কালিয়াগঞ্জ
হাতে তখন সাড়ে সতের টাকা। পিসতুতো দাদা, বড় পিসি আর নেই, পশ্চিমবাংলার এক থানা
শহরের স্কুল মাস্টার।
পড়ন্ত বেলায় আমাকে এক জামা, এক পাজামা, পায়ে চটিতে দেখে চমকে উঠলেন। বললাম সকালেই বাড়ি থেকে পালিয়েছি। কেউ জানে না। দাদার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। 'বাড়ি থাইকে পালালি ক্যান? কচি বয়স তোর। আমার যা অবস্থা, তিন ছেলেমেয়ে...' বুঝলাম, ভয় পেয়েছেন, ওর ঘাড়ে না পড়ি। বলি, 'আমি আজ নয় তো কাল কলকাতা চলে যাব। টাকা আছে আমার কাছে।' নিশ্চিন্ত হলেন। পরদিন সকাল হতেই বৈজু ডাগার কাছে।
হাই রোডের পাশেই বাড়ি, ওই কালিয়াগঞ্জেই। মাড়োয়ারি। কয়েকটা চালকলের
মালিক। বড়দার ছোটবেলার বন্ধু। বললাম,
'কলকাতায় যাব। বাড়ির কেউ জানে না। আমি সাংবাদিক হতে চাই।' ইনিও ভয়
পেলেন। সমর জানে না, আমি তোমাকে টাকা দিলে, ও রাগারাগি করবে...
'কিন্তু আমার কাছে মাত্র সাড়ে সতেরো টাকা! এই দেখুন।' আমি পাজামার পকেট থেকে খাবলা মেরে সব কটা টাকা পয়সা বের করি। বৈজুদা আমার ছেলেমানুষী দেখে মৃদু হাসলেন। বসতে বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম। উনি টাকা না দিলে হিচ হাইকিং করব। মন খারাপের কোন জায়গাই
নেই। কালিয়াগঞ্জ থেকে বা কালিয়াগঞ্জের
ওপর দিয়ে সারাদিন রাত ট্রাক যাচ্ছে কলকাতায়, খোঁজ নিয়েছি আসার সময়।
বৈজুদা এলেন। হাতে কিছু টাকা, আমাকে
দিলন, 'পঞ্চাশ আছে, এর বেশি হাতে নেই এখন।' সত্যি কি মিথ্যে আমার কী যায় আসে? আমি আত্মহারা!
কালিয়াগঞ্জ থেকে কলকাতার ট্রেন ভাড়া ষোল টাকা।
এখন
আমার কাছে সাড়ে সাতষট্টি টাকা! পরম নিশ্চিন্তি। নিতাইদার বাড়িতে ফিরি। আমাকে দেখেই
দাদা ছাত্রদের বসতে বলে বাইরের বারান্দার মাদুর ছেড়ে উঠে এলেন। আমার কাঁধে হাত
রেখে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন,
'তোর কপাল ভালো। আমাদের হেড মাস্টার মশায় আজ কলকাতা যাচ্ছেন। রাতের
ট্রেন। সঙ্গে বাড়ির লোকজন। ওদের সঙ্গে গেলে তোর
আর ভয় থাকবে না।' আমি ট্রেনের টিকিট কাটতে স্টেশনে চলে যাই।
ফিরে
এসে আমরা দুজন যখন ভেতরের টানা বারান্দায় আসন পেতে খেতে বসেছি, রোগা লিকলিকে সংসারের ভারে
নুজ্ব মানুষটা হয়ে গেলেন এক প্রাণময় পুরুষ। 'একটা কথা কিন্তু
বলব বাবলু, জীবনে বড় হতে গেলে, এভাবেই
হয়। তুই পারবি। কলকাতায় নেমেই বিবেকানন্দ মুখার্জীর সঙ্গে দেখা করবি।'
আমি
জানতে চাই, 'কে এই
বিবেকানন্দ মুখার্জি?' 'ওহ, তোর তো
জানার কথা নয়। যুগান্তরের এডিটর।
মস্ত
সাংবাদিক। নেহেরুও ভয় পায় তাঁকে।'
সেই প্রথম ভারতের এক সাংবাদিকের নাম জানলাম। নেহরুর নাম জানতাম।'
মনে মনে ঠিক করলাম, প্রথমেই যাব যুগান্তরে।
নিতাইদা যুগান্তর রাখতেন, ঠিকানাটা নোট করে নিলাম।
বিকেলের
ট্রেন। আমাদের শহরের মত মিটার গেজ লাইন। কাটিহার যাবে। আমাদের বগিটা যাবে কলকাতায়।
দু তিনটি স্টেশন পরেই বারসই জংশন। এখানে আমাদের বগিটাকে কেটে একটা ইঞ্জিন যখন
অন্ধকার কোন এক জায়গায় ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল,
তখন রাত। বগিটাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাস্টার মশয় মোমবাতি জ্বাললেন।
মাঝে মধ্যে কারো কারো হাতের টর্চের আলো এদিক ওদিক লাফালাফি করছিল। আমি ভেতরের আর
বাইরের অন্ধকারে একাকার। খানিক পরেই ঝাঁপিয়ে এলো মন খারাপ। মা'র জন্য। গতরাতে এই সময় খোলা বারান্দায় মাদুরে মা'র
পাশে শুয়ে ছিলাম। জুন মাসের আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা ঝিলমিল করছিল। আমি একবার তারার
দিকে, একবার মা'র দিকে তাকাচ্ছিলাম। দু'একবার মা'কে জড়িয়েও ধরছিলাম। কিন্তু একবারও বলিনি,
'মাগো, কাল আমি থাকব না তোমার পাশে।' জানতাম ঐ তারাভরা আকাশ আর
মা
রয়ে যাবেন আমার ভাবনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে,
কয়েক মুহূর্ত পর থেকেই, তবু। এখন ভাবি,
কিশোর মন কি সত্যিই সবচেয়ে নিষ্ঠুর হয়? নতুন
জীবনের আহবানের জয়ঢাকের আওয়াজ কি ঢেকে ফেলে মায়ের ডাককেও? আমার
কানে কেন বাজল না বাতাসে ভেসে ভেসে আসা মা'র উৎকন্ঠায় ভেজা 'বাবলু' ডাকটা?
অন্ধকারে নিজেকে বোধয় স্পষ্ট দেখা যায় বেশি। আমি টের পেলাম, আমি কাঁদছি। জামার হাতায় 'ঘুম পাচ্ছে' অছিলায় চোখের জল মুছতে থাকি। কত মুছব? প্লাবন যেন বড়
বড় ঢেউ তুলে ছুটে এলো। ছানুর জন্য, বড়দার জন্য, ফিজু, শিখা, ডিকু, বাড়ির শিশু দোপাটি, লাল ঝুঁটি মোরগ ফুল, বটগাছ.... নদীর বিশাল বিশাল ঢেউ একের পর
এক এসে পাড় ভাঙ্গতে থাকে…
ভোর। ট্রেন ছুটছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এখন আর ঠিকঠাক মনে পড়ে না, রাতটা জেগে কেটেছে নাকি ঘুমিয়ে। মাঝরাতে বগিটাকে ঠেলেঠেলে যখন দার্জিলিং মেলের লেজে জোড়া হল, জেগেছিলাম। দার্জিলিংমেল যে লাইনটায়
দাঁড়িয়ে, সেই লাইনটা ধরে পিছন দিকে সোজা একটানা ছুটে নয়টা ছোট ছোট
স্টেশনপেরুলেই সোজা মা'র কোলে। নেমে
পড়ব? মনটার ভেতরে ছোট্ট একটা মাছ তিরতির পাখনা নাড়ল, কিন্তু ঘাই তুলল না। মাস্টার মশয় বলেছিলেন, বারসই থেকে ট্রেন বাঁক নেবে বাম দিকে।
মানে, মা আমার সরলরেখারবাইরে চলে যাবেন। আমি হব কক্ষচ্যুত। হলও তাই। ভোর হল বিহারের মাটিতে। ট্রেন ছুটছে সকড়িগলিরগঙ্গা পারের দিকে।
মাস্টার মশয় সঙ্গের ছেলেটাকে, আমার থেকে একটু বড়, বললেন, 'একটা চাদর নিয়ে ছুটবি। ওপারে ট্রেনেজায়গা রাখতে হবে। নইলে মুশকিল।' আমি শুনেই আগ বাড়িয়ে বলি, 'আমাকে একটা চাদর দেবেন, আমিওদৌড়ুব।' এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের বাহাদুরাবাদ ঘাটেও ঢাকা
টাঙাইল থেকে আসা-যাওয়ারসময় এটা ছিল মাস্ট।
ট্রেন থামতেই আমরা দু'জন দে দৌড়! সবার আগে স্টীমারে। উঠেই ছেলেটাকে
বলি,'আর এগিয়ো না। এখান দিয়েই নামতে হবে। সেটাই নিয়ম। অন্য সাইডটা
ঘাটে ভেড়ে না। এখানে দাঁড়ালেআমরাই প্রথমে ট্রেনে পৌঁছুতে পারব। হলও তাই।
আমরা একটা ফাঁকা কামরা পেয়ে গেলাম। ইচ্ছে মতোভালো জায়গা দখল করি।
আমি নিলাম আলাদা। জানালার সাইডে সিঙ্গল সিট।
ট্রেনটা এখন ভারতের মাটি কামড়ে ছুটছে। এ তো মাথার চুল নয়, সতের বছরের শৈশব আর কৈশোর ট্রেনেরগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কপালে সাপটা মারছে। জেল
থেকে বেরিয়ে, দু'মাসের মধ্যে, পরশু, এমনই একঝলমলে সকালে বাড়ি থেকে
বের হয়েছি, আজ ২৫ জুন। বুকটা গুমগুম শব্দ করে।
১৯৫৮ সালে আয়ূবক্ষমতায় আসার সময় থেকেই, প্রত্যক্ষ আয়ূব বিরোধিতার দায়ে বাবা জেলবন্দী। আর আমি? চার বছরেরমধ্যেই এই।
পলাতক। দেশদ্রোহী। বাবার চোখে আমি বিধর্মী এখন। মাইকেল ত্যজ্যপুত্র হয়েছিলেনধর্মান্তরের কারণে, রামমোহন ধর্মকে অস্বীকার করে। আর আমি? বাবার দেশধর্মকে ত্যাগ করেছি। সারাপূর্ব পাকিস্তানে চলছে তুলকালাম, আয়ূবকে টেনে নামাতেই হবে। সেই দাবীতে, লক্ষে আমিও তো ছিলামরাস্তায়। অথচ...
'বাবা, তুমি-ই তো বলেছিলে, দেশের ঋণ শোধ করা যায় দু'ভাবেই।
সমাজের ভেতরে থেকে বা সমাজের বাইরেথেকে। বলেছিলে তো!' গা ঝাড়া দিয়ে বুক টান করে সিটে বসে যাই। ভারতের মাটি মানুষকে চেনার খেলায় মেতেযাই।
বগির
ভেতরে, মানুষগুলোর গায়ে মনে এক একটা
উপন্যাসপম ইতিহাস ঝলসাতে থাকে। বাইরে ,মাঠের আলে আলে আর এক
ইতিহাস। যা আমার জানা হয়নি কোনদিন।
ট্রেনটা
নলহাটি ছাড়তেই একটা আওয়াজ কানে আসে। 'জল খাইবেন নাকি, বাবু? জল! ঠান্ডা জল। খাইবেন?'
ভীড় ঠেলে ঠেলে আমার পাশে দাঁড়াতেই দেখি, বেঁটেখাটো। গোলগাল। শক্তপোক্ত। কাঁধের দু'পাশ দিয়ে এসেপেটের কাছে
ঝুলছে ক্যামবিসের একটা বড় ব্যাগ, তাতে দশ পনেরোটা কোকের ভরা বোতল। গলায় লকেটেরমত ঝুলছে ওপেনার, তার সঙ্গে জপমালার টোপলা, সেটা ক্যাশবক্স। শিউড়ে উঠি, লোকটার
দুটো হাতইকনুই থেকে বাদ। কেউ ঠান্ডা কোক লিমকা সোডা কিছু চাইলেই,
কোমর ভেঙ্গে সামনে ঝুঁকে পড়ছেন। খপ করে
দুই কনুইয়ের সঁড়াশিতে একটা বোতল তুলে দু'হাঁটুর ফাঁকে বন্দী করে ফেলছেন। বুকের কাছে পেনডুলামওপেনারটাকেও দুই
কনুইয়ে খপ করে ধরে চাড়, ভভক শব্দে খুলে যাচ্ছে বোতল। বোতলটা দুই কনুই থেকেকাস্টমারের হাতে চালান হয়ে যাচ্ছে অবলীলায়, এক লহমায়। আমি থ।
আমাদের শহরে এমন হাতকাটা ভিখ্রীরসংখ্যা অনেক। কিন্তু এখানে?
আমি এক অন্য পৃথিবীর স্বাদ পেতে শুরু করি।
খানিক পরে আরো বিস্ময়।লোকটা তার 'জল খাইবেন,বাবু, জল?' আওয়াজ হাঁকিয়ে হাঁকিয়ে কামরার এমাথা ওমাথা বার দুয়েক ঘুরে দর্জারকাছে গেলেন। ট্রেন
ছুটছে। ওই কনুই হাতেই দরজার হ্যান্ডেল ধরে ধরে
পা দুটকে দু'ফালা করে করে পাশেরকামরায় চলে গেলেন। গলায় বোতল-ব্যাগের ঝুড়ি। ওই মানুষটার এই দৃশ্য আমি আজো চোখ বুঝলে দেখতেপাই।
মানুষটাকে না দেখলে আমার লড়াই অনেক দীর্ঘায়িত হত বলে মানি।
[অরুণ চক্রবর্তী]
পরবর্তী
সংখ্যায়~~~~~~