আসলে
এটা আমাদের গুজরাট ভ্রমণের কথা। আমাদের এই ভ্রমণের সঙ্গে মুন্না ড্রাইভার
ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই গল্পের নাম দিলাম, ‘মুন্না ড্রাইভার’।
আমার
ভাই অশোক ব্যাঙ্কে কাজ করে, তখন রাঁচিতে
পোস্টেড, এবার বদলি
হবার কথা চলছে। তার অদম্য ইচ্ছা কলকাতায় বদলি হবার। অশোকের এই কলকাতা-প্রীতি দেখে
একদিন রাগ করে বললাম, ‘তোর অনেক
দূরে গুজরাতে বদলি হলে ভালো হয়, তাহলে একটু দুনিয়া দেখবি।’ ও মা! বদলির অর্ডার এল পাটনা, খুব দুঃখ তার, সব জিনিস
গোছাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ
খবর এল তাকে গুজরাট ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে এয়ার টিকিট পর্যন্ত পাঠিয়ে
দিয়েছে। বেচারা মনের দুঃখে ফ্যামিলি নিয়ে চলে গেল গুজরাটের জামনগর। ওখানে গিয়ে
সমানে বলে, ‘দিদি, একবার এখানে
এসে বেড়িয়ে যাও।’
আমরা
ঠিক করলাম, একবার ঘুরেই
আসি—দ্বারকা, সোমনাথ দর্শন
হয়ে যাবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, আমরা গিয়ে পৌঁছলাম জামনগর। তারা আমাদের পেয়ে খুব খুশি, ঠিক হল, আমরা সবাই
একটা গাড়ি ভাড়া করে সারা গুজরাট ঘুরব। অশোক একটা গাড়ি ঠিক করল। সে আমাদের দ্বারকা, সোমনাথ, পোরবন্দর, অক্ষরধাম—আরো অনেক
জায়গায় ঘোরাবে। যাত্রার দিন সকালে গাড়ি সময়মতো চলে এল, আমরা
জিনিসপত্র নিয়ে নেমে এলাম। ড্রাইভার আমাদের নমস্কার করে বলল, ‘মেরা নাম
মুন্না হ্যায়।’ আমাদের প্রথম
দ্রষ্টব্য জায়গা অক্ষরধাম, কারণ কাছেই
অশোকের গন্ডোল বলে এক জায়গায় মিটিং আছে, সে সেখানে যাবে ইতিমধ্যে আমরা অক্ষরধাম মন্দির দেখে নেব।
অশোককে নামিয়ে আমি, আমার কর্তা, ভাইয়ের বউ
চৈতালি গেলাম অক্ষরধাম।
অক্ষরধামের
স্বামী নারায়ণের বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। কীভাবে সাধু স্বামী নারায়ণ এসে এই
মন্দির স্থাপনা করেন, মুন্না তা
আমাদের বিস্তৃতভাবে বলল। এরপর আমাদের রাজকোট রামকৃষ্ণ মিশন মন্দিরে যাওয়ার কথা, বেশ বেলা হয়ে
গেছে, আমরা চিন্তা
করছি মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে কিনা, আমাদের চিন্তা দেখে মুন্না বলল, ‘আপনারা একদম
চিন্তা করবেন না, আমি ঠিক সময়
পৌঁছে দেব।’ তাও মনে
আমাদের সন্দেহ। মন্দিরে পৌঁছে দেখি ভোগের পরে মন্দির কিছুক্ষণের জন্য খোলা হয়েছে।
আমরা মন্দিরে গিয়ে বসলাম, কিছুক্ষণ
ঠাকুরের কাছে প্রার্থনাও করলাম। মন্দির বন্ধ হলে আমরা মন্দির থেকে বেরোবার সময়
দেখি মুন্নাও মন্দিরে বসে আছে। বেরিয়ে আসছি এমন সময় মুন্না বলল, ‘তোমরা কীরকম
ভক্ত?’ আমরা সমস্বরে
বললাম, ‘কেন?’ ‘আমরা অনেক
কষ্টে মন্দির খোলা পেয়ে আনন্দে বসে একটু ধ্যান করলাম আর তুমি....!’ মুন্না
আমাদের সেদিন একটা বড় শিক্ষা দিল, যা ঠাকুরেরই কথা, সে বলল, ‘ঠাকুরের সামনে বসে তাঁকেই নয়ন ভরে দেখে নাও, মনে তাঁর ছবি
বসে যাবে। তোমরা চোখ বন্ধ করে কী করছিলে?’ আমরা নিজেদের লজ্জিত মনে করলাম। ভাবলাম, ওরে বাবা, মুন্না কত
