ধলেশ্বরীর
বরদাভূষণ
চারাবাড়ির বিন্যাফৈর গ্রামে আমাদের দেশের বাড়ি। টাঙ্গাইল
শহর থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে, সে সময়ের ধলেশ্বরী নদীর তীরে। আমি গ্রামের
বাড়ির শেষ রমরমা দেখেছি ১৯৫২-৫৩ সালে। বাড়িতে ঠাকুমা ছিলেন, ছোটকাকা, কাকিমা। আমরা থাকতাম দিনাজপুরে, মা প্রতি বছর ঠাকুমার কাছে নিয়ে যেতেন, শীতে। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল মস্ত একটা পুকুর। সেখানেই
চলত বাড়ির কাপড় কাচা, বাসন ধোয়া, চান করা। আমাদের বাড়িতে টিনের চালার মন্দির ছিল। তাতে কষ্ঠিপাথরের কালী
মূর্তি ছিল। শুনেছি, আমার ঠাকুর্দা কোন এক বিধবার বাড়ি থেকে
মূর্তিটি কাঁধে নিয়ে ছুটে বাড়িতে এসে বেদী পেতে দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। থানা
পুলিশেও কিছু হয় নি। আমি ঠাকুর্দাকে দেখিনি। দাদুর কথায়, দেবী তাঁকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন। জাগ্রত এই কালীকে
গ্রামের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানতেন।
ঠাকুরদাকে সবাই ‘পাগলা ঠাকুর’ বলে ডাকতেন। বরদেশ্বরী চুরির কারণ ছিল। দাদুর কোন সন্তান বাঁচত না। কালি
প্রতিষ্ঠার পরে, আমার দুই পিসিমা, এবং পরে ঠাকুমার অষ্টম গর্ভে আমার বাবার জন্ম (১৯০১)। তাই নাম
বরদাভূষণ। ঠাকুমার কাছে শুনেছি, সেই সময় গ্রামে শেয়াল আর বুনো শূয়োরের খুব অত্যাচার ছিল (এটা আমিও দেখেছি)। আতুর ঘরের
পাটকাঠির বেড়া ভেঙে এই সব শয়তান জন্তুজানোয়াররা সদ্যজাতদের মুখে নিয়ে পালাত, খুবলে খুবলে খাওয়ার চেষ্টা করত। ঠাকুমার ভয় ছিল না।
বাবাকে বরদেশ্বরীর সামনে কলাপাতায় শুইয়ে পুকুরে ঘরের কাজ করতে চলে যেতেন। বলতেন, মা বরদেশ্বরী রক্ষা করবেন। বাবা ছোটবেলাতেই দিনাজপুরে চলে যান দাদুর সঙ্গে। সেই সময়ে
ঠাকুর্দা দিনাজপুর শহরের বালুবাড়িতে এক জমিদারের সেরেস্তায় নায়েব ছিলেন। বাবা
একাডেমী স্কুলে পড়তেন। স্কুলে থাকতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেটা সমাজের
ন্যায় অন্যায়ের এক্কাদোক্কায়। তার বেশী নয়। এখানেই পাবনার নদীপাড়ের এক
গ্রামের ব্রাক্ষ্মণ কন্যা, আশালতার সঙ্গে বাবার বিয়ে হয়। বাবা তখন
দিনাজপুর কোর্টে উকিল। ঘোর কালী তপস্বী।
আমাদের মা’র সমবয়সী ছিলেন আমাদের ছোটকাকা (কুলদা) এবং তার খুড়তুতো ভাই, সত্যপ্রিয়। মার এই দুই দেবর ছিলেন বিপ্লবী দল, অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য। মাকে তাঁরা সহজেই প্রভাবিত
করলেন,
এবং মা’ও বিপ্লবী দলে যোগ দিলেন। বাবা এসবের কিছুই জানতেন না। কালী প্রণাম করে
কোর্টে যান, বাড়ি ফিরে কালী প্রণাম করেন। বাবাকে দলে
টানার জন্য দুই ভাই আর বউ বাড়ির এখানে সেখানে নানা প্রচার পুস্তিকা ছড়িয়ে
ছিটিয়ে রাখতেন। বাবা পড়তেন, কিন্তু কিছু প্রকাশ করতেন না। মৌণং সম্মতি
মেনে দেবররা ও বৌদি তিনজন দলের অন্যন্যদের সঙ্গে দুঃসাহসিক কাজ করে বসলেন। বিখ্যাত
হিলি মেইল ডাকাতির ছক কষে ফেললেন। ডাকাতি হল, স্টেশনের এক চৌকিদার গুলিবিদ্ধ হল। কিন্ত
ডেরায় ফেরার পথে ধরা পড়লেন অনেকে। ছোটকাকা পালিয়ে গেলেন মুঙ্গেরে সাধুর
ছদ্মবেশে। বিচার হবার সময়ই মারা গেলেন চৌকিদার। ফাঁসির আদেশ হল সত্যব্রত কাকার
এবং আরো কয়েকজনের। মা’র হল জেল। এই সময় বাবাকেও গ্রেফতার করা হল।
ডাকাতির ষড়যন্ত্র করার অপরাধে। আপীলে ফাঁসির হুকুম মকুব হলেও, আন্দামানে নির্বাসন দেয়া হল ফাঁসির আসামীদের। বাবার হল সাত বছরের জেল। মেধাবী বরদাভূষণ জেলে বসেই সংস্কৃত
সাহিত্যে দু দুটি উপাধী অর্জন করলেন—রাষ্ট্রভাষাবিশারদ এবং কাব্যতীর্থ—খ্যাত হলেন ‘পন্ডিত হিসেবে। তবে এর ফলে তিনি ত্যাগ করলেন
তাঁর ধর্মাচার। বললেন, ধর্ম ইতিহাস বই কিছু নয়। হয়ে উঠলেন কট্টর
কম্যুনিস্ট। নেতৃত্ব দিলেন তেভাগা আন্দোলনে। সঙ্গে মা।
এরপর দেশভাগ। বাবা দেশত্যাগ করলেন না। টাঙ্গাইলে ছোটভাই
কুলদা তখন মোক্তার। আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব প্রায় সবাই পাড়ি দিলেন সীমান্তের
ওপারে। এই দুই ভাই যাবেন না। ছোট দিদি (আমাদের ছোট পিসিমা) বললেন, থাক, ওদের যা মন চায় তাই করতে দে। অনেক সয়েছে।
থাকুক। বাবা কলকাতায় পড়তে থাকা আমাদের বড়দাকে (সমর)
ডাকিয়ে এনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে
দিলেন। কিন্তু এতেও নতুন পাকিস্তানী সরকার, সোহরাবর্দীর হোক বা নাজিমুদ্দিনের কিংবা
আইয়ূব বা ইস্কান্দার বা ভুট্টো, কারো চোখেই বাবা দেশভক্ত তা প্রমাণিত হয় না।
প্রমাণের অভাবে দন্ডিত হতে থাকেন। তাঁকে বারাবার জেলে পাঠিয়েছে সবাই। তবে নতজানু
করতে পারে নি কেউ। বাবা রাজনীতিও ছাড়েন নি। কৃষক সমাজের জম্য কাজ করতে থাকেন। এই
সময়েই মৌলানা ভাসানীর সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা, ন্যাপ ভাসানীর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩ দিন দিনাজপুর শহরকে পাক সেনামুক্ত
রাখতে কম্যান্ড সামলেছেন। ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে। স্বাধীন
হতেই আবার ফিরে গেছেন দিনজপুরের বাড়িতে। সেখানে একটি টেবিল আর একটি ইজি চেয়ার
ছাড়া লুঠেরারা অবশিষ্ট রাখে নি আর কিছুই। এই সময়, ৭৪ বছর বয়স তাঁর। আক্রান্ত হলেন ক্যান্সারে। মুজিবর রহমান তখন স্বাধীন
বাংলাদেশের ক্ষমতায়। বাবার চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করলেন মুজিব।
সিদ্ধান্ত-- অপারেশন একমাত্র চিকিৎসা। সুপারিশ-- ভারতে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হোক। বাবা রাজি নন। ভারতে যাবেন
না। তাঁর তিন চিকিৎসক সন্তান তাঁদের বন্ধু বান্ধবদের নিয়েও বাবাকে রাজি করাতে
পারলেন না। শেষটায় চিকিৎসক সন্তানেরা মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত
বিধস্ত প্রায় বিকল মনা পিতাকে বলা হল--’তোমাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে’। বাবা রাজি। সকালের ফ্লাইটে বাবা এলেন কলকাতা বিমান বন্দরে। কলকাতার
এয়ারপোর্টে আমাকে দেখে তাঁর মৃতপ্রায় শরীরটা যেন বিদ্যুৎপৃষ্ঠে কঁকিয়ে ওঠে।
তিনি হতবাক। অপমানিত। সেই যাত্রাতেই মারা গেলেন (১৯৭৪)। কিন্তু নিজভূমে
নয়।
যেটা আমার মত নাস্তিককে বিমূঢ় করে রেখেছে আজও, তা মা বরদেশ্বরীর অন্তর্ধান। বাবা যেদিন কলকাতায় নামলেন, সেই রাত থেকেই বরদেশ্বরী তাঁর প্রায় দেড়শ বছরের আসন ত্যাগ
করে উধাও হয়ে গেছেন। আমি বলি, বরদেশ্বরী চুরি হয়ে গেছেন। ছোট কাকা মানেন
না,
বলেন, 'মন্দিরে না ছিল তালা, না শক্তপোক্ত দরজা। বহু বছর ধরেই। বরদেশ্বরী আমাদের
পরিবারকে ত্যাগ করেছেন।' বরদেশ্বরীকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আজো
না। আমি বাবার চিতা থেকে তার অদাহ্য নাভিমূল চুরি
করে,
রেকটিফায়েড স্পিরিটে তা চুবিয়ে কাঁচের পাত্রে
বন্দী করে বরদেশ্বরীর শুন্য বেদীর পাশে প্রোথিত করে রেখেছি। আজো তা বিন্যাফৈর
গ্রামে শূণ্য বেদীর মন্দিরে বর্তমান।
বাবার বাতিক
আমাদের বাবার কতগুলো মজার ব্যাপার ছিল। মা বলতেন, বাতিক। এসব ঘটত, দেশে এক একটা রাজনৈতিক ঘটনায় বন্দী হয়ে কয়েক
মাস বা বছর পরে বাড়ি ফেরার পর। মামা বলতেন, জেলে বসে যা যা করে সময় কাটাতেন, বাড়ি ফিরে কিছুদিন সেইটা না চালু রাখলে, জামাইবাবুর ওকালতির পসার ফিরে জমাতে মন বসত না। মানে, যে যেমন নিজের অ্যাঙ্গল থেকে ব্যাখ্যা করতেন। আমার জীবনের
প্রথম সতেরো বছর বয়স কালে (এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি) বাবা বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন, তাই আমিও তার কয়েকটি বাতিকের সাক্ষী। একবার বাবা খৈনী খেতে শুরু করলেন নিয়মিত।
একবার শুরু করলেন হোমিওপ্যাথির পড়াশুনা আর চিকিৎসা। একবার প্রতি ছুটির দিনে সিনেমা
হলে গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখা শুরু করলেন। মা কিছুতেই এই সবে সঙ্গ দিতেন না তাঁকে।
একবার সকাল সকাল কোলে হার্মোনিয়াম টেনে তারস্বরে ধ্রুপদী গান। আর একবার লম্বা
ডাইনিং টেবিল বানিয়ে তাতে আট ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে খাওয়া দাওয়া করবেন, রাজনীতি, জেল আর ওকালতির ব্যাস্ততার ফাঁকে পারিবারিক
পরিমন্ডলে খানিক সময় কাটাবার বাসনা।
যেবার, খৈনী খেতে লাগলেন। একবার স্নান করতে করতে
হুড়মুড়িয়ে বালতির ওপর পড়ে গেলেন। খৈনী বাদ হয়ে গেলো। যেবার হোমিও শুরু করলেন, বাড়িতে মেথর জমাদার, নানা বাড়ির কাজের লোক, নিজের মক্কেল থেকে শুরু করে সকাল-বিকাল এত লোকের ভীড় শুরু হয়ে গেলো, ওকালতি মাথায়, রাজনীতিও প্রায় ঘর ছাড়া। বন্ধ হয়ে গেলো হোমিও-দান। মাস দুই তিনেক হিন্দি সিনেমা দেখার পর, নিজেই নিজেকে ফতোয়া দিলেন, শুধু প্রেম করে এই সমাজের কিছু হবে না। সমাজ না-গড়ার কাজে ঐ সব গাল-গল্প, গান বিষ মাত্র।
যেবার গান শুরু করলেন, আমরা ভাই বোনেরাই বলাবলি শুরু করলাম, বাবা কী করছেন বলত? গলায় সুর নেই এক ফোঁটা, আকাশ পাতাল চিৎকার করলেই কি ক্লাসিক্যাল গান হয়? আমরা বলাবলি করি, কিন্তু বাবার গান-সাধা চলতেই থাকে। একদিন বোনের তবলা টিচার বাবার গানের সঙ্গে
মাথা হেলিয়ে তবলায় কয়েকটা চাটি মেরে বাবাকে দ্বিগুণ উৎসাহিত করে তুললেন। মেজদা বলল, কী করা যায় বলত? বুদ্ধি আসে না। একদিন দেখি, মেজদা বাবাকে খুব বকছে, এই সব ভাল্লাগে? আমার বন্ধুর দাদা, আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'আচ্ছা বলত পিন্টু, তোদের বাড়ির ওদিকে কোন শালা সকাল বেলা ফাটা গলায় চিৎকার করে
গান গায় রে? সকাল বেলায় দূরে বসে শুনলেও বিরক্ত লাগে.. তুই চিনিস? আমি কী করব, বলতেই হল, আমি তো কানে কম শুনি, শুনতে পাই নি তো! বাবা গান গাওয়া ছেড়ে দিলেন।
বাড়ির একটা লম্বাটে ঘর খালি করা হল। কয়েকদিন
ধরে খসড় খসড় করে একটা লম্বা ডাইনিং টেবিল তৈরি করা হল। অত বড় টেবিল দরজা দিয়ে
ঢুকবে না, তাই ঘরের ভেতর বানানো হল। দুপাশে ছাড়া ছাড়া
ভাবে দশটা চেয়ার। আমরা আট ভাই-বোন আর বাবা-মা। টেবিলের ওপরে লম্বা রবার ক্লথ। নীল রঙের। ঝকঝকে কাপডিস, ডাইনিং প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট, গ্লাস.. কাঁচের আর চীনামাটির। দেয়ালে একটা ঘন্টাও
লাগানো হল। তার দড়িটা ঝুলছে। ঘড়ি ধরে মা সবাইকে খেতে আসতে ডাকবেন, দেরি করা চলবে না। আমাদের জন্য যে নিয়ম, বাবার জন্যও তা। ছুটির দিনের লাঞ্চ দিয়ে শুরু হল। দারুণ
অভিজ্ঞতা! সিনেমায় দেখেছি, রাজার বাড়িতে দেখেছি। টেবিলে বসে খাওয়া সেই প্রথম। ডিনারেও
সমান উত্তেজনা। পরদিন সকাল থেকেই আমি জেগে। মা কখন ঘন্টা বাজাবেন। একসময় বাজল।
সেদিন লুচি আর আলুর দম, মনে আছে। মেজদা রোগা পটকা, তাই তার প্লেটে একটা বাড়তি ধবধবে ফর্সা ডিম। ব্রেকফাস্ট
শেষ। সবাইকে অবাক করে মা একটা বড় নতুন চায়ের কেটলি আনলেন এবার। কেটলির গলা দিয়ে
ধোঁয়া বের হচ্ছে। মা কেটলিটা টেবিলে রাখলেন। বাবার নির্দেশে আমরা যে যার কাপ উল্টে
দিলাম। বাবা মাকে এবার চা দিতে বললেন। কিন্তু মা টেবিল থেকে কেটলি তুলতেই রবারের
গোটা টেবিল ক্লথটাই কেটলির সঙ্গে উড়ান দিলো! কাপ ডিস প্লেট সব চারপাশে ছত্রাখান। বাবা উঠে
চলে গেলেন তার কাছারি ঘরে। সেই ডাইনিং টেবিল এবার কেটে কেটে আমাদের পড়ার টেবিল
তৈরি হল। আমরা ফিরে গেলাম আসন পেতে খাওয়া দাওয়ায়।
এরপর পরবর্তী সংখ্যায়……………
[অরুণ চক্রবর্তী]