কোন কোন রাত অপেক্ষায় থাকে
এক
কচি কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়ী পরনে আতরজান
বিবি বসে আছেন বিশাল খাটের একপ্রান্তে। হাতের সামনে রূপোর পানের বাটা পরিপাটি
সাজানো। মোটা মোটা কারুকার্যময় সোনার বালায় ঝাঁকুনি তুলে তিনি পান সাজাচ্ছেন
রেকাবীতে। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছেন বলে গলার তিন লহরী চেনটা দুলছে,
সাথে কানের মাকড়িগুলোও।
---
আম্মা আইজকাও কি সরবত আলার বাইত্তে খাওন
পাঠাইবেন নিহি? বলতে বলতে ঘরে ঢোকে নায়না,
এ বাড়ীর ছোট বউ।
মাথা না তুলেই তিনি বললেন,
হ। আইজকা তো তিন দিন হইছে,
আইজ বাদে আর দেওন লাগব না।
পাশের বাড়ীর সরবতওয়ালার স্ত্রী মারা গেছেন
পরশু দিন। মরা বাড়ীতে চুলো চলবে না, এটাই রীতি। তাই এই তিন দিন এ বাড়ী থেকেই খাবার যাচ্ছে। বৌ’টিও জানে আজ খাবার দিতে হবে। তবু শাশুরীকে
জিজ্ঞেস করা নিয়ম। এই বৌটি যেমন শাশুরী অন্ত প্রান, শাশুরীও বাকি ছয় বৌয়ের চেয়ে এই বৌকেই একটু
বেশী আশকারা দেন, এটা সবাই জানে। নায়না চলে যাচ্ছিল এবার তিনি
মুখ তুলে ওর দিকে তাকালেন,
---
কাইল সাহেদ ঘরে আইছে কখন?
---
আহে নাইক্যা---মলিন মুখে বাক্য দু’টি ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নায়না।
আতরজান বিবি এবার একটু অসুখি হলেন কি?
এই ভরা সংসারে তার সাতটি ছেলে। সবগুলো বাপ
মন্তাজ মহাজনের ছড়ানো ছিটানো বিশাল সব ব্যাবসা আর নিজের বউবাচ্চা নিয়ে ব্যাস্ত।
ছোটটাই কেমন দলছুট। এ বাড়ীর প্রথা ভেঙ্গে ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছিল। তারপরই
জড়িয়ে পড়ল বদসঙ্গে। সারাদিনরাত নেশা করে পড়ে থাকে। সে তো নেশা নাকি মন্তাজ মহাজনও করত
অল্পবয়সে। বিয়ে করে কই গেছে এইসব। সেই আশায় ইমামগঞ্জের কলেজ পড়া মেয়ে নায়নাকে বিয়ে
করানো। দুই বছর হতে চলল, কোথায় কি! ছেলে যেন আরো নীচে নামছে। ‘আজ ওর বাপ আইলে সব কয়া দিমু’—ভাবছেন আতরজান বিবি।
দুই
এই শোনোই না----মৃদু স্বরে ডাকে সাহেদ
না, তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না আমার---নায়না পাশ ফিরে
শোয়
---
ক্যান?
---
ক্যান? কাল রাতে কোথায় ছিলে? এই ভাবে আমাকে কষ্ট দেবার মানে কি?
---
স্যরি নায়না, আমার ভুল হয়ে গেছে,
আসলে ওই কামাইল্যার দোষ—
---
খবরদার মিথ্যে বলবে না। প্রতিদিন বলো,
আর এমন হবে না, স্যরি। আবার সেই একই ভুল! সত্যি আমি আর পারি
না। শুধু আম্মাজানের মুখের দিকে তাকিয়ে---
সাহেদের হাত নায়নার গাল ছোঁয়। নায়নার কাঁধে
মুখ গুঁজে নরম মায়া মায়া কন্ঠে সে ভালবাসা ঢেলে যেতে থাকে,
আর এমন হবে না, হবে না। নায়নাও অভিমানী জড়ানো গলায় বলে যেতে
থাকে, আর ক্ষমা পাবে না,
পাবে না।
---
সাহেদদদদ
---
আহিইইইই
বাইরে থেকে কামাল ডাকতেই হুড়মুড় করে ঘর থেকে
বেরিয়ে যায় সাহেদ। পেছন থেকে ওর শার্ট চেপে ধরে নায়না। এক রকম ওকে ধাক্কা দিয়ে
ফেলেই বেরিয়ে যেতে যেতে সাহেদ বলে, অক্ষনই আয়া পড়ুম। পাথরের মত বিছানায় বসে পড়ে নায়না।
এই সব ওর নিত্যদিনের জীবন। কেন যে সে এসব
ফেলে বাপের বাড়িতে চলে যেতে পারে না! অভিমানে একবার কাঁদে। কামালকে অভিশাপ দেয় মনে
মনে। তারপর শান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আজ রাতেও আর ঘরে ফিরবে না সাহেদ,
জানা কথাই।
তিন
---
পেটি ক্যাশ থিকা চাইর লাখ লিয়া গেছে। কইছে
বাকি ছয় লাখ রেডি রাখবা
---
কেলা? আব্বায় কই আছিল?
---
আব্বার কান্ধেই তো পিস্তল ঠেকায়া থুইছিল
কামাইল্যা
---
কছ কি!
এহন আব্বায় কই?
---
বেপারীগো লগে মিটিং এ বইছে। আর টুন্ডা জাকির
রে খবর দিছে।
---
টুন্ডায় কি করব?
ওর গ্রুপ রে ট্যাকা দ্যাওন লাগব না?
---
টুন্ডায় নিহি বাকি ছয় লাখ নিয়া কাম কইরা দিব।
আর কুনো হমুন্দির পো য্যান অপিস ঘরে নজর দিবার না পারে।
---
কি? টুন্ডারে ট্যাকা দিব আব্বায়? খাড়া আমি যাইতাছি। সবতের ট্যাকা খাওন বাইর
করুম---
কর্মচারী ইউসুফের হাত ধরে সাহেদ প্রায় বের
হয়েই পড়েছিল। আতর জান এসে দাঁড়ায় সামনে।
---
সাহেদ, কই যাস? তর বৌ রে ইমামগঞ্জে দিয়া আয় আগে
---
হুনো কথা! কেলা?
অহন কেলা?
---
অহনই তো! ওর সইল বালা না। খাইবার পারে না।
মায়ের লগে গিয়া থাকুক কয়দিন
---
হুর আপনে খালি দিকদারি করেন আম্মা। হুনতাছেন
আব্বার লগে গ্যাঞ্জাম---
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আতরজান বলেন,
---
হুনো চান্দ, তোমার বাপের ব্যাবসা আইজকার না। এইসব অহে,
অইব। তুমার চিন্তা কি?
আর কথা বাড়ায়ো না,
বউরে লিয়া যাও।
আতরজানের কণ্ঠে আদেশ এলে তার বরখেলাপ করার
সাধ্যি এ বাড়ীতে কারো নেই। শুধু সাহেদই পারে সেটা পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে।
নেশাসক্ত সাহেদও বুঝে নেয়, আজ এ কণ্ঠে অন্য সুর। একে অবহেলা করবার
সাধ্যি তার নেই। নত মুখে সে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
চার
নায়না তৈরীই ছিল। সাহেদ ঘরে ঢুকতেই সে ছোট
স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে বলে, চলো। সাহেদ হাসে,
---
এত আয়োজন? ব্যাপার কি নায়না বেগম?
---
হ্যা আয়োজন তো বটেই! এ বাড়ি থেকে চিরদিনের
জন্যে বিদায় নেব, আয়োজন হবে না?
---
মানে?
---
মানে জেনে তুমি কি করবে?
---
নায়না!!!
এ বাড়ীর নিয়ম ভেঙ্গে ছেলে আর তার বউ এক ঘরে
নির্জনে থাকা স্বত্ত্বেও ছেলের ঘরে এসে ঢোকেন আতরজান বিবি। যা বলেন তার মর্মার্থ
এই যে, নায়না সন্তান সম্ভাবা। তিনি সাহেদকে সুপথে
নিয়ে আসবার জন্যে নায়নাকে ঘরের বউ করে এনেছিলেন। কিন্তু যদি জানতেন ছেলে তার কখনোই
ঠিক হবে না। তাহলে এই কাজটি তিনি করতেন না। এখন বউটিকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে তিনি এর
প্রায়শ্চিত্ত করবেন। নায়না ওখানে গিয়ে পেটের এই শত্রু কে বিদায় করে যেন আবার নতুন
করে জীবন শুরু করতে পারে, সে জন্যেই আজ তিনি ছোট ছেলের বউকে এভাবে বাড়ি
থেকে এক রকম সরিয়েই দিচ্ছেন।
পাঁচ
---
আপনি স্বেচ্ছায় এসেছেন তো?
---
জ্বী
---
কিনতু ফেরত গিয়েও কি আবার সেই নেশার জগতে
ঢুকতে ইচ্ছে করবে না?