কিছু জানে! কিন্তু তখনো তার জ্ঞানের পরিধির আন্দাজ করতে বাকি ছিল। এরপর অশোককে
গন্ডোল থেকে তুলে নিয়ে সোমনাথ দর্শন করতে এগিয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমাদের
নাকে মাছের আঁশটে গন্ধ এল, অশোক বলল, ‘আমরা এসে
গেছি সোমনাথ।’ আমি অবাক হয়ে
বললাম, ‘তুই কী করে
জানলি? তুই তো
ঘুমিয়ে ছিলিস।’ সে বলল, ‘মাছের গন্ধ
পাচ্ছ না?’ আমি বললাম, ‘গন্ধ তো
পাচ্ছি।’ সে বলল, ‘আমরা মাছের
বড় বন্দর ভেরাবল পার করছি, যেখানে
ট্র্লারে করে টন টন মাছ আসে আর বাজারে চলে যায় ট্রাকে করে। আর একটু পরেই আমরা
সোমনাথ পৌঁছে যাব।’ বিকেল বিকেল
ভারতের অন্যতম জ্যোতির্লিঙ্গ সোমনাথ মন্দিরে পৌঁছলাম।
একেবারে
ভারতের পশ্চিমের শেষ সীমানায় আরব সাগরের ধারে, জ্যোতির্লিঙ্গ সোমনাথ প্রতিষ্ঠিত। একটি স্মারক স্থাপন করা
রয়েছে দেখলাম, ভারতের
পশ্চিম সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। আরব সাগর শান্ত, বঙ্গপোসাগরের মতো ঢেউ নেই বিচে, উটে করে, ঘোড়ায় চড়ে
লোকে ঘুরছে। কত রকমের জিনিস, কত রকমের মূল্যবান পাথর লোকে দরদাম করে কিনছে। সূর্য
অস্তাচলে, জলে লাল রঙের
খেলা। অপূর্ব দৃশ্য—কিছুক্ষণ
বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করে সন্ধ্যা-আরতি দেখব বলে মন্দির পরিসরে গেলাম। প্রচুর ভিড়, আমরা ভিড়ের
মধ্যেই মন্দিরে ঢুকলাম। ভিড়ের মধ্যে আমরা দলছাড়া, আমি একেবারে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। হঠাৎ
দেখি পুলিশ এসে দরজার কাছে সবাইকে সরিয়ে দিচ্ছে যাতে আরতির জ্যোতি চারিদিকে ঘুরিয়ে
চার কোণে যে ঠাকুরের মূর্তি আছে, তাদেরও আরতি করা যায়। পুলিশ এসে আমাকেও মন্দির থেকে বার করে
দিল। আমার মনে খুব দুঃখ হল। এত দূর এসে শেষে সোমনাথের আরতি দেখতে পেলাম না। মুখ
চুন করে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ মুন্না কোথা থেকে উদয় হল। আমাকে ঐরকম করে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যা হুয়া
মাতাজী, কিঁউ আপ দুখী
হ্যায়?’ আমি প্রায়
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘আমাকে পুলিশ
বার করে দিয়েছে, আমার আর আরতি
দেখা হল না।’ সে বলল, ‘উসমে ক্যা
হ্যায়, পিছে দেখিয়ে।’ পিছনে তাকিয়ে
দেখলাম, বিশাল বড়
টিভি লাগানো, সুন্দর আরতি
দেখা যাচ্ছে, আমার তো
আনন্দে মন ভরে গেল। মুন্না কিন্তু পাশেই দাঁড়িয়ে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী করে
আরতি দেখছ?’ আমি অবাক হয়ে
বললাম, ‘কেন, আরতি যেমন
দেখে তেমনি।’ ততক্ষণে দেবী
পার্বতীর আরতি শুরু হয়ে গেছে। সে বলল, ‘ওয়সে নাহি, মাতাজী আপ পহলে পার্বতীজী কি নুপুর পর ধ্যান
দিজিয়ে, ফির ধীরে
ধীরে উপর কি ওর পার্বতীজীকা দর্শন কিজিয়ে, তাভিতো উনকা ছবি মন মে অঙ্কিত হো জায়গা।’ আমি বিস্ময়ে
মূক হয়ে গেলাম!! সত্যি সেদিন থেকে আরতি দেখতে শিখলাম।
আরতির
পর অহল্যাবাইয়ের শিবমন্দির ইত্যাদি ঘুরিয়ে মুন্না আমাদের নিয়ে গেল মন্দিরের পিছনে
