>

মিত্রা ঘোষ

SongSoptok | 12/10/2014 |




জমজ ভাই পল আর পিট।
[ফ্রান্সের গল্প]
ফ্রান্সের এক শহরে জমজ ভাই পল আর পিটের একটা বেকারী ছিল কেক পাউরুটি আর নানারকম বিসকিট-কুকীস-এর সুগন্ধে তাদের দোকান ‘ম’ ‘ম’ করত। দোকান খোলা থাকলেই ভীর উপচে পড়ত

দুই ভাইকে হুবহু এক রকম দেখতে হলেও তাদের স্বভাব ছিল একদম উল্টো। পিট চটপটে, খুব কাজের, দোকানটা আসলে তার পরিশ্রমেই চলে। সে হাসিখুশী, গান গায়, খেলার ছলে কাজ করেওদিকে, কাজের প্ল্যান, টাকা পয়সার হিসেব এসব পলের, তার বেজায় উপস্থিত বুদ্ধি, কিন্তু আসলে সে খুব কুড়েযত পারে ঘুমোয়, ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা মারে আর মাঝে মধ্যে দোকানে মুখ দেখিয়ে যায়, ভাই-কে পরামর্শ দিয়েই উধাও, অত কাজ দেখলে তার মাথা ঘোরে।

একদিন ওখানকার হোমড়া চোমড়া জমিদার বেকারীতে এসে পিটকে বলল ‘আমার বউ তোমাদের থেকে যে স্পেশাল পাউরুটি নেয়, আমাকে বেশ কয়েক পাউন্ড দাও দেখি। সে আর চাকরবাকর সবাই ব্যস্ত, তাই আমাকেই আসতে হল

পিট তার স্বভাব মত গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তাকের থেকে গরম রুটি তুলে সুন্দর করে কাগজে মুড়ে, ঠোঙায় ভরে, মিষ্টি হেসে সেই ধনী লোকটার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এই রুটিই রানী মা পছন্দ করেন।’

লোকটি ভুরু কুচকে বলল, ‘তুমি কি সব সময়েই এরকম ফুর্তিতে থাক?’
‘হ্যাঁ স্যার! ভগবানের আশীর্বাদে সব সময়ে দিব্বি আনন্দেই আছি!’

‘কোন মানুষই সবসময়ে সুখে, আনন্দে থাকতে পারে না। যতসব বাজে কথা! ঝুট ঝামেলা, বিপদে পড়লে সবার অবস্থাই টাইট্‌! তা, তোমার প্রশংসায় আমার বউ-ও পঞ্চমুখ। কিন্তু ব্যাবসা চালাবার জন্য তোমার এই মিথ্যে লোক দেখান ভরং-টা আমি সবার কাছে প্রমাণ করে দেব

পিট তো অবাক!  এক মুহুর্তের জন্য তার হাসি আর গান বন্ধ করে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখল এই হামবড়া লোকটিকে।

‘শোন হে হিরো, তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করব। এক্ষুনি। উত্তর ভেবে, কাল দুপুরের মধ্যে আমার বাড়িতে দেখা করবে। ঠিক ঠিক উত্তর পেলে আমিও তোমার আর তোমার দোকানের সুনাম গাইব। কিন্তু ভুল উত্তর দিলে, তোমার মুখের এই বানানো হাসি দূর করার উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে।’

বাপের জন্মে এরকম অকারণ ঝামেলায় পড়েনি পিট, খুব ঘাবড়ে গেলেও মনে জোর এনে ছোট্ট হেসে বলল, ‘বলুন কী কী প্রশ্ন, স্যার?’

‘প্রথম, আমার দাম কত? দ্বিতীয়, চাঁদের ওজন কত? তৃতীয়, আমি কি ভাবছি? মনে রেখ, কাল দুপুর পর্যন্ত সময়।’

ঘোড়ার গাড়ি মজুত ছিল, তিনি যেমন এসেছিলেন, পাউরুটি নিয়ে তেমন চলে গেলেন, শুধু পিটের হাসিটা মুছে দিয়ে। পলের দেখা পাওয়া পর্যন্ত পিট তার রোজকার কাজে ব্যস্ত থাকলেও, প্রশ্নগুলোর মাথামুন্ডু কিণারা করতে না পেরে ছট্‌ফট্‌ করতে থাকল। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার একটু আগে পল এল ভাইকে সাহায্য করতে।

‘কী হয়েছে রে? কী ছিন্তা করছিস?’ পলের প্রশ্ন। পিটেরও তর সইছিল না। গড়গড় করে বলল সব।
‘হুম্। ভাবিস না। কাল আমি গিয়ে উত্তর দিয়ে আসব। চল্, আগে কিছু খাওয়া যাক।’
পলের কথায় আস্বস্ত হয়ে দোকান বন্ধ করে তার সঙ্গে চলল পিট।

পরদিন দুপুরে সেই লোকটির প্রাসাদের মত মস্ত বাড়ির নানান্‌ পাহারা, অনেক গেট পেরিয়ে অবশেষে লোক্টির কাছে পৌঁছল পল। গুন্‌গুন্‌ করে সুর ভাজছে, মুখে আনন্দের হাসি। লোকটি তার বউকেও সঙ্গে এনেছিল নিজের বুদ্ধি দেখিয়ে, খেলাটা ভালভাবে উপভোগ করার জন্য। দামী পোসাকের দুই পকেটে হাত রেখে বাঁকা হাসি গম্ভীর গলায় প্রশ্ন তার,  ‘ কী? উত্তর আছে তো সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ স্যার।’ কেউ বসতে বলে নি, তাই দাঁড়িয়েই উত্তর দিল পল
‘বাঃ বেশ! ফলাফলটা আশা করি আর একবার মনে করিয়ে দিতে হবে না?’
‘না স্যার। আমি ভুল উত্তর দিলে আমাদের বেকারী উঠে যাবে, হয়তো আরো দুর্ভাগ্য ঘটতে পারে, সেগুলো পরিষ্কার করে খুলে বলেন নি। যাই হোক, তা-নিয়ে আমার চিন্তা নেই’ এই বলে মুচকি মুচকি হাসল সে। ‘করুন আপনার প্রশ্ন।’

‘হ্যাঁ, বলেছিলাম তো। প্রথমে, আমার দর কত?’
‘উনত্রিশ রূপার মুদ্রা’
‘কেন? কী ভাবে ঠিক করলে?’
‘লর্ড যীশু তিরিশ রূপার মুদ্রায় বিক্রি হয়েছিলেন। আপনাকে বিক্রি করলে নিশ্চই এক মুদ্রা কম হবে অন্তত?’

হি হি হি করে জোরে হেসে উঠল মোটাসোটা, হাসিখুশী, দামী পোসাকে আর দামী গয়নায় মোড়া বউটি। লোকটি তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ইশারা করে চুপ করতে বলল।
‘ঠিক আছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, চাঁদের ওজন কত?’
‘এক পাউন্ড?’
‘কেন শুনি?’
‘চাঁদের চারটে কোর্‍্যাটার। চার কোর্‍্যাটারে এক পাউন্ড। কোথাও চাঁদের ওজন লেখা থাকলে মিলিয়ে নেবেন।’

অনেক কাল আগের কথা; তখন বিজ্ঞানের এত অগ্রসর হয়নি। সুতরাং এ-উত্তরে লোকটি চুপ করে রইলেন। তার গিন্নী মুখে রূমাল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল ।

‘প্রথম দু’টোর ঠিক উত্তর পাওয়া গেছে। এবার শেষ প্রশ্ন। আমি কি ভাবছি?’ বউ-এর দিকে তাকিয়ে এবার লোকটি হাসল হা হা করে, চোখ টিপে তাকেও যেন সম্মতি দিল জোরে হাসতে পারার।

‘এটা কিন্তু সবচেয়ে সহজ প্রশ্ন স্যার। উত্তরটা হল, আপনি ভাবছেন কাল পাউরুটি কেনার সময়ে যার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, আমি সেই পিট। ঠিক কী না? আমি কিন্তু তার ভাই পল।’

বউটি হাততালি দিয়ে হেসে উঠে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে, দাসীদের খাবার নিয়ে আসতে বলল তক্ষুনি। আবার ঘরে এসে পলের পিঠ চাপ্‌ড়ে দিলেন
তোমাদের বেকারীর আর তোমাদের দুই ভাই-এর জীবনে অনেক উন্নতি হোক! সুখে থেক তোমরা’
লোকটিও পলের বুদ্ধি দেখে না হেসে পারলেন না। খুসী হয়ে বললেন, ‘তোমরা দুই ভাই-ই অসাধারণ! এখন বুঝলাম কেন তোমাদের দোকানের এত সুনাম, গিন্নী কেন এত প্রসংশা করে। এবার থেকে আমিও তোমাদের খদ্দের হলাম আর আমার চেনা জানা সবাইকেও পাঠিয়ে দেব, যেমন কথা দিয়েছি।’

ভাল খাবারদাবার চেখে, ভাইকে সুসংবাদ দিতে দোকানের পথ ধরল পল।      


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.