মুখোমুখিঃ জয়া চৌধুরী।
সংশপ্তক: রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে বলা যায় সাহিত্য অর্থে সহিত, সাথে; অর্থাৎ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা তাই সাহিত্য। এই যে জীবনের সাথে সংলগ্নতা, যা সাহিত্যের মূলগত রূপ বলে বিশ্বকবি নির্দেশ করে গেলেন, সেই সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি?
জয়া চৌধুরী: বিস্ময়
ও ধন্যবাদ প্রথমে সংশপ্তককে আমাকে এইখানে ডাকার জন্য। আমার প্রিয় ব্লগ এটি।
বিস্মিত হচ্ছি এর কারণ জেনে... আমার মত সামান্য মানুষ কী ই বা জানাতে পারে এই সব
কঠিন প্রশ্নের। তবু চেষ্টা করছি। প্রথম কথা হলো রবীন্দ্রনাথের বাক্য ঋষিবাক্য, তা প্রাচীন ভারতের নামী অনামী বহু ঋষিদের মতই নীরিক্ষালব্ধ।
সুতরাং তা নিয়ে তো কথাই চলে না। তবু সভ্যতা এগিয়ে চলে আর নিত্য নতুন মানুষেরা
মেলাতে চায় তাদের মত করে মেলাতে তাঁদের বলে যাওয়া কথাগুলির যাথার্থ্য। হ্যাঁ আমার
বোধি তো তাই ই বলে যে কোন সাহিত্যই জীবনকে বাদ দিয়ে হয় নি হয় না হবেও না। এমন কি
কল্পবিজ্ঞান শাখার সৃষ্টিও এক ভাবে মিলিয়ে দেয় বাস্তব অবাস্তব ও পরাবাস্তবকে।
অদ্বৈত বেদান্তীরা বলেন জগত হল মায়া। তো সাহিত্য যদি এই মায়াকে তার মতো করে তুলে
ধরে ক্ষতি কি! এই মায়াময় জগতকে তো মায়া জেনেও আমরা দিনরাত সত্যের মত আন্তরিকতায়
লড়ে যাচ্ছি। সাহিত্য তো জগতকেই প্রতিনিধিত্ব করে। সেখানেও তো কল্পিত চরিত্ররা গল্প
সাজায় হাসায় কাঁদায়। যদি আমাদের বেঁচে থাকা মরে যাওয়া সত্য হয় তাহলে সাহিত্য ও
সত্য। আমাদের নিয়ে খেলেন বিধি আর সাহিত্যিক খেলেন সাহিত্য নিয়ে। মন্দ কি?
সংশপ্তক: আপনার লেখালেখির সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন। সময়ের
পরিধিতে এবং পরিবেশের প্রেক্ষাপটে।
জয়া চৌধুরী: লেখালিখি
করি একথাটা বললে বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে। আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি ২০১৪ সালের
ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ থেকে। আর অনুবাদ সাহিত্যে অবশ্য হয়ে গেল বছর চারেক। আসলে ঠিক
মনে পড়ে না কত বছর বয়স থেকে আমি পড়ি। বোধহয় অক্ষর জ্ঞান হবার পরে মোটামুটি যবে
থেকে পড়তে পারি আমি পাগলের মত পড়তাম।
সম্ভবত ক্লাস টু-তে
আমার প্রথম উপন্যাস পড়া শারদীয় অমৃতবাজার পত্রিকায়। নাম মনে নেই কিন্তু একথা মনে
আছে বেশ কিছু শব্দ মানে বুঝি নি একটুও অথচ সেটা যে বড়দের কথা সেই অনুভূতি হয়েছিল। কি
ভাবে? জানি না। অত ছোট বয়সে কি ভেবেছিলাম তা কি আর
মনে থাকে এই বয়সে? তবে জিলিপির ঠোঙা ফেলে দেবার আগেও তার মধ্যে
ছাপা কোন কিছু পড়তে ছাড়ি নি আমি, বাবার মেটিরিয়া মেডিকার কেস হিস্ট্রি গুলো অবধি আমার খাদ্য ছিল এক বয়সে। এই
করতে করতে একটা বিশেষ ধারার বইও আমি পড়ে চলি অবিরত। তা হলো hagiology । এই সবের ফাঁকে কখন
যেন লিখতে শুরু করেছি। যতদূর মনে পড়ে প্রথম কবিতা লিখি ক্লাস নাইনে। বোধহয় ক্লাস
ইলেভেনে উঠে আমার বোধোদয় হলো যে এই সব ছাইপাঁশ লিখে মহান বাংলা সাহিত্যের আবর্জনা
বাড়ানোর কোন মানে নেই। তখন ছেড়ে দিলাম। মাঝে দীর্ঘ যতি। আবার শুরু এবছর।
সংশপ্তক: জীবনের বিভিন্ন পর্বে কোন কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আপনার
জীবনদর্শনের গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন?
