(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -১২
ঝুলন্ত সংসার
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়
ডাঃ গৌতমের শেষতম আবিষ্কার অর্থাৎ একান্ত
ব্যক্তিগত -১১ পৃথিবীর মানুষকে খাদ্যে শুধু স্বয়ংভর করেই তোলে নি তাকে করে তুলেছে
অহিংসও। মানুষের সেই আদিম দিনের অভ্যাস অর্থাৎ জন্তু জানোয়ার মেরে, কেটে, পুড়িয়ে (বা
রেঁধে) ভুলে গিয়ে এখন কৃত্রিম বা রাসায়নিক খাদ্যে অভস্ত হয়েছে। মানুষ আজ
জন্তু-জানোয়ার বা পশু মারে না খাবার জন্যে। এমন কি গাছেরও প্রাণ আছে এই তত্ত্বে
বিশ্বাসী হয়ে উদ্ভিদের চাষও করে না। ডাঃ গৌতম এমন এক মানুষ যিনি শুধু উপদেশ দিয়েই
তাঁর কর্তব্য শেষ করেন না। নিজে পথিকৃৎ হয়ে পথ দেখান। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে
শিখায়’ এই প্রবাদ বাক্য মেনে চলার লোক।
এখন তাই চাষের জন্য আলাদা কোনও জমি রাখতে হয়
না। গ্রামের বিস্তীর্ণ ফাঁকা চাষের জমিতে এখন বাড়ি হয় লোকের থাকার জন্যে। লোক বেড়ে
বেড়ে শহর ক্রমশ ঘিঞ্জি হওয়ায় সেখানে প্রচন্ড পরিবেশ দূষণ হচ্ছিল। ফ্ল্যাট বাড়ির
অল্প পরিসরে প্রচুর লোক বাস করে। এখন আইন করে ফ্ল্যাট করা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আগের
সব ফ্ল্যাট ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে আস্তে আস্তে। তেতালার বেশী উচু কোনও বাড়ি করা যাবে
না। আর তার কোনও দরকারও নেই। গ্রামের ফাঁকা চাষের জমিগুলোতে এখন বাড়ি হচ্ছে। আবার
হচ্ছে পশুদের জন্যে অভয়ারণ্যও। পশুদেরও মানুষের মত এই পৃথিবীর জমি ব্যবহারের
অধিকার আছে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাটবাড়িগুলি সব ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে এখন
কেমিক্যাল খাদ্যের কারখানা আর গোডাউন করা হচ্ছে। এই কারখানাগুলি সব চলছে
সৌরবিদ্যুতে। কয়লাপুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী তাপবিদ্যুৎ চুল্লীগুলি (Thermo
Electric Projects) ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো
হচ্ছে প্রাকৃতিক জলবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি থেকে (Hydro and Solar Electricity Projects)।
খাদ্যের প্রয়োজনে প্রাণী বা উদ্ভিদ হত্যা
করতে হয় না বলে মানুষ আগের চেয়ে বেশি অহিংস হয়ে উঠছে। নিজের দেশের মধ্যেই সব
চাহিদা মিটে যাওয়ার ফলে আর অন্য দেশের দিকে লোভের হাত বাড়িয়ে বা অন্য দেশের হিংসার
থাবা থেকে বাঁচতে প্রাণক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানুষ এতদিনে
সত্যি আদিমতা ঘুচিয়ে আধুনিক মানুষ নাম নেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠেছে বা উঠছে। এই সব
কিছু যার জন্য সম্ভব হয়েছে তিনি হলেন একজন বাঙ্গালী গবেষক ডাঃ গৌতম। তাঁকে এখন
নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বিশ্বে সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে। গত
জানুয়ারিতে তিনি বিরাশিতে পা দিলেন। কিন্তু এই বিরাশিতেও তিনি আকারে প্রকারে
