বল্লেন বেশ তবে শুনুন। সে অনেক
যুগ আগের কথা। তখন উঠতি যৌবন, সদ্য ক’বছর হলো
সরকারী চাকুরীতে জয়েন করেছি। জানেনই তো আমার তিনকূলে কেউ নেই। মানুষ হয়েছিলাম আমার
এক দূরসম্পর্কের মামার কাছে। তাঁরও আত্মীয় স্বজন বলতে একমাত্র আমি। তাই আদর যত্নের
অভাব ছিল না। তিনিও ছিলেন আমারই মতো একলা। তবে অকৃতদার নয়। মামী হঠাৎই স্ট্রোক হয়ে মারা যান।
বিয়ের কিছুদিনের ভিতরেই। সেই থেকে মামাও একলাই ছিলেন। তাই আমাকে পেয়ে তিনিও যেন
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর সমস্ত স্নেহ দিয়ে আগলিয়ে রাখলেন আমাকে। বড়ো করে তুললেন
প্রকৃত অভিভাবকের মতো। কিন্তু সবই আমার কপাল। নাহলে চাকরি পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই
মামাই বা চলে যাবেন কেন? এই বিরাট
বিশ্বে বৈচিত্রের তো কোন অভাব নাই। তাই হয়তো কিছু কিছু মানুষের জীবনে আপনজন টেকে
না বেশি দিন। আমার ভাগ্যটাও ছিল ঠিক সেই রকম।
সুবোধবাবুর কথার মধ্যে এক
নিঃসঙ্গ মানুষের দীর্ঘশ্বাসে যেন জগতের সকল নিঃসঙ্গ মানুষের হাহাকার বেজে উঠলো
একসাথে। সকলেই কান পেতে শুনছিলাম তাঁর গল্প। নিবিষ্ট মনে। দেখতে পাচ্ছিলাম মানুষটি
যেন হঠাৎই তাঁর ফেলে আসা জীবনের অনেকটা পেছনেই পৌঁছিয়ে গিয়েছেন। সেখানে আমরা
উপলক্ষ্য মাত্র। তিনিও বলতে থাকলেন সেই সব পুরানো দিনের কথা। মামার মৃত্যুর পর
একেবারে ঝাড়াহাতপা সদ্য যুবা সুবোধ পুরোকায়স্থর কথা।
তারপর থেকে অফিস আর বাড়ি বাড়ি
আর অফিস। এরই মধ্যে নতুন শহরে বদলি। নতুন পরিবেশ নতুন বন্ধুবান্ধব। মেসের জীবন।
এইভাবেই চলছিল জানেন। কিন্তু তলায় তলায় একটি শান্তির নীড় একটি ছোট্ট সংসার একটি
মনের মতো সুন্দর বৌ এই সব প্রাত্যহিক মোহগুলো যেন দিনে দিনে প্রবল হয়ে উঠতে লাগলো।
কিন্তু আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ না থাকায় সেই বিষয়ে উদযোগ নেওয়ারও কেউ ছিল না। সেই
কালটাও ছিল অন্যরকম। এ যুগের মতো এমন খোলামেলা কাল তো ছিল না। সমাজ সংসারের ধরন
ধারণও ছিল আলাদা। এই ভাবেই চলছিল একার সাথে একা থাকার দৈন্দিন পালা। এই ভাবেই
চলছিল রোজকার কর্মব্যস্ত জীবন। তারই মধ্যে একদিন কি মনে হলো হঠাৎ ঠিক করলাম আজ আর
অফিস গিয়ে কাজ নাই। তখন যে পদে কাজ করতাম, তার দায়িত্ব বা কর্ম ব্যস্ততাও এমন বিরাট কিছু ছিল না যে হঠাৎ একদিন ডুব
মারলে অফিস অচল হয়ে যাবে। তখন আমরা নেহাৎই জুনিয়র স্টাফ। তাই সকাল সকালই বেড়িয়ে
পড়লাম। ঝাড়া হাত পা। কার্তিকের নীল আকাশ। মনের মধ্যে যেন একটা ছুটি ছুটি ভাব।
আমাদের সেই শহর থেকে ঘন্টা
খানেকের দূরত্বেই ছোট একটা পাহাড় জঙ্গল ঘেরা আধা শহর আছে শুনেছিলাম। ট্রেন লাইনের
পথেই। ষ্টেশনও আছে একটা। অনেকেই শীতকালে বেড়াতে যায় শুনেছি। ট্রেনের টিকিট কেটে
অপেক্ষা করছি প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে। যাত্রীদের ভিড় সামান্যই। আর তখনই দেখলাম
ওকে।
সুবোধবাবু কিছুক্ষণের জন্যে চুপ
করে আত্মনিমগ্ন হলেন। আমরাও চুপ। পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছি। সমাদ্দারের চোখদুটো
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছি, গল্পের খোঁজ পেয়েছে সে।
কি আর বলবো এখন। বলতে থাকলেন
সুবোধবাবু। তখন যৌবনের স্বপ্ন মাখা চোখ। চলতে ফিরতে মেয়েদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ
ওঠাবসা গালগল্পের যুগ ছিল না সেটা। সে এক অন্য
জেনারেশনের যুগ। এখনকার মতো নয়। কল্পনা আর
সাহিত্যের মধ্যেই ছিল মেয়েদের সাথে দেখা সাক্ষাতের পরিসর। কিন্তু মনের মধ্যে
যৌবনের অনুভবে সঙ্গসুখের টানটা ঠিকই থাকতো সেই যুগেও। এমনকি আমাদের মতো আত্মীয়
স্বজনহীন একাকী মানুষদেরও। আর তাই প্রথম দেখার সেই মুহুর্ত্তেই সারা শরীরে বয়ে গেল
একটা সুখানুভুতির অনুরণন। মনে হলো আহা, এই কি সেই যার কথা মনের কল্পনায় ডানা মেলে ক্ষণে ক্ষণে? এমনই একজনের সাথে জীবনের রঙগুলি
মেলানোর জন্যেই কি অপেক্ষা করে না যৌবনের অষ্টপ্রহর!
আমরা যারা তখন অফিসের জুনিয়র
স্টাফ, সদ্য যোগ
দিয়েছি সরকারী চাকরিতে, সুবোধবাবুর
স্মৃতিরোমন্থনের পথে আমাদেরও মনের কল্পনা যেন একাকার হয়ে উঠতে লাগলো। সত্যইই তো
এইরকমই হয়। আবাক হলাম স্বভাব চুপচাপ সুবোধবাবুও তো আমাদের থেকে আলাদা কোন গ্রহের
বাসিন্দা নন জেনে। লোকে যে তবে বলে জেনারেশন গ্যাপ, কই সুবোধবাবুর জেনারেশনেও তো সেই
একই অনুভবের ক্যানভাস। আর ওদিকে সুবোধবাবু যেন তখন ঠিক আমাদের মধ্যে নেই। ফিরে
গিয়েছেন সেই কত যুগ আগের সদ্য যুবক সুবোধ পুরোকায়স্থতে।
সাধারণ আটপৌর ঘরের মেয়েই হবে।
খুবই সাধারণ সাজসজ্জা। বলতে থাকলেন সুবোধবাবু। আমাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিগুলির দিকে
তাকিয়ে নিয়ে আলতো হাসিতে বললেন, না না চটকদার সুন্দরী সে ছিল না। খালি সারা মুখে একটি পরিতৃপ্তির আভা
সূর্যের মতো দীপ্ত। কাঁধে একটা নীল রঙের হাতব্যাগ। সেও ট্রেনেরই অপেক্ষায়। আমার
এতদিনের যে স্বপ্ন, যা আবছা আবছা
হয়ে অস্পষ্ট একটা আর্তিতে ঘিরে রাখতো আমার সারাটা দিন, সেই যেন সেই মুহুর্ত্তে সশরীরে
হাজির আমারই দৃষ্টি সীমানায়। এদিকে আমার পাল্সরেট হার্টবিট দুই তখন এক্সপ্রেস
ট্রেনের গতিতে ছুটছে। কিন্তু আমাদের জেনারেশনটা তো এখনকার মতো এত এক্সপ্রেসিভ ছিল
না। বিশেষ করে প্রেম ভালোবাসা মেয়েদের সাথে আলাপ পরিচয়ের বিষয়ে। সবসময়ে একটা
স্বম্ভ্রমের দূরত্ব থাকতো আমাদের চলাফেরায়। সেই যুগটাই ছিল এমনই। ফলে সুখানুভুতির
সাথেই একটা কষ্টও দেখা দিচ্ছিল ধীরে ধীরে।
দেখতে দেখতে ডাউন লাইনে একটি
লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়ালো। যাত্রীদের ওঠা নামার মধ্যেই মেয়েটিও দেখলাম একটি কামরায়
উঠে পড়লো। আমি যাবো আপ লাইনের ট্রেনে। আমার গাড়ী তখনো এসে পৌঁছায়নি। যাত্রীদের
নেমে যাওয়ার পর ট্রেনটিও বেশ খালি হয়ে যাওয়ায় মেয়েটি দেখলাম জানলার ধারেই বসার
যায়গা পেয়ে গিয়েছে। আমি যেন ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল
আমিও উঠে পড়ি ঐ ট্রেনে। কাছাকাছি বসার একটা জায়গা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তখনকার দিনে
এখনকার মতো এতো ভিড়ভাট্টা লেগে থাকতো না সবসময়ে। কেবলই মনে হতে থাকলো আর কয়েক
মুহুর্ত্ত মাত্র। তারপরেই জানারণ্যে মিলিয়ে যাবে সে। হঠাৎ দেখা একটুকরো স্বপ্নসম
ভালোলাগা।
কিন্তু জীবন তো সাহিত্য সিনেমার
মতো রঙিন নয়। তার আছে নিজস্ব বাস্তবতা। সেখানে আমরা কেউই চিত্রনাট্টের নায়ক নায়িকা
নই। পরিচালকের নির্দেশের টাট্টুঘোরা। তাই আমারও আর ওঠা হলো না সেই ডাউন ট্রেনের
বিশেষ কামরায়। যে কামরায় রয়ে গেল হঠাৎ দেখা একটুকরো জ্যোৎস্নাধারা। আমারই বুকের
