(কল্প-বিজ্ঞানের গল্প)
একান্ত ব্যক্তিগত -১৬
উড়ুক্কু ট্রেন
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়
উড়ুক্কু প্লেন আছে। ধরতে গেলে প্লেন তো উড়ুক্কুই হয়। ওড়ার জন্যেই তো প্লেনের
আবিস্কার। উড়ে উড়ে যায় বলেই এত তাড়াতাড়ি নিমেষের মধ্যে পৌঁছে যায় দূর থেকে দূরে। ডাঃ
গৌতমের আবিস্কার অবশ্য এগিয়ে গেছে আরও অনেক যোজন বেশি। তিনি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত
-১৪ তে আবিস্কার করেছেন চমকপ্রদ এক উড়ুক্কু যান।
সামান্য ছোট্ট মানিব্যাগের আকারে একটা উড়ুক্কু গাড়ি। কিন্তু
প্লেনই হোক বা ডাঃ গৌতমের আবিষ্কৃত মানিব্যাগ আকারের উড়ুক্কু যান, কতগুলো যাত্রী
আর বইতে পারে একবারে? খুব বেশি হলে বড় জোর কয়েকশ। কিন্তু কোটী কোটী মানুষের
যাতায়াতের জন্যে এ তো একেবারে নস্যি। ট্রাম, বাস, মোটর গাড়ি, প্লেন, জাহাজ এসবের
মধ্যে একেবারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে পারে তা হল ট্রেন। তাই সব
উন্নত দেশে ব্যবস্থা রয়েছে বা উন্নয়নশীল দেশে চেষ্টা রয়েছে সর্বাপেক্ষা গতিশীল
ট্রেন আবিস্কারের। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। বুলেট ট্রেন এল বলে।
ওদিকে চীন জাপানে বুলেটের সঙ্গে চলেছে মনোরেলের যাত্রা। মনোরেলের
একটা বৈশিষ্ট হল খানিক দূর চাকা লাইনের ওপর দিয়ে গড়ানোর পর লাইন থেকে ওপরে উঠে
যায়। চাকা আর লাইনের মধ্যে কাজ করে একটা শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র। গতি বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে এই চুম্বক ক্ষেত্রের ক্ষমতা বাড়তে থাকে আর ট্রেনকে তা ভাসিয়ে রাখে। এই
ভাসিয়ে রাখার কারণে চাকার সঙ্গে লাইনের ঘর্ষণ জনিত বাধা থাকে না আর ট্রেন
বাধাহীনভাবে এগোতে পারে।
এরোপ্লেনের ক্ষেত্রে এই বাধা আরও কম। এরোপ্লেন হাওয়ায় ভর করে ভেসে ভেসে যায়।
বাতাসের ঘর্ষণ বল খুব কম। তাই প্লেনের গতিবেগও অনেক বেশী। ডাঃ গৌতম ভাবলেন উড়ুক্কু
জিনিসের গতিবেগ অনেক বেশী আর সবচেয়ে বেশি। একটা এরোপ্লেন তৈরি হয় এলুমিনিয়ামের
মিশ্র ধাতু দিয়ে আর তাই হাল্কা। তাতে তার আকারও অনেক ছোট। অন্তত একটা ট্রেনের
তুলনায় তো তা নস্যি। তাই একটা ট্রেনকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখা বা আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে
যাওয়া একটা কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিমান আর সতর্ক পাঠকেরা
সবাই জানেন ডাঃ গৌতমের এ পর্যন্ত সব আবিষ্কার মানে তাঁর ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ প্রথমে
থাকে কষ্টকল্পনাই। পরে তা কিন্তু সহজ হয়ে চলে আসে সব মানুষের হাতের নাগালে। ডাঃ
গৌতমের এই আবিষ্কৃত বিষয়গুলো সব সাধারণ মানুষ একান্ত নিজের অর্থাৎ ‘একান্ত আপন’
বলেই ভাবেন। তাই তিনি স্থির করলেন উড়ুক্কু ট্রেন তিনি বার করবেনই। আর তাই আবার
তাঁর শান বাঁধানো সিন্থেটিক বটগাছতলা আগামী ছমাসের জন্য হল তাঁর ঠিকানা। ধ্যান ভেঙ্গেই কিন্তু এবার আর সাংবাদিক বৈঠক ডাকা গেল না। কেননা এবার
ব্যাপারটা যে রেলের সঙ্গে যুক্ত। তাই সরকারের আর রেল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ তো
করতেই হবে। আরও মাস ছয়েক লাগল এসব কাজে। এখন এই ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে ফাইলের লাল
ফিতের বাঁধন আলগা হয়ে চেপে ধরেছে কম্পিউটারের আই-ডি আর পাস ওয়ার্ডের অনেক বাধা। তারপরে
ইন্টারনেটের লিংক ফেল আর ভাইরাসের ভূত। তাই এসবের বাধা ডিঙ্গোতে অন্তত ছটা মাস এমন
কিছু বেশি নয়।
সব বাধা কাটিয়ে আবার সাংবাদিক জমায়েত। এবার আর প্রেস ক্লাব, প্রেস কর্ণার,
প্রেস গ্যালারি এসব কিছু নয়। স্থান বিরাট বড় এক রেলওয়ে স্টেশন। সারা দেশের মন্ত্রী
সান্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ। খবব্রের কাগজ আর নিউজ
চ্যানেলের প্রতিনিধি। শুধু দেশ নয় সারা পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত, উন্নয়নশীল এমন কি
উন্নয়নকাংক্ষী দেশ প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। নাসা কি ইসরো চাঁদ মঙ্গলে রকেট পাঠাচ্ছে এ
যেন তার থেকেও বড় ব্যাপার। কারণ চাঁদ মঙ্গলে আর কোটিপতি ছাড়া কে যেতে পারে? কিন্তু
ডাঃ গৌতমের আবিষ্কার হল ট্রেন অর্থাৎ একটা গন পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে যাতে সব সাধারণ
মানুষই যুক্ত স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে। ষ্টেশনের প্লাটফর্মে
দাঁড়িয়ে আছে একটি অতি সুসজ্জিত ট্রেন। ফুল মালা দিয়ে সাজানো। ডাঃ গৌতমের পরিচালনায়
যে চিত্রনাট্যটি আজ বাস্তবায়িত হতে চলেছে তার সম্মানিত নায়ক হল ট্রেনটি। তাই উপযুক্তভাবেই
তাকে সাজানো হয়েছে। লোহার লাইন বটে তবে ট্রেন কিন্তু লোহার নয়। বিশাল এই ট্রেনের
সারা দেহটা তৈরি হয়েছে বিশেষ এক প্রকার সিন্থেটিক ফাইবার দিয়ে। খুব হাল্কা কিন্তু
প্রচণ্ড মজবুত। কয়েক শত কেন কয়েক হাজার মানুষের ভার বহনে সক্ষম। একে আলাদা করে রঙ
করতেও হয় না। ময়লা পরিষ্কারেরও ঝক্কি নেই। কারশেডে নিয়ে গিয়ে এক ধরণের গ্যাস গাড়ির
মধ্যে ব্লো করলেই সব ময়লা পরিস্কার হয়ে যাবে।
সেই মুহূর্ত এল যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা দেশ বিদেশের ভি-আই-পি,
ভি-ভি-আই-পি থেকে শুরু করে সব মানুষের চোখের সামনে ডাঃ গৌতম নাড়লেন তাঁর হাতের
সবুজ পতাকাখানা। আর অমনি ট্রেন চলতে শুরু করল। যেমন ভাবে লাইনের ওপর দিয়ে যায়
তেমনি ভাবেই। তারপর গতি বাড়তে লাগল।
ট্রেনের গতিবেগ যেমন করে বাড়তে থাকে তার থেকে অবশ্য বেশ একটু বেশি ভাবে।
মাত্র এক মিনিট। তারপরই সকলের চোখের সামনে যা ঘটল সেটা পৃথিবী
বিখ্যাত জাদুকররাই ঘটাতে পারে। কিন্তু কোনও মায়াজাল নয়। নয় কোনও সম্মোহন বা চোখের
ভুল। একেবারে চিমটিকাটা বাস্তব সত্য। চিমটি কাটা সত্য হল সেই সত্য যখন নিজের গায়ে
চিমটি কাটলেও খুব লাগে। সকলের দুই চোখ ছানাবড়া করে দিয়ে হুস করে লাইন ছেড়ে আকাশে
উঠে গেল সেই ট্রেন। সবাই তাকালো আকাশের দিকে। একটা ছোট্ট পাখির মত চেহারা নিল
মুহূর্তে। কিন্তু উপস্থিত সকলে
তো আর উড়তে পারে না ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে। তাই তাদের জন্যে ব্যবস্থা রয়েছে বিশাল বড়
ভিডিও স্ক্রিনের। তাতে দেখা যাচ্ছে আকাশের উড়ুক্কু ট্রেনের উড়ন গতিবিধি। বিভিন্ন
দিক থেকে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে। কখনও জুম ইন তো কখনও জুম আউট। মানে কখনও বড় হচ্ছে তো
কখনও ছোট। কখনও ক্লোজ আপ তো কখনও ডিস্ট্যান্ট ভিউ। কখন ফ্রন্ট ভিউ তো কখনও রিয়ার
ভিউ আবার কখনও সাইড ভিউ। লং শট, মিড শট, মিড লং শট এমনিভাবে পোজ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে
চলল সেই ট্রেন আর মাত্র দু মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পরে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী এক
স্টেশনের একটু আগে আবার নিচে নেমে স্পর্শ করল তার পায়ের নিচের লোহার লাইনকে।
যাত্রা শুরুর ঠিক দু মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড পর ৩০ কিলোমিটার দূরের একটি জংশনে
গিয়ে তার যাত্রা শেষ করল। মনিটরে তার গতিবেগ দেখাল। আর সেটা হল প্রায় ৬০০
কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। উল্লসিত ডাঃ গৌতম ঘোষণার মাধ্যমে জানালেন কিছুদিনের মধ্যেই
এই গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় এক হাজার কিলোমিটারের কাঁটা স্পর্শ করতে সক্ষম হবে। জনতা
হর্ষধ্বনী করে উঠল। সবাই উন্মুখ হয়ে রইলেন এরপর ডাঃ গৌতম কি বলেন তার জন্য। শুরু করলেন ডাঃ গৌতম। একেবারে পিনপতন নীরবতা।
ডাঃ গৌতম যখন কিছু বলেন তখন সব খুলেই বলেন। কোনও প্রতিপ্রশ্ন করতে হয় না মাঝপথে।
আর সেটা মোটেও পছন্দ করেন না তিনি।
-দেখুন একটা প্লেন উড়ে চলে আর তাই তার চাকার সঙ্গে মাটির কোনও ঘর্ষণ থাকে না।
ট্রেনের সঙ্গে লাইনের ঘর্ষণজনিত বাধা অনেকটাই। কারণ একটা ট্রেনে অনেক চাকা। যে
কোনও গাড়ির যত চাকা তার বাধাও ঠিক তত বেশি। যদিও চাকা আর লাইন দুইই লোহার তৈরি
হওয়ায় এই বাধা অনেক কম। বাস ট্রাম
মোটরের থেকে কারণ পিচের বা মাটির রাস্তার বাধা অনেক। রাস্তা যত মসৃণ হবে বাধা তত
কমবে। আর যদি সেটা উড়ে যায় তো বাধা হবে সবচেয়ে কম। কারণ বাতাস গ্যাসীয় উপাদানে গড়া
হওয়ায় তার বাধা সবচেয়ে কম। একটা এরোপ্লেন বেশী লোক পরিবহন করতে পারে না। আমার
তাগিদ ছিল একসঙ্গে অনেক মানুষকে সবচেয়ে কম সময়ে অনেক দূরে পৌঁছে দেবার। ভিডিও
স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে একটা ট্রেনের ছবি। তার বিভিন্ন অংশের বর্ণনা দিচ্ছেন ডাঃ
গৌতম। তার বলার সঙ্গে সঙ্গে ছবিতে ট্রেনের অংশগুলো বড় হয়ে উঠছে। ট্রেনের মাথার
দিকে দেখিয়ে তিনি তখন বলছিলেন, ট্রেন যখন একটা নির্দিষ্ট গতিবেগ লাভ করে তখন তার
মাথার এই অংশগুলো থেকে প্রচন্ড তাও উৎপাদিত হয়ে সে অঞ্চলের বাতাসকে গরম করে দেয়।
সেই গরম বাতাস হাল্কা হয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যায় আরও ওপরে। এটাই বাতাস বা যে কোনো
গ্যাসীয় পদার্থের ধর্ম। সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থান শূন্য মানে ফাঁকা হয়ে যায়। কিন্তু
ট্রেনের নিচের হাওয়া ঠান্ডা থাকায় তার ঘনত্ব অনেক বেশি অর্থাৎ ভারি। তার চাপে
ট্রেন আকাশে উঠে পড়ে। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর ট্রেনের মাথার তাপোৎপাদক
যন্ত্র বন্ধ হয়ে চালু হয়ে যায় সামনের যন্ত্রগুলো। ওপরের মত একই ঘটনা ঘটতে থাকে
সামনে। অর্থাৎ সেইখানকার বাতাস গরম হয়ে হাল্কা হয়ে ওপরে উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে
ট্রেনের পেছনের ঠান্ডা ভারি বাতাসের ঠেলা খেয়ে ট্রেন এগিয়ে চলে সামনের দিকে। এছাড়াও
অবশ্য লাইনের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন চুম্বক ক্ষেত্রের দ্বারা। ট্রেনটা
সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি, এর চাকাগুলোও তাই। তবে তাতে দেওয়া আছে সূক্ষ্ম
নাইক্রোমের কোটিং। নাইক্রোম হল নিকেল আর ক্রোমিয়ামের মিশ্র ধাতু। এটি ইস্তিরিতে
ব্যবহৃত হলেও এর চুম্বক ধর্ম আছে। এই চুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে ট্রেন আকাশপথেও
সর্বদা তার লাইনকে অনুসরণ করেই চলে। অর্থাৎ স্টিয়ারিঙয়ের কোনও দরকার হয় না। পরবর্তী
স্টেশনে আসার কিছু সময় আগে থেকেই ট্রেনের গতি নিজেই কমে আসে আর ওপরের তাপোৎপাদক
যন্ত্রগুলো একটু একটু করে কাজ বন্ধ করতে থাকে। ট্রেন আস্তে আস্তে লাইনের ওপর নেমে
পড়ে। লাইন আর চাকার মধ্যেকার চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবও ক্রমশ কমতে থাকে। এই ট্রেনে
কোনও চালক বা গার্ড কিছুই লাগে না। পুরোটাই কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে
দূরনিয়ন্ত্রিত। তবে সিগন্যাল ব্যাবস্থার
সঙ্গে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণের কথাটা বলতেই হবে। সিগন্যাল সিস্টেমের বেশ কিছু
পরিবর্তন আনতে হয়েছে। সিগন্যালের লাল, হলুদ বা সবুজ রঙের আলোর প্রভাবে এর গতি
নিয়ন্ত্রিত হয়। ধরা যাক সিগন্যাল লাল রয়েছে। সেই লাল আলো একটি ট্রেনের সেন্সারে
পড়ে তার সামনের তাপ উৎপাদক যন্ত্রকে স্তব্ধ করে দেয়। কিন্তু ওপরের যন্ত্র চালু
রাখে। তাই তখন ট্রেন আকাশে ভেসে থাকলেও গতিহীন হয়ে যায়। অর্থাৎ থেমে গিয়েও শূন্যে
শুধু ভেসে থাকে।
এরপর? হে পাঠক আপনারাই নাহয় বাকিটা কল্পনা করে নিলেন। কল্পবিজ্ঞানের গল্প যখন
তখন পাঠকের কল্পনাকেও কি অসম্মান করা যায়? তারা তো কল্পনা করতেই পারেন বিশ্বের সর্বোচ্চ
পুরস্কারের থেকেও বড় কোনও পুরস্কার অর্থাৎ এই সৌর মন্ডলের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘সৌর
প্রতিভা পুরস্কার’ এরপর থেকে চালু হতে চলল আর -------
[অরুণ
চট্টোপাধ্যায়]