---
না
---
ভেবে বলছেন তো? তা’ছাড়া তিনমাস কিনতু কম সময় নয়। বাড়ি ফেরার জন্যে অস্থির হবেন
না তো? বা আমরা যেভাবে কাজ করব সে ভাবে আপনার
সাহায্য পাব তো?
---
জ্বী
---
নিন, আপনি স্বেচ্ছ্বায় এসেছেন, এই মর্মে এখানে একটা স্বাক্ষর দিন।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক
যোসেফ গোমজ কাগজটা টেনে নিতে নিতে নায়না কে বলেন, এবার আপনাদের চলে যেতে হবে। সাহেদ থাকল। কোন
চিন্তা করবেন না। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ওর সাথে আপনারা দেখা করতে পারবেন।
নায়না দরজার দিকে যাচ্ছে,
সাথে সাহেদও আসছে এগিয়ে দিতে---
---
নায়না! ফিসফিস করে সাহেদ
---
বলো। চোখের জলে ভিজে গেছে নায়নার গাল,
যেখানে সাহেদের নরম হাতের ছোঁয়া এখনো লেগে
আছে
---
আমার সন্তান! ঠিক থাকবে তো?
আর তুমি?
এবার নায়না, বনেদী ঢাকাইয়া বাড়ির বউ,
শাশুড়ি আর রিহ্যাবের গাদা গাদা লোকের সামনেই
সাহেদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। আতরজান বিবি বোরকার ভেতর ঘেমে চুপচুপে হয়ে আছেন।
এমন জায়গায় তাকে আসতে হবে কে জানত? তিনি নায়নার হাত শক্ত করে ধরে রাখেন।
ছয়
আজ রাতটা কি একটু অন্যরকম?
আকাশ ভর্তি জোনাক পোকার মতো ঝিলিক তোলা ক্ষীণ
আলোর তারাদের হুটোপুটি দেখতে দেখতে আনমনা হয় নায়না। আর কি মুশকিল বাগানের
দোলনচাঁপার সৌরভ একেবারে জানালা পেরিয়ে ঢুকে যাচ্ছে সরাসরি নায়নার নাকের ভেতর।
মাথার ভেতরটা কেমন ঝিমঝিম করছে। শরীরের সব অনুভুতি লোপ পেলেও বুকের ভেতর থেকে উছলে
পড়ছে আনন্দের এক ঝর্ণাধারা। আর মাত্র এই একটি রাত! কাল সকালেই সাহেদ বাড়ী ফিরবে।
রাতটা সেই যে বারোটায় এসে আটকেছে এখনো বের হতেই পারছে না। সকালটা কতদূরে?
এসব ভাবতে ভাবতে নায়না বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
---
কেউগা? ছোট বউ নিহি?
---
জ্বি আম্মাজান। আপনি ঘুমান নাই অহনতরি?
---
ঘুম আহে না রে ছেড়ি। কাইল আমার সাহেদ আইব---
দুই নারী কাঁদে। রাতের আকাশে তৈরী হয়ে যায়
একটি সেতু। বুদ্ধিমতি শাশুড়ির যোগ্য ছেলের বউ নায়নার মনে হয় একবার শাশুড়ির হাতটা
আঁকড়ে ধরে। কিনতু কি এক সংকোচ বেঁধে রাখে তাকে। শুধু শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মাখামাখি
হয়ে ওঠে মন। আতরজান বিবিও তেমনি। ক্ষীন কটি আর হরিনের দৃষ্টিতে মায়া মাখানো এই
মেয়েটি কেমন করে যেন তার বুকের গভীরে ঢুকে গেছে। সাহেদের সাত মাসের ভবিষৎ বংশধর ওর
পেটে। তবু কোন ক্লান্তি নেই এই মেয়ের। এত ভাল মেয়ে পৃথিবীতে কি আরো আছে?
খুব মন চায় একবার নায়নাকে বুকে টেনে নিতে।
কোত্থেকে যেন একরাশ দূরত্ব মন টেনে ধরে। এ দূরত্ব সমাজের,
এ দূরত্ব ঐতিহ্যের। অথচ মেধায়,
মননে, শৈলীতে দু’টো নারী আজ একাকার। কোথায় বৌটাকে বুকে চেপে ধরবেন তা নয়!
কেমন যেন আদেশের সুরেই বলেন,
---
এই শইলে বাইরে আর থাকন লাগব না বৌ,
ঘরে যাও
---
হ আম্মাজান যাইতাছি। আপনে ভি হুইয়া পড়েন গা।
দুইদিকের দুই দরজা আটকে যায়। মাঝখানের
বারান্দাটুকু শুধু সারা রাত জেগে থাকে। অপেক্ষার রাতে ঘুমাতে নেই।
শাকিলা তুবা