মধ্যে দিয়ে যেন হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে গেল ডাইন লোকাল। সত্যি বলতে কি তখনও কিন্তু
দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়া যেত। খুব ইচ্ছেও করছিল। কিন্তু শুধু যে সেই যুগ বলেই
পারিনি তাও তো নয়। কারণ তো আরও একটা ছিলই। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে টিকিট কেট এসে
বসা থেকে ডাউন লাইনের ট্রেন এসে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাওয়া অব্দি একটি বারের জন্যেও
কিন্তু তার সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয় নি। হবেই বা কি করে! তার সেই আত্মনিমগ্ন পরিতৃপ্ত
প্রতিমূর্তীর দৃষ্টিপথে একবারও স্থান হয় নি আমার। সবটাই আমারই মনের ক্যানভাসে দেখা।
না সে তো দেখে নি একবারের জন্যেও আমাকে। প্ল্যাটফর্মের যাত্রীদের ভিড়ে কোন সুবোধ
পুরোকায়ষ্থকে আবিষ্কার করে নি তো সে।
চলে গেল সকালের ডাউন লোকাল।
কিন্তু আমার ভেতরে সব কিছুই যেন একটা ওলোট পালোট হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি আমি
তখন ঠিক আমার মধ্যে ছিলামও না। বাস্তব আর কল্পনার টলমলে সাঁকোতে সুবোধ পুরোকায়স্থ
তখন বেসামাল। এতটাই আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি তখন। তাই কখন যে আমার আপ লাইনের
গাড়ি এসে ছেড়ে গেছে খেয়ালও হয় নি। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এই জীবনের জনারণ্যে আর কি
কখনো তাকে দেখতে পাবো? আর সেই কথা
ভাবতে ভাবতেই কিছু না ভেবেই পরবর্তী ডাউন গাড়িতেই চেপে বসলাম। কোথায় যাচ্ছি কেন
যাচ্ছি কোন কিছুরই হুঁশ নেই। শুধু জানি সে চলে গেছে ডাউন লোকালে।
এইভাবে যে কতটা সময় কেটে গেছে
বলতে পারবো না। হঠাৎই সম্বিত ফিরে পেলাম আশপাশের তুমুল ব্যস্ততায়। যাত্রীদের
কোলাহলের মধ্যে খেয়াল হলো মাঝ রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে। অনেকেই নামা ওঠা করছে। কি
ব্যাপার? জানা গেল
সামনেই নাকি একটি বড়ো একসিডেন্ট হয়েছে। আপ ও ডাউন লাইনের গাড়ি এক লাইনে ঢুকে পড়ায়
মুখোমুখি সংঘর্ষ। কি সাংঘাতিক! সে না ছিল ডাউন লোকালেই? সেই গাড়ির সাথেই কি আপ লাইনের গাড়ির ধাক্কা লেগেছে? আমার সমস্ত ঘোর গেল ছুটে। গাড়ি
থেকে নেমে আমিও ছুটলাম লাইন ধরে। অনেকেই যাচ্ছে। কি ঘটেছে দেখতে। বেশ মাইল খানেক
যেতেই সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! দুটো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক
একটি কামরা বীভৎস ভাবে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রয়েছে এদিক সেদিক। মানুষের আর্ত চিৎকার।
ছুটোছুটি। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। সে এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। চারিদিকে আহত
নিহত মানুষের ছিন্ন ভিন্ন দেহ। কেউ শেষ চীৎকার দিচ্ছে, কেউ অজ্ঞান। কোথাও কাটা হাত পা পড়ে আছে। কারুর
থ্যাৎলানো মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। অনেকেই ব্যস্ত উদ্ধার
কার্যে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি গাড়িরই সমানের কামরাগুলি। কিন্তু সে? সে তো উঠেছিল মাঝামাঝি কোন একটি
কামরায়, এইটুকুই
খেয়াল ছিল তখনো আমার।
আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, তবু আমি পাগলের মতো খুঁজে চলেছি।
কাউকে জিজ্ঞাসা করছি শাদা লম্বাহাতা ব্লাউজের গোলাপী ডুড়ে শাড়ীর কাউকে দেখেছে কি