স্বভাবে চরিত্রে যেন মাত্র বত্রিশ বছর বয়সী হয়ে রয়েছেন।
এই ডাঃ গৌতম একবার জম্মু-কাশ্মীরে বেড়াতে
গেছেন। জম্মুর হোটেলে আরাম করে কেমিক্যাল চিকেন বিরিয়ানি খাচ্ছেন কেমিক্যাল মাটন
দিয়ে। সঙ্গে গরম কেমিক্যাল ফ্রায়েড রাইসের ধোঁয়া উঠছে পাত থেকে। এমন সময় ঢং ঢং টং
টং করে সব কিছু মানে টেবিলের থালা গেলাস নড়তে লাগল। যেন কোন অদৃশ্য হাত জলতরঙ্গ
বাজাচ্ছে। এরপর চেয়ার টেবিলগুলো নাচতে লাগল আর সবাই কাত ধয়ে ধপাস ধপাস করে পড়তে
লাগল মাটিতে। মুহূর্তে চিৎকার, চেঁচামিচি হৈ হৈ। ভূমিকম্প। সবাই বাইরে বেরিয়ে একটা
ফাঁকা জায়গায় বেরোল। ভাগিস বেরিয়েছিল তাই। নাহলে হোটেলটা তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে
পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণপাখিরা সব উড়ে চলে যেত আকাশে।
এক মুহূর্তে মানে মাত্র মিনিট খানেকের মধ্যে
সব একেবারে ধংসস্তুপ। একটা সরকারি রিলিফ ক্যাম্পে ঠাই। সেখানে টিভিতে খবরে ব্রেকিং
নিউজের পর ব্রেকিং নিউজ। ধ্বংসস্তুপের সব টাটকা জ্বলন্ত ছবি আর কান্নার আওয়াজ।
উত্তর ভারত, আফগানিস্তান আর পাকিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্প। একটা ভূমিকম্পে এত হয়রানি?
অসংখ্য হতাহত, রাস্তাঘাট বাড়িঘরদোর তছনছ আবার যোগাযোগ ব্যবস্থা মায় মোবাইল পর্যন্ত
বিপর্যস্ত। অথচ এর খবর আঁচ পর্যন্ত করা যায় না। পূর্বাভাষ দেওয়া যায় না। মানুষ কত
অসহায়।
ডাঃ গৌতমের আর কাশ্মীর বেড়ানো হল না। ফিরে
এলেন কোলকাতায়। আবার বসলেন সকলের পরিচিত সেই বটগাছের তলায় তাঁর ধ্যানে। ধ্যান
ভাঙ্গল ছমাস পরে। এখন ডাঃ গৌতম আর যেন আগের গৌতম নন। এক নতুন মানুষ। কারণ তিনি
আবিস্কার করেছেন তাঁর “একান্ত ব্যক্তিগত ১২” কে। মানুষের স্বার্থে, মানুষের
কল্যাণে।
সাংবাদিকের দল আর উপস্থিত জনতা সবাই চমকে গেল
যখন তিনি তাঁর গোপন ভাঁড়ারের চাবিকাঠি খুললেন। ডাঃ গৌতম মন্ত্র পড়লেন “খুল যা শিম
শিম”। আর মুহূর্তে খুলে গেল একটা ডিজিট্যাল পর্দা। ভেতরে একটা যেন কৃত্রিম শহর। বড়
বড় বাড়ি রাস্তা, গাড়ি সব। ডাঃ গৌতম আবার উচ্চারণ করলেন, স্টার্ট ওয়ার্কিং। অমনি বাড়ির
ভেতরে লোকেরা কাজ করতে লাগল। কেউ খাচ্ছে, কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ টিভি দেখছে।
রাস্তায় বাস, ট্রাক, টেম্পো, ট্যাক্সি সব চলছে। এগুলো সব মডেল মানে পুতুল। আসলে
ডাঃ গৌতম এখন একটা নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। সুইচ
গুলিতে হাত ঠেকাতে হয় না। রিমোটের দরকার নেই। এক একটা মন্ত্র উচ্চারণ করলেই সুইচ
কাজ করতে শুরু করে যায়। আসলে মন্ত্র উচ্চারিত
হলে এক একটা শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে রিমোটের মত পৌছে যায় সুইচের কাছে। আর সুইচ অন
বা অফ হয়ে যায়। প্রথমে মানুষ দেখল নগর বা শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তারপর আবার
মন্ত্রোচ্চারণ। শুরু হয়ে গেল ভয়ংকর কম্পন। রিখটার স্কেল মাপতে লাগল সে কম্পনের
মাত্রা। কখনও পাঁচ, কখনও ছয়। আবার বাড়তে লাগল সে মাত্রা। আসলে একটা যন্ত্র
