একান্ত ব্যক্তিগত পর্ব ৫
গৌতমবাবুর সেই সিন্থেটিক বটগাছ তুলে দেওয়ার
বিরুদ্ধে তাঁর উকিল কোর্টে কেস ঠুকেছিল সে তো গতবারই বলেছি । আর তাঁর উকিল যে
ক্ষতিপূরণ বাবদ দশ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছিলেন তাও বলেছি । কিন্তু যেটা বলি নি
সেটা হল সেই টাকায় তিনি কি করেছিলেন ।
কি আবার করবেন ? রিটায়ার্ড বিপত্নীক মানুষ আবার
বিজ্ঞানী । তিনি আর কি করতে পারেন গবেষণা করা ছাড়া ? আর তাঁর গবেষণা তো অন্য কারোর
মত নয় । তাঁর গবেষণায় ল্যাবরেটরি লাগে না । বটগাছ লাগে । ভাবনার জন্য । ভাবনা করে
আবিষ্কার করে রেখে দেন তাঁর মস্তিষ্কের ভেতর । কিন্তু বাস্তবায়িত করে প্রস্তুতকারক
কোম্পানীগুলো ।
ফর্মুলা চুরি হবার ভয় নেই । কারণ ফর্ম-ই থাকে না
তো ফর্মুলা ! স্পন্সর দেয় টাকা । সেই টাকা পেলে প্রস্তুতকারক কোম্পানী যায় ডাঃ
গৌতমের কাছে । ডাঃ গৌতম আবার ধ্যানে বসেন । তাঁর মুখ দিয়ে যেগুলো বেরোয় কোম্পানি
তেমন তেমন কাজ করে ।
লিখিত
কিছুই নেই । এমন কি ডাঃ গৌতমকে হিপ্নোটাইজ করে কিছু ফল নেই । চেষ্টা অনেকে করে ফেল মেরে
গিয়েছিল । বিদেশী কোম্পানির গুপ্তচররা ফর্মুলা চুরি করতে এসে বেকুব বনে
গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে কেটে পড়েছিল । তারা সব বরখাস্ত হয়ে এখন দর্জির দোকানে ছেঁড়া
প্যান্ট সেলাইয়ের চাকরি নিয়েছে । আর নাকে কানে খত দিয়ে বলেছে, ডাঃ গৌতম ! কাম তো
দূরে থাক নামও মুখে আনব না কোনোদিন ।
সেই ডাঃ গৌতমের এখন আর বটগাছের কোনও চিন্তা নেই ।
সিন্থেটিক বটগাছ । আবার তার সঙ্গে আছে কোর্ট কাছারির পাকাপোক্ত আদেশনামা । শীত
গ্রীষ্ম বর্ষা সব সময় তাঁর বটগাছে সবুজ পাতা, লাল ফল আর নীচে পাখীর সাদা বিষ্ঠার
সুন্দর ডিজাইন ।
পাখীর কিচির মিচির আছে সর্বদা । পাখীরা ফল খায় না
খেতে পারে না বলে । সিন্থেটিক ফল কি আর কেউ খেতে পারে ? কিন্তু ওদের পেট সর্বদা
ভর্তি থাকে । কারণ ওদের মন সর্বদা ভর্তি মানে খুশি থাকে বলে । ওরা কথা বলে গান করে
। কিন্তু খায় না । ব্যাপারটা ডাঃ গৌতম বেশ কিছুদিন ধরে দেখেছেন । তারপর বেশ
কিছুদিন ধরে ভেবেছেন ।
এরপর গৌতমবাবু একবার একটা জায়গায় বেড়াতে গেলেন ।
একা একাই । দোকা আর কোথায় পাবেন ? গৌতম বাবুর দোকা হওয়া আর বেশ একটু
ঝুঁকির তো বটেই । কিছু কিছু মানুষের মৃগী রোগ থাকে । যখন তখন মৃগীর ফিট হয় । মুখ
গেজলে পড়ে থাকতে হয় সঙ্গে যে থাকে তখন তার বিপদ । ছেড়েও আসতে পারে না আবার থাকলেও
হাজার প্রশ্ন হাজার উপদেশ আর হাজার অস্বস্তি ।
তেমনই হয়েছে ডাঃ গৌতমের কেসটা । হঠাত হঠাত যে
কোনও বটগাছ পেলেই নীচে বসে যাবেন। বসে যাবেন আবিষ্কারের ধ্যানে । তখন সঙ্গীর কি
দশা হবে ভাবো । নমাস ছমাসের আগে তো ভাঙ্গে না সে ধ্যান । তাই এই ক’মাস মানে এই
ধ্যান–পিরিয়ডে লাখো প্রশ্ন, লাখো সন্দেহ, লাখো কৌতূহল আর হয়ত লাখো ঘন্টার অনিশ্চিত
অপেক্ষা ।
তাই যেখানে যান ডাঃ গৌতমকে একাই যেতে হয় । একা
একাই একবার গিয়েছিলেন চিড়িয়াখানায় । বাঘ-সিংহ-হাতি-হরিণ দেখে চোখ যখন পচে গেল তখন
মাঠের ধারে একটা গাছ দেখে নিয়ে বসেছেন । না আপনাদের ভাবার কোনও কারণ নেই । কারণ এই
গাছ বটগাছের মত তেমন ঝাকড়া গাছ নয় যে ডাঃ গৌতমের ভাবনা বেশ পাকিয়ে উঠবে । আর
ভাবনায় সরকারের কপালে ভাঁজ পড়বে ।
তা যা বলছিলুম । গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছেন ডাঃ
গৌতম । তাঁর মুখ কিন্তু বিশ্রাম পাচ্ছে না একটুও । এই এক ঘন্টায় কত কি যে খেয়ে
গেলেন তার ঠিক নেই । ডালপুরি থেকে ভেলপুরি, দইবড়া থেকে আলুর বড়া, লর্ড চমচম থেকে
সামান্য বোঁদে কিছুই বাদ নেই । এমন কি ফুচকার জল দিয়ে পাউরুটি খাওয়া যায় কিনা তার
পরীক্ষাও হয়ে গেল । আর একেবারে ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ । তিনি নন, খাবারগুলো । তাঁর
জিভ কোয়ালিফাইং মার্ক্স দিয়ে গপাগপ খাদ্যনালী দিয়ে উদরে চালান করে দিতে লাগল ।
- একটা রুটি দেবেন স্যার ? বড্ড খিদে পেয়েছে সকাল
থেকে কিছু খাই নি ।
একটা বাচ্চা ছেলে । বয়েস সাত আট । পরনে ময়লা
গেঞ্জি আর একটা ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট । সে জানে আজকাল স্যর বলে না ডাকলে কেউ খুশি হয়
না । আর ডাঃ গৌতম তো একজন গুণী লোক ।
ডাঃ গৌতম খুশি হয়ে তাকে এক পিস রুটি দিলেন । আবার
আলুর দমের একটা আলুও । ছেলেটা রুটিতে কামড় বসাতে বসাতে চলে গেল । শিম্পাঞ্জির
খাঁচার সামনে একজন খুব সুন্দর মাউথ অরগান বাজাচ্ছিল । ছেলেটা একটা কামড় দিয়েই
একমনে বাজনা শুনতে লাগল ।
এমনই তন্ময় হয়ে শুনছে যে অন্যদিক দিয়ে যে
শিম্পাঞ্জীটা তার হাতের রুটি ফাঁক করে দিচ্ছে একটুও টের পেল না । বাজনা শেষ করে
অন্যদিকে চলে গেল ছেলেটা যে মাউথ অরগান বাজাচ্ছিল ।
ডাঃ গৌতম অবাক হয়ে দেখলেন যে সেই বাচ্চাটা আর তার
হাতের রুটিটার কথা মনেই আনল না । নিশ্চয় খিদে পেয়ে আবার তাঁর কাছে আর এক পিস চাইতে
আসবে । তিনি প্রস্তুত হয়েই ছিলেন । এখনও
কটা পিস আছে তাঁর হাতে । আহা গরিব বাচ্চা একটু খেতে দিতে পারবে না তাকে ?
