>

কমলেন্দু চক্রবর্তী

SongSoptok | 9/10/2014 |








স্বপ্নুদা




আমি মারা গেছি ৷ কোলকাতা  শোকস্তব্ধ ৷ খবরের কাগজের হেডলাইন এখন আমি৷ কত  শোকগাঁথা, অজস্র লেখনী, শোক মিছিল ৷ স্বদেশ-বিদেশের লোকেদের সঙ্গে কলকাতার  লোকদের আড়াআড়ি ভীড় ৷ মার্কিন  প্রেসিডেন্টও আসবেন বলেছেন ৷
ভীড়ে চিৎকার মারামারি, আমার শরীরের স্পর্শ পাওয়ার জন্য প্রাণপন চেষ্টা ৷ আমি অবশ্য মিছিলের মধ্যে ঠান্ডায় বেশ আরামেই আছি ৷ ভি আই পি-দের মধ্যে একজন আমার দাঁড়ির চুল পাওয়ার জন্য কী ছেলেমানুষি ৷ টেনে তুলেও নিয়েছে একটা কি দুটো ৷ আমার ব্যথা লাগার বদলে আনন্দ হয়েছে ৷ অমন ভি আই পি আমার পিছনে পড়েছে দেখে ৷

কয়েকদিন হল আমি ঠান্ডা ঘরে শুয়ে আছি ৷ না, না লাশকাটা ঘরে নয় ৷ একবারে রাজকীয় ঘরে ৷ দিনের বেলায় ভালোই কাটে, কত প্রণাম, কত চোখের জল, কত ফুল, মালা স্তবক ৷ আচ্ছা মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে ফুল দেবে, বাজারে তার দাম কত হবে? বিক্রি করলে ভালোই আমদানি হবে ৷ মানে আরও একটু ধনী ৷ আচ্ছা আহাম্মক তো ৷ তুই  তো এখন মরা ৷ এখনো স্বপ্ন? মরা মানু—ষ কি স্বপ্ন দেখে? তোর স্বভাবটা একই রয়ে গেল ৷

সাতদিন হয়ে গেল ৷ এখন আর অতটা উত্তেজনা নেই ৷  লোকজন আসাও কমে গেছে ৷ রাতে আমার খুব ঠান্ডা লাগে ৷ ভীষণ ঠান্ডা ৷ কাঁচের ঘরে এসি চলছে সর্বক্ষণ৷ একটু ভয়ও করে, গম্ভীর মুখে সিকিউরিটি গার্ড কাঁধে অস্ত্র – পায়ে গট গট করে বুটের আওয়াজ ৷ আমি নিজেকে বলি মরার আবার ভয় কীরে ? ঠান্ডাই বা কেন গরমই বা কেন? কিন্তু তবু লাগে ভয় আর শীত ৷

একটু কাশি শুরু হয়েছে ৷ বোধহয় একটু হাঁপও ধরছে ৷ ফুসফুসটার মধ্যে কেমন চাপচাপ ভাব ৷ হার্টটা ঠিক আছে তো ? অবশ্য আমি এখন ভি আই পিদের ভি আই পি, ভেরি ভেরি অনেক ভেরি – ভি আই পি ৷ বিড়ি খাওয়ার জন্য এমন হয়েছে ? কমদামী বিড়ি? আর চিন্তা কী? এখন বিদেশী সিগারেট খাব ৷ সবাই পাঠাবে ৷ কিনতেও হবে না ৷ আচ্ছা হাবানার চুরুট খেলে  কেমন হয় – পাওয়া যায় এখনও ? শরীরে সু্যট করবে কীনা সেটাও ভাবতে হবে ৷ বয়েস তো হয়েছে ৷ তবে চিন্তা নেই ডাক্তার আসছে লন্ডন থেকে শুধু  আমার জন্য বিশেষ বিমানে করে ৷