জয়া চৌধুরী: বন্ধুরা বরাবরই
আমাকে উৎসাহিত করেছে। আমার ছোটবেলার
বান্ধবী ডঃ বিদিশা দত্ত তো ছিল আমার আদর্শ। এছাড়া ছাত্রজীবনে সবারই শিক্ষকের
ভূমিকা একটা বড় জায়গা নেয়। আমার ইংরিজীর শিক্ষক বাণেশ্বর বাবু সে অর্থে আমার প্রথম
প্রেরণা। তাঁর হাত ধরেই ইংরিজী সাহিত্যকে ভালোবাসা এবং নিজেকে গোছানোর চেষ্টা
শুরু। ইদানীং কবিতা লিখতে গিয়ে কবি রত্নদীপা দে ঘোষ বা কবি নীরজা কামাল বা অপরাহ্ন
সুস্মিতের লেখা পড়ে প্রেরণা পাই। তবে প্রকৃত অর্থে কবিতাকে ভালবাসতে শেখা আমার কবি
শর্মিষ্ঠা ঘোষ এর কাছে। আজকাল আমি একটু একটু ছুঁতেও পারছি কবিতাকে ওরই প্রেরণায়। আমি মানুষটা একটু বেশিই অগোছালো আর কি। জীবনের
নানা পর্বে নানান রকম মানুষের কাছ থেকে আমি শিখেছি শিখছিও। আমার নাট্য গুরু শ্রী
জগন্নাথ বসু র কাছ থেকে শিখেছি পরিমিতিবোধ। তা আমার জীবনেও কাজে লেগেছে। আমার
স্প্যানিশ শিক্ষক ডঃ দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায় এর কাছ থেকে শিখেছি ধৈর্য। এরকম বহু
মানুষ আছেন যারা আমাকে নানা ভাবে প্রেরণা দিয়েছেন। তবে সর্বক্ষণ নীরবে পৃথিবীর মত
ধরে রেখে পথ দেখিয়েছেন আমার মা। দুঃখ যে ভালো লাগার জিনিষ একথা মা-ই শিখিয়েছেন। সব
পরিস্থিতিতে নানারকম গান গেয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়ে
শুনিয়ে মা-ই চেতনা জাগিয়েছেন যে এই পৃথিবী বিশাল বড় জায়গা... কিন্তু আমিও ক্ষুদ্র
নই। চরিত্র যে আসল আদরণীয় বস্তু এই কথা জীবনে যাপন করে আমাকে শেখাতে চেয়েছে মা...
এক কথায় যা কিছু শিব যা কিছু সুন্দর তা মার হাত ধরেই চেনা। যদি দর্শন বল তা হলে এই
আমার সারাৎসার।
সংশপ্তক:
আপনার সাহিত্যচর্চার ক্যানভাসে অনুবাদের একটা বড়ো পরিসর গড়ে
উঠেছে। হঠাৎ অনুবাদই বা কেন?
আপনার
কি মনে হয় না মৌলিক সাহিত্যচর্চাতেই পাঠক একজন লেখককে অধিকতর স্মরণে রাখে?