কম্পন তৈরি করছিল যখনই ডাঃ গৌতম মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেন “ভাইব্রেশন” কথাটা।
এত কম্পন যাতে এক একটা পাহাড় গুঁড়িয়ে যায় শহর
পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে- কিন্তু এখানে এই কৃত্রিম শহরে কিছুই ঘটল না এসব। সমস্ত
জীবনযাত্রা একেবারে স্বাভাবিক। কারোরই খাওয়া বিশ্রাম বা ঘুমের ঘটল না এতটুকু
ব্যাঘাত। শহরের মানে কৃত্রিম শহরের ভাইব্রেশন মেপে যন্ত্র বলল কম্পন “zero” অর্থাৎ এতটুকু কম্পিত হচ্ছে না এই শহর।
সবাই চিৎকার করে উঠল “হুররে” বলে। ডাঃ গৌতমের নামে জয়ধ্বনি। এ তো দারুণ আবিস্কার।
এ তো মারাত্মক কোনও মারণাস্ত্র আবিস্কার নয়। এ যে এক রোমহর্ষক জীবনাস্ত্র
আবিস্কার। বলে ভাল মানুষের বেঁচে থাকার মন্ত্র আবিস্কার। প্রকৃতিকে সত্যি সত্যি
হারিয়ে দেবার আবিস্কার। ডেমনস্ট্রেশন বন্ধ হল। সবাই ফিরে গেল হলঘরে। ডাঃ গৌতম বলতে
লাগলেন।
-আপনারা এতক্ষন যে নকল শহরটিকে দেখলেন
প্রকৃতপক্ষে তা হল একটা ঝুলন্ত শহর। ঝুলন্ত এর সব কিছু- বাড়িঘর, রাস্তাঘাট। অর্থাৎ
মাটিতে ঠেকে নেই এর কোনও অংশ। তাই ভূমিকম্পের মাত্রা যাই হোক না কেন সেই কম্পনের
ঢেউ স্পর্শ করতে পারে নি একে। কম্পন বাইরে দিয়েই গেছে। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠে বা মাটির
নিচে যাই ঘটুক না কেন এই শহর থাকবে সম্পূর্ণ অক্ষত। ডাঃ গৌতমের একটা মস্ত গুণ হল
সাংবাদিকদের কোনও কথা বলতে দেন না। কারণ তাদের কথা বলার দরকারই হয় না। তাদের মনের প্রশ্ন আগাম আঁচ করে নিজে থাকেই উত্তর দিয়ে দেন। তাই কোনও হৈ হল্লা
হয় না। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুধু শুনে যায়।
-একটা বিশাল বড় চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়
আকাশে। আর শহরের নিচে সৃষ্টি করা হয় ভূ-চুম্বকের সমমেরু। ফলে এই কৃত্রিম শহরের
মেঝে আর মাটির সঙ্গে থাকে বিকর্ষণের সম্পর্ক। আকাশে তৈরি করা হয় বিপরীত মেরু ফলে
সেই চুম্বক আকর্ষণে সম্পূর্ণ আকাশে ঝুলন্ত থাকে এই শহর। মাটির সঙ্গে তার কোনও
স্পর্শ নেই। আর এর জন্যে যে বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন তা মেটায় আকাশের সূর্যরশ্মি
অর্থাৎ সৌরবিদ্যুৎ। পৃথিবীর চারপাশে যে সব কৃত্রিম উপগ্রহগুলি পৃথিবীর অন্য কাজ
করে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে এই কৃত্রিম শহরটিকে বা গুলিকে। ফলে
পৃথিবীর বুকে যতই কম্পন হোক না কেন তার কিছুমাত্র ছোঁয়া স্পর্শ করতে পারবে না এই
নকল ঝুলন্ত শহরগুলিকে। সেগুলি হবে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
বাইরে এখন একটাই আলোচনা। সব বিজ্ঞানীরা চাঁদ
মঙ্গল নিয়ে অনেক ভাবে কিন্তু ডাঃ গৌতমের মত পৃথিবী আর মানুষ নিয়ে কজন ভাবছে? সত্যিই
একজন খাঁটি মানবপ্রেমী তিনি। একজন খাঁটি মানুষ। বলতে ভুলে যাচ্ছি এ বছর থেকে আবার
একটা নতুন পুরস্কার চালু হচ্ছে বিশ্বে। সেটা হল “বিশ্ববন্ধু”। তার প্রথম প্রাপক –
ডাঃ গৌতম আবার কে?
[অরুণ চট্টোপাধ্যায়]