আচ্ছা আমি কিসের জন্য বিখ্যাত? সব চাইতে বিখ্যাত রাজবাড়ির জামাই বলে , অথবা বৃত্তি পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর ? বেস্ট ফুটবলার, ক্রিকেটার, দাপুটে আই সি এস, গায়ক, নাকি – আবার স্বপ্ন ? ঠিক আছে সতি্ই তো মরার আবার স্বপ্ন ? হয় নাকি?
চায়ের খিদে পাচ্ছে ৷ আমার এমন হ—য়— ৷ কখনো চায়ের খিদে পায়, কখনো পান্তাভাতের , বিরিয়ানি আমার সহ্য হয় না ৷ ফ্রায়েড রাইস চলতে পারে ৷ কখনও আমার দু-টাকার কটকটি ভাজার খিদে পায় ৷ তখন অসুবিধা হয় – ওই টাকা পিয়ারলেস ইন বা সোনার বাংলায় খাবারই খাব ৷ সাধারণ মানু—ষ তো নই আর? সাধারণ খাবার খেতে দেখলে লোকে কী বলবে ? আবার বাজে কথা? তুই হাভাতে ঘরের ছেলে, বুড়ো হয়ে— মরে রয়েছিস, কথাটা মনে থাকে না কেন? সরি, কিন্তু একটু গরম চা  - পাতি ফুটপাতের চা হলেও চলবে ৷

-   আপনার চা, তাড়াতাড়ি খান ৷ পরে আর গরম করতে বলবেন না – পারবে না ৷

কী হল ? গলাটাতো চেনা ৷ আমার বউমার ছাড়া এমন কর্কশ স্বর আর বলার ঢং আর কার হবে?
ঘুম ভেঙে গেল ৷ খুব কষ্ট পেলাম মনে ৷ মরে এতক্ষণ আরামে ছিলাম ৷ মরে গিয়ে ভিআইপি৷ আর এখন বেঁচে শুয়ে আছি, বারান্দায় একটা কোণে মাদুরের উপর ছেঁড়া তোষক পেতে ৷ শীতে কুঁকড়ে আছি ৷ আহা, মরাতে এত সুখ এই স্বপ্নটা না দেখলে কে জানত ৷ পাশে ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটায় চুমুক দিলাম ৷

আমার আসল নাম – রমাকান্ত কামার ৷ হাসছেন, ভাবছেন  ছোটোবেলার ধাঁধা? শব্দগুলো প্রথম দিক থেকে সাজালেও যা, পিছন দিকে সাজিয়ে এলেও তা – রমাকান্ত কামার ৷ আমার বাবার কী দরকার ছিল আমার নাম রমাকান্ত রাখার, যখন কামার আমার চোদ্দ পুরুষের টাইটেল ৷ বাচ্চারা খ্যাপাত, অ্যামা, সামনে পিছনে সব, সমান ৷ এখন অবশ্য ওই বলে কেউ খ্যাপায় না ৷ হাসে ৷ আমার একটা নতুন নাম দিয়েছে  - স্বপ্নময় ৷ স্বপ্নু হয়ে গিয়েছিল সেটা ছোটোবেলায় ৷ বড়ো হতেই সবার কাছে বারোয়ারী স্বপ্নুদা ৷

চায়ে একটা চুমুক দিয়ে – বিড়ি ধরাতে ইচ্ছা হল ৷ গুনলাম দুটো আছে ৷ কাল সকালের কোষ্ঠকাঠিন্য না ছাড়ানো পর্যন্ত এটা দিয়েই চালাতে হবে ৷ আমি বিড়ির ব্যাপারে খুব ডিসিপ্লিনড ৷ নিজেই আইন করেছি ৷ এখনো পর্যন্ত ভাঙ্গিনি ৷ খোকা বিড়ির রেশন করেছে ৷ প্রতিদিন পাঁচটা ৷ ওতে হয় না ৷ তবে কী আর করা যাবে ?

ছোটোবেলার কথা খুব মনে পড়ে ৷ মা গল্প বলত ৷ বলত ভালো করে খাও, ঘুমাও – চাঁদ কপালে টিপ দিয়ে যাবে ৷ সেই শুরু আমার স্বপ দেখার ৷ রাতে কপালে হাত দিয়ে দেখতাম চাঁদের টিপটা কেমন ৷ টিপ পাইনি, না ঘুমিয়ে কপারে বারবার হাত দেওয়ার জন্য মায়ের বকুনি, দু-চারটে চড়-চাপড় পড়েছে৷

বাবা বেশি কথা বলত না ৷ কামারের হাঁপর টানার মতো বুকটা হাঁপাত ৷ আমি সবে হাঁটতে শিখেছি – বাবা হেসে বলল, বাঃ, হাঁটছে দেখ যেন রাজপুত্তর – রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেব ৷ তারপর ঠাকুমার ঝুলিতে যতো রাজকন্যার ছবি আছে  - সেগুলো বাছার পালা ৷ খুঁটিয়ে নাক-মুখ- চোখ পোশাক সব দেখা – কোন রাজকন্যার সঙ্গে আমি বিয়েতে রাজি হব ৷ বিয়ে অবশ্য পরে হয়েছিল ৷ তার নামও ছিল রানী, তবে যাকে গে, ওসব কথা ৷

দুপুর বেলায় নান্টুর সঙ্গে আম গাছতলায় গুলি খেলাটা বেশ মজার ৷ কিন্তু  ছোটো কাকার বাড়িতে আসার পর থেকে সবে বন্ধ ৷ কাকা বলল, দুপুরে  ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঠিক বৃত্তি পরীক্ষায় ফাস্ট হব – বৃত্তি পাবে ৷ স্বপ্ন দেখলাম – মাঝখান থেকে নান্টুর সঙ্গে সারা জীবনের জন্য গুলি না খেলার জন্য আড়ি ৷

ক্লাস সেভেনে পড়ি ৷ তিন বছর ধরে পড়ছি ৷ বাবার মুখ ভার ৷ সঙ্গে করে নিয়ে গেল নিজের জঘন্য একটি টালির তলায় হাঁপড়ের সামনে ৷ বলল টান ৷ আমি টানি, বাবা মা, খুন্তি বানায় ৷ আমার মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে ৷ এটা কোনও কাজ?  বাবা হা করে ঘুমোয় ৷ তখন আমি কেদ্দানি মারি বাবার মতো ৷ রাগে গড়গড় করে আমার মন ৷ একদিন একটা লোহাকে গরম করে কারিগরি করছি – বাবা দেখে বলল, বাঃ তোর হাত তো ভালো ৷ একটার মধ্যে তিনটে – দা, কাস্তে আর করাত ৷ পড়াশোনা করতে হবে না, লেগে পড় ৷ পেটের ভাতের অভাব হবে না ৷

বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হল ৷ এর মধ্যে স্বপ্ন কোথায়? কামারের ছেলে কামার ৷ আর যাইনি বাবার ওখানে ৷ মেতে উঠলাম পাড়ার ক্রিকেট মাঠে ৷ সমরদা বিশাল লোক ৷ পুরো সাদা শার্ট, প্যান্ট, জুতো পরে মঠে আসে ৷
-   খেলা শিখবে? ক্রিকেট ?

-   জানি তো ৷ মাঝে মাঝে চার-টার মারতে পারি ৷

-   এটা ক্রিকেট নয়, ক্রিকেট একটা বিজ্ঞান  - একটা সাধনা – একটা পরম্পরা ৷

আরো কী সব কথা বলেছিল সমরদা ৷ মনে নেই, মানেও বুঝিনি ৷ তবে এটা বুঝেছিলাম খুব ভালো ভালো কথা বলেছিলেন সেদিন সমর দা ৷ আমার মনে ধরেছিল ৷ কারণ, ওতে স্বপ্ন ছিল ৷
-   তিনশো টাকা? (সে সময় তিনশো টাকা মানে এখন যে কত আমার জানা নেই ৷ কিন্তু অনেক ৷) টাকা কোথায় পাব ? মায়ের একটা বালা বের করে বিক্রি  করলাম ৷ পাঁচশো টাকা লুকিয়ে রাখলাম নিজের কাছে ৷ বই-এর ভাঁজে ৷

শুরু হল ক্রিকেট কোচিং – টানা এক বছর ৷

-   তোর হবে ৷ প্রথম দিন বলেছিল সমরদা ৷ তোর স্টাইলটা পতৌদির মতো, স্টোকগুলো পঙ্কজ রায়ের মতো ৷ তোর অনেক কিছু হবে ৷

আমার আনন্দে ব্রেনের মধ্যে সাগরের ঢেউ উথালপাথাল করতে লাগল কথাটা শুনে ৷ স্বপ্ন দেখতে দেখতে শুধু ভাবছিলাম – আমার মধ্যে এত ক্ষমতা – আমাকে ব্যাট করতে না দেখেই বলে দিল – আমার স্টাইল স্টোকের কথা ৷ প্রথমে কয়েক মাস ব্যাটিং, তারপর বোলিং, সব  শেষে উইকেটকীপার – সব চেষ্টার পর দেখলাম, আমার গায়ের সাদা পোশাক ছাড়া ক্রিকেটীয় কিছুই নেই ৷ খুব আফশোষ হল মায়ের বালাটা চুরি করার জন্য ৷

ঘষটে ঘষটে প্রমোশন পেয়ে ক্লাস নাইন ৷ মাঝে কিছুদিন গয়না বেচার দুশো টাকা দিয়ে ফুলবল কোচিং শেষ করেছি ৷ লাল-হলুদ জার্সিটা পরে বিকেলে সাইকেল চালাই ৷
 বন্ধুরা সব  কোচিং ক্লাশে ভর্তি হয়েছে ৷ খেলার নয় _ পড়ার ৷ ওখানে পড়লে নাকি প্রথম ডিভিশন অবধারিত ৷ লেটার, স্টারও খুব শক্ত নয় ৷ কোচিং  সেন্টারের বিরাট সাইনবোর্ডে ওভাবেই সব লেখা আছে ৷ বাবাকে বলেছিলাম থাক না পড়াশোনা হাতের কাজ শেখ আমার কাছে ৷

কোচিং  সেন্টারে প্রথম দিন মাস্টারমশাই খুব ভালো কথা বলেছিল – আমরা স্বপ্ন বেচি – আমরা স্বপ্নের সওদাগর ৷ সেদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম – মেট্রিক পরীক্ষায় আমি ফাস্ট হয়েছি ৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য থার্ড ডিভিশনে পাশ করে গেছি ৷ সেই মাস্টার তখন আমাকে বলেছিল, স্বপ্ন দেখাটা ছাড়ো না স্বপ্নু, থার্ড ডিভিশন তো কী হয়েছে  - প্রায় তো সেকেন্ড ডিভিশন টাচ্ করে ফেলেছিলাম ৷

কিন্তু কলেজে পড়াটা কিছুতেই হচ্ছে না ৷ বাবা যেতে দেবে না ৷ আসলে বাবা বরাবরই আমার স্বপ্নকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছে ৷ লাগতে হল কামারের কাজে ৷ নিজে ইচ্ছা নেই, তবু বানাতে লাগলাম দা, হাতুড়ি , বটি, ছুরি ৷
    
কাগজে হঠাৎ বেরোলো এই প্রথম আমার সতিকারের স্বপ্নপূরণের আমন্ত্রণ ৷ গোলদার হোল ফর ফিউচার ৷ নীচে লেখা আমার স্বপ্নের সওদাগর, স্বপ্ন দেখাই, স্বপ্ন বেঁচি ৷ হাজার হয়ে গেলাম সেখানকার ঠিকানায় ৷ অত সুন্দর ঝকঝকে বাড়ি, অমি আগে দেখিনি ৷ চারধারে পেল্লাই কাঁচের দেওয়াল ৷ সামনেই বসে একজন ফর্সা সুন্দর দেখতে লোক ৷ সুন্দর পোশাক ৷ গলায় টাই ৷
-   আমি এসেছি ৷

-   আসুন স্যার৷

স্যার, আমাকে? বারোয়ারী স্বপ্নুদাকে স্যার বলছে ? আমার লজ্জা লেগে গেল ৷
-   বলুন স্যার ৷

-   না, মানে আমি স্বপ্ন দেখতে খুব ভালোবাসি ৷ আমার নাম স্বপ্নুদা ৷

-   এতো খুব ভালো কথা স্বপ্নু দা ৷ স্বপ্ন দেখা লোকেদের নিয়েই তো আমাদের কারবার ৷

-   আচ্ছা স্বপ্ন দেখতে হলে আমাকে কী করতে হবে?

-   আপনাকে কিছুই করতে হবে না ৷ সব আমরা করব ৷ বায়োডাটা এনেছেন?

-   ডাঁটা? নাতো ? ডাঁটা খাবেন ?

-   না, না মি. স্বপ্নুদা, আপনার অ্যাকডেমিকস?

-   অ্যাঁ ৷ মানে এখানেও স্বপ্নে ফেল মারলাম – প্রথমেই ৷

-   কে বলছে স্যার, আপনি ফেল করেছেন ৷ কতদূর লেখাপড়া করেছেন?

-   মেট্রিক ৷

-   ডিভিশন?

-   থার্ড স্যার, তবে সেকেন্ডকে প্রায় টাচ্ করে ফেলেছিলাম ৷

-   কোন সালে পাশ করেছেন ?

-   ১৯৩৪ সালে ৷

-   ও- কে ৷ ডকুমেন্ট, মানে কাগজপত্র কিছু এনেছেন?

-   না ৷

-   ঠিক আছে স্যার ৷ আপনার এইমটা বলুন – মানে আপনি কি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন?

-   এখানে কী হওয়া যায়?

-   সব, সব আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারব ৷

-   ঠিক বলেছেন স্যার ৷ আমি না স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি খুব ৷

-   আচ্ছা আপনি মেট্রিক পাশ করার পর অন্য কোনো কাজ করেন নি?

-   না ৷

-   তার মানে চৌত্রিশ সাল থেকে ঊনচল্লিশ সাল একদম বেকার বাড়িতে বসে, মি. স্বপ্নু দা?

-   বলতে পারেন ৷

-   সময় কাটাতেন কী ভাবে?

-   কী আর করা যাবে ৷ বাবার কামারশালায় গিয়ে বসতাম – ওখানে কিছু করতে হত ৷ তবে সময় কাটাতাম স্বপ্ন  দেখেই ৷

-   তবে তো হাতের  কাজ কিছুটা জানাই ৷ ইঞ্জিনিয়ার হবেন , মি. স্বপ্নু দা?

-    ইঞ্জিনিয়ার? মানে মিস্ত্রির? ওতে স্বপ্ন কোথায়?

-   আহা মিস্ত্রি কেন বলছেন ? নিজের হাতে  তো কিছু করবেন না ৷ আপনার বুদ্ধিতে অন্য মিস্ত্রিরা কাজ করবে ৷ বাড়ি বানাবেন, রাস্তা বানাবেন , বানাবেন বড়ো বড়ো ব্রিজ –

-   মানে হেড মিস্তিরি ৷ না না আর কী হওয়া যায়?

-   হওয়া তো অনেক কিছুই যায় ৷

-   না, না বড়সড় কিছু৷

-   আই . সি. এস, সি এ, সরকারি অফিসার থেকে ব্যাঙ্কের ক্লার্ক ৷ রেলের স্টেশানমাস্টার / ব্যারিস্টার৷

-   এদের মধ্যে কোনটা সবচাইতে ভালো ৷ ভালো তো নিঃসন্দেহে আই. সি. এস ৷ সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা ৷

-   তবে ওটাই করে দিন আমাকে ৷

-   ওভাবে তো হয় না মি. স্বপ্নু দা ৷ আমাদের সিস্টেমে আসতে হবে ৷

-    সেটা কী?

-   আপনি থার্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাশ –

-    না না, সেকেন্ড ডিভিশন প্রায় টাচ্  করা

দু- বছর আই এ পড়তে হবে ৷ ওখানে খুব ভালো ফল করতে হবে ৷ তারপরে ডিগ্রি নিতে হবে বি.এস. সি বা বি.কম ৷ তারপর চলবে আই সি এস হবার মুসাবিদা ৷ সব মিলিয়ে বছর দশেকের মতো সময় লাগবে ৷

-   সময়ের জন্য কোনো চিন্তা নেই ৷ আমার স্বপ্নটা বেঁচে থাকলেই হল ৷

-   ঠিক আছে ৷ তবে টাকাটার ব্যবস্থা করে ফেলুন ৷

-   কত টাকা?

-   পঞ্চাশ হাজার ৷

-   পঞ্চাশ হাজার? সস্তার কিছু নেই ৷

-   সব আছে আমাদের কাছে, সব আছে ৷ কত টাকার বাজেট, সরি, স্বপ্ন আপনার?

-   মানে একদম কমের মধ্যে ৷

-   দুই হাজার – ব্যাঙ্কের ক্লার্ক – এইটাই আমাদের লোয়েস্ট ৷

-   ত্রিশ হাজার? ক্লার্ক ? পারব?

-   কোন্ টা ৷ টাকাটা, না ক্লার্কগিরিটা?

-   দুটোই ৷ না, মানে ক্লার্কগিরিটা  -

-   আর পারবেন মানে ? আলবাৎ পারবেন ৷ আপনিই তো পারবেন আদর্শ ক্লার্ক হতে ৷

-   বলছেন?

-   আলবাৎ বলছি ৷ স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? না পারলেন, আমরা তো আছি ৷

-   এক হাজারের তো কোনো স্কীম নেই আমাদের ৷

-   আর আমার ক্ষমতা নেই ৷ তবে থাক ৷

-   থাকবে কেন? মি. স্বপ্নু দা, আপনাদের মতো লোকদেরই আমাদের দরকার- স্বপ্ন না বেঁচলে তো আমাদেরও চলবে না ৷

-   কিন্তু৷

-   কিছু কিন্তুর নেই ৷ এই এক হাজার টাকা ক্যাশ দিন ৷ আমরা বাদবাকি লোনের ব্যবস্থা করব ৷ মাসিক কিস্তি ৷

শুরু হল ব্যাঙ্কের ক্লার্ক হওয়ার স্বপ্ন দেখার প্রাকটিস ৷ মাসিক কিস্তি দিতে এখন আমি, আমারই বেচে দেওয়া কামারশালায় মজুরী খাটি ৷ আর লোন করার সময় রাখতে হয়েছিল বাড়িটা বন্ধক ৷ তবে থাকি ওখানেই ৷
তিন বছর প্রাকটিস আর তিনবার পরীক্ষা দিয়ে থাকলাম ৷
-   চিন্তা করছেন কেন ? আমরা তো আছি ৷

-   কিন্তু সংসার যে চলছে না – ক্লার্ক হব ধরে নিয়ে যে বিয়েটাও হয়ে  গেল৷

-   ঠিক আছে ৷ আপনি আমাদের এখানেই চাকরি শুরু করুন ৷ কিছুই না , গেটে টুল নিয়ে বসে থাকবেন৷ আর কিছু করতে হবে না ৷  

সেই থেকে নীল পোশাকের দারোয়ান ৷ পোশাক পরে গেটে বসে থাকি – আর স্বপ্ন  দেখা ছোটো ছোটো ছেলে- মেয়েদের যাতায়াত লক্ষ্য করি ৷ মাইনে মাস গেলে ত্রিশটাকা ৷

তারপর থেকে আমার কেটে গেছে অনেক বছর ৷ আমার বিয়ে হয়েছে ৷ ছেলে হয়েছে ৷  ছেলের বিয়ে হয়েছে, তার ছেলে হয়েছে ৷ কিন্তু আমার পোশাক আর বসার টুল পালটায় নি ৷ ষাট বছর বয়সে স্বপ্নের সওদাগরা বলল, বয়স হয়েছে  - আর স্বপ্ন দেখতে হবে না স্বপ্নু দা, বাড়ি যান ৷ পকেটে দুশো টাকা আর হাতে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম ৷

  এখন আমার বয়স সাতানব্বই ৷ এই বারান্দায় শুয়ে থাকি ৷ কয়েকজন পাড়ার লোক বলে গেছে, যে করেই হোক একশো পার করতেই হবে ৷ বিশাল সম্মানের ব্যাপার ৷ এটা আমাকে করতেই হবে ৷ এখন এটাই আমার একমাত্র স্বপ্ন ৷ নোংরা কাপে ঠান্ডা চা-টা তখনও আমার হাতে ৷ একটা চুমুক দিয়ে দেখলাম – বিচ্ছিরি ৷

-   বউমা, ও বউমা এ দিকে একটু এস তো ৷ অনেক বছর পর আমার গলার স্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম ৷ বেশ পুরুষ পুরুষ লাগছিল নিজেকে ৷

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরে বউমা এসে দাঁড়াল, মুখ ভরা বিরক্তি ৷

-   আর একটু চা হবে? গরম গরম

-   হাতের চা-টা কী হল ? ওটাই খান ