স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন আশা ও আশঙ্কা - দলতন্ত্র ও রাজনীতি!
যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন দেশ বিদেশে যে ভাবে সারা ফেলেছে তা বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসে অভুতপূর্ব! ছাত্ররা যে রকম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে, সেটাও বাংলার সমাজ ও রাজনীতির প্রচলিত ঘরাণার সাম্প্রতিক ইতিহাসের নিরিখে যথেষ্টই বিস্ময়ের; কারণ এদেশের ছাত্র আন্দোলনগুলি মূলত রাজনৈতিক দলগুলির স্বার্থেই রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের অঙ্গুলি হেলনই পরিচালিত হয়ে থাকে। সেখানে তথাকথিত কেবল মাত্র কেরিয়ারমুখি উচ্চশিক্ষার্থী , সমাজ রাজনীতির প্রতি মূলত উদাসীন বর্তমান এই প্রজন্ম যে এই ভাবে একটি অন্যায়ের প্রতিবাদে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তা আমাদের কাছে সত্যিই বিস্ময়ের বইকি! সেই বিস্ময়ের সাথেই যোগ হয়েছে বর্তমান প্রশাসনের লাগামছাড়া দূর্নীতি ও শাসক দলের স্বৈরাচারী মানসিকতার ক্রমাগত বহিঃপ্রকাশের বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীর একাংশের বিক্ষুব্ধ আবেগ! সেই আবেগকে পাশে পেয়ে এই আন্দোলনের অভিমুখ এখন কোনদিকে অগ্রসর হয়, সেটাই দেখার। শাসকদল যে তার প্রশাসনকে ব্যবহার করে সর্বতোভাবেই এই আন্দোলনের অভিমুখ বদলে দিতে, ও তাকে ছত্রভঙ্গ করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। ছাত্ররাও এই বিষয়ে যথেষ্টই সচেতন। কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা কি ভাবে সরকার ও প্রশাসনের এই প্রবল প্রতিরোধের বিরুদ্ধে তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধকে ধরে রাখতে পারবে। বা আদৌ পারবে কিনা। পারলেও কতদিন? তাদের দাবিগুলির কাছে সরকার পক্ষ কি মাথা নোয়াবে? কারণ যে কোনো সরকারের কাছেই যে কোনো আন্দোলন, যাতে সরকারি দলের স্বার্থরক্ষা হয় না- তাতে মাথা নোয়ালেই মানুষের কাছে দূর্বল প্রতিপন্ন হওয়ার ভয় ও আশংকা থাকে একটা।
কোন সরকারই তাই এই ঝুঁকিটা নিতে চায় না। বরং এই ঝুঁকিটা থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়ার জন্যেই স্বচেষ্ট হয় আরও বেশি করে। আর তাই এই রকম আন্দোলনগুলি, যেগুলির একটা অভিমুখ গড়ে ওঠে সরকার বিরুদ্ধ ক্ষোভের দিকেই, সেইরূপ আন্দোলনগুলির উপর সরকারও ঝাঁপিয়ে পড়ে তার আস্তিনের গুপ্ত অস্ত্রগুলি নিয়েই, সময় নষ্ট না করে। এবং তখনই বিরোধীদলগুলি ক্ষমতা পরিবর্তনের স্বপ্নে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনগুলির পাশে কখনো বন্ধু সেজে কখনো বা অভিভাবক রূপেই দাঁড়িয়ে পড়ে এবং সময় সুযোগ বুঝে হাইজ্যাক করে নেয় গোটা আন্দোলনটাকেই। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সরকার ও সরকারী দলের প্রবল প্রতাপ ও প্রবল প্রতিরোধের সম্মূখীন সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে তৎকালীন প্রধান বিরোধীদল ঠিক যেভাবে হাইজ্যাক করে আজ ক্ষমতার গদিতে সমাসীন। ফলে তাদের এই পথটি অতি ভালোভাবেই জানা আছে বলেই, যে কোনো আন্দোলন দেখলেই তারা সিঁদুরে মেঘ দেখে। আর এই আশঙ্কা , এই ভয়ের বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান শাসকদলের শীর্ষনেতৃত্বের মধ্যে যেমন দেখা গেছে তেমনটি সত্যিই অভুতপূর্ব অন্তত পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘরাণায়! সেটা পার্কস্ট্রীট গণধর্ষণ কান্ড থেকে শুরু করে কার্টুন বিতর্ক হয়ে সামান্য সারের