না? পরে ভেবেছি
সেই জিজ্ঞাসার মধ্যে প্রলাপ ছাড়া আর কিছু ছিল না বোধহয়। কারুর উত্তরের অপেক্ষা না
করেই খুঁজে চলেছি এদিক সেদিক। এইভাবে কতক্ষণ হবে কিছুই খেয়াল নাই, হঠাৎই লাইনের পাশে কাৎ হয়ে পড়ে
থাকা একটি কামরার ভাঙা সীটের তলায় সেই নীল রঙের হাতব্যাগটা চোখে পড়লো। যেটা তার
কাঁধে ঝুলতে দেখেছিলাম। ব্যাগটা দেখেই চিনতে পারি আমি। চাপ চাপ রক্তে ভেজা। অনেক
কষ্টে সীটের তলা থেকে টেনে হিঁচড়ে যখন ওর থ্যাতলানো দেহটা বার করলাম, তখন সেই দেহ ছেড়ে ক্ষণিক দেখা সেই
ক্ষণিকা অনেক দূরে চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। শুধু পড়ে রয়েছে একটা মাংসের দলা পাকানো
পিণ্ড। পেটের নাড়িভুড়ি সব বেড়িয়ে এসেছে বাইরে। সেই পরিতৃপ্ত সূর্যদীপ্ত মুখশ্রীটা
আর নাই। মুখের ছাল চামড়া প্রায় উঠে গেলেও চেনা যাচ্ছে। শুকনো রক্তের দাগ নেমে
এসেছে ঠোঁট বেয়ে।
আমাদের অনেকেরই খাওয়া বন্ধ হয়ে
গিয়েছে ছিল ততক্ষণে। প্রায় দমবন্ধ পরিবেশে একনিশ্বাসে সবাই সেই রোমহর্ষ ঘটনার
সাক্ষী হচ্ছিলাম যেন কত যুগ পড়েও। সুবোধ বাবুও কিছুক্ষণ চুপ করলেন। দুই চোখ বন্ধ
করে বসে রইলেন মিনিট খানেক। আমরাও যে যার মতো নিশ্চুপ। কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম
না প্রায় কেউই। শুধু সমাদ্দারের চোখের কোন চিক চিক করছিল দেখলাম স্পষ্ট। সুবোধবাবু
চোখ খুলতেই সবার দিকে নজর পড়তে অবস্থাটা টের পেয়ে বললেন- একি আপনারা খাচ্ছে না যে। না না
আগে খেয়ে নিন তারপর বাকিটা শুনবেন। বড়োবাবু নিখিলেশদা ওনার কথায় কান না দিয়ে তাড়া
দিয়ে উঠলেন। তারপর কি হলো জানতে চেয়ে।
তারপর? সুবোধবাবু হঠাৎই মৃদু হেসে উঠে
বলেন, তারপর আর কি।
তার সেই নীল হাতব্যাগ খুলে কাগজ পত্রের মধ্যে বাড়ির ঠিকানাটা পেলাম। তারপর মশাই সে
অনেক ঝক্কি ঝামেলা। একদিকে ঐ ছিন্নভিন্ন দেহ, অন্য দিকে বিস্তর দৌড়া দৌড়ি। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তো এখনকার মতো ছিল না।
সে অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপর আমি তো আত্মীয়স্বজন কেউ না। যাই হোক আমাদেরই
সেই অফিসের ক্যাশিয়ার অমিতেশের মেজো শালা রেলের এক বড়ো কর্তা ছিলেন তখন। তাঁকে
ধরেই বাকি বন্দোবস্ত করে ওর দেহটা নিয়ে যখন ফিরলাম আমাদেরই সেই শহরে, তখন সত্যইই আমি বিদ্ধস্ত।
সুবোধবাবু আবার থেমে যান। বেশ
কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বেয়ে ওঠা মাধবীলতাটার দিকে চেয়ে থাকেন। আমাদের মুখেও কোন কথা
নাই। উনিই আবার শুরু করলেন। সমান্য হেসে বললেন সে ছিল বাড়ির একমাত্র সন্তান।
ক্যানসার আক্রান্ত বাবা ও মায়ের ছোট সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। সেই শহরেই
একটি স্কুলে পড়াতো নাকি। সম্প্রতি এলাইসিতে চাকরি পেয়ে ডেলিপ্যাসেঞ্জারী শুরু
করেছিল। তখনো এলাইসির মাইনে ভালোই ছিল। তাই মেয়ের সরকারী চাকরি পাওয়াতে বাবা মাও
একটু আশার আলো দেখছিলেন। যদি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ক্যানসারের ভালো চিকিৎসা করাতে
পারেন। এসবই ওর বাবা মায়ের কাছ থেকে শোনা পরে। যখন ওনাদের সাথে ভালো করে পরিচয় হলো
তখন। পাড়াপ্রতিবেশীরা খুব সাহায্য
করলেন। কিন্তু সেই সদ্য সন্তান হারানো মা বাবার তীব্র হাহকার আমি আজও ভুলতে পারি
না কিছুতে জানেন?
