>

সুশান্ত কুমার মুখোপাধ্যায়

SongSoptok | 3/15/2016 |




শিবকন্যা  নর্মদা

ঋষি সেবিত দেশ আমাদের এই ভারতবর্ষ এখানকার ব্রহ্মর্ষি, মহর্ষিদের ধ্যান দৃষ্টিতেই পৃথিবীতে ঘোষিত হয়েছিল, "যে যে বস্তু চোখে পরে সেই সব-ই ব্রহ্মের প্রকাশ বিশেষ হিন্দু প্রধান ভারতবর্ষে যারা আজও পূজার্চনা, তর্পণ ও হরণাদি  করে থাকেন  তারা জানেন এই মন্ত্র -
                                    "গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী
                                     নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু "
এই মন্ত্র জল-শুদ্ধি মন্ত্র পূজার্চনার সময় আচমন ও আসন শুদ্ধির পর এই মন্ত্রে জলশুদ্ধি করা নিয়ম গঙ্গা, যমুনা, কাবেরী, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা ও সিন্ধু এই সাতটি নদীকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে পবিত্রতম নদী বলে মনে করা হয় এবং আমাদের সংস্কার ও বিশ্বাস যে এই নদীগুলিকে স্মরণ করলেই এই সব নদীর আবির্ভাব ঘটে  

সরস্বতী নদী বর্তমানে অবলুপ্ত গঙ্গার দিব্যসত্বা আছে, নর্মদারও দিব্যসত্বা আছে গঙ্গাস্নানে পরম পুণ্য লাভ হয় গঙ্গা জল পবিত্র জল এবং প্রকৃতির আপন কৃপায় পরিশ্রুততম জল যাতে পোকা হয় না হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসে ত্রিকুটী কুম্ভক বলে একটি কুম্ভকে গঙ্গার নিম্নে মহাযোগী যোগেশ্বররা বাস করেন উচ্চতম কোটির যোগপ্রণালী এই মহাযোগেশ্বররা ছাড়া কেউ জানেন না তাঁদের সেই পবিত্রতম ও মহাচৈতন্যময় দেহের উপর দিয়ে গঙ্গার জলপ্রবাহ বয়ে চলেছে তাই এই জলও শুদ্ধ্ব এবং তাই গঙ্গাজলে কোনো ক্ষতিকারক জীবাণু হয় না বহু বৈজ্ঞানিক এবং পরিবেশবিদরা এই নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং করে চলেছেন; তাদের মতে গঙ্গার ভিতরে অনেক স্ফটিক-শিলা, রত্ন-শিলা, ভেষজগুণসম্পন্ন ও রোগঘ্ন অনেক লতা-পাতা-শিকড় গঙ্গার মাটিতে জন্মায় যা গঙ্গার জলকে পরিষ্কার ও রোগমুক্ত রাখে ভারতবর্ষের হিন্দু মানুষের মৃত্যুক্ষণে গঙ্গাজল দেওয়া হয় । গঙ্গা-গোবিন্দ-গায়ত্রী-গীতাএরাই হলো মনুষ্যদেহের শেষ সম্বল, আবার পারের কড়ি । নর্মদা সম্বন্ধেও একই কথা, একই বিশ্বাস।  নদীর দুটি রূপ: একটি "তোয়" যা জলরূপে প্রবাহমান, যে রূপ স্থূলরূপ, যে রূপ আমরা চোখে দেখি । এই প্রবাহমান জল-রূপ সারা জীবকূলকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বিশাল ভূখন্ডকে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা করে অন্ন তুলে দিয়েছে অন্নদারূপে; এই রূপে তার পরিচয় মৃত সঞ্জীবনীধারা রূপে । নদীর অন্যরূপটি দিব্যরূপ, যার দর্শন পাওয়া যায় ধ্যানে। গঙ্গার সিদ্ধ বীজমন্ত্র, ধ্যানমন্ত্র ও স্তোত্র আছে । নর্মদারও একইরকম সিদ্ধ বীজমন্ত্র, ধ্যানমন্ত্র ও স্তোত্রাদী আছে । জল-রূপে গঙ্গা ও নর্মদার একটি শরীর-সত্বা, অন্য রূপটি পরমশক্তি-প্রদায়িনী দিব্যসত্বা।

ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশে শাডোল জেলার অন্তর্গত অমরকন্টক নর্মদার উৎসস্থল । আটশ পনের মাইল দীর্ঘ নর্মদার তিনচতুর্থাংশ মধ্যপ্রদেশে; সেইকারণে নর্মদাকে মধ্যপ্রদেশের "জীবন-রেখা" বলা হয় । কোনো কোনো জায়গায় এই নদীকে রেবা বা রেয়া নামেও উল্লেখ করা  হয় । উত্তরে বিন্ধ্য ও দক্ষিণে সাতপুরা, মাঝে বহমান নর্মদা প্রকৃতি সৃষ্ট উত্তর-দক্ষিণের বিভাজন রেখা ।  কেবলি ভারতবর্ষের মাঝে বহমান নদীগুলির মধ্যে দৈর্ঘ্যে তৃতীয় আর সমস্ত নদীগুলির মধ্যে দৈর্ঘ্যে পঞ্চম নর্মদা । পবিত্র নর্মদার উৎস অমরকন্টক তীর্থস্থান এবং হিন্দু বিশ্বাসে অমরকন্টক দর্শনে ও নর্মদা জল মাথায় ছোঁয়ালে মনুষ্যজন্মে পরমপুণ্য ও মুক্তি।অমরকন্টকের চারিদিকে পাহাড় ও ঘনঘোর অরণ্য। পাকদন্ডী বেয়ে, ঘন কন্টকাকীর্ণ, দুরাগম্য জঙ্গল ভেদ করে এই মহাতীর্থে যেতে হত তীর্থযাত্রীদের । এতসব প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্বেও নর্মদা তীর্থদর্শনে যাত্রীর অভাব ঘটে নি। মহর্ষি ভৃগু, দুর্বাসা, মার্কন্ডেয় থেকে আরম্ভ করে  বহু মহাসাধক ও সাধারণ পুন্যার্থী বারবার ছুটে গেছেন অমরকন্টকে; নর্মদার তটে-তটে তপস্যা করে হয়েছেন সিদ্ধ্ব । আবার বহু পুণ্যার্থী আরও কৃচ্ছসাধন করে করেন পুরো নর্মদা পরিক্রমা, উৎস অমরকন্টক থেকে শুরু করে  সাগর ঘুরে ফিরে আসেন। এই পরিক্রমার পথে তারা বিশ্রাম নেন এক মন্দির থেকে আর এক মন্দিরে বা পূণ্য স্থানে এবং সম্পূর্ণ করতে লাগে প্রায় তিন বছর। বিলাসপুর-কাটনি রেলপথের দুটি কাছাকাছি ষ্টেশন অনুপপুর ও পেনড্রা রোড, অধিকাংশ যাত্রী রওনা হন পেনড্রা থেকে। নর্মদার উভয়তটে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের কোলে কোলে শিবতীর্থ ছড়ানো রয়েছে। যদিও সারা ভারত জুড়েই শিব মন্দির, তা সত্বেও নর্মদার স্বাতন্ত্র জীবন্ত শিবভাষ্যের কারণে। এই ভাষ্যের প্রথম অধ্যায় অমরকন্টকে সুরু হয়ে শেষ হয়েছে বিমলেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গে।

পেনড্রা রোড থেকে ১৪ মাইল গেলে দেখা যাবে বিশাল তোরণ ঘেরা অমরকন্টকের মন্দির। তোরণ পেরিয়ে বিশাল চত্বর, চত্বরের মাঝখানে একাদশ কোণ বিশিষ্ট এক কুন্ড যার পরিধি ২৬০ হাত এবং দশ হাত গভীর কুন্ড পূর্ণ কাকচক্ষু জলে। এই সেই নর্মদা কুন্ড যেখানে উদ্ভূত হয়েছেন শঙ্করের তেজসম্ভুতা নর্মদা, যার বাহ্যরূপ এই জল যা কুন্ডের মধ্য থেকে বেরিয়ে নর্মদা নদী নামে বয়ে চলেছে। নর্মদার উৎপত্তি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত; কারো মতে মহাদেব ধ্যান করতে করতে যখন ঘেমে উঠেছিলেন সেই জল নর্মদা সৃষ্টি করে। কারো মতে ব্রহ্মার দুই চোখের ধারা থেকে অমরকন্টকে উৎপত্তি দুই নদীর - নর্মদা ও শোন । নর্মদার উল্লেখ রামায়ণ, মহাভারত, মৎস্য, অগ্নি, শিব, স্কন্দ ও আরো অন্যান্য পুরাণ-এ রয়েছে; এমনকি গ্রীক গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে। কুন্ডের যেখান থেকে বেরিয়ে নর্মদা নদী হয়েছেন সেই জায়গাটাকে বলা হয় গোমুখ (গঙ্গার উৎস-ও এক গোমুখ থেকে, তবে এ নর্মদার গোমুখ)| পুরাণকথায় বলে শিবের যজ্ঞভাঙ্গার অপরাধে শিব এক অসুরকে তার ত্রিশূল ছুঁড়ে বধ করেন। ধোয়ার জন্য ত্রিশূলটি ছুঁড়তে গিয়ে  পরে গেঁথে যায় এবং সেই পথে নর্মদা বেরিয়ে আসেন কুন্ড হতে এবং তার পরে আবার একটি কুন্ডে ঝরে পড়েন যার নাম কোচীতীর্থ । এর পাশেই আরো দুটি কুন্ড - গায়ত্রী ও সাবিত্রী এবং একটি ছোট নদী যারও নাম সাবিত্রী । সাবিত্রী নদী অমরকন্টক মন্দিরের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বয়ে এসে নর্মদার সাথে মিশে গেছে। অমরকন্টকের চূড়ায় নর্মদা মন্দিরটিকে একটি দুর্গের মত দেখায়। নর্মদা কুন্ডের চত্বর ঘিরে রয়েছে শ্বেত পাথরের ১৬-টি মন্দির; বিষ্ণু, নারায়ণ সহ  ভিন্ন-ভিন্ন দেব-দেবীর। এ ছাড়াও রয়েছে ছাড়ানো আরও ছোট ছোট দেব-দেবীর মূর্তি। নর্মদা কুন্ডের মধ্যে জলের নীচে বিরাজ করছেন নর্মদেশ্বর মহাদেব,তাঁর ডান পায়ের উপর কৃতাঞ্জলিপুটে দন্ডায়মানা কন্যা নর্মদা। শঙ্করের কন্যা বলে নর্মদার আর এক নাম শঙ্করী। মহর্ষি ভৃগু মার্কন্ডেয় থেকে আরম্ভ করে মহর্ষি পতঞ্জলি, গুরু গোবিন্দপাদ, শঙ্করাচার্য, প্রমুখ ছুটে গিয়েছিলেন নর্মদায় তপস্যা করতে। ইন্দোরের হোলকর, নাগপুরের ভোঁসলা, বরোদার গাইকোয়াড়, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া প্রভৃতি মারাঠা রাজবংশের প্রায় সকলেই নর্মদা ও নর্মদাশঙ্করের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন । ইন্দোরের মহারাজা নর্মদেশ্বর-মন্দির সংস্কার করিয়েছিলেন ১৯২৯ সালে।

মধ্যপ্রদেশের থেকে মহারাষ্ট্র হয়ে গুজরাট পেরিয়ে আরব সাগরে যাত্রা শেষ করেছে নর্মদাধোঁয়াধার প্রস্রবণ, মার্বেল পাহাড় বেষ্টিত বেধঘাট, ওমকারেশ্বর মন্দির (শিব মন্দির) ও আরো অনেক দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে নর্মদা ঘিরে । এই অঞ্চলে বেশির ভাগ স্থানেই কালোমাটি এবং প্রকৃতি সৃষ্ট খাদ ও প্রপাত । নর্মদার জলে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য সর্দার সরোবর প্রকল্প পরবর্তী কালে অনেক বিতর্কিত হয়ে দাঁড়ালেও ধর্মের দিক দিয়ে নর্মদার মাহাত্ম্য কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় নি ।


[সুশান্ত কুমার মুখোপাধ্যায় (কলকাতা)]

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.