মুল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে মাওবাদী তকমা জুড়ে দেওয়া থেকে কামদুনির মানুষের অতি ন্যায্য দাবির গণআন্দোলনকে ছত্রভঙ্গের কৌশলেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অথচ মজার বিষয় হলো প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের ক্ষোভ প্রাথমিক ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না আদৌ! কিন্তু ঐ সিঁদুরে মেঘ দেখার আতঙ্কই, যা একটু গভীরে ঢুকলে বোঝা যায়- আসলে স্বৈরাচারী মানসিকতারই একটা প্রকাশ ভঙ্গিমা মাত্র: বর্তমান শাসকদলকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। যে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমার কাছে প্রধান বিরোধী দলটি বর্তমানে কার্যতই সম্পূর্ণ রূপেই দিশাহারা। যার সরাসরি ফলস্বরূপ একদিকে সাধারণ কর্মীসমর্থকদের দলত্যাগের হিড়িক, অন্যদিকে একের পর এক নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে পরাজয়। আর ঠিক সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানের মরিয়া প্রয়াসে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনকেই তারা যদি ঢাল করতে চায় তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আর ঠিক সেই কারণেই এই ছাত্র আন্দোলনের পাশে বন্ধু সেজে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা তারা নিতেই পারে। ফলত যাদবপুরের এই ছাত্র আন্দোলনের সামনে এখন উভয় সঙ্কট! এক দিকে রাষ্ট্রশক্তির প্রতিরোধ, অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদল সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির বন্ধু সেজে দাঁড়িয়ে পড়ার ষোলয়ানা সম্ভাবনা। একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সামনে এর থেকে বড় চ্যালেঞ্জ আর কি হতে পারে?
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নকশাল আন্দোলনের সামূহিক ব্যর্থতার পর প্রধানত দুইটি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে যায়। এক, ছাত্র আন্দোলনের পরিসর থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সরে যাওয়া ও দুই, শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলির সরাসরি হস্তক্ষেপ নিশ্ছিদ্র করণ। ফলে শিক্ষাঙ্গনগুলি কার্যত হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীসমর্থক তৈরীর আখড়া। বামফ্রন্টের সুদীর্ঘ শাসন কালে সমস্ত শিক্ষাঙ্গনগুলিকে নিজেদের দলীয় নিয়ন্ত্রনাধীনে নিয়ে আসার এই সংস্কৃতি আজ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে ও শিক্ষার সার্বিক গুণগত মানকে ক্রমেই কলুষিত ও নিম্নমুখী করে তুলেছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী পূর্বতন সরকারের এই কর্মসংস্কৃতিকেই পাখির চোখ করে তুলেছে। আর সেই নিয়েই রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে চলছে রাজনৈতিক দঁড়ি টানাটানির খেলা। আর ভুতপূর্ব সরকারের মতোই বর্তমান সরকার তার সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার নিরঙ্কুশ প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এই যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সরাসরি দলীয় কর্তৃত্ব ও নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তারের সর্বগ্রাসী প্রয়াস- প্রধানত এটি তিনটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রাথমিকস্তরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্রসংসদ দখলকে কেন্দ্র করে যার সূচনা হয়। দ্বিতীয়স্তরে অশিক্ষক কর্মীসংগঠনগুলিকে দলীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে ও তৃতীয়ত প্রশাসনিক স্তরে সরকারী পরিচালন ব্যাবস্থাবলে শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোকেই দলীয় সংস্কৃতি ও স্বার্থের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেলা; ঠিক যে কারণে বাম আমলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধ্যক্ষ উপাচার্য নিয়োগ হতো আলিমুদ্দিনের আশীর্বাদধন্য হয়ে; আর আজ হচ্ছে বর্তমান শাসকদলের অলক্ষ্য অঙ্গুলি হেলনে।
সেই প্রক্রিয়ারই নিদর্শন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অস্থায়ী উপাচার্যের নিয়োগ। যার পদত্যাগের দাবিতেই উত্তাল এই ছাত্র আন্দোলন। ফলে বর্তমান শাসক দল ও তার সরকারের কাছে এই দাবি তাদের আত্মসম্মানের পক্ষে যে আদৌ অনুকুল নয়; সেই বিষয়ে কোনোই বিতর্ক থাকতে পারে না। আর ঠিক সেই কারণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিকে সরকারপক্ষ সরকার বিরোধী আন্দোলন রূপেই দেখছেন। আর ঠিক এই কারণেই যে আন্দোলনের অভিমুখ উপাচার্যের দিকে ছিল, সরকারপক্ষ নিজেদের আত্মসম্মানের বিষয় মনে করে সেই আন্দোলনকে নিজেদের দিকেই টেনে নিলেন। এইখানেই সরকারী দলের শীর্ষনেতৃত্বের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয় বর্তমান সরকারী দলের অসহিষ্ণু ও আত্মম্ভরী মানসিকতার ছবিও। যে কারণে ২০ শে সেপ্টেম্বর - এর বৃষ্টিস্নাত স্বতঃস্ফূর্ত ঐরকম মহামিছিলের পরেও সরকারী দলকে তার ছাত্র সংগঠনকে ঢাল করে পাল্টা মিছিল করে লোক হাসাতে হয়। ব্যবহার করতে হয় সরকারী আমলাদেরকে উপাচার্যের কার্যের সাফাই গাইতে। খেয়াল থাকে না, শুধু ছাত্ররাই নয়, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আচার্য তথা রাজ্যপালের সঙ্গেও দেখা করে আসেন। বর্তমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যা যথেষ্ট অর্থবহ। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের প্রশ্নে আপোষ করতে যারা রাজী নয়, অত অর্থ তলিয়ে দেখার মতো সময় ও প্রজ্ঞা তাদের কোথায়? আর এইখানে এসেই আটকে পড়েছে এই সমস্যার জট খোলার যাবতীয় সম্ভাবনা। যাদবপুরকান্ডের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যায়, বর্তমান অস্থায়ী উপাচার্যের প্রতি শুধুই ছাত্রছাত্রীদেরই নয়, অন্যান্য অধ্যাপক অধ্যাপিকাদেরও সমর্থন নেই। আর এই সমর্থন না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ বর্তমান সরকারী দলের সাথে উপাচার্যের একান্ত ঘনিষ্ঠতা, এবং সরকারী দলের নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণাধীন থেকেই কার্যত তাদের প্রতিনিধিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যপ্রণালী পরিচালনা করা। একটি স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান রূপে যা মানায় না। আর এইখানেই তার নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে তার কর্মদক্ষতা নিয়েও।
প্রশ্ন উঠছে সুষ্ঠভাবে কাজ করার সদিচ্ছা নিয়েও। ১৬ই সেপটেম্বর মধ্যরাতে নিরস্ত্র নিরপরাধ, অহিংস পথে তাদের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশি বর্বরতার পেছনে উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যার নিন্দায় সরব আসমুদ্রহিমাচল! লক্ষনীয় একমাত্র বর্তমান সরকারী দল ও তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন আমলা, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবি ছাড়া দেশে বিদেশে সকল শুভবোধসম্পন্ন মানুষই এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে তীব্রভাবে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্ত প্রশ্ন হল, সেদিন ছাত্রদের উপর এই ভাবে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়ার পেছনে শুধুমাত্র উপাচার্য কি একাই দায়ী? না তার পেছনে কোনো বড়ো মস্তিষ্ক ক্রিয়াশীল ছিল? একথা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছ যে ঘেরাও মুক্ত করে উপাচার্যকে উদ্ধার ও ছাত্রছাত্রীদের উপর পাশবিক বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সম্বন্ধে অন্যান্য আধিকারিক ও অবরূদ্ধ অন্যান্য অধ্যাপকরা সম্পূর্ণ অন্ধকারেই ছিলেন। যার প্রতিবাদ স্বরূপ সহউপাচার্যের পদত্যাগ পরবর্তীতে। ফলে দায়টা শেষ পর্য্যন্ত উপাচার্যের উপরেই বর্তায়। কিন্তু তাঁর কর্মপদ্ধতি লক্ষ্য করলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, এত বড়ো একটা অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতোও মানসিক দৃঢ়তা তার আদৌ নেই। থাকলে যে ছাত্রীটির শ্লীলতাহানির নিরপেক্ষ সঠিক তদন্তের ন্যায্য দাবিতেই এই আন্দোলন গড়ে ওঠে; সেই ছাত্রীর অভিভাবককে তিনি প্রথম দিনেই বিশ্ববিদ্যলয়ের তরফ থেকে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারতেন। তাঁকে কদিন পর দেখা করতে বলতেন না, বরঞ্চ তৎক্ষনাৎ পার্শ্ববর্তী থানায় অভিযোগ দায়ের করার ব্যবস্থা করতে পারতেন। যা তাঁর পদাধিকার বলে তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই প্রাথমিক দায়িত্বটুকুও যিনি পালন করতে অপারগ তাঁর পক্ষে তাঁর একক দায়িত্বে- মধ্যরাতে তাঁরই প্রতিষ্ঠানের নিরস্ত্র নিরপরাধ ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া আদৌ সম্ভবপর কিনা সেটাই মূল প্রশ্ন! আর তখনই পর্দার অন্তরালে কারা তাঁকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমর্থন যুগিয়েছেন বা উদ্দীপ্ত করেছেন কিংবা নির্দেশ দিয়েছেন; সেটা অনুমান করে নিতে বিশেষ অসুবিধে হয় না। আর এইখানেই মুল ছবিটা চলে আসে সেই ঘুরে ফিরেই! অর্থাৎ সেই চেনা ছকের চেনা গল্প! সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই দলতন্ত্রের আওতায় নিয়ে এসে সরকারী দলের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে হবে।
সেইসুত্রেই বর্তমান অস্থায়ী উপাচার্যের নিয়োগ, অশিক্ষক কর্মীসংগঠনকে সরকারী দলের ইউনিয়নের ছাতার তলায় নিয়ে আসা। বাকি থেকে যায় শুধু ছাত্রসংগঠনকে আপাদমস্তক কব্জা করা। আর সেইখানে এসেই যদি ঠেকে যেতে হয় বার বার, তবে অসহিষ্ণুতা অধৈর্য আক্ষেপ যে গ্রাস করবে তাতে আর সন্দেহ কি? আর সেই অবরুদ্ধ ক্ষোভের তপ্ত বাষ্প কোনো না কোনো ছুতোয় কোনো উপলক্ষে যদি বেড়িয়ে পরেই তাতে তো অস্বভাবিকতার কিচ্ছু নেই। এই যে নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদ ও দলতত্ন্রের প্রতি একান্ত আনুগত্য প্রতিষ্ঠার সীমাহীন উদগ্র বাসনা; এই অপসংস্কৃতি বামফ্রন্টের সাড়ে তিন দশকের রাজত্বে বাংলার সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বভাবতঃই বর্তমান সরকারী দলটি এই অপসংস্কৃতির সদম্ভ উত্তরাধিকারী। তফাৎ শুধু দুটি দলের সাংগঠনিক সংস্কৃতিতে। তাই পূর্বতন সরকারের আমলে যেটি সুষ্ঠ সাংগঠনিক দৃঢ়তায় একটি সময় সাপেক্ষ কার্যকরি নিপূণ পদ্ধতিতে সংঘঠিত হতো, সেইটি বর্তমানে পেশী শক্তির উন্মত্ত আস্ফালনে, অধৈর্য্য মানসিকতায়, অতিদ্রুত সংঘটিত করার তাগিদ থেকেই ঘটে চলেছে। তাই এখানে কত তাড়াতাড়ি নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হল সেটাই বড়ো কথা!
সেই আধিপত্যবাদী মানসিকতা থেকেই মধ্যরাতে পুলিশ ডেকে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের উপর পাশবিক বলপ্রয়োগ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা। সন্ত্রস্ত করা। তাদের ন্যায্য আন্দোলনকে বানচাল করে একটাই স্পষ্ট বার্তা পৌঁছিয়ে দেওযার প্রয়াস; ঠিক যে বার্তা একদিন ভুতপূর্ব মার্কীণ রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ সদম্ভে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববাসীর ঘরে ঘরে; - হয় আমাদের পাশে থাকো, নয় আমাদের শত্রুতার শিকার হও! ১৬ই সেপ্টেম্বরের মধ্যরাতে উপাচার্যকে ঘেরাও মুক্ত করার অজুহাতে পুলিশ ডাকা ও ছাত্রছাত্রীদের উপর বর্বর হানার নেপথ্যে এটাই যে মুখ্য কারণ, সেটা অনুমান করতে কি খুব বেশি কষ্ট করতে হয়? ফলত এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পুলিশ ডেকে উপাচার্যকে ঘেরাও মুক্ত করার সিদ্ধান্ত কখনোই শুধুমাত্র উপাচার্যের একার ছিল না। তাঁর সমর্থনের সরকারী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সবুজ সংকেত না থাকলে কখনোই তাঁর একার পক্ষে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানো আদৌ সম্ভবপর ছিল না। আর এইখানেই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আজ! এইভাবেই কি দলতন্ত্রের করালগ্রাসে ন্যুব্জ হতে থাকবে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদন্ড? আর তাই যদি হতে থাকে অনবরত, তবে এ কোন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা! আজকের ছাত্রছাত্রীদের এ কোন ভয়ঙ্কর পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলছি আমরা? যে শিক্ষাব্যবস্থাই হল একটা জাতির মেরুদন্ড গড়ে তোলার আঁতুরঘর, সেই ব্যবস্থার মেরুদন্ডই যদি এইভাবে ভাঙ্গতে থাকে তবে যে কোনো দেশের পক্ষেই বিষয়টা ভয়াবহ। যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন তাই শুধু আর যাদবপুরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়!
সীমাবদ্ধ নয়, কোন সরকারী দল কতটা স্বৈরাচারী মানসিকতার শিকার তার তুল্যমূল্য বিচার। কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের হাতে ছাত্রছাত্রীরা অধিকতর সুরক্ষিত। বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক পরিকাঠামোর ও ক্ষমতা দখলের ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির। বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবের।, স্বদেশচেতনার অভাবের। বিষয়টি একটি জাতির গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের সচেতনতার অভাবের। তাই আজ যে বিরোধী দলগুলি যাদবপুরকান্ডে ছাত্র অন্দোলনের সমর্থনে বন্ধু সাজার চেষ্টায় আহত অপমানিত অত্যাচারিত ছাত্রছাত্রীদের জন্যে কুম্ভীরাশ্রুপাত করছে তাদের অভিপ্রায় ও প্রকৃতি সম্বন্ধেও সচেতন হওয়ার সময় এসেছে আজ! আশার কথা যাদবপুরের শিক্ষার্থীদের সমর্থনে আজ বৃহত্তর ছাত্রসমাজ যে ভাবে সামিল হয়েছে তা এক কথায় অভুতপূর্ব! আশঙ্কার কথা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি এর থেকে ফয়দা লোটার জন্যে সর্বদা তৎপর! ফলে একদিকে যেমন সরকারী দলের আন্দোলন বানচালের অপপ্রয়াসের সম্মুখীন এই আন্দোলনের আশুভবিষ্যৎ; অন্যদিকেও বিরোধী দলগুলির সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলী হওয়ারও সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে দলমত নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ!
আর ঠিক এইখান থেকেই একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে আজ এদেশের ছাত্রসমাজের! তাদের এই অভুতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের একটি অভিমুখ হয়ে উঠুক- শিক্ষাঙ্গণ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এই ভয়াবহ রাজনৈতিক দলতন্ত্রের আধিপত্যবাদী অপসংস্কৃতির করালগ্রাস থেকে মুক্ত কারার আন্দোলন! এই খন্ড বাংলার সমাজ সংসারে আজও যে কজন সৎ নির্ভীক সমাজ সচেতন আদর্শবাদী শুভবোধ জাগ্রত নাগরিক ও বুদ্ধিজীবি অবশিষ্ট আছেন- যাঁরা এখনো নিজেদের মেরুদন্ডকে বন্ধক রাখেননি এই ভয়াবহ রাজনৈতিক দলতন্ত্রে, তাঁদের উপরেও এই আন্দোলনের পাশে থাকার একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়ে যায়। তাই এখন অপেক্ষা কোনদিকে কিভাবে অগ্রসর হয় এই আন্দোলনের অভিমুখ!