সুবোধবাবুর দিকে তাকিয়ে আমরাও
নির্বাক। কোন কথাই মুখে এল না। উনি নিজেই আবার নীরবতা ভেঙে বলতে শুরু করলেন। তারপর
থেকে সন্তান হারা ঐদুটি মানুষের সাথে আমিও যেন কি এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম।
কিন্তু সেও যে খুব বেশি দিনের জন্যে তাও নয়। ভদ্রলোক তো আগেই গত হলেন। ওর মাও
তারপর আর বেশিদিন টিকলেন না। মনের দুঃখেই যেন চলে গেলেন তার পরপরই। ব্যাস এই তো
হলো আমার গল্প। বলেই সামন্য হাসলেন সুবোধ বাবু। রোজকার সেই চেনা পরিচিত হাসিতে।
অনেকক্ষণ পর পারচেজের রমেশ
পোদ্দারই অসহ্য সেই নীরবতাটাকে ভাঙলেন। কিন্তু সুবোধ দা, আপনি তাঁর কোন ফোটো বা স্মৃতিচিহ্ন
কিছু রাখেন নি? বুঝলাম
আমাদের সকলের মতো ওনারও খুব ইচ্ছে করছে যদি একটি ফটোও দেখা যেত। সুবোধবাবু বুঝি
একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন, তাই রমেশদার
কথা শুনতে পান নি মনে হলো। আমাদের ডিপার্টমেন্টের দেবেশ সরখেল হঠাৎ বলে বসলো, কিন্তু তাই বলে আপনি সারাটা জীবন
একা কাটিয়ে দিলেন সুবোধদা?
সুবোধবাবু এবার সম্বিত ফিরে
বললেন, কই না তো! একা কোথায়?
এবার আমাদের অবাক হওয়ার পালা
সকলের। সবাই সবার দিকে অবাক বিস্ময়ে মুখ চাওয়াচায়ি করছি, এমন সময় সুবোধ বাবু বললেন, ও হ্যাঁ একটা কথা আপনাদের বলতে
ভুলে গিয়েছি। ওর দেহটা যখন ভাঙা সীটের তলা থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে আনি, দেখি ওর ডান হাতের একটা আঙুল উপোর থেকে ইঞ্চি দেড়েক নেই। তখনো রক্তে ভেসে যাচ্ছে। চাপ চাপ রক্ত মাখা কাটা আঙুল। শুধু
একটি আংটি তখনো আঙুলের বাকি অংশের সাথে লেগে রয়েছে। ওরই রক্তে মাখামাখি হয়ে।
কি মনে হলো, তখন ওই অবস্থাতেই সেটা খুলে নিলাম তখনও ওর তাজা রক্তে মাখা সিঁদুর
রাঙা সেই আংটি। দেখলাম আমার ডান হাতের কড়ে আঙুলে দিব্যি ফিট করে গেল। তারপর তো আজ
এত বছরেও কোনদিন সেই আংটি আর খুলিনি। এই যে।
সুবোধবাবু ডান হাতটা প্রসারিত
করে ধরলেন। আমাদের বিস্ফোরিত চোখের সামনে। ঠিক কড়ে আঙুলেই একটি আংটি। সেই যেটি ছিল
আর একজনের হাতে রক্তমাখা হয়ে, আজ সুবোধ বাবুর হাতে, আমাদের ফিস্টের মাছের ঝোলের দাগ লেগে আছে তখনো।
[শ্রীশুভ্র]
ঊনত্রিশে জুন ১৯৮৯।