সমুদ্রের ধারে। তখন ভাঁটার সময়, আমাদের বলল, ‘ছোট ছোট শিবলিঙ্গ দেখতে পাচ্ছ?’ আমরা দেখলাম, দূরে দূরে
বেশ কিছু শিবলিঙ্গর ওপরটা দেখা যাচ্ছে। মুন্না আমাদের জ্ঞান দিল সোমনাথকে যতবার
ধ্বংস করা হয়েছে সেগুলি সমুদ্রে লীন হয়ে গেছে কেবল ভাঁটার সময় মন্দিরের
শিবলিঙ্গগুলি দেখা যায়। এরকম অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেলাম শুধু মুন্নার জন্য। পরদিন
সকালে আমরা মন্দিরে গেলাম শিবলিঙ্গে জল অর্পণ করতে। কী অপূর্ব ব্যবস্থা! মন্দিরে
একটুও জল পড়ে নেই, ওখানেই বোতলে
জল, ফুল, বেলপাতা, কিনতে পাওয়া
যাচ্ছে। এতদিন জানি, শিবমন্দির
মানেই জল, কাদাময়, এখানে কত
সুন্দর ব্যবস্থা! আমাদের ফুল, বেলপাতা নিয়ে পূজারি একটা ঝুড়িতে রেখে দিল। ঝুড়ি ভরে গেলে
শিবকে অর্পণ করে দিচ্ছে। রাতে আমরা মন্দিরের পিছন দিকে ওপেন এয়ার গ্যালারি বানানো
আছে, তাতে বসে
লাইট এন্ড সাউন্ড দেখতে গেলাম। অপরূপ দৃশ্য।
সূর্য
পশ্চিম প্রান্তে অস্তাচলে চলে গেছেন, সন্ধে নেমে আরব সাগরের জলে কালি মাখিয়ে দিয়েছে। মাছ ধরার
ডিঙিগুলো আলো জ্বালিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়েছে। সাগরের মাঝে যেন দীপাবলি! পুরাণের
কাহিনি দিয়ে প্রোগ্রাম শুরু হল, কীভাবে চন্দ্রমা অভিশপ্ত হয়ে পাশের চন্দ্রভাগা নদীর ধারে
তপস্যা করে পাপ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন। তারপর সোমনাথের ধ্বংস, আবার নির্মাণ
কাহিনি এবং সবশেষে সর্দার প্যাটেলের দ্বারা কীভাবে এক টাকা চাঁদায় বর্তমান মন্দির
তৈরি হয়েছিল, সেটাও জানা
গেল। পরদিন সোমনাথের শৃঙ্গার দেখে আমরা চন্দ্রভাগা নদী দেখতে গেলাম। মুন্নার
পুরাণের নানা কাহিনি বলে চলল সঙ্গে।
তখনো
জানি না, আরো কী কী
বিষয়ে মুন্নার বিশেষ জ্ঞান আছে। সারাদিন আরো কিছু কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে শেষ
বিকেলে আমরা শেষবার সোমনাথ দর্শন করে পোরবন্দর রওনা হলাম, সন্ধে তখন
প্রায় সাতটার সময়। আমার চিন্তা ছিল রাতে গাড়িতে কোনো ভয় আছে কিনা। মুন্না হেসে বলল, গুজরাতে নাকি
সবই সেফ, ভয় ডর কিছু
নেই। আমাদের যাত্রা শুরু হল। অপূর্ব সুন্দর রাস্তা, চাঁদনী রাত আর সমুদ্রের পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে
১৮০ কিলোমিটার স্পিডে। অপরূপ দৃশ্য, রাত বাড়ছে আমার ভয় হচ্ছে যে, মুন্না গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে না পড়ে, আমি সমানে
তার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকলাম, তার মধ্যে বেশির ভাগই পুরাণের কথা। আচমকা আমি তাকে জিজ্ঞেস
করলাম, আচ্ছা বল তো, ‘সোমনাথ আর
দ্বারকা এত কাছাকাছি, সোমনাথের মতো
দ্বারকাতেও তো অনেক ধন থাকত, তাহলে ওখানে কেন মুসলমান আক্রমণকারীরা দ্বারকাকে আক্রমণ
করেনি?’ তার জবাব
শুনে আমি অবাক, ‘মাতাজী, ওহ লোগ জানতা
থা, শিবজি ভোলে
ভালে হ্যায়, কুছভি কর লো
উন্হে কোই ফারাক নহি, লেকিন ওর
কালা ঠাকুর ছোড়নে বালে নাহি হ্যায়, ওহ জরুর উন্হে মার ডালেঙ্গে, ইসলিয়ে উঁনকো হাত নাহি লাগায়া।’ এরপর আমি আর
কী বলব!!
আমরা
পোরবন্দর পৌঁছলাম প্রায় রাত তিনটে। অবাক হয়ে দেখি অত রাতেও বাজার দোকান খোলা, লোকে
কেনাকাটা, পান খাওয়া, সবই করছে, রাস্তায় গরুও
এত রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের বিস্ময় দেখে মুন্না বলল, ‘এ শহর সোতা
নাহি, জাগতা হুয়া
শহর হ্যায়।’ আমরা
গান্ধীজির শহরকে নতুন নামে জানলাম। কথা বলতে বলতে একটা গরু যখন প্রায় গাড়ির সামনেই
চলে এল, আমি মুন্নাকে
ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘হর্ন বাজাও, গরু সামনে,’ একথার যা
উত্তর পেলাম, তাতেও চমকিত।
সে বলল, ‘য়হাঁ গাই অউর
বাই (মহিলা) আপনে মর্জিসে চলতে হ্যায়, কিসিকা বাত নাহি সুনতে।’ আমরাও বেশিক্ষণ
না ঘুমিয়ে তৈরি হয়ে গান্ধীজির বাড়ি দেখতে গেলাম। গান্ধীজি কোথায় বসে প্রার্থনা
করতেন, কোন ঘরে বসে
পড়াশুনো করতেন, মুন্না সব
কিছু ঘুরিয়ে দেখাল। ওখানে আরো কিছু কিছু দেখার ছিল, সেগুলোও নিয়ে গিয়ে দেখাল। আমরা কিছু খেয়ে
নিয়ে দ্বারকার দিকে এগিয়ে গেলাম। এমন সময় অশোক বলল, ‘দিদি, হোটেলটায় চাঁদতারা ছিল, দেখেছিলে?’ আমি বললাম, ‘হাঁ, আমি দেখেছি, তাতে কী হল?’ আমাদের কথা শুনে চৈতালি রেগে গিয়ে বলল, ‘কী, তোমরা আমায়
বিধর্মীর হোটেলের চা খাইয়ে দ্বারকা দর্শন করাতে নিয়ে যাচ্ছ? এখুনি গাড়ি
ঘোরাও আমি আবার স্নান করব, কাপড় চেঞ্জ করব, তবে যাব”।আমরা হতবাক।
আবার ফিরে যাব? এতটা
রাস্তা!! আবার আমাদের উদ্ধার কর্তা মুন্না। সে বলে উঠল, ‘না না, মাতাজী আমিও
তো ওখানে থেকেছি সব রাঁধুনেরা হিন্দু, সকালে উঠে পুজো করে তবেই রান্নাঘরে ঢোকে।’
চৈতালি
শান্ত হল। আমি তো মনে মনে মুন্নার বুদ্ধির তারিফ করলাম। মুন্নার আরো জ্ঞানের
ভাণ্ডারের পরিচয় পাওয়া তখনো বাকি ছিল। দ্বারকার পথে প্রভাস তীর্থ। আমরা সমুদ্রের
ধার দিয়ে অপূর্ব রাস্তা ধরে চললাম। যেতে যেতে মুন্না প্রভাসে ব্যাধের তীরে
শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর কাহিনি শোনাল। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা পৌঁছলাম পবিত্র প্রভাস তীর্থে।
এখানে সরস্বতী নদী, হিরণ্য আর
কপিলা নদীর সঙ্গে মিলেছে, একে
ত্রিবেণীও বলে। প্রভাস মন্দিরের মূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণ গাছের ওপর বসে আছেন আর ব্যাধের
তীর পায়ে লেগেছে। একটি ঘরে শ্রীকৃষ্ণের চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে।
প্রভাস
থেকে এগিয়ে গেলাম দ্বারকার দিকে। এক দিকে বিশাল আরব সাগর তার পাশ দিয়ে রাস্তা।
আমরা নানা রকম গল্প করতে করতে যাচ্ছি। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখি, কালো কালো
গোল গোল কিছু বয়ার মতো ভেসে আছে। আমি অশোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওগুলো কী রে?’ অশোক বলল, ‘যতবার এখান
দিয়ে গেছি, ওগুলো দেখেছি
কিন্তু কোনোদিন কাউকে জিজ্ঞেস করিনি ওগুলো কী।’ ইতিমধ্যে মুন্না জানাল, ‘ওগুলো ভাসমান তেলের ট্যাঙ্ক, অশোধিত তেলের
জাহাজ বন্দর পর্যন্ত আসতে পারে না বন্দরে জল কম বলে, তাই মাঝসমুদ্রেই ঐ তেল আনলোড করে। সমুদ্রের
তলা দিয়ে পাইপ আছে, সেই দিয়ে
রিলায়েন্স রিফাইনারিতে যায়।’ আমি অবাক। সে এত সব জানে! ততক্ষণে দূরে বিশাল বিশাল
রিফাইনারির কলামগুলো দেখা যাচ্ছে। আমি অশোককে বললাম, ‘জানিস, ওতে তেল রিফাইন হয়।’ মুন্না বলে উঠল, ‘হাঁ মাতাজী, উস মে ক্রুড অয়েল ডিস্টিল হোকর পেট্রল বনতা
হ্যায়, আউর উপর
গ্যাস নিকালতা হ্যায়, রসোই কা কাম
মে আতা হ্যায়।’ আমি তো থ! এ
তো দেখি পুরাণ থেকে কেমিস্ট্রি সবই জানে। আমি বললাম, ‘তুমি এত জান কী করে?’ মুন্না আমাকে
আরো অবাক করে পুরো পিরিয়ডিক টেবিল মুখস্থ বলে গেল। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম!!! হায়
ভগবান! এতক্ষণ পুরাণের গল্প, অন্যান্য গল্প পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু পুরো
কেমিস্ট্রি!!! সম্বিত ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে জানো এত?’ সে বলল, ‘কেমিস্ট্রি
অনার্স পড়েছিলাম, তারপর কোনো
চাকরি পাইনি, তাই নিজের এই
ট্যাক্সি ব্যবসা করেছি। এই রিলায়েন্স রিফাইনারিতে অনেক দিন ট্যাক্সি চালিয়েছি।’
বেলা
এগারোটা নাগাদ দ্বারকা পৌঁছে গেলাম। অশোক অপূর্ব সুন্দর এক গেস্ট হাউস বুক করে
রেখেছিল। আরব সমুদ্রের ঢেউ এসে গেস্ট হাউসের বাউন্ডারিতে ধাক্কা খেয়ে তরঙ্গে পরিণত
হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরা একেবারে
সমুদ্রের মাঝেই আছি। কিছুক্ষণ সমুদ্রের সুনীল রূপ দেখে তৈরি হয়ে নিলাম দ্বারকা
মন্দির দর্শন করব বলে। অশোক একটু ধীরে সুস্থে তৈরি হচ্ছিল, আমি তাড়া
লাগালাম, ‘তাড়াতাড়ি
তৈরি হয়ে নে অশোক, মন্দির বন্ধ
হয়ে যাবে।’ মুন্না পাশেই
ছিল সে বলল, ‘অভি দের
হ্যায়, মাতাজী।’ আমি একটু
অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে বললাম, ‘তুমি এখান
থেকেই জান যে মন্দির বন্ধ হবে না?’ বন্ধ হওয়ার সময় তো হয়ে এল। সে মুচকে হেসে বলল, ‘অভি দের
হ্যায়।’ আমি এবার
রেগে গেলাম, তার প্রশ্রয়ে
অশোক আরো দেরি করে ফেলবে আর এতদূর এসে আমার শ্রীকৃষ্ণকে দেখা হবে না। মুন্না আমাকে
বলল, ‘মাতাজী
চিন্তা মত করো, ইধার আও।’ আমি
বাউন্ডারির কাছে গেলাম, সে তখন আমাকে
বলল, ‘দেখিয়ে উধার
মন্দির দেখিয়ে’—এত দূর থেকে কেবল
মন্দিরের চূড়াটা দেখা গেল। আমি তাকে বললাম, ‘চূড়া দেখে কী করে বোঝা যাবে—মন্দির বন্ধ
কি খোলা? তুমি কি মজা
করছ?’ আবার সে হেসে
বলল, ‘না মাতাজী, অচ্ছে সে
দেখো, এক আদমী চূড়া
পর চড় রহা হ্যায়, বহ যাকে চূড়া
পর ধ্বজা ফাহরায়গা, তাভি পূজা
হোগী, আউর উস্কে
বাদ হি মন্দির বন্দ হোগী।’ আমি তাজ্জব।
আমরা
এরপর গাড়ি করে মন্দিরে পৌঁছলাম। ভিড়, কিন্তু সব যেন সুশৃঙ্খল। কোনো ধাক্কাধাক্কি নেই। বাইরে
তুলসির মালা, বড় বড় রুটির
মতো দেখতে খাখরা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ঐ সব প্রসাদ বলে কিনে ভেতরে গেলাম। মন প্রসন্ন
হয়ে উঠল, অপরূপ
মুরলিধারী কৃষ্ণকে দেখে। আরতি দেখলাম, প্রণাম করলাম একে একে লাইন করে। তুলসী পাতা প্রসাদে পেলাম।
এরপর গেলাম মন্দিরের ভেতরে, সেখানে
বলরামের মন্দির আর মাঝে শঙ্করাচার্যের মন্দির। ওখানে বাস করতেন তিনি। মন্দিরের
পিছন দিকে গেলাম সমুদ্র দেখতে। এখানে সমুদ্র একেবারে শান্ত, নদীর মতো।
গোমতি নদী এসে এখানে মিলেছে সমুদ্রের সঙ্গে। সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটার সঙ্গে গোমতির
জল বাড়ে কমে। লোকে স্নান করছে। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
মন্দির
দর্শন করতে করতে বেশ বেলা হয়েছে, সকলের খিদে পেয়েছে। চৈতালি বাঙালি খাবার ছাড়া খেতে পারে না।
তাই আমরা বাঙালি রেস্টুরেন্ট খুঁজছি এমন সময় মুন্না বলল, ‘আজ আমাদের
গুজরাটি খাবার খাও, ভালো লাগবে।’ চৈতালি প্রায়
আঁতকে উঠল, ‘না না, আমি কিছুতেই
ঐ গুজরাটি খাবার খেতে পারব না।‘ আমরা আবার অনেকবার গুজরাটি ডিশ খেয়েছি, তাই আমরা
রাজি, শেষে ঠিক হল, আমরা গুজরাটি
থালি খাব আর পরে চৈতালি বাঙালি খাবার খাবে। সেই মতো আমরা মুন্নার চেনা
রেস্টুরেন্টে গেলাম। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ড্রেস-পরা বয়-রা সার্ভ করছে। আমরা হাত ধুয়ে
বসলাম। প্রথমেই থালি এল, ছোট ছোট
বাটিতে সাজানো নানা রকম সবজি, ডাল, একটু হালুয়া।
তারপরই এল গরম গরম রুটি, তাতে ঘি
মাখানো। আমরা শুরু করলাম, চৈতালি বলল, ‘আচ্ছা, আমিও একটু
টেস্ট করি।’ খেয়ে সে
মুগ্ধ হয়ে গেল, বলে উঠল, ‘আমি এটাই খাব, আমার বাংলা
খাবার চাই না।’ খুব আনন্দের
সঙ্গে আমরা পেট পুরে গুজরাটি খাবার খেলাম।
এবার
আমাদের ভেট দ্বারকা যাত্রা শুরু হল। মুন্না যথারীতি ভেট দ্বারকার কাহিনি বলতে বলতে
আমাদের নিয়ে চলল। ইতিমধ্যে আমাকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ তো ঠাকুরজী লাল কাপড়ে পহনে হোনগে?’ আমি অবাক হয়ে
বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি
তো ভিতরে গেলে না, তুমি কী করে
জানলে?’ আমি তাকে
জিজ্ঞাসা করলাম, সে বলল, ‘আজ রবিবার, এই দিনে লাল কাপড় পরানো হয়। এখানে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ যে রাজকার্য চালাতেন। এখানে তো
তিনি রাজার ভূমিকায়। রাধা আর সব সখীরা তো ভেট দ্বারকায়।’ আমি মনে মনে
তাকে সালাম করলাম। কত কিছু জানে! ভেট দ্বারকার পথে অনেক নুনের পাহাড় দেখা গেল।
সমুদ্রের জল শুকিয়ে নুন বিশাল বিশাল পাহাড়ের মতো করে জমিয়ে রাখা আছে। অশোক বলল, ‘দেখ দিদি, কত অপরিষ্কার
নুন আমাদের খাওয়ায়।’ মুন্না সঙ্গে
সঙ্গে বলে উঠল, ‘নহি নহি, এহ নমক সাফাই
