'পরগাছা' ধারাবাহিক আত্মকথা (পর্ব ৫)
তাই তো! আমি খেয়ালই করিনি! কখন যে গুটি গুটি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে, কখন যে তার শান্ত, নির্লিপ্ত থাবা একেবারে নখসুদ্ধু বসিয়ে দিয়েছে আমার ঘাড়ে, আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। হুঁশ হতে দেখি, আমার সারাগায়ে তার ভালোবাসার আঁচড়, পুঁজরক্ত জমে আছে প্রতিটা আঁচড়ের মুখে। বয়েস আমাকে ছাড়েনি। আমার উদভ্রান্ত ছেলেমানুষির মুখে সপাটে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছে সে। দিনকে দিন আমি মোটা, থলথলে আর ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছি। সেই সঙ্গে কুঁড়ের হদ্দও। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাওয়া দূরে থাক, এখন মনে হয় কেউ হাগিয়ে-মুতিয়ে দিলেও ভালো হয়।
ভারসাম্য অবশ্য আমার কখনোই বিশেষ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই পড়ে যেতাম ধুপধাপ। কলেজে পড়তেও, মনে আছে একবার নৈহাটিতে সুমনের সঙ্গে রেললাইন পার হচ্ছি, কিছুদূর গিয়ে সুমন দ্যাখে, আমি ধাঁ। রেললাইনের ওপর লটকে পড়ে আছি। বেচারা সুমন। তখন আবার হাত ধরে টেনে তোলো রে, ফার্মেসিতে নিয়ে যাও রে, টিটেনাস লাগাও রে, বাড়ি পৌঁছে দাও রে। কাজকর্ম, রিহার্সাল, সব মায়ের ভোগে। কম জ্বালিয়েছি ওদের? সারাজীবন মনে রাখবে আমায়। এইভাবেই হয়তো, কোনও মহৎ কাজে না হোক, অন্ততঃ হাড়জ্বালানোর কারণে কোনও কোনও বন্ধুর মাথায় কিছুকাল থেকে যাব আমি। সেটাই বা কম কী?
আজও সুমনকে একটু ঘাঁটালেই ও এক ঝটকায় ফিরে যায় সেই কলেজের দিনগুলোয়। বরং বলা ভালো, সুমন হয়তো বেঁচেই আছে ওই দিনগুলোর মধ্যে। যেই না একটু খুঁচিয়ে দিই, "সুমন, মনে আছে সেই কল্যাণী স্টেশনে...", ব্যাস! অমনি তার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে আর মহোৎসাহে সে বলতে থাকে শ্যামনগরের কম্পিটিশনের কথা, কল্যাণীতে আমাদের একের পর এক উল্টে পড়ার কথা, আমাকে হাসপাতালের বেডে বেঁধে রাখার কথা আর শেষ আমার মায়ের এক দাবড়ানিতে সুড়সুড় করে জহরলাল নেহরু হাসপাতালের জেনারেল বেড থেকে আমার বাড়ি ফিরে আসার কথা। আজও সুমন প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। সেই ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়েসটাকে পকেটের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, হয়তো একদিন বুড়োও হয়ে যাবে।
আমার কলেজজীবনের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একমাত্র সুমন-ই এখনও টিঁকে আছে। বাকিরা ছিটকে গেছে যে যার মতো। নাকি আমরাই ছিটকে গেছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি স্বাভাবিক জীবনযাত্রার থেকে। যাবতীয় সামাজিক আর নৈতিক দায়িত্ব, স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়েছে আমাদের। কারণ আমরা আলাদা। সাধারণ মানুষের যে সহজ, একমুখী জীবনপ্রবাহ, আমরা তার মধ্যে বেঢপ কিছু ঘূর্ণাবর্ত। জটিলতাসৃষ্টিকারী। আত্মকেন্দ্রিক।
অবশ্য, আমরাও সেয়ানা। এই 'আলাদা' ব্যাপারটার সুবিধে নিয়েছি পুরোদমে। সমাজ বা নীতির ধার ধারিনি। চরিত্রকে জামাকাপড়ের মতো ব্যবহার করেছি। যেন দাগ লাগলে সাবান দিয়ে একটু কেচে নেওয়া অথবা ফেলে দিয়ে নতুন জামা গায়ে পরে নেওয়া। সেই দাগ উঠল কী না উঠল, নতুন জামা গায়ে ফিট করল কী না করল, ভাবতে বয়েই গেছে আমাদের। আমরা হলুম যাকে বলে গিয়ে 'আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না'- গোত্রের।
চুল ভেজানোর অভ্যেস আমার কোনওকালেই নেই। গুটলির মতো একটা খোঁপা পাকিয়ে মাথার সামনেটা সামান্য ভেজানো। ইদানিং তবু তিন-চার দিন পর পর শ্যাম্পু করি, কলকাতার ধুলোকে মাথায় চড়ে বসতে দিই না বেশিদিন। কিন্তু ছোটবেলায়, যখন শ্যাম্পুর চল ছিল না তেমন, বছরে বড়জোর তিন থেকে চারদিন মাথায় সাবান দিতাম। তখন অত ধুলো নেই। পলিউশন নেই। একধামা চুল ছিল তখন আমার মাথায়। রাত্তিরবেলায় মা কালো কার দিয়ে টাইট করে বিনুনি বেঁধে দিত। গায়েও সাবান মাখতাম মাসে একদিন কী দুদিন। ময়লা চিট হয়ে বসত গায়ে। সেই ময়লা আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে তুলতে কী ভালোই যে লাগত। আমার দেখাদেখি পাপাই-ও সেরকম করত। আমাদের মধ্যে কম্পিটিশন চলত, কে কত নোংরা থাকতে পারে। আর কে কত ন্যাকামি করতে পারে। ন্যাকামিতেও আমরা দুজন কেউ কারও চেয়ে কম যেতাম না। পাপাই ছিল আমার ক্লাসমেট। আমার একই পাড়ায় থাকতাম।
পাপাইয়ের মামার নাম ছিল কাঞ্চন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। আমাদের বাগানে একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ ছিল। একদিন পাড়ার শ্যমলদা মাকে বলল, "বৌদি, ল্যাংড়া ফুল তুলবেন না?" মা-ও হাসছিল। ঠিক তখনি কাঞ্চনমামা চলে গেল আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। একবারও তাকাল না। মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। শ্যামলদাও থুম মেরে গেল কিছুক্ষণ। সেদিন বুঝেছিলাম কানাকে কানা বলতে নেই, আর পাগলকে পাগল।
আজও সুমনকে একটু ঘাঁটালেই ও এক ঝটকায় ফিরে যায় সেই কলেজের দিনগুলোয়। বরং বলা ভালো, সুমন হয়তো বেঁচেই আছে ওই দিনগুলোর মধ্যে। যেই না একটু খুঁচিয়ে দিই, "সুমন, মনে আছে সেই কল্যাণী স্টেশনে...", ব্যাস! অমনি তার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে আর মহোৎসাহে সে বলতে থাকে শ্যামনগরের কম্পিটিশনের কথা, কল্যাণীতে আমাদের একের পর এক উল্টে পড়ার কথা, আমাকে হাসপাতালের বেডে বেঁধে রাখার কথা আর শেষ আমার মায়ের এক দাবড়ানিতে সুড়সুড় করে জহরলাল নেহরু হাসপাতালের জেনারেল বেড থেকে আমার বাড়ি ফিরে আসার কথা। আজও সুমন প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। সেই ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়েসটাকে পকেটের মধ্যে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, হয়তো একদিন বুড়োও হয়ে যাবে।
আমার কলেজজীবনের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একমাত্র সুমন-ই এখনও টিঁকে আছে। বাকিরা ছিটকে গেছে যে যার মতো। নাকি আমরাই ছিটকে গেছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি স্বাভাবিক জীবনযাত্রার থেকে। যাবতীয় সামাজিক আর নৈতিক দায়িত্ব, স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়েছে আমাদের। কারণ আমরা আলাদা। সাধারণ মানুষের যে সহজ, একমুখী জীবনপ্রবাহ, আমরা তার মধ্যে বেঢপ কিছু ঘূর্ণাবর্ত। জটিলতাসৃষ্টিকারী। আত্মকেন্দ্রিক।
অবশ্য, আমরাও সেয়ানা। এই 'আলাদা' ব্যাপারটার সুবিধে নিয়েছি পুরোদমে। সমাজ বা নীতির ধার ধারিনি। চরিত্রকে জামাকাপড়ের মতো ব্যবহার করেছি। যেন দাগ লাগলে সাবান দিয়ে একটু কেচে নেওয়া অথবা ফেলে দিয়ে নতুন জামা গায়ে পরে নেওয়া। সেই দাগ উঠল কী না উঠল, নতুন জামা গায়ে ফিট করল কী না করল, ভাবতে বয়েই গেছে আমাদের। আমরা হলুম যাকে বলে গিয়ে 'আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না'- গোত্রের।
চুল ভেজানোর অভ্যেস আমার কোনওকালেই নেই। গুটলির মতো একটা খোঁপা পাকিয়ে মাথার সামনেটা সামান্য ভেজানো। ইদানিং তবু তিন-চার দিন পর পর শ্যাম্পু করি, কলকাতার ধুলোকে মাথায় চড়ে বসতে দিই না বেশিদিন। কিন্তু ছোটবেলায়, যখন শ্যাম্পুর চল ছিল না তেমন, বছরে বড়জোর তিন থেকে চারদিন মাথায় সাবান দিতাম। তখন অত ধুলো নেই। পলিউশন নেই। একধামা চুল ছিল তখন আমার মাথায়। রাত্তিরবেলায় মা কালো কার দিয়ে টাইট করে বিনুনি বেঁধে দিত। গায়েও সাবান মাখতাম মাসে একদিন কী দুদিন। ময়লা চিট হয়ে বসত গায়ে। সেই ময়লা আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে তুলতে কী ভালোই যে লাগত। আমার দেখাদেখি পাপাই-ও সেরকম করত। আমাদের মধ্যে কম্পিটিশন চলত, কে কত নোংরা থাকতে পারে। আর কে কত ন্যাকামি করতে পারে। ন্যাকামিতেও আমরা দুজন কেউ কারও চেয়ে কম যেতাম না। পাপাই ছিল আমার ক্লাসমেট। আমার একই পাড়ায় থাকতাম।
পাপাইয়ের মামার নাম ছিল কাঞ্চন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। আমাদের বাগানে একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ ছিল। একদিন পাড়ার শ্যমলদা মাকে বলল, "বৌদি, ল্যাংড়া ফুল তুলবেন না?" মা-ও হাসছিল। ঠিক তখনি কাঞ্চনমামা চলে গেল আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। একবারও তাকাল না। মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। শ্যামলদাও থুম মেরে গেল কিছুক্ষণ। সেদিন বুঝেছিলাম কানাকে কানা বলতে নেই, আর পাগলকে পাগল।