একদিন অথবা প্রতিদিনের গল্প
সনাতন মুদীর মেয়ে ময়নার ঘর পালিয়ে বিয়ে, তাও মাত্র চোদ্দ বছরে। কাঠেরমিস্ত্রি সুবলের সাথে ওর বয়সের তফাত প্রায় বছর পনেরো বা তারও বেশী। অমসবয়সের প্রেম হলেও জমাটি সংসার করছিল মেয়েটা। সাত বছরের মাথায় অতিরিক্ত চোলাই টেনে বাড়ী ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টে দুইপা খুইয়ে একদম শয্যাশয়ী হয়ে পড়ল সুবল। অসুস্থ সুবল এই যে শয্যগত হয়ে ময়নার যন্ত্রণা বাড়ালো তা নয়, বোঝার ওপর শাকের আঁটির মত একটা বছর খানেকের রুগ্ন মেয়ে আর অশক্ত বুড়ো বাপকেও ময়নার ভরসায় রেখে দিল। অতএব ময়নাকে উঠে দাঁড়াতেই হল। বছর একুশের সোমত্ত মেয়ে, সুযোগসন্ধানীর চোখে রসের বান, পড়াশুনা জানা নেই, টিপছাপ সম্বল। গতরখাটনীই ভরসা। ওদের বস্তির কয়েকজন লোকের বাড়ী বাসন ধুয়ে, জামাকাপড় কেচে, ঝাঁটপাট দিয়ে, বা বাচ্চা রেখে রোজগারপাতি করে। ময়নাও কয়েকটা বাড়িতে কাজ ক'রে তিনটে পেটের ভাত আর অসুস্থ স্বামীর ওষুধের পয়সা রোজগারের চেষ্টায় লেগে গেল। মা হিসাবে পুঁচকে মেয়েটার চিন্তাটাও আছে। খুব কষ্টে খুঁড়িয়ে চলতে থাকল সুবল ময়নার সংসার ।
সাময়িক স্বস্তি এলেও শান্তিটা তাতে পুরোপুরি বরবাদই হয়ে গেল এ সংসারে । সাত বাড়ী খেটে খাওয়া জীবন। লোক একপয়সা ব্যয় করে কাজের লোকের থেকে তিন পয়সার কাজ চায়। ময়না একে এ লাইনে নতুন, তায় ও জানে ওকে মাটি কামড়ে টিঁকতে হবে, কিন্তু তার জন্য ঘরে ফিরতে দেরী হ'লে সুবল চেঁচায় । অশ্রাব্য গাল দেয়, আসলে সদ্য যুবতী বউয়ের সাধ আহ্লাদ , বা চাহিদা পূরণে স্বামী হিসাবে অক্ষমতাটা ,নিজের পঙ্গুত্ব আর ময়নার ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসার নিরাপত্তহীনতা সুবলকে ক্রমশ অসহায় থেকে হিংস্র করে তোলে,সন্দেহের বাতিক এসে ভর করে, ময়না সহ্য করে।
সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটনির পরও বাড়ী ফিরে ঘরের কাজ সারে, মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বকবকম করে। বুড়োশ্বশুর হাঁপানির টান সামলে দিনে দুটি শাকভাত বেড়ে নেয়, নাতনী সামলায়, ছেলের গাল খায়। ময়না ফিরে এসে যতটা পারে বাপ ছেলের যত্ন নেয়। তবু সুবলের মুখ থামেনা, মাঝেমধ্যে হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে মারে। আশেপাশের লোক মজা দেখে। চোখের জল লুকিয়ে ময়না মেয়ে কোলে একচিলতে মাটির দাওয়ার ওপর চট ঘেরা রান্নাঘরে বসে বালিকা বয়সে বাপের বাড়ীর স্মৃতি ঘাঁটে,ঘরের পেছনের সুপারি বাগান, ঘর - উঠান, চৌকি, রসুই - হাঁড়ি - পাতিল, খেঁজুর পাতার পাটি পেতে খাওয়ার দৃশ্য, পান চিবুতে চিবুতে বাবার গল্প বলা, মায়ের লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়া, মিতুদের তেঁতুল গাছের ডালে বাঁধা দোলনা, শ্যাঁওলাপড়া নিনকি ঝিল, ঝিলের ধার ঘেঁষা সন্ধ্যমালতির ঝাড়, পাড়ার যত আম -জাম -খেঁজুর গাছ, সবার কাহিনী বলে কোলের একরত্তি মেয়েটাকে।