জয়া চৌধুরী: এই প্রশ্নটি আমার
খুব পছন্দ হয়েছে। স্প্যানিশ ভাষাটি হঠাতই শেখা আমার কিন্তু অনিবার্য ছিল আমার
অনুবাদ করা। ছোটবেলায় দেব সাহিত্য কুটিরে বেরোনো অসাধারণ বহু লেখা যে অনুবাদ
সাহিত্য তা জেনেইছি বড় হয়ে। আমার তো মনে হত ওগুলো মৌলিক। জুলে ভার্ণের অমনিবাস এর
অসামান্য অনুবাদ অদ্রীশ বর্ধনের বা মানবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , সৌরীন্দ্রমোহন
মুখোপাধ্যায়-এর নানান লেখা বিশ্ব সাহিত্যকে আমার চেনার শুরু তাঁদের হাতেই। বাংলা
মাধ্যমে পড়া মেয়ে আমি। শেক্সপীয়ার ও অনুবাদেই পড়েছি। সবচেয়ে বড় কথা রামায়ণ মহাভারত
ও অনুবাদেই পড়া। ওগুলো যে সংস্কৃত থেকে বাঙ্গালায় করা। কৃত্তিবাস ওঝা বা কাশীরাম
দাস বা পরশুরাম যে কত বড় অনুবাদক আমরা কি একবারো খেয়াল রাখি তা? ইউরোপীয় সভ্যতাটি অসভ্যই থেকে যেত যদি অনুবাদ সাহিত্য না থাকত। ওই টুকু
মহাদেশে অজস্র ছোট ছোট দেশ , তাদের প্রত্যেকের ভাষা আলাদা,
খাবার, পোশাক, রীতি...সব
আলাদা, অথচ সংস্কৃতি এক। কী ভাবে তা সম্ভব হলো? শুধুমাত্র অনুবাদে। ফরাসী সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতি ইউরোপকে ছাইতে পেরেছিল এই অনুবাদের মাধ্যমেই। মৌলিক সাহিত্য
চর্চা তো ঈশ্বর দত্ত প্রতিভা না থাকলে পাঠক মনে চিরস্মরণীয় থাকা সম্ভব নয়। সেই
প্রতিভা আমার নেই। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে প্রতিভার তেমন দরকার নেই,
তাহলে আমার উত্তর হবে এই যে বাংলা ভাষার পাঠকদের আমার সামান্য
যোগ্যতা দিয়ে প্রাণপণে জানাতে চাই ইংরিজী ভাষী দুনিয়ার বাইরেও বিশাল পৃথিবী পড়ে
আছে । তারা জানুন ও সমৃদ্ধ হোন। বিদেশী ভাষা মানেই ইংরিজীই শুধু নয়। তাই যদি হোতো
তাহলে সোয়াহিলি ভাষায় লিখে নোবেল জয় করতে পারতেন না ওলে সোয়েঙ্কা। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলি পাঠক লেখক বা
অনুবাদকে মনে রাখে তাঁদের পড়তে ভালো লাগলেই। সেটা অনুবাদ না মৌলিক সেটা অত
গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সংশপ্তক: সাধারণত দেখা যায়, একটি ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদকের
ইন্টারপ্রেটেশানই মূখ্য হয়ে ওঠে। বিশেষত কবিতার
ক্ষেত্রে তেমনটি হলে কবির মূল
অভিপ্রায় কি ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায় না?
জয়া চৌধুরী: হ্যাঁ। এই ব্যাপারটি খুব স্পর্শকাতর। কবিতাকে আমি মনে করি সাহিত্যের সূক্ষ্মতম শাখা। তাই সেটির অনুবাদও সতর্ক হয়ে করা উচিত। তবে অনুবাদকের ইন্টারপ্রিটেশন থাকবেই। কারণ কবি একটি কথা বলেন। অনুবাদক পাঠক হিসাবে সেটি আগে পড়েন। তারপর তাঁর বোধি দিয়ে কবিকে অনুবাদে বোঝাতে চান। সুতরাং জেরক্স কপি পাবার সম্ভাবনা নেই। তবে সেটি কতদূর স্বাধীনতা নেওয়া যাবে তা অনুবাদকের শিক্ষা ও শুভবুদ্ধির ওপরেই নির্ভর করতে হবে।
সংশপ্তক: বাংলায় আজও অনুবাদ সাহিত্যের তেমন কদর নেই। এর পেছনে বাঙালি
পাঠকের অতিরিক্ত ইংরেজী সাহিত্যপ্রীতি বা নির্ভরতাই কি বেশি দায়ী বলে আপনার ধারণা? না কি ভালো অনুবাদকের অভাবকেই আপনি বেশি দায়ী করবেন?
জয়া চৌধুরী: দুটোই। ইংরিজী
সাহিত্য প্রীতি আমাদের বড্ড বেশি। আর তাছাড়া ভালো অনুবাদক প্রায় দেখাই যায় না
আধুনিকে সাহিত্য মহলে। এর কারণ আমি মনে করি প্রচলিত সবাই অনুবাদের অনুবাদ করেন
সাধারনতঃ। অর্থাৎ সেটি মূল জার্মান বা ফরাসী বা স্প্যানিশ বা সোয়াহিলি থেকে
ইংরিজীতে করা থাকে , তারপর সেখান থেকে বাংলায় হয়। এভাবেই মূল
থেকে সরে যায় লেখাটি। আর বিদগ্ধ পাঠকেরা সরাসরি ইংরিজী তেই পড়ে নেন। তার ফলে ইংরিজী অজ্ঞ পাঠক গুণগত
মানে আপোস করে সাহিত্য পড়েন। তাঁদের ভালো না লাগলে দোষ তো তাঁদের নয়। আমাদের অনুবাদকদের
দোষ এটি। আমাদের আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এই শূন্যতা ভরাট করার জন্য। বেশ কজন
অনুবাদক দরকার এই কাজে এখনই।
সংশপ্তক: বর্তমানের তথ্যপ্রযুক্তির
এই বিশ্বায়ন, সাহিত্যচর্চার কতটা অনুকুল বা অন্তরায় বলে
আপনার ধারণা?
জয়া চৌধুরী: দেখো সময়ের সঙ্গে
আমাদের নিজেদের মানিয়ে নিতেই হবে। তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বায়নের ফলে ছোট ছেলেমেয়েদের
পড়ার অভ্যাস খুব কমে গিয়েছে ঠিকই। আমাদের বাবা মাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে
তাদের আগ্রহ যাতে বাড়ে। আমাদের দেশ তো অনেক পিছিয়ে । ইউরীপীয়ান দেশ গুলোতে
তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগায় কি ভাবে, তা নিজের চোখে না
দেখলে বিশ্বাস হবে না। অথচ আজও ওদের বইয়ের
বিক্রি সাংঘাতিক। ওরা কি আমাদের চেয়ে কম টেক স্যাভি? আসলে চিরকালই মদের
দোকানে লাইন পড়ে আর গোয়ালা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ বেচে। আমাদের আসলে ভালো গোয়ালা
দরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বইমুখী করে তোলার জন্য।
সংশপ্তক: সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আপনার নাট্যচর্চার প্রেক্ষিতটা একটু
বিস্তৃত পরিসরে জানতে চাইছি। বিশেষত আপনার সাপ্রতিকতম প্রযোজনা বিশ্বকবির যোগাযোগ
উপন্যাসের নাট্যায়ন সম্বন্ধেও যদি কিছু বলেন!
