আগে যা ঘটেছে ::: ঋজু সুভদ্রা লুরে কেভার্স ও শ্যানানডোহা ন্যাশনাল পার্ক দেখে বেশ রাত্রে ফিরে
আসে ওয়াশিংটন ডিসিতে।
মধুচন্দ্রিমা (পর্ব ৬)
ঝলমলে রোদেলা সকালে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙ্গে ঋজুর "ঋজু ঋজু ওঠো ওঠো ওঠো" জোরে জোরে ধাক্কা দেয়
সুভদ্রা। ঋজু ঘুম ভেঙ্গে কিছুটা সময় আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে। একে তো এতো কাছে
মুখ নামিয়ে ডাকছে, কি
অদ্ভূত স্পর্শ মেয়েটার, তায়
কেমন সুন্দর করে সাজগোজ করে রেডি আর ঝলমলে হাসি যেন দারুন কোনো একটা অভিজ্ঞতা হতে
চলেছে ঋজুর। ভালো করে তাকিয়ে দেখে সাদা রঙের লেসের একটা জামা পড়েছে, চুলগুলোকে কেমন করে বেনুনী করেছে যেন
জলপাই পাতার মুকুট পরা মাথায়। কানে গলায় হাতে চেরী ব্লসমের ফুলের মতো দেখতে নকল
ফুলের গয়না।
"শুধু দুটো পালকওলা
ডানা থাকলেই____"
বলে আলতো করে হাত চেপে ধরে ঋজু। কথাটাতে আরোও হাসে
"কি হত? ডানা থাকলে?" হাত ছাড়িয়ে নেয়
সুভদ্রা। আধ শোওয়া হয়ে মাথার নীচে হাত রেখে বলে ঋজু
"পার্ফেক্ট অ্যাঞ্জেল" ঋজুর কথায় ওর মুখের
সামনে হাত নাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলে
"হ্যালো, রাতে কি ড্রিঙ্ক করে ছিলে নাকি? যে সকাল সকাল অ্যাঞ্জেল দেখছ? ওঠো শিগ্গির।"
"উঠে?"
"আমি কাল রাতেই
বুঝেছি, তাই তোমার ইচ্ছাপূরণ
করতে নিয়ে যাব"
"মানে কি?" বলে আবার শুয়ে পড়ে
ভালোকরে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দেয় ঋজু
"বলব না, উফ্ সারপ্রাইসও বোঝে না। দেখছ আমি রেডি; কোথায় চটপট রেডি হবে তা নয়। ওঠো না, আমার ক্ষিদেও পাচ্ছে তো" শেষ কথাটায়
ম্যাজিকের মতো কাজ হ'ল।
দ্রুত তৈরী হতে লাগল, শুধু
স্নানের সময় বেশ টের পেল নোনতা জল মিশে যাচ্ছে সাওয়ারের জলে। একটা কষ্ট যেন দলা
পাকিয়ে গলার কাছে আটকানো। কোনো অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিতকে বিদায় দিতে এতো কষ্ট
হয়? কেন মনেহচ্ছে 'চুলোয় যাক সব আর ফিরব না, কাজ করতে হলে এখানেই কোথাও করি। নাঃ
মেয়েটাকে আমার মনোভাব টের পেতে দেওয়া যাবে না। খুব চেষ্টা করতে হবে ওর সাথে
রেগুলার যোগাযোগ রাখার। মন জুড়ে বসে গেছে মেয়েটা' ভাবতে ভাবতে রেডি হ'ল
ঋজু। দেশী জামা গায়ে গলিয়েছে জিনসের সঙ্গে, এই
পোশাকে যে ওকে সতি্যই সুন্দর লাগে সেটা ঋজুর অজানা নয়। জামাকাপড় যা সঙ্গে এনেছিল
সবই প্রায় পরা শেষ, ধোওয়ার
সময় তো পেলই না। কাজেই সবেধন নীলমনি পাঞ্জাবীটাই পরতে বাধ্য। স্নান সেরে বের হয়ে
আবিষ্কার করে সুভদ্রা স্মোক করছে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, ঋজুর উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেট নিভিয়ে