মান্তি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মায়ের গল্প শোনে।রাত গভীর হলে মা থেকে বউয়ের কর্তব্য সারতে ঘুমে অবশপ্রায় দেহে সুবলের পাশে শুয়ে পরে।ঘুমন্ত শরীরে ক্ষুধার্ত পুরুষের অবাধে হাতের সুখ, দেহের সুখ চলে।অভাবের সংসারেও লোকসংখ্যা বাড়ে।
সুবলের যোগানদার হানিফ আসে প্রায়ই । একথা সেকথার ফাঁকে জানিয়ে যায় উত্তরপাড়ার পিলু মিস্ত্রীর বউ বাচ্চা হয়না বলে শ্বশুরবাড়ীর গঞ্জনা মাত্রা ছাড়ানোয় ফাঁস দিয়েছে গতকাল রাতে । পিলুও সুবলের মত কাঠের কাজ করে। শুনে চমকে উঠে সুবল। নিমা বউদির মুখখানা ভেসে উঠে,কি সুন্দর হাসিমুখ বউদির ,কপালের লাল টিপখানা জ্বলজ্বল করত । হঠাৎ কেমন শীতশীত লাগে সুবলের , যদি ময়নাও সেরকম কিছু করে বসে? একদিন যদি ধৈর্য হারায়? কি হবে সুবলের তখন? কোথায় যাবে সে? অতএব সুবল পাল্টায়,ময়নার সাথে সাঁঝবেলায় সোহাগের কথা বলে,সারাদিনের খবর নেয়।
এইভাবেই কাটে আরো কয়টা বছর। ময়নার বুড়ো শ্বশুর আর ইহলোকে নেই, তবে সুবল ছাড়াও মান্তির পর মরে হেজে আরো দুই মেয়ে এক ছেলে আছে ঘরে। ময়নাও পাল্টেছে অনেক, সারাদিনের সাতবাড়ীর কাজ, ঘরের লোক বাইরের লোকের কথার ঝাঁঝ, একাধিক সন্তান ধারন,তার উচ্ছ্বল যৌবনের অনেকটাই শেষ করে ফেললেও যেটুকু স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য রয়ে গেছে তার উসকোখুসকো তেলবিহীন চুলে, শীর্ণ মুখের অকাল বলিরেখায়,তাতেও ময়নাকে পথেঘাটে লোকে সুন্দরীই বলবে।সুবলের দুশ্চিন্তাও তাই বোধহয় গিয়েও যায়না।
আমাদের তিনতলা ভাড়াটে বাড়ীর পেছনের বস্তিতেই ওদের ঘরসংসার, ময়না আমার বাড়ীও কাজ করে। ছোটবেলা থেকে চিনি ওকে, তাই দু’চারটে কথাও বেশী চলে। ময়না আমার বাড়ীতে ঘরদোর সাফা করার কাজ দিয়ে দিনের শুরু করে, সন্ধ্যাবেলায় সেই দূরের স্টেশনপাড়ার ব্যানার্জীবাবুদের বাড়ীর রান্নাবান্নার কাজ সেরে হাতে ওর সেদিনের বরাদ্দ খাবারটুকু নিয়ে ঘরে ফেরে। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই দেখি সুবল ওর চাকা লাগানো চেয়ার ঠেলে নিয়ে এসে রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করে। কোনদিন মান্তি চেয়ার ঠেলে আনে, কোনদিন ওর ভাই বাবলা। অন্ধকারে রাস্তার আলো জ্বলে ওঠারও অনেক পরে ফেরে ময়না। মাকে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে টিফিনকৌটোটা কেড়ে নিয়ে ঘরের দিকে ছুট দেয় মান্তি বা বাবলা, ময়না ক্লান্ত হাসিতে মুখ ভরিয়ে সুবলের চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে পেছন পেছন যায়। এটা ওদের নিত্যদিনের কাজ।