হোনে কে লিয়ে কারখানা যাতা হ্যায়, ইলেকট্রোলিসিস প্রসেস মে সাফ হোতা হ্যায়।’ বুঝলাম, মুন্নার কাছে
আমাদের জ্ঞান অতি ক্ষুদ্র। মুন্না এরপর ভেট দ্বারকার কথা শুরু করল। শোনা যায়, আসল ভেট
দ্বারকা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর দিনেই সাগরের নিচে ডুবে যায়, কেবল কিছু
অংশ এখন দেখা যায়। কথা বলতে বলতে আমরা হরি কুণ্ড জেটিতে পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে
মোটর বোটে ভেট দ্বারকা দ্বীপে পৌঁছে গেলাম, অনেকটা পাথরের পাহাড়ের মতো। আমরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে
মন্দিরে গেলাম, ওখানে
শ্রীকৃষ্ণ এবং সখীদের অনেক মূর্তি রয়েছে সেগুলিতে রোজ তুলসী দিয়ে পূজা অর্চনা হয়।
আমরাও পূজা দিয়ে আবার মোটর বোটে ফিরে চললাম, সঙ্গে মুন্নার কৃষ্ণ কাহিনি।
এরপর
আমরা এগিয়ে গেলাম নাগেশ্বর মন্দির দর্শন করতে। নাগেশ্বরে পৌঁছতেই দূর থেকেই দেখা
গেল এটি বিশাল শিব মূর্তি। এত বিশাল মূর্তি আগে কখনো দেখিনি। প্রণাম করে মন্দিরে
গেলাম, বেশ বড়
মন্দির ওখানেই নারকেল, বেলপাতা
ইত্যাদি পুজোর জিনিস কেনা হল। পুজো দেওয়ার পর পূজারির সঙ্গে বেশ ঝগড়া হল। পূজারি
জোর করে আমাদের দিয়ে অনেক টাকা দেওয়ানোর প্রতিজ্ঞা করাচ্ছিল শিবের সামনে। এই নিয়ে
বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পরে আবার আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম মুন্নাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কোথায়
নিয়ে যাবে?’ সে বলল, ‘কেন, তোমরা
রুক্সিণী মন্দির তো এখনো দেখনি। এখন ওখানেই যাব আমরা।’ একেবারে
সন্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণের পত্নী রুক্মিণী দেবীর মন্দিরে পৌঁছলাম।
রুক্মিণী
দেবীর রূপের কথা আগেই শুনেছিলাম, কিন্তু ওখানে গিয়ে দেবীর অপরূপ রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ
ধরে দর্শন করলাম। ওখানেও আরতি দেখলাম। মন্দির বন্ধ হলে এবার ফেরার পালা। ফিরছি
জামনগর, বেশ রাত
হয়েছে। এবার আর রাতে যাত্রা করতে ভয় নেই, জেনে গেছি গুজরাতে কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে ফিরতি যাত্রা
শুরু হল। রাস্তায় আবার রিলায়েন্স রিফাইনারি দেখা গেল, এবার রাতের
আলোয় ঝলমল করছে। সমুদ্রেও তেল নামাবার বয়ারগুলোও ঝলমল করছে। রাতে মুন্নার পছন্দের
ধাবাতে খাবার খেয়ে বাড়ি পৌঁছতে রাত দেড়টা। নামার সময় মুন্নাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তোমাকে এত
পুরানো কথা শিখিয়েছে?’ সে বলল, মায়ের কাছে
ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে শিখেছে। আমি বললাম, ‘তোমার মাকে আমার প্রণাম জানিও। জানি না তুমি
আমাদের সঙ্গী না হলে আমাদের যাত্রা এত মধুর হত কিনা। জয় শ্রীকৃষ্ণ।।’
আলপনা
ঘোষ