ছেলেটি কিন্তু আর এলোই না । তার মানে ওর খাবারটার
কথা আর মনেই নেই । মুখ দেখে মনে হল খিদে বলে এখন আর তার কিছু অবশিষ্ট নেই । তার
মানে ?
মানেটা আর চিড়িয়াখানায় খোঁজা হল না । পড়ি মরি করে
ছুটে এলেন নিজের বাড়ীতে । বসলেন সিন্থেটিক বটগাছের নীচে পাখীর সাদা বিষ্ঠার ডিজাইন
করা লাল মেঝেতে । এখানে না বসলে যে চিন্তা দানা বাঁধবে না ।
তাই তো । এর মানে হল বাঁশি বা সঙ্গীতের একটা
সম্মোহনী শক্তি আছে যাতে করে খিদে তেষ্টা সব ভুলিয়ে দেওয়া যায় মানুষের । তার মানে
সঙ্গীত দিয়ে খিদের কষ্ট ভোলানো যাবে এবার থেকে ।
তিনমাস পরে ধ্যান ভঙ্গ হল ডাঃ গৌতমের । তাঁর
এবারের আবিষ্কার মিউজিক থেরাপি নিয়ে । কতগুলো বিশেষ তরঙ্গের মিউজিকের আওয়াজ দিয়ে
খিদে ভুলিয়ে দেওয়া যায় । এই পোড়া দেশে রোজ জিনিসের দাম বাড়লেই যেখানে রাজনৈতিক
দলগুলো ভুখা মিছিলের আওয়াজ তোলে সেখানে ডাঃ গৌতমের এই আবিষ্কার তো রীতিমত আলোড়ন
ফেলে দেবে ।
শুধু মাউথ অরগান নয় । গীটার, সেতার, সরোদ এমন কি
হারমনিয়াম দিয়েও পরীক্ষা হল । সবাই পাশ করলেও ডাঃ গৌতমের মন পাশ করতে না পেরে
মনমরা হয়ে রইল । তাই তো সেতার গীটার এসব তো কৃত্রিম বাজনা । এসব তো বেশ দামী জিনিস
। খুব সস্তায় কি কিছু হয় না ?
তা ছাড়া এসব তো কৃত্রিম । ব্যবস্থাটা প্রাকৃতিক
বা ন্যাচারাল হয়ে বেশ হয় । যেই ভাবা তেমনই কাজ । বটগাছের ডালে ডালে বসা পাখীদের
ডাকগুলো সব ডিজিটাইজ করা হল । সেগুলো এবার নিয়ে যাওয়া হল বুভুক্ষু ছেলেমেয়েদের সামনে
। এক্কেবারে মিরাকুলাস রেজাল্ট ।
এক একটা যন্ত্র বার করলেন ডাঃ গৌতম । দারুণ সে
যন্ত্র । রোজ রোজ খাবার কিনতে হবে না। যন্ত্রটা কিনতে হবে জীবনে মাত্র একবার ।
সেটাতেই বাজবে পাখীর কল কাকলি । আর তাতেই খিদের দফারফা । ঘুম হবে দারুন । প্রথম
প্রথম সরকার বি-পি-এলদের বিনাপয়সায় আর এ-পি-এলদের সাবসিডি দিয়ে দিতে লাগল ।
দারুন ফেভারিট । ডাঃ গৌতমের পঞ্চম একান্ত
ব্যক্তিগত । গরীব দেশে সবাই এবার বড়লোক
হয়ে যাবে । না খেয়ে খেয়ে । এই ডাকগুলোর প্রথমে ডাঃ গৌতম জুড়ে দিয়েছেন কিছু
বাঘ-ভালুক আর কুকুরের ডাক । শুনলেই পিলে চমকে পালিয়ে যাবে । সঙ্গে খিদেও । তারপর
শুরু হবে পাখিদের কলকাকলি । মধুর আর সুমধুর । না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে সব । কারণ
সকলের পেট ভর্তি ততক্ষনে ।
৪/১০/২০১৪