জয়া চৌধুরী: নাটক চর্চা করেন
সিরিয়াস গুণী মানুষেরা। আমি তো নাটক না করলে নিঃশ্বাস নিতে পারব না তাই করি। স্বশিক্ষিত
নাটক মোদী মানুষ আমি। মনের আনন্দে করে যাই ।। তাতে কতটা কি দাঁড়ায় জানি না। আচ্ছা
সব বিষয়েই কি উদ্দেশ্য নিয়ে করে মানুষ? কি জানি। আমার তো
মনে হয় বাঁচবো না ওটা ছাড়া। রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ আমার প্রিয়তম উপন্যাস। আমার
গীতা আমার বাইবেলও বলতে পারো। ওনার
জন্মের ১৫০ বছকে স্মরণীয় রাখার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা এই উপন্যাসটিকে বেছে নিই। এটি
খুব সিনেমা ধর্মী লেখা। ৩২৭ পাতার লেখাটিকে দেড় ঘন্টায় নামানো খুব সহজ নয়। আমি
সেটাই করেছি আর তা করতে গিয়ে ভুল ও হয়েছে। কি করবো রবীন্দ্রনাথ আমাদের এতই প্রাণের
যে তাঁকে নিয়েও ভুল করতে পারি আমরা। নিশ্চিত জানি তিনি অন্তরালে বসে ক্ষমা করে
দেবেন। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি আমাদের নাটক সাধারণ দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছে খুব। তবে
অনেকে আমার মুন্ডপাত ও করেছেন কেন এটিতে হাত দিয়েছি আমি। আমার একটা কথা বোঝা
হয় নি যে যারা নিন্দা করছেন আমার কাজের
এতকাল তাঁরা করলেন না কেন? আমি কোথায় দাবী করেছি আমি বাদল
সরকার বা উৎপল দত্ত ?
সংশপ্তক: আমাদের সমাজসংসারে নারীর অবস্থান আপনাকে কতটা
ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন ছন্দে ও
সৃষ্টিশীলতার বিস্তৃত ক্যানভাসে এর প্রতিফলনের সরূপ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত ভাবেই
জানতে চাইছি।
জয়া চৌধুরী: নারীর অবস্থান
চিরকালই সবার নিচে ছিল। বহু লড়াই করতে হয়েছ নারীকে। কেবল টিভি আসার পরে সারা
দুনিয়া হাতের মুঠোয় আসাতে মানুষ এখন অনেক সচেতন। তাই আজ অন্ততঃ নারীর স্থান নিচে
নয় পুরুষের, পাশেই। মানে পাশ্চাত্য সভ্যতার মতো ঘটা করে
আগে গাড়ির দরজা খুলে ধরার আদিখ্যেতা ও নয় আবার সবার খাবার পরে শেষে তলানি খেয়ে
লক্ষ্মী বউটি হয়ে থাকাও নয়। চাই স্বাভাবিকতা। সেটাই সমাজে আজও আসে নি। আসল দরকার
সম্মান দেওয়া পরস্পরকে। কোনও রকমে সভ্যতার জামা পরানো আছে এখন। দরকার সেই কথাটাকে
মজ্জায় মিশিয়ে নেওয়া। এই কথাটাই রবীন্দ্রনাথ সেই কত বছর আগে বলে গেছিলেন “ নহি সামান্যা নারী/ পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধে/ সে নহি সে নহি...
ঋষিবাক্য মিথ্যে হবার নয়। আর আমার জীবন টাও অজস্র বাধার চেনা গল্পই। আমি
শুধু ওগুলোকে বাধা মনে না করে লড়ে যাচ্ছি। সৃষ্টি করার সময় আমার সেই যন্ত্রণা
গুলোকে আমি কাজে লাগাই।
সংশপ্তক:
তথাকথিত একাডেমিক নারীবাদের চর্চা আমাদের তৃতীয়বিশ্বের এই আর্থসামাজিক পরিসরে কতটা ফলদায়ী ও
আশাব্যঞ্জক বল মনে করেন?
জয়া চৌধুরী: দেখো কোন কিছু
বদলানোর কোনও থিওরি হয় না। আর সার্বিক বদল ঘটা তে গেলে সার্বিক প্রচেষ্টাও চাই। একাডেমিক
নারীবাদকে আমি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে রাজী নই। আজকাল অনেকেই আর্থ সামাজিক কারণের
অজুহাতে তাঁদের আন্তরিক চেষ্টার সবটাকেই উড়িয়ে দিতে চান। নারীবাদ মানে যে
অন্তর্বাস পোড়ানো নয় সেকথা নারীরাই ষাটের দশকের পরে স্বীকার করেছেন। আবার সারদা
মায়ের মত নারী যিনি দেড়শ বছরের আগে নারী স্বাধীনতার চূড়ান্ত করে গেছেন, তাঁর
ধরণও কিন্তু এঁদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আমার মনে হয় দেশ কাল ভেদে একটি বিষয় কমন।
তা হোলো সহ্য ও ধৈর্য রাখা। আজকের নারীরা নিজেদের নারীবাদের চূড়ান্ত জয়গান ঘোষণা
করতে পারে এই দুটি থাকলেই। অ্যাপ্রোচ পালটে যায় দেশ আর সময় ভেদে। ও নিয়ে অত হৈচৈ
করার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
সংশপ্তক:
আমাদের
জীবন জিজ্ঞাসায় ইতিহাসবোধের গুরুত্ব সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? আপনার কি মনে হয় না মানুষের সুষ্টিশীলতার পেছনে ইতিহাস
চর্চা খুবই গুরূত্বপূর্ণ?
জয়া চৌধুরী: আমি তো ইতিহাস ভীষণ
ভালোবাসি। ইতিহাস বোধের গুরুত্বকেও অপরিসীম মানি। অবশ্যই আমার মনে হয় মানুষের
সৃষ্টিশীলতার পেছনে ইতিহাস চর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসকে ভিত্তি করেই আমাদের
ভবিষ্যতের কল্পনা গড়ে ওঠে। সাহিত্যে যার ভীষণ প্রয়োজন। আমাদের অতীত না থাকলে
বর্তমান কিসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে? ইতিহাস অতীত আর
তাই সেটি জানা অবশ্য কর্তব্য।
সংশপ্তক: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কি? নতুন প্রজন্ম যারা আপনার পেশা ও নেশার আঙিনায়
পা রাখতে চায় তাদের সম্বন্ধে আপনি কতটা আশাবাদী?
জয়া চৌধুরী: পরিকল্পনা অনেক আর
সাধ্য সীমিত, আয়ুষ্কাল অনিশ্চিত তাই না? ইচ্ছে করে নবনীতা আশাপূর্ণা আর মহাশ্বেতার মতন লেখিকাদের স্প্যানিশ ভাষী
পাঠকের গোচরে আনি। আবার এও ইচ্ছে প্রাতঃস্মরণীয় হিস্পানিক সাহিত্যিকদের সৃষ্টির
সামান্য কণাও যদি বাঙ্গালী পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারি। ১১ জন সাহিত্যে নোবেল জয়ী
লেখক স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন। বাঙ্গালী পাঠকদের জানা তো পাবলো নেরুদা, গার্সিয়া মার্কেস, লোরকা তেই সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ
জানেন ইয়োসার কথা। কজন জানেন মিগেল উনামুনোর কথা? খুলিও
কোর্তাসারের কথা? লুই সেরনুদার কথা? একটি
বিশেষ ইচ্ছেও আছে অনুবাদের ব্যাপারে। সেটি আমার স্বপ্ন। জানি না মরে যাবার আগে তা
করে যেতে পারবো কি না। সেটি এতই ব্যক্তিগত স্বপ্ন যে তার নাম বলতে চাই না আগে।
ভাবি জীবন এত সীমিত... কিই জানলাম! কিই বা করে যেতে পারব! তবে চেষ্টা আমৃত্যু ই
করে যাব স্প্যানিশ ভাষা ও বাংলা ভাষার মাঝে বন্ধন গড়ে তোলার। নতুন প্রজন্ম আরও
আসুক এই প্রত্যাশায় আছি। তাদের উদ্দেশ্যে বলার এই যে অনুবাদ করতে গেলে রিটার্ন কি
পাবে ভেবো না। মনের আনন্দে করতে থাকো। সময়ে ফল পাবেই।