রুটিনে অন্যথা হলে চোখে পড়ারই কথা, তবু মান্তি এসে রাতে আমাদর দরজা খটখটিয়ে ব্যানার্জীবাবুদের ফোন নং না চাইলে খেয়ালই করতাম না যে সন্ধ্যায় ময়নাকে দেখিনি। ফোন করে জানা গেল ময়না আজ কাজেই যায়নি ওদের বাড়ী। কি হল মেয়েটার, কোন বিপদআপদ…নাকি সুবলই ঠিক, ময়না শিকল কেটে উড়েছে। আবার কাল সকালে কাজকামাই করা মানে আমারও রবিবারের ছুটি, শপিং, আউটিং সব মাটি।
ব্যজার মুডে শুতে যাব ভাবছি,তখনই রা্স্তায় বেশ হই হল্লা চেঁচামেচি শোনা গেল, আশপাশের বাড়ীর বাইরের আলোগুলো একে একে জ্বলে উঠে অন্ধকার গলিপথটা বেশ কিছুটা আলোকিত করে তুলল। শনিবার, তবু রাত বারোটার আগেই ঘর্ঘর্ করে শাটার নামিয়ে বন্ধ হয়ে গেল পাড়ার মোড়ের হিন্দু পাইস হোটেলটা। ‘কি হল, কি হল’ বলতে বলতে বারান্দার আলোটা জ্বালিয়ে আমার শাশুড়ীমা বেরিয়ে গেলেন বারান্দায়। বাবু, বিকিদের ডাকাডাকিতে আমার উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলে অর্কও সন্তোষমাস্টারদের পুকুরধারের জলাজমির পিছনের ভাঙা ক্লাবঘরটার দিকে দৌড়াল, অর্কের বাবা এখনও ফেরেননি, অতএব ছেলেকে না আটকাতে পেরে পিছুপিছু আমিও কিছু না বুঝেই ছুটলাম। বাবু জানাল ক্লাবঘরের পেছনে পুকুরের কাছটায় কি একটা পড়ে আছে। মনে হচ্ছে বডি।
মোবাইলে কেউ পাড়ার কাউন্সিলারের নাম্বার খুঁজছেন তো কেউ পুলিশের, কেউ আবার দমকল আর সংবাদপত্রের অফিসেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, বাচ্চাদের ওদিকে না যেতে বলে ভারী গলায় চেঁচাচ্ছেন বয়স্ক গোপালমামা। গিয়ে পৌঁছতে দেখলাম চারধার ঘন অন্ধকার। সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পপোস্টটার আলোও এতদূরে আসে না। ঝোপড়া বট অশথ্থের ছায়ায় ভাঙা শিবমন্দিরে আগাছার জঙ্গলে নিশুতি রাত। খানিকদূরে সন্তোষমাস্টারদের পুকুরঘাটের লেবুগাছগুলোও আলোর বিন্দু ঝিক্মিক্ করছে খুব। পাশেই বারোয়ারী আমবাগানটায় অজস্র জোনাকি। ঝিঁঝির ঐক্যতান। কুকুরগুলোর সমস্বরে কাঁদুনি,অমঙ্গলের চিহ্ন সর্বত্র। কারো হাতে টর্চ, কারো হাতে মোবাইলের আলো। জ্বলছে নিভছে। তাতেই দেখলাম আধখোলা উদোম এক নারীশরীর দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে পুকুরের জলে আধডোবা হয়ে। মুখখানা মাটিতে গোঁজা থাকলেও পাশ থেকে চেনামুখ চিনতে ভুল হলোনা এতটুকু। বুকের ভিতর উথাল পাথাল সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।
- “একি!! এ যে আমাদের ময়না গো!”
অনেকদিন কেটে গেছে। আমার ঘরে নতুন কাজের মেয়েটাকে টাকা বেশী দিয়ে কাজে রাখতে হয়েছে তবু ময়নার মত ছিমছাম গোছানো কাজের হয়নি।