ঘরে আসে; এবার সুভদ্রার মুগ্ধ
হবার পালা, তাকিয়ে
থাকে ঋজুর দিকে
"যাঃ, এতো সেজেগুজে শেষে কিনা বিড়ি টানছ? অ্যাঞ্জেলরা যে বিড়ি ফোঁকে এই প্রথম
জানলাম" হাসে
ঋজু
"বিড়ি কি?" বাচ্চাদের মতো গোল
গোল চোখ করে জিজ্ঞেস করে সুভদ্রা।
"ওঃ! সে হ'ল ভেরী পপু্যলার ইন ইন্ডিয়া, ওয়ান কাইন্ড অফ লিফ যেটার ভেতরে আবার টোব্যাকো ভরে
সিগারেটের মতো বানিয়ে একটা লালসুতো দিয়ে বাঁধা থাকে। বলতে পার পুওরম্যানস্
সিগারেট, চিপার দ্যান সিগারেট
তবে র' টোব্যাকো। সিগারেটের
থেকেও আনহেল্দি আর গন্ধটাও কড়া। র' না
সব।"
"আমি বিড়ি পাব
কোথায়?" এমন
সহজ সরল উত্তরে আরোও হাসে ঋজু। কাছে এসে মায়া নিয়ে বলে
"ওটা তো মজা করে
বললাম। তবে আমি ভেবেছিলাম তোমার এই খুঁতটুকু সারিয়ে দিতে পারলাম বুঝি, এই ক'দিন একদম স্মোক করনি।" কাছে
এসে গভীর চোখে তাকায় ঋজু। 'সত্যিই
মেয়েটা নিঁখুত হোক' ভাবে।
"না, না, আমি
এমনিতেও বেশি স্মোক করি না। শুধু টেনশন হলে বা খুব আনন্দ বা খুব দুঃখ হলে তবেই।"
"ও, তাই বুঝি? নাঃ তবে তো সতি্যই বেশি খাও না। তা' আজ কোনটা হচ্ছে শুনি? টেনশন? আনন্দ? না
দুঃখ?" হাসি
লুকিয়ে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলে ঋজু। শুধু মনেমনে চায় একটাই উত্তর শুনতে 'খুব দুঃখ হচ্ছে'।
"আজকে না সবগুলো মিশিয়ে
কেমন লাগছে। ধুর চলো নীচে যাই খেয়ে নিয়ে তবে তো চেরীব্লসম দেখতে যাব"
বলেই লম্বা একহাত জিভ কেটে বলে "এহেঃ, সেই বলেই ফেললাম। সারপ্রাইস রইল না। বাই
দ্য ওয়ে তোমায় একটা কথা বলাই হয়নি, এই
ইন্ডিয়ান পোশাকে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। কেমন আরামদায়ক চেহারা পোশাকটার আর মনে
হচ্ছে তুমিও খুব স্বচ্ছন্দবোধ করছ এটা পরে।" নিজেদের
ব্যাগপত্র নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে লাউঞ্জের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে সুভদ্রা।
"ওঃ আবার সেই শক্ত
শক্ত ভাষায় কথা বলে। পাতি বাঙলায় বলো না।" হাসে
দুজনেই, সুভদ্রা একটু কপট
রাগ ও দেখায়। ব্রেকফাস্ট সেরে চেকআউট করল ঠিকই কিন্তু গাড়ি হোটেলের পার্কিংএ
আরোও কিছু সময় রাখতে পারে সেই সুবিধেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল ওরা। লাগেজ রেখে
শুধু ক্যামেরা নিয়ে চলল ফুল দেখতে। রাতের বৃষ্টির ফলে দিনটা খুব সুন্দর না গরম না
ঠান্ডা; রোদ ঝলমলে আবার
হাওয়াটা ঠান্ডা ফলে দুটোর কোনোটারই প্রকোপ তেমন নয়। বৃষ্টি হয়ে আরোও একটা উপকার
হয়েছে পোলেন বা রেণু ধুয়ে গেছে অনেক, আবার
এতো বৃষ্টি হয়নি যে সব ফুল ঝরে যাবে। ওরা যে দু'দিন লুরে কেভার্নস ঘুরল সেই দিনগুলোয় ডিসিতে অনুকুল পরিবেশ
পেয়ে সব গাছের ফুল ফুটে গেছে। ঋজুর কল্পনারও বাইরে যে এতো দ্রুত পরিবর্তন হতে
পারে। চারিদিকে মানুষ বেড়িয়ে পড়েছে ফুল দেখতে, একটা উৎসবের মেজাজ। যদিও অফিসিয়াল চেরীব্লসম ফেস্টিভ্যাল
শুরু হতে আরোও দিন দুয়েক বাকি, কিন্তু
এখনি সবাই ফেস্টিভ মুডে। পথ চলতি মানুষের সাথে ধাক্কা না লাগে করতে করতে কখন যেন
ঋজুর হাতটা ধরে আহ্লাদীর মতো চলতে শুরু করেছে সুভদ্রা। ওয়াশিংটন মন্যুমেন্টের
চারপাশে ওদিকে পোটোম্যাক রিভারের টাইডাল বেসিনে সব দিকে ফুল। ওরা একবার এখানে
দাঁড়ায় একবার ওখানে দাঁড়ায়, ঠিক
কোন জায়গায় ছবিটা সব থেকে ভালো আসবে বোঝার চেষ্টা করে। ঋজু হঠাৎই আবিষ্কার করল সুভদ্রা
একটা হলদে রঙা ইউস এন্ড থ্রো ক্যামেরা বের করল তার সুন্দর পোশাকের পকেট থেকে।
হ্যাঁ, শুনতে আজব হলেও একটা
মোটা কাগজের বাক্সে লেন্স লাগানো, একটা
রিল ভরা ইউস এন্ড থ্রো ক্যামেরাগুলি তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। একবার ব্যবহার করে রিল
খুলতে গেলেই ক্যামেরার জীবনাবসান। বহু সময়েই ক্যামেরা সহ ফটো ডেভেলপ করতে দেওয়া
হ'ত। দুটো নামকরা
ফিল্ম কোম্পানীর ক্যামেরা ছিল একটা হলুদ একটা সবুজ। হঠাৎ প্রয়োজনে খুব সুবিধেজনক
ছিল ক্যামেরাগুলো, যেকোনো
জায়গাতেই কিনতে পাওয়া যেত। জুম টুম করা না গেলেও ছবি যথেষ্ট ভালোই উঠত, বিশেষ করে দিনের আলোয়।
"ও বাবা, আপনি হঠাৎ ইউস এন্ড থ্রো ক্যামেরা কিনলেন
যে?" পিছে
লাগে সুভদ্রার
"কি করব, এক্ষুনি তো ক্যামেরা কেনা সম্ভব না, আর সব ছবি তো তোমার ক্যামেরায় তোমার
সাথে থাকবে। আমার কাছে কিছুই রাখব না?" শেষের
কথাটায় ঋজু দুর্বল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে
তাকিয়ে নিজেকে সামলায়।
"কেন তোমার ঠিকানা, ফোন নম্বর দেবে না? যোগাযোগ রাখবে না আমার সাথে?" একটু ভারী আওয়াজ
ঋজুর।ততক্ষণে সুভদ্রা একটা সুন্দর পজিশন পেয়ে ঋজুকে দাঁড় করিয়ে টপাটপ ছবি তোলে, উত্তরটা যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়েই গেল।
ওরা লক্ষ্য করল একাধিক বিয়ের বরকনে তাদের ট্র্যাডিশনাল বিয়ের পোশাকে ফটো সেশন
করছে এই দারুন ফুলের সাথে। কেমন গদগদ রোম্যান্টিক পোজে ছবি তুলছে। একটা জায়গায়
দু'ধারে গাছের সারি ঠিক
যেন পুজো মন্ডপের প্রবেশ পথের আলোকসজ্জার মতো, মাথার ওপর চাঁদোয়া করে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনি
সময়ে তেমন চোখে না পড়লেও ফুলন্ত অবস্থায় চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা। আর বৃষ্টির দৌলতে
কিছু সাদা গোলাপি পাঁপড়ি সবুজ ঘাসে বিছিয়ে রঙিন আলপনা করা গালিচা বানিয়েছে; সেখানেই এক বরকনেরা ছবি তুলছিল। এদেশে, অনেক সময়ই একই জায়গায় ছবি তুলতে চাইলে
লোকে অপেক্ষা করে। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে কমই। তাতে সুবিধা এই যে, সময় একটু বেশি লাগলেও অন্য কারোর ছবির
ব্যাকগ্রাউন্ডে আমার ছবি চলে গেল না বা আমার ছবিতেও অচেনা মুখ ঢুকে পড়ল না।
সেইমতো ঋজুরাও অপেক্ষা করছিল। ওদের দেখে বিয়ের বরকনে না মনে হলেও প্রেমিক
প্রেমিকা মনে হচ্ছিলই। একজন একজন করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে দেখে ওইখানে ছবি তুলতে
আসা অপরিচিত এক মানুষ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে ওদের একসঙ্গে ছবি তুলে দেবে কি না।
এটা খুবই প্রচলিত এদেশে; বহু
সময়েই অচেনা মানুষ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে এগিয়ে আসেন ছবি উঠিয়ে দেবার জন্য, তাতে পুরো পরিবারের ছবি তোলা হয়ে যায়।
ঋজু, সুভদ্রা দু'জনেই রাজি, ওদের দু'জনের
ক্যামেরাতেই আলাদা করে বেশ কটা যুগল ছবি তুলে দিল আর প্রশংসাও করে গেল যে দু'জনকে দারুন মানিয়েছে এইসব বলে। যথেষ্ট
ঘনিষ্ঠ হয়ে পরস্পরের হাত ধরে ঘুরছিল ওরা। একটু একটু সাহসী হয় ঋজু, মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে থাকা একথোকা ফুল
পেয়ে কুড়িয়ে তুলে আলতো হাতে গুঁজে দেয় সুভদ্রার চুলে, আবার ছবি তোলে। হঠাৎই ঋজু বলে "মে আই গিফ্ট ইউ
সামথিং?" ঋজুর
আওয়াজে যেন কি ছিল সুভদ্রা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলা ছাড়া আর কিছুই যেন করার বলার
খুঁজে পেল না। পকেট থেকে একটা ছোট্ট মতো সাধারণ চেহারার বাক্স বের করে সুভদ্রার
হাতে দিল ঋজু। বাক্স খুলে দেখে একটা এস লেখা পেন্ডান্ট সুভদ্রার পছন্দের জেমস্টোন
বসানো; লুরে কেভার্নস থেকে
কেনা, সুভদ্রা বুঝল সেদিন
তারমানে এটাই কিনে লুকিয়েছিল ঋজু। লুরে কেভার্নসে সেমি প্রেশাস জেমস্টোন
ক্রিস্টাল রূপে মানে আনপলিশড্ অবস্থায় কিনতে পারা যায়। আবার পলিশড্, সুন্দর শেপ করে কাটা তেমনটাও পাওয়া
যায়। সে পাথর হিসাবেই হোক কি গয়না বা অন্য জিনিষের রূপেই হোক। "আমাদের দু'জনের নামই তো এস দিয়ে তাই ভাবলাম, মানে লুরে কেভার্নসে দেখে মনেহল তোমার
কথা" একটু
লজ্জা লজ্জা স্বরে আমতা আমতা করে ঋজু। সুভদ্রার রিঅ্যাকশন বোঝার চেষ্টা করছিল।
"থ্যাঙ্কস, খুব সুন্দর। কিন্তু আমি তো তোমার জন্য
কোনো গিফ্ট নিলাম না।" ছলছলে
চোখে তাকায় সুভদ্রা।
"তোমার অ্যাড্রেস দাও, ইমেলআইডি দাও, ফোন নাম্বার এখনি না থাকলে পরে দিও
এগুলোই আমার গিফ্ট।"
(এরপর পরের পর্বে)
[© মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী]