কাঁটাপাহাড়ী গ্রামের সোনাঝুরি জঙ্গলের প্রান্তে
পশ্চিমবঙ্গ বনবিভাগের একটি পুরোনো ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে
নিজের বন্দুকটা পরিষ্কার করছিল লখা। নামেই ডাকবাংলো। এক আধটি
আস্ত ঘর আর বারান্দা টুকু সার। আর সব মেরামতের অভাবে ধসে পড়েছে কবেই। খবরটা
এসেছে আজ সন্ধ্যার মুখে। পাপুড়িয়া গ্রামের লবা মাহাতোর আখের খেত,
সংলগ্ন কুঁড়ে ঘর সম্পূর্ণ নষ্ট করেছে হাতির
পাল। বনবিভাগের এই চাকরি মাত্র এক বছর হলো পাকা হয়েছে। পানিসোলা থেকেও
একই খবর। এখনো কারো প্রাণহানি হয় নি এই রক্ষে। কংসাবতী নদী পেরিয়ে
বিনপুর, বেলপাহাড়ি
হয়ে দলমা জঙ্গলের দিকেই হস্তিযুথের গন্তব্য
স্থল। নয়াগ্রামে ঢোকার আগেই ওদের যাত্রা পথ পরিবর্তন করতে হবে।
দলে অন্তত আটটা দাঁতাল হস্তী রয়েছে,
বাকিগুলো শিশুশাবক সহ মাদী হস্তী।
বনবিভাগ দপ্তর থেকে একটিও হাতী মারা বা জখম করার
হুকুম নেই। স্থানীয় যুবকদের একটি প্রতিরোধ বাহিনী
তৈরী করার দায়িত্ব বনবিভাগের কর্মীদের। উপদ্রুত অঞ্চলের
মানুষ এসব শুনতে প্রস্তুত নয়। কাজেই সরকারী হাতি “খেদা”
লখার মাথায়
দুশ্চিন্তার পাহাড়। মাথা ঠাণ্ডা রেখে একটা উপায় বার করা চাই।
একটু আগেই দুগী সামান্য তেল দিয়ে গেছে মাটির সরায়। গজ
কাপড় ও তেল দিয়ে বন্দুকের কলকবজা সাফ করা জরুরী। লখার হাত চলতে
থাকে , মনটা পিছিয়ে যায় ফেলে
আসা গাঁ ঘরের পানে। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। অসংখ্য জোনাকী জ্বলছে,
নিভছে উঠোনের ওধারে দোপাটি
, গাঁদা ও আগাছার
মত বেড়ে ওঠা ভূতভৈরব ঝোপে।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা . মা তখন বেঁচে। দিনরাত পেছনে টিকটিক করে, গালিগালাজ করতো। সদ্য কিশোর লখা রোজগার করতে শেখে নি তখনও। প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত গিয়ে ইস্কুল পর্বে ইতি টেনেছিল লখা. মা বলেছিল, যার বাপ নাই তার এত বাবুগিরি সাজে না। তাদের ঘরে লেখাপড়ার চাল নেই । তাছাড়া ইস্কুল লখার ভালো লাগত না। মা দিনভোর জঙ্গলে শাল পাতা কুড়িয়ে সন্ধ্যেবেলা হারিকেন জ্বেলে পাতার থালা , দোনা বানাত, একটির সঙ্গে আরেকটি পাতা টিপে। সকালে লখা বাড়ি বাড়ি সেইগুলি যোগান দিতো। প্রতি সন্ধ্যায় মশার মত গুনগুন করে সুর করে বিলাপ করতো মা, “ এ লখা ধন আমার , যা না ক্যানে পবন মিস্ত্রী কত্য ডাক্যে। উর সনে কাজ কর, দু পয়সা আসবেক ঘরকে।” মায়ের গঞ্জনায় বাধ্য হয়ে লখা গিয়েছিল মিস্ত্রীদের সঙ্গে ছাদ পিটতে। এ কাজে তার মন লাগত না। পদে পদে ভুল হত. বড় মিস্ত্রী চড় চাপড়, কানমলা লাগাত হরদম। মনে পড়ে ছোটো মিস্ত্রী কিষ্ট গোপালের মিঠে গলায় গান, “মকর পরবে , চালের পিঠে খাঁইয়ে টুসু লাচবে কেমন গরবে।" মেয়ে যোগান্দাররা পাল্টা জবাব দিত গানে গানে। লখার মনটা হু হু করত। এক ছুটে পালাত শালবনির জঙ্গলের দিকে। কি চাই তা ঠাহর হত না সেই বয়সে।
জঙ্গল ছাড়া আরেকটি নেশা
ছিল লখার। গ্রীষ্মবন্ধে শহরের হোস্টেল থেকে বাড়ি আসতো বাবুদের কনিষ্ঠা কন্যা
রেণুকা। । সেইসময়, বাবুর মেজাজ ভালো থাকত। একটু তামাক চেয়ে নিয়ে পেপে গাছটার তলায়
বসে লখা দেখত রেণুকার কেশ চর্চা চলছে , কখনো বা সর হলুদ বাটা দিয়ে রূপটান তৈরী করে
স্বাভাবিক গৌর বর্ণকে আরও উজ্জল করে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। লখা ভুলেও
সামনে আসতো না. ওকে
দেখলেই রেণুকার সুন্দর ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠত। বাবুদের বাড়িতে একটি
কোণার ঘরে গানের যাবতীয় সরঞ্জাম ছিল। লখার প্রায়ই ইচ্ছে হত ডুগি
তবলাটা বাজিয়ে দেখে। কিন্ত ছোটো বাবুর শখের জিনিষের দিকে নজর
দেওয়া চলে না তার মত ছেলের। ঘরের উল্টো দিকে ঝাঁকড়া জাম গাছটার ডালে
চড়ে সে দেখতে পেত রেণুকা আরও কয়েকটি সঙ্গিনী জুটিয়ে নাচ করছে।
গানটা আজ আর মনে নেই,
তবে নাচের ধরন গাঁয়ের মেয়ে মরদের পরব দিনে
নাচের মত নয়। জামের সময় জাম এনে কতবার দিয়েছে তার হিসেব নেই।
রেণুকা অন্যমনস্ক ভাবে জাম খেয়ে উপরের টানা বারান্দা থেকে নিচে বিচি
ফেলেছে। যোগনদারকে লক্ষ্য করে নি। আবার স্নানের সময়,কোনো কোনো দিন তাল সায়রে স্নান করতে
যেতেন বাবুদের বাড়ির সব মেয়ে বউরা , সঙ্গে নাপিত বউ , ওদের স্নানের তেল, হলুদ গামছা নিয়ে। সেই দলে রেণুকাও থাকত। মেয়েদের ঘাটে
লখার যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সে বড় বাঁধের পাড়ে খেজুর গাছের তলে বসে থাকতো ,
প্রায়দিন অতবড় পুকুরটি অনায়াসে এপার ও পার
করতো চিত সাঁতার দিয়ে।
ছোটো বাবুর বন্দুকটির তুলনায় উপরুক্ত সব আকর্ষণ
ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। ছোটবাবু বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঝে মাঝে
শখের পাখি শিকারে যেতেন। লখার হাতের নিশানা ছিল নির্ভুল। শিশু বয়স থেকেই সে খরগোশ,
পাখি, কাঠ বেড়ালী মেরে হাত পাকিয়েছে। নাছোড়বান্দা
হয়ে লেগে থাকতো
শিকার দলের সঙ্গে। বাবুরা রোদে ঘুরে ক্লান্ত হলেই
বন্দুকটা বইতে তার ডাক পড়বে। গুলি খরচ করার অধিকার পায় নি সে. শুধু বুক ভরে বারুদের গন্ধ নিতো। মরা পাখি গুলো কুড়িয়ে ঝুড়িতে
তুলে ঘরে আনত ওরা. গিন্নীমা বার বাড়ি থেকেই ছিল আপত্তি শুরু করতেন। “ শিগগির ফেল ওসব,
মা গো কি ঘেন্না!” বাবুদের বাড়ির রান্নাঘরে যে সে বস্তু ঢোকার
উপায় ছিল না. অতএব পাখিগুলি ঘরে নিয়ে আসতো লখা। মা গালিগালাজ করতে করতে পাখির পালক ছাড়াতে বসতো।
বেশি রাত করে সেদিন খাওয়া হত
মোটা
চালের ভাতের সঙ্গে লাল গরগরে লঙ্কা
দেওয়া মাংসের ঝোল ।
লখার সাপটে ভাত খাওয়া দেখে মার
চোখে জল আসতো। আজও
অবচেতনে সেই রান্নার সুবাস আসে। মা
খেটে খেটে,
অপুষ্টিতে ও রোগে ভুগে একরকম বিনা চিকিৎসায়
মারা গিয়েছিল। প্রথমে ঝাড়ফুক হয়েছিল। বোঙা অসন্তুষ্ট হয়েছেন
এরকম কথা ওঠায়
একটি মুরগি বলি
দেওয়া হলো, হাঁড়িয়া চড়ানো হলো মারাংবুরুর থানে। শেষমেষ মরিয়া হয়ে বড়বাবুর জীপে বাঁকুড়া
হাসপাতাল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েও শেষ রক্ষা হলো না. মা সেই সকালেই চলে গেলেন সবার
নাগালের বাইরে।
তার পর কয়েকটা মাস ওর কেটেছে ভূতগ্রস্তর মতো , আজ এখানে কাল সেখানে। বেশিরভাগ সময় লখাকে পাওয়া যেত বাবুদের বড় থাম ওয়ালা বার বার বাড়ির বারান্দায়। সেবার অগ্রহায়ণ মাসে গিন্নীমা ও রেণুকা যাবে কুটুম্ব বাড়ি। আগের দিন রাত থেকেই ছোটোবাবুর ধুম জ্বর। শেষ মুহুর্তে বড়বাবু বললেন “ দিনকাল ভালো নয় , না হয় লখাটা সঙ্গে যাক, ড্রাইভার এর পাশে বসে থাকুক বন্দুকটা ধরে। লখা বিনা বাক্য ব্যয়ে জীপে উঠে বসেছিল, ছোটোবাবু বিছানা থেকে ক্ষীণ আপত্তি জানালেও তা ধোপে টেকে নি । লখা নিজের একমাত্র সম্পত্তি গামছাটি মাথায় বেঁধে বন্দুক ধরে বসে ছিল দুরু দুরু বুকে। গাড়ি চলেছে তাদের খয়রাডোবা গাঁ ছাড়িয়ে, বড়বাঁধের পাশ দিয়ে, আমবাগানের দিকে। রেনুকা কলকল করে কথা বলছে, গিন্নী মা মহানন্দে নানান আত্মীয়পরিজনের কেচ্ছাকাহিনী বর্ণনা করে চলেছেন। গাড়ি আরও খানিক এগিয়েছে, আরেকটু এগুলেই ঝিলিমিলির জঙ্গল। এমন সময় লখার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো, মুখের তামাক একপাশে ঠেলে বিপিন ড্রাইভার এর দিকে তাকাতেই সে গাড়ির গতি কমিয়ে আনলো। বিপিন স্থানীয় লোক, বিপদের ইঙ্গিত সহজেই ধরে ফেললো। বেশ কিছুটা দূরে ধান খেতে ধান পেকেছে। আবছা, ধুসর, বিশালকায় কয়েকটি অবয়ব নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে, আওয়াজ উঠছে মসমস। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে একপাশে চুপচাপ বসে রইলো চারজনেই। লখার হাতের আঙ্গুল বন্দুকের ঘোড়ায় , যদিও সে বিলক্ষণ জানে এই বন্দুকে প্রাপ্তবয়স্ক হস্তী ঘায়েল হবে না। রেণুকা ভয়ে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে অস্ফুটে গোঙাতে লাগলো। গিন্নীমা ক্রমাগত রাধামাধব জপতে লাগলেন। ঘন্টা দেড়েক ধানক্ষেতে তান্ডব চলল। স্থানীয় মানুষ মশাল নিয়ে রে রে করে তেড়ে আসতে হাতির পাল ধীরে সুস্থে জঙ্গলের পানে এগুলো। সেযাত্রা কুটুম বাড়ির নেমন্তন্ন নমঃ নমঃ করে সেরে ফেরা হলো। বড়কর্তা লখার উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করেই ক্ষান্ত হন নি. সরকারী মহলে তদ্বির করে বনবিভাগের একটি কাজ জুটিয়ে দিলেন। বছর খানেকের মধ্যে বনবিভাগের কাজটা পাকা হয়েছে, পরনে সরকারী উর্দি , হাতে সরকারী বন্দুক। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে লখার চোখ বুজে এসেছিল, কখন যে রাত কেটে গেছে টের পায় নি। ভাতের গন্ধ আসছিল। বেলা প্রায় নটা। চোখ খুলে দেখে বাংলোর উঠোনের এক কোণে রোজকার মত তোলা উনানে রান্না বসেছে। বাংলোর কাজের মেয়ে দুগী আঁচল বেশ করে জড়িয়ে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। বন বিভাগের অন্যান্য কর্মচারীরা ভিন্ন প্রদেশের লোক. তারা দুগীকে নিয়ে অশ্লীল রসিকতা করে আসছিল কদিন ধরেই। লখা রুখে উঠতেই, সে একঘরে হয়েছে। কেউ তাকে চা, তামাক খেতে ডাকে না, কাজেও সহযোগিতা পাওয়া ভার । কিছুক্ষণ পরে বালতির তোলা জলে মুখ ধুয়ে এসে লখা অবাক হয়ে দেখল দুগী একটি কাঁচের গেলাস তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। তাতে তরল পানীয় রয়েছে। সলজ্জ হেসে দুগী জানালো, “ চা বঠে ,চপসা লয়, আদা গুড় দিয়া আছে।”
গতকাল মারা পাখি দুটো একপাশে পড়ে ছিল। লখা একটু ইতস্থত করে দুগীকে বলল, “ এ দুগী , লাল গরগরা ঝোলটি বানাতে পারবি না লারবি ? এক ঝাপ্টায় চুলগুলি মুখের উপর থেকে সরিয়ে , কালো চোখে বিদ্যুৎ হেনে উঠে দাঁড়ালো সেই মেয়ে, “ ই বাবা! লারবো ক্যেনে ? তুই সিনান সেরে আয় ন, এখনি হইয়ে যাবেক।”
সমাপ্ত
[রিমি পতি]