বিশ্বায়ন: গল্প ও গ্যাঁড়াকল
আবিশ্ব
বিশ্বায়নের জয়রথের ঢক্কানিনাদে মনে হয় মানুষ খুব সুখে আছে। আছে নিশ্চয়ই। প্রচারের
আলো যেখানেই গিয়ে পড়ছে সেখানেই বিশ্বায়নের প্রশস্ত রাজপথের স্বর্ণালী রেখা আর
উৎসবের রোশনাই। দেখে মনে হয় মানুষের সামনে আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে
আছে বিশ্বায়ন। যার যেমন প্রয়োজন, সে যেন তেমনই সুখের ঠিকানা আর ঐশ্বর্য্যের চাবি
কাঠি চাইলেই হাতে পেয়ে যাবে। দেখে মনেও হয়, অনেকেই পেয়ে গেছে আশ্চর্য্য প্রদীপের
সেই অলৌকিক আশীর্বাদ! তাই লাইনে স্বপ্ন দেখা মানুষেরও সংখ্যা বেড়ে চলছে প্রতিদিন।
আর লাইন যতই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ততই জমে উঠছে বিশ্বায়নের প্রচার। সেই প্রচারের
জাঁক আর জমকের আড়ালে বিশ্বায়নের লম্বা সুতোয় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে কারা? কেন ও
কিভাবে? বিশ্বায়নের গল্পটায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার, প্রচার ও সত্যের টানাপোড়েনই বা কি
রকম, আসুন না একবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করা যাক। অনেকেই বলতে পারেন, কি হবে
উঁকি দিয়ে? এ বড় সুখের সময়। বিশ্বায়নের জয়রথে বরং চেপে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সেই রথের সারথি কে বা কারা, মালিকই বা কে কিংবা রথের চাকার তলায় কেউ পড়ে মরলো কিনা
সেসব দেখার বা জানার দরকারই বা কি আর সময়ও বা কই? সে কথা ঠিক, আপনি বাঁচলে বাপের
নাম। আগে তো নিজের বন্দোবস্তটুকু করে ফেলা যাক, তারপর না হয় ণত্ব বিধান ষত্ব বিধান
নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে। হ্যাঁ যদি সে সময় থাকে শেষ অব্দি। আর তাই সবাই ছুটছে সকলের
আগে। বিশ্বায়নের আশ্চর্য্য প্রদীপের ছোঁয়া হতেই হবে। পৃথিবীর
ইতিহাসে এই সুযোগ এক আধবারই আসে। কে আর চাইবে সে সুযোগ হারাতে।
বিশ্বায়নের
প্রচারের মহিমা এমনই সর্বগ্রাসী যে ঠিক এইভাবেই ভাবছে আবিশ্ব মানুষ। জাতি ধর্ম
বর্ণ নির্বিশেষে। আর এইখানেই একটি প্রাথমিক প্রশ্ন জেগে ওঠে, কি এমন শক্তি যা
আবিশ্ব মানু্ষকে একই ভাবে ভাবাতে পারে? এই বিরাট বিশ্ব আর তার বৈচিত্রময় সমাজ
সংসার। জাতি ধর্ম সংস্কৃতি। অন্তহীন বৈচিত্র। অথচ তা সত্তেও সারা পৃথিবীর মানুষের
কাছেই বিশ্বায়ন আজ স্বপ্ন পুরণের জাদুকাঠি! আসল কারণটা খুঁজতে গেলে মনে পড়বে একজন
মনস্বীর কথা। তিনি ডারউইন। বহু যুগ আগেই এক চরম কথা বলে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিলেন পৃথিবীর সম্পদ সীমিত। কিন্তু মনুষের চাহিদা
অনন্ত! তাঁর সেই আমোঘ বাণীকে শিরোধার্য্য ধরে নিলে দেখব ধনতন্ত্রের সেটাই জীয়ন
কাঠি। সেই সীমিত সম্পদের উপর ভোগ দখলের অসীম অধিকার কায়েম করাই বস্তুত ধনতন্ত্র।
ধনতন্ত্র তাই সেই অধিকার কায়েম রাখারই কৌশল মাত্র। আর এই কৌশলটিকে আয়ত্ত করার
জন্যেই হন্যে হয়ে ছুটছে সবাই। শতাব্দী থেকে শতাব্দী জুড়ে। সেই দৌড়ের ইতিহাসই
বস্তুত সভ্যতার ইতিহাস। ডারউইনের সেই অমোঘ বাণীর সার সত্য লুকিয়ে আছে আমাদেরই
ব্যক্তি মানুষের চেতনার পরতে পরতে। আমরা প্রত্যেকেই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে,
আমাদের সেই অসীম চাহিদা মেটানোর আশায় বসে থাকি। আর আমরাও প্রত্যেকে জানি, সেই
চাহিদা পুরণের চাবিকাঠিই হলো ঐ সীমিত সম্পদের উপর ভোগ দখলের অধিকার কায়েম করা। তাই
সম্পদের সুষ্ঠ ও সমানুপাতিক ভাগ বাঁটোয়ারায় আমরা কেউই বিশ্বাসী নই। কারণ তাহলে
অসীম চাহিদা পুরণ সম্ভব নয় কখনোই। আর সেই কারণেই ব্যক্তি মানুষ মাত্রেই সাধারণত
খুবই স্বাভাবিক ভাবেই ধনতান্ত্রিক মানসিকতায় বিশ্বাসী। দেশ কাল জাতি ধর্ম বর্ণ
নিরপেক্ষ ভাবে।
আর
সেইটাই বিশ্বায়নের প্রচারের মূল চালিকা শক্তি। যা আবিশ্ব মানুষকে বেঁধে ফেলেছে এক
সূত্রে। বিশ্বায়নের এই প্রচার মানুষের মনের সেই অন্তহীন চাহিদাকেই জাগিয়ে তুলে
তাকে এক কেন্দ্রীয় শক্তির সুতোয় বেঁধে ফেলতে সফল হয়েছে। হয়েছে বলেই আবিশ্ব মানুষ
একই ভাবে ভাবতে শুরু করেছে। একই ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, বিশ্বায়নের
প্রচারকে। এইখানেই বিশ্বায়নের সাফল্য। এই বিশ্বাস। যে
বিশ্বাসের আশ্বাসে মানুষ সব রকমের শর্ত্তেই রাজি বিশ্বায়নের জয়রথের সওয়ারী হওয়ার।
আর ধনতন্ত্রের সেটাই প্রাথমিক দাবি। এবং ঠিক এই পথেই আজকের পৃথিবীতে ধনতন্ত্রের
কোন বিকল্প নেই। বিকল্প বলে যে তত্ত্বগুলিকে খাড়া করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়
কখনো সখনো, সেগুলি নেহাতই কাগুজে বাঘ। না আছে গর্জন না আছে তর্জন। সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনের হাত ধরে পূর্ব ইউরোপের পালাবদল ধনতন্ত্রের কাজটাকে মসৃণ করে দিয়ে
গেছে। এবং সেই সুযোগেই একেবারে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো করেই ধনতান্ত্রিক
সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের পতাকা উড়িয়ে দখল করে ফেলেছে গোটা বিশ্বটাকেই। দখল করে
ফেলেছে নিজের শর্ত্তেই আপন স্বার্থের পরিসীমায়। হ্যাঁ বিশ্বায়নের মূল গল্প ও
গ্যাঁড়াকলটাও সেখানেই।
আচ্ছা
সাধারণ ভাবে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করে দেখা যায়, বিশ্বায়ন বলতে তিনি কি বোঝেন?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি গালভরা কথা শোনা যাবে, ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। বিশ্বায়ন অর্থাৎ
আমরা একটি গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। বেশ তো ভালো কথা। তাই না হয় হল। আমরা নয়
প্রথমেই আবিশ্ব সমস্ত বৈচিত্রকে বিসর্জন দিয়ে একমাত্রিক একটি বিশ্বসংস্কৃতিকেই বরণ
করতে চাইলাম। বেশ ভালো কথা। কিন্তু গ্রাম থাকলেই তার একটি নিয়ম কানুন, সামাজিক
অর্থনৈতিক ধারা থাকবে। থাকবে সেই সমস্ত ঠিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, সে সব দেখা
শোনা করার মতো একজন মোড়ল, বা জমিদার! তাহলে, আমরা আজ যে বিশ্বায়নের যুগে পৌঁছিয়ে
গিয়ে উর্দ্ধবাহু হয়ে নৃত্য করছি এবং সেই একই সময়ে আমরা যে গ্লোবাল ভিলেজের
বাসিন্দা বলেও গর্ব বোধ করছি সদর্পে; সেই ভিলেজেরও তো একটি মোড়ল থাকার কথা! অনেকেই
মানবেন একমেরু বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওরই তো এই গ্লোবাল ভিলেজের সেই মোড়ল। আবার
গ্রামের মোড়লের মতো এই সুপারপাওয়ারেরও একটি পারিষদ বর্গ আছে। সেটাও আমরা কম বেশি
জানি। কিন্তু এই সব জেনেও অধিকাংশ সময়েই আমরা একটি বিষয় ঠিক খেয়াল রাখি না,
গ্রাম্য সংস্কৃতিতে সীমিত ধনসম্পদের অধিকাংশের উপরেই কিন্তু মোড়ল ও তার
পারিষদবর্গেরই ভোগসত্ত্ব কায়েম থাকতো। আজকের যে গ্লোবাল ভিলেজ নিয়ে আমাদের এত
গর্ব, প্রচারের এত ঢক্কানিনাদ, সেই ভিলেজেও মোট সম্পদের সবচেয়ে বড়ো অংশের উপরেই
কিন্তু একচ্ছত্র অধিকার এই একমাত্র সুপারপাওয়ার ও তার আপন পারিষদবর্গেরই। বাকি
সবারই কিন্তু সেই রামা কৈবর্ত ও রহিম শেখের মতোই দশা। এটাই কিন্তু বিশ্বায়ন।
আসুন
এবার একটু চোখ ফেরানো যাক ইতিহাসের পাতায়, আজ থেকে ঠিক সাতানব্বই বছর আগে গত শতকের
গোড়ায় মার্কীন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ঠিক কি বলেছিলেন দেখুন,
“Since trade ignores national boundaries and
the manufacturer insists on having the world as a market, the flag of his
nation must follow him, and the doors of the nations which are closed against
him must be battered down. Concessions obtained by financiers must be
safeguarded by ministers of state, even if the sovereignty of unwilling nations
be outraged in the process. Colonies must be obtained or planted, in order that
no useful corner of the world may be overlooked or left unused”. -- WOODROW WILSON, 1919
না
আজকের এই একমেরু বিশ্ব বন্দোবস্তের ভাষা যে একটুও ভিন্ন, সেকথা আদৌ বলার কোন উপায়
নেই। আর হ্যাঁ এইটাই বিশ্বায়নের ভাষা। এইটাই বিশ্বায়নের মন্ত্র। অনেকেই অবশ্য তর্ক
করবেন, বিশ্বায়ন তো কোন দেশের একচেটিয়া কারবার নয়। সব দেশই তো এর সুযোগ কাজে
লাগিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। আবার বিশ্বায়নের সুযোগে বহুজাতিক সংস্থাগুলি
যে আবিশ্ব বাণিজ্যের সাম্রাজ্য পত্তন করে তার সাথে কোন একটি দেশের কি সম্পর্ক?
বস্তুত বহুজাতিক কোম্পানিগুলি কতটুকু বহুজাতিক আর কতখানি বিভিন্ন দেশের ব্যজার দখল
করে থাকে, সেই বিষয়ে আমাদের ধারণার গোড়াতেই যে একটি মস্ত গণ্ডোগল রয়ে গিয়েছে, আমরা
কজনই বা সে কথা খেয়াল রাখি! আসলেই প্রায় কোন সংস্থাই বহুজাতিক নয়। অধিকাংশ বাণিজ্য
সংস্থাই একদেশীয়। একটি দেশেরই অর্থনীতিকে বিশেষ ভাবে পুষ্ট করে তোলে বিভিন্ন দেশের
বাজার দখল করে লগ্নী করে ও মুনাফা অর্জন করে। অধিকাংশ সংস্থার জন্যেই শত শত দেশের
আঞ্চলিক বাজারগুলির উপর একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করতেই বিশ্বায়নের এই গল্প ফাঁদা হয়।
এই যেমন ধরুন, কোক পেপসি! বহুজাতিকই তো? কিন্তু কোক পেপসি উড্র উইলসন কথিত কোন
দেশের পতাকা বহন করে মূলত? আপনার কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমের মালিক আর এক
বহুজাতিক মাইক্রসফ্টের হাতে কোন দেশের পতকা? আপনার নিজের ইমেলটি, সে গুগুলই হোক
আরা ইহায়ু কিংবা হটমেল? কোন পতাকার ছবি ভাসিয়ে তোলে আপনার চেতনায়? আবিশ্ব যে যে
সোশ্যাল সাইটগুলিতে মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে, সেই ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব,
ওয়ার্ড-প্রেস, ব্লগার, এই সব সাইটগুলিরই মালিক কিন্তু মূলত একটিই দেশের বিভিন্ন
সংস্থা। ঠিক যেমন আপনার ঘরের টিভি ফ্রিজ হাতের মোবাইল
সেটগুলির মালিকও মূলত হয় জাপান নয় দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলিই! এই ভাবেই এক একটি
দেশের একাধিক কোম্পানি আবিশ্ব সকল দেশের বাজার দখল করে নিয়ে ডারউইন কথিত সেই সীমিত
সম্পদের বেশির ভাগের উপরেই আপন ভোগ দখল কায়েম করে রেখেছে। এবং তাতে সম্পদশালী করে
তুলছে তার নিজের দেশটিকেই। এটাই বিশ্বায়ন। বিশ্বের বাজারকে নিজের দখলে রেখে
একচেটিয়া কারবার পত্তন। আর সেই কাজে রাষ্ট্র যখন সর্বতো ভাবে ঝাঁপিয়ে পরে তখনই
বুঝতে হবে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে আসলেই কর্পোরেট বিশ্বের হাতে। যে কর্পোরেট
বিশ্বকে সর্বতো ভাবে সাহায্যের দিক নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন আজকের এই বিশ্বায়ন
তত্ত্বের উদ্ভাবক মার্কীণ মুলুকের একদা রাষ্ট্রপতি উড্র উইলসন আজ থেকে সাতানব্বই
বছর আগেই! তাঁর সেদিনের কথাটির মধ্যেই বিশ্বায়নের বীজমন্ত্র রয়ে গিয়েছে। আর সে
কথাটি ঠিক মতো বুঝতে পারলে বোঝা যায় আজকের
এই বিশ্বায়ন আর সব দেশ ছেড়ে কেনই বা একমাত্র মার্কীণ মুলুকের সাম্রাজ্যবাদী
ধনতন্ত্রের হাত ধরেই এমন সর্বগ্রাসী রূপে আত্মপ্রকাশ করল?
এবার
শুনুন আরও এক মহা শক্তিধরের কথা, খেয়াল করুন ঠিক কি বলতে চেয়েছিলেন তিনি আজ থেকে
প্রায় সাত-আট দশক আগেই!
"Fascism should more appropriately be called
corporatism because it is a merger of state and corporate power." -- BENITO MUSSOLINI
এবার চোখ
খুলে তাকিয়ে দেখুন তো বিশ্বায়নের এই জয়রথের দিকে। আজকের এই বিশ্বায়ন মুসোলিনি কথিত
সেই রাষ্ট্রশক্তি ও শিল্পমহলের মিলিত শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ নয় কি? যাকে তিনিই ফ্যাসিজিম
বলে আখ্যায়িত করেছেন। আসলেই বিশ্বায়ন ফ্যাসিজিমেরই নয়া দিগন্ত! মুসোলিনি কত দিন
আগেই বুঝতে পেরেছিলেন সেই সত্য। এটাই বিশ্বায়নের আসল গল্প। আবিশ্ব প্রচারের আড়ালে
যা মুখ লুকিয়ে থাকে। এই যে মুসোলিনি কথিত ফ্যাসিজিমের নতুন রূপ অর্থাৎ
কর্পোরেটিজিম যা কর্পোরেট পাওয়ার ও রাষ্ট্রশক্তির সমবায়ে গড়ে ওঠে, ঠিক সেই একই
কথাই কি বলেন নি ১৯১৯ সালেই মার্কীণ রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন? পাশাপাশি মিলিয়ে
দেখলেই দেখতে পাবো আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই সাম্রাজ্যবাদী
ধনতন্ত্র তার জমি তৈরী করছিল কি নিপূণ অধ্যাবসায়ে। এই দুই মহানয়কের কথায় সেই
ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি পাই আমরা। আজকের বিশ্বায়ন সেই ধারারই সার্থক উত্তরসূরী
মাত্র। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, তা কি করে হবে আজকের বিশ্বায়ন তো এই শতকের দান।
উইলসন ও মুসোলিনির কথার উপর তো আর আজকের বিশ্বায়ম গড়ে ওঠে নি। উঠলে তা এতদিন
অপেক্ষা করতো নাকি? সে কথাটুকু আমরা বুঝতে পারবো আবারও সেই ইতিহাসের পাতায় নজর
দিলেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরো বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে একটি ভারসাম্য গড়ে
উঠেছিল। সেই ভারসাম্য হলো সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার মধ্যে
ক্ষমতার একটি ভারসাম্য। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার কাছে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া একটি বিরাট
বিপদ ও আতঙ্ক সরূপ হয়ে বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আতঙ্ক এই কারণেই যে সামাজতান্ত্রিক
অর্থনীতির সাফল্যে মানুষ ধনতন্ত্রকে অবিশ্বাস করতে শুরু করলে যদি ধনতান্ত্রিক
দুনিয়ার ভিতটাই আলগা হয়ে যায়? তাই ধনতন্ত্রকে সেদিন ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিসর তৈরী
করেই সমাজতন্ত্রকে প্রতিরোধ কারার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। তারা জানতো, সেই সময়ে
বিশ্বায়নের প্রচারে আবিশ্ব মানুষকে টলানোও যেত না। সেদিন আজকের এই বিশ্বায়নের রথের
চাকা তরতরিয়ে চালানো সম্ভব ছিল আদৌ। কারণ সেদিন মানুষের সামনে বিকল্প পথ খোলা ছিল।
কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথেই ধনতন্ত্রের পথের কাঁটা সরে যেতেই বিকল্পহীন
ফাঁকা মাঠে বিশ্বায়ন তত্ত্বকে খারা করা অত্যন্ত সহজ হয়ে গেল। কিন্তু সেই পরিস্থিতি
সৃষ্টির জন্যে সাম্রাজ্যবাদী ধনতন্ত্রকেও অপেক্ষা করতে হল প্রায় এক শতাব্দী। একেই
বলে সবুরে মেওয়া ফলে!
বহুজাতিক
সংস্থাগুলির মালিকানা কিন্তু বহু জাতির মধ্যে ছড়িয়ে থাকে না। প্রায় প্রতিটি
বহুজাতিকেরই মূল মালিকানা রয়েছে ইউরোপ আমেরিকা এশিয়ার এক একটি দেশে গড়ে ওঠা
বিভিন্ন কোম্পানিরই হাতে। যা সমৃদ্ধ করছে নিজ নিজ দেশেরই অর্থনীতিকেই।
যারা আবিশ্ব বিভিন্ন দেশের বাজারকে দখল করে রাখে। যাতে করে আঞ্চলিক কোম্পানিগুলির
পক্ষে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সুযোগ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। এইভাবে আবিশ্ব বিভিন্ন
দেশের সকল আঞ্চলিক বাজারগুলি নিজেদের দখলে ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই বিশ্বায়নের মূল
লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যে বিশেষ বিশেষ দেশের শিল্পমহলগুলিই যাতে লাভবান হতে পারে,
সেইটা দেখাই বিশ্বশক্তিধর দেশকয়টির কাজ। যে কাজের দিকনির্দেশনা কত আগেই না দিয়ে
গিয়েছিলেন উড্র উইলসন। যে কাজকেই ফ্যাসিজিম বলে উল্লেখ করেছিলেন মুসোলিনি। এইভাবেই
আবিশ্ব কাজ করে চলছে বিশ্বায়ন, গুটি কতক দেশ ও তাদের শিল্পমহলকে সর্বশক্তিমান
বানিয়ে তুলতে। যে শক্তিকয়টির নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে আবিশ্ব মানুষ ও বাজার। সেটাই
বিশ্বায়নের প্রাধানতম শর্ত্ত। মুসোলিনি কথিত কর্পোরেটিজিম। ফ্যাসিজিমের আসল মুখ!
যাকে আমরা বলছি সাম্রাজ্যবাদী ধনতন্ত্র। আর আবিশ্ব মানুষের কাছে প্রচার করা হচ্ছে
গ্লোবাল ভিলেজের বিশ্বায়ন বলে। আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের মতো আলৌকিক প্রতিভায়।
এবার
দেখা যাক বিশ্বায়নের প্রভাবে কি ভাবে আবর্তিত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির
জনজীবন। এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন মার্কীণ রাষ্ট্রপতির একটি উক্তি বিশেষ
প্রণিধানযোগ্য। শোনা যাক ঠিক কি বলেছেন তিনি।
“Globalization, as defined by rich people
like us, is a very nice thing... you are talking about the Internet, you are
talking about cell phones, you are talking about computers. This doesn't affect
two-thirds of the people of the world.” JIMMY CARTER (1924 -)
আমাদের
মনে রাখতে হবে কথাটি বলেছেন সর্বশক্তিমান দেশের
অন্যতম একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান। তাই কথাটি কোনভাবেই লঘু করে দেখার
উপায় নেই। এই যে কার্টার কথিত দুই তৃতীয়াংশ জনসাধারণ, যারা বিশ্বায়নের প্রসাদ থেকে
বঞ্চিত তাদের অধিকাংশেরই বাস কিন্তু তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলিতে। ঠিক যে দেশগুলিই
বহুজাতিক সংস্থাগুলির মৃগয়া ক্ষেত্র। আর এইখানেই সেই অমোঘ প্রশ্নটি উঠে আসে, তাহলে
বিশ্বায়নের প্রভাব আবিশ্ব এই দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর উপর সদর্থক হয়ে ওঠেনি
নিশ্চয়ই। না হলে কার্টারের মুখ থেকেও এই সত্য ভাষণ বেড়িয়ে আসতো না। এইবার আসুন
দেখা যাক আমাদের এই কাঁটাতারে বিভক্ত সোনার বাংলায় বিশ্বায়ন কিরকম সোনা ফলিয়েছে, দেখে
নি বরং। আমরা বাঙালিরা বরাবরই শক্তের ভক্ত, নরমের যম। বরাবরই শক্তিশালী বিদেশী
শক্তির প্রচারিত তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাদের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতিতে আপ্লুত জাতি।
এইভাবেই একদিকে অ্যাংলো স্যাকসন সংস্কৃতি ও আর এক দিকে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি
আসক্ত হয়ে উঠেছি আমরা বহু শতাব্দী ধরেই। তাই আজ আর আমাদের নিজস্ব বলতে বিশেষ
কিছুই অবশিষ্ট নেই। যা কিছু আমাদের নিজেদের বলে মনে করি, দেখা যাবে তার বেশির
ভাগটাই ইংল্যাণ্ড আমেরিকা নয়তো আরবের থেকে আমদানী করা। তাই আমাদের কাছে বিদেশের
বাণীই দৈববাণী। বিশ্বায়ন নিয়ে তাই বাঙালি মাত্রেই গৌরবান্বিত। আর বিশ্বায়নের ভাষা
যেহেতু ইংরেজী, ঠিক যে ভাষাটায় আমাদের শতাধিক বছর ব্যাপি দাসত্ব করার ঐতিহ্য ও
উত্তরাধিকার গড়ে উঠেছে বংশ পরম্পরায়; সেই ভাষাটি করায়ত্ব থাকায় আমরা স্বভাবতঃই মনে
করে ফেলি এই বিশ্বায়ন যেন আমাদেরই বিশ্বায়ন। তাই নিজেদেরকে সেই গ্লোবাল ভিলেজের
বাসিন্দা মনে করতে আমরা আহ্লাদে আটখানা। আনন্দের সেই বহরে কে আর খেয়াল রাখে
বিশ্বায়নের আসল মুখ কোনটি। আর সেই মুখের প্রতিফলনে আমাদের আসল আবস্থাই বা ঠিক কি রকম।
অনেকেই বলে থাকেন বিশ্বায়নের সাফল্যকে করায়ত্ব করতে মধ্যবিত্ত বাঙালির নতুন
প্রজন্মকে বেগ পেতে হয়নি ইংরেজী ভাষায় তাদের স্বচ্ছন্দ চলাচলের জন্যই। কি ভাবে
করায়ত্ব হলো সেই সাফল্য? না আউটসর্সিং! আরও একটি গালভরা কথা। ইংরেজী না জানা দেশের
ছেলেমেয়েদের থেকে বাঙালির ছেলেমেয়েরা কাঁটাতারের দুই পারেই এই বিষয়ে কয়েক যোজন
এগিয়ে। বাহঃ খুব ভালো কথা। সত্যিই তো আউটসোর্সিংএর দৌলতে ঝাঁচকচককে অফিসে
কেতাদুরস্ত পোশাকে নতুন প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা জীবন যাপনের মান বেশ বাড়িয়েই
ফেলেছে। বড় বড় নগরগুলিতেই যে নজীর দেখা যায় অহরহ। কিন্তু সেতো আলোর রোশনাইটুকুই!
তার তলায় আসল ছবিটা ঠিক কিরকম? এই যে আউটসর্সিং-এর কাজ, এই কাজে ছেলেমেয়েদের
মেধাশক্তির পরিচর্যা কতটা হয়, ভেবে দেখেছি কখনো আমরা? তাদের পেশাগত মানের উত্তরণরই
বা কি বা কতটুকু সম্ভাবন রয়েছে এইসব আউটসোর্সিং পেশায়? এবং তাদের আয়ের পরিমাণও কি
আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সমানুপাতিক? পেশা হিসেবেও একটি দেশের জনসম্পদ বৃদ্ধির
ক্ষেত্রে এই আউটসর্সিং কতটুকু কার্যকরি? না এইসব জরুরী প্রশ্নগুলি নিয়ে চিন্তা
ভাবনা করার মতো সময় আবসর ও সদিচ্ছা আমাদের বাঙালিদের নেই। একবারও কি আমরা ভেবে
দেখেছি আজ যদি হঠাৎ কোন কারণে এই আউটসোর্সিং সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই
হাজার হাজার ইংরেজী বলিয়ে কয়িয়ে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কি হবে? এদের ইংরেজি শুনে
বুঝতে পারা আর বলে বা লিখে তথ্য চালান করা ছাড়া আর কোন জ্ঞান ও স্কীল রয়েছে কি?
বিশ্বের অনেক দেশেই তো মাতৃভাষা ইংলিশ। অনেক দেশেই মানুষ ইংলিশে অভ্যস্ত। কিন্তু
সেই সব দেশে কি ইংলিশ জানাটাই একটি পেশাদারী স্কীল বলে গন্য করা হয় কোথাও? অথচ
আমাদের বাংলায় ইংরেজি জানাটাই একটি পেশাদারী স্কীল বলে গন্য করা হয়। হ্যাঁ
বিশ্বায়নের প্রাথমিক পর্যায় সেই সুযোগে কিছু ছেলেমেয়েরা লাভবান হলেও তার স্থায়িত্ব
ও পরিমাণ কতটুকু, সে বিষয়ে কতটা ওয়াকিবহাল আমরা?
অনেকেই
জানেন বিশ্বায়নের সুযোগে রপ্তানী বাণিজ্যের অগ্রগতির কথা। যা নাকি আমাদের দেশে
অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। ও করবে। এই যেমন ধরা যাক বাংলাদেশের
গারমেন্ট শিল্পের কথা। গোটা দেশের রপ্তানী আয়ের একটা বড়ো অংশই আসে এই শিল্প থেকে।
লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত এই শিল্পে। কিন্তু কজন আমরা জানি, এই শিল্পজাত দ্রব্যের
আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য নির্ধারণ করে ক্রেতা সংস্থাগুলিই। সেই শিল্পজাত দ্রব্যের
রপ্তানী মূল্য কিন্তু ঠিক করতে পারে না বাংলাদেশের গারমেন্ট কোম্পানীগুলি, বা
শিল্পমহল। তারা শুধু আবেদন নিবেদন করেই খালাস। সেই পারাধীন ভারতের সময়ের মতো। অথচ
দেখুন আমাদের বাজারে কোক পেপসী হামবার্গার পিৎসার দাম থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুরই
দাম কিন্তু ঠিক করে দিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানীগুলিই। এইটাই কিন্তু বিশ্বায়নের
দস্তুর। আর তখনই বোঝা দরকার, এই বিশ্বায়ন কাদের বিশ্বায়ন? ফলে বাংলাদেশের গারমেন্ট
শিল্পমহলকে আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থাগুলির নির্ধারণ করে দেওয়া সর্বনিম্ন মূল্যেই
রপ্তানী করতে হয় উৎপাদিত দ্রব্য। আর যার সরাসরি প্রভাব পড়ে শিল্পে নিযুক্ত লক্ষ
লক্ষ শ্রমিকের উপর। ন্যূনতম মজুরীতেই তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয় সারাদিন। বিশ্বায়নের
রোশনাইয়ের তলায় এই যে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির শোষণতন্ত্র, সেই সত্যটাই আজ চাপা পড়ে
গেছে আবিশ্ব প্রচারের সেই ঢক্কানিনাদে, যে ঢক্কানিনাদের প্রসঙ্গ ধরেই বর্তমান
আলোচনার সূত্রপাত।
বিশ্বায়ন
আর বৈদেশিক লগ্মীর কথা বলে ইংরেজী জানা বাঙালিরও মনে হয়, এই পথে আলো জ্বেলে এই
পথেই বাংলার ক্রমমুক্তি হবে। কিন্তু আমরা প্রথমেই ভুলে যাই বৈদেশিক লগ্নীর
প্রাথমিক কারণগুলির কথা। উন্নত বিশ্বের উচ্চ মজুরী, কড়া শ্রম আইন, জমির চড়া খাজনা,
জল বিদ্যুৎ খরচ ও নানবিধ করের কড়াকড়ি প্রভৃতির কারণে যে কোন দ্রব্যেরই উৎপাদন
মূল্য যা দাঁড়ায়, তাতে আন্তর্জাতিক বাজারের বিক্রয়মূল্যের অনুপাতে মুনাফার হার
বিশেষ বাড়ানো যায় না। আর সেই কারণেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলির
দূর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুযোগে অনুন্নত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ফোঁকর দিয়ে ও
সর্বপরি বিশাল জনসংখ্যার ভারে সস্তার শ্রমকে কাজে লাগিয়ে দ্রব্যের উৎপাদন মূল্যকে প্রবলভাবে
কমিয়ে মুনাফার হারকে তীব্রভাবেই বাড়িয়ে নেওয়া যায়। আর তাই বিদেশী বহুজাতিক
সংস্থাগুলি তাদের নিজেদের গরজেই অনুন্নত দেশগুলিতে কলকারখানা খুলে বসে ধনতান্ত্রিক
অর্থনীতির শোষনযন্ত্রে বেঁধে ফেলছে আমাদের জীবনযাপনকে। আর সেইটাকেই গালভারা
বিশেষণে ভূষিত করা হচ্ছে বিশ্বায়ন বলে। এবং এরই সাথে এই কথাও স্মরণে রাখা দরকার,
যে যে যে শিল্পে পরিবেশ দূষণের মাত্রা যত বেশি, এই সুযোগে উন্নত বিশ্বের দেশগুলি
সেই সব শিল্প কারখানাগুলিকেই বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে স্থানান্তরিত করে
ফেলছে। ফলে বিশ্বায়নের দৌলতে যে বিদেশী লগ্নী নিয়ে আমাদের এত আশা আকাঙ্খা ও গর্ব,
তার পেছনের কারণগুলির কথা ভাবলে স্বভাবতঃই শিউড়ে উঠতে হয়।
শিউড়ে
উঠতে হয় ঠিক এই প্রসঙ্গেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কর্ণধার ও
নীতিনির্ধারকদের কথা ভাবলেও। ঠিকমত খোঁজখবর করলেই দেখতে পাওয়া যায়, এইসব দেশের
কর্ণধাররা ও নীতিনির্ধারকরা আসলেই উন্নত বিশ্বের ধনতান্ত্রিক দেশগুলি ও তাদের
বহুজাতিক সংস্থাগুলির স্বার্থ রক্ষা করার প্রতিনিধি স্বরূপই কাজ করে থাকে। আর
সংবাদ মাধ্যমগুলি সেই কাজকর্মগুলিকেই আর্থিক সংস্কার বলে বাহবা দিয়ে জনগণকে
বিভ্রান্ত করে চলে। ভারতবর্ষের এই কর্মকাণ্ডের অন্যতম পুরোধা কংগ্রেস ও ভারতীয়
জনতা পার্টির শাসনকালগুলিকে পর্যবেক্ষণ করলেই সেই সত্য স্পষ্ট বোঝা যায়। যে
মনমোহনী আর্থিক সংস্কারের সাফল্য নিয়ে গর্ব করে সংবাদ মাধ্যমগুলি, সেই আর্থিক
সংস্কার আসলেই উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক স্বার্থের কাছে মুচলেকা দেওয়া অঙ্গীকার
ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় সামিল হতে নব্বইয়ের দশকে ভারতবর্ষ যে
গ্যাটচুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তার মূল বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে পারলেই এই
সত্য উদ্গঘাটিত হয়ে যায়। আলোচনা প্রসঙ্গে এইখানে শুধু দুইটি বিষয়ের উল্লেখ খুবই
জরুরী। গ্যাটচুক্তির শর্তাবলী ও নির্দেশনামা অনুযায়ীই ভারত সরকার ধারাবাহিক ভাবে
কৃষির সার, রান্নার গ্যাস ও জীবনদায়ী ওষুধপত্তরের উপরে প্রয়োজনীয় ভর্ত্তুকি তুলে
দিচ্ছে দিনে দিনে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাজারদরের উপর, মানুষের দৈনন্দিন
জীবনযাপনের উপর। অথচ সেই একই সময়ে খোদ মার্কীণ মুলুকেই কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক
পরিমাণেই সরকারী ভর্ত্তুকি বহাল আছে। ভর্ত্তুকি বহাল আছে রান্নার গ্যাসেও। এই যে
বৈপরীত্য, এটাই বিশ্বায়নের গ্যাঁড়াকল। এতো শুধুমাত্র দুইটি উদাহরণ, এইরকম ভুরিভুরি
উদাহরণ রয়েছে, চার দিকে। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখার অপেক্ষা মাত্র। সম্প্রতি
ভারতের নবতম প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদের একেবারেই প্রথম দিকে মার্কীণ সফরে গিয়ে যে
সকল চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এসেছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জীবনদায়ী দূর্মূল্য
ওষুধপত্রের উপর থেকে সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষেত্র বিশেষে ভর্ত্তুকি তুলে নেওয়া। যার
ফলে দূরারোগ্য ক্যানসারের মতো মারণব্যাধির কোন কোন ওষুধের মূল্য এক লাফে আট হাজার
থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সোয়া লাখ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। এই হোল বিশ্বায়নের নগ্ন চেহাড়া।
উন্নত বিশ্ব তার অর্থনীতিকে একচেটিয়া ভাবে সমৃদ্ধ করতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির
অর্থনীতিকে কি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেইটাই আসল বিশ্বায়ন। আর সেই বিশ্বায়নকে সফল
ভাবে রূপ দিতেই তাদের প্রয়োজন আমাদের মতো দেশগুলির কর্ণধারদের ও নীতিনির্ধারকদের।
যাতে তারা প্রথম বিশ্বের কর্পোরেটিজিমের সফল প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে। পাঠক আরও
একবার স্মরণ করতে পারেন সাতানব্বই বছর আগের উড্র উইলসনের সেই অমোঘ বাণী।
বিশ্বায়নকে
প্রতিরোধহীন প্রতিযোগিতাহীন খোলা জমি দিতেই, আঞ্চলিক বাজারগুলির নিয়ন্ত্রণকে
বহুজাতিক সংস্থাগুলির হাতে তুলে দিতেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আর্থিক সংস্কারের
ঢেউ। আর সংবাদমাধ্যমগুলির বদান্যতায় আমরা সেই সংস্কারকেই বিশ্বায়নের জয়রথে সওয়ার
হওয়ার ছাড়পত্র ভেবে আহ্লাদে আটখানা হই। হ্যাঁ এটাও একই সঙ্গে স্বীকার্য্য, এই
আর্থিক সংস্কার ও বিশ্বায়নের হাত ধরে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া কারবারে
প্রতিটি দেশেই কিছু শতাংশ মানুষ ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে ওঠে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই
সেটা হয়। কিন্তু সেই সমৃদ্ধি সারা দেশের সর্বত্র সমান ভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে না।
দেশের, কার্টার কথিত সেই দুই তৃতীয়াংশ জনগণের কেউই তাতে লাভবানও হয় না। এইখানেই
বিশ্বায়নের মূল গ্যাঁড়াকল। আর সেইটা বুঝতে বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের উপর নজর দিলেই
যথেষ্ট। যেমন, বিপুল ঢক্কানিনাদে যে আর্থিক সংস্কার ও বিশ্বায়নের জয়গান গাওয়া হয়,
তাই যদি বাস্তব সত্য হয়, তাহলে ডলারের তুলনায় টাকার দাম কেবল পড়তেই থাকে কেন?
খেয়াল করে দেখুন বিশ্বায়ন ও আর্থিক সংস্কার পূ্র্ববর্তী কালে ডলারের তুলনায় টাকার
দাম কত ছিল? আর আজ সেই দাম কোথায় নেমে এসেছে? তাহলে আর্থিক সংস্কারের সাফল্য
কতটুকু? আবার অতি সাধারণ বুদ্ধিতেই এই প্রশ্নটাও করা যায়, আর্থিক সংস্কারেরে দুই
দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও মুদ্রাস্ফীতির এই ভয়ঙ্কর রূপ কেন? যে কারণে টাকার
ক্রয়ক্ষমতার হার দ্রুতবেগে কমে চলেছে। তাহলে উন্নয়নটা হলো কোথায় কি ভাবে? অনেকেই বলবেন
কেন দেশের লোকের গড় আয় তো বেড়ে চলেছে। চলেছে ঠিক। কিম্তু সেই সাথে জীবনযাপনের খরচ
যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে নিট ফল তো ঋণাত্মক? আমরা বলছি কার্টার কথিত সেই দুই
তৃতীয়াংশ মানুষেরই কথা। বিশ্বায়ন ও দেশে দেশে আর্থিক সংস্কার তাদের কি দিল তবে
আসলে? এই প্রসঙ্গে আরও একটি কঠিন বাস্তব সত্য উল্লেখ করা দরকার। বিশ্বায়ন ও এই
ধরণের আর্থিক সংস্কার যা কিনা বিশ্বায়নেরই স্বার্থ রক্ষার্থে কাজে লাগে, তার কি
ভয়াবহ পরিমাণ লক্ষ্য করুন আরও একজনের উক্তিতে-
“Recent evidence confirms that retail prices of essential
consumer goods in poor countries are not appreciably lower than in the United
States or Western Europe. In fact, with deregulation and "free
trade", the cost of living in many Third World cities is now higher than
in the United States. My experience in Latin America and Haiti is that the
prices of meat, fish and fresh vegetables are about the same as in the United
States. Can you imagine eating on less than one dollar a day?” ― VINCENT A. GALLAGHER, The True Cost of Low Prices: The Violence of
Globalization
এই হল
বাস্তবতার আসল রূপ। বিশ্বায়নের সরাসরি পরিণাম। আর্থিক সংস্কার ও মুক্তবাণিজ্য
অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। সাম্রাজ্যবাদী ধনতন্ত্রের নগ্ন চেহাড়া। যে ধনতন্ত্রের
বিজয়কেতনই ঐ বিশ্বায়ন। এই ধনতন্ত্র সম্বন্ধে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিবেক
নোয়াম চমস্কি কি বলছেন শুনে নেওয়া যাক বরং একবার।
“What is called 'capitalism’ is basically a system of corporate
mercantilism, with huge and largely unaccountable private tyrannies exercising
vast control over the economy, political systems, and social and cultural life,
operating in close cooperation with powerful states that intervene massively in
the domestic economy and international society.” -- NOAM CHOMSKY
এই ভাবেই
কাজ করছে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের ছদ্মবেশে। যে কাজের দিক নির্দেশনা
দিয়ে গিয়েছিলেন উড্র উইলসন আজ থেকে ঠিক সাতানব্বই বছর আগে। মুসোলিনির পরিভাষায় যা
ফ্যাসিজিমেরই প্রশস্ত রাজপথ। সেই পথেই এগিয়ে চলেছে বিশ্বায়নের সেই জয়রথ!
[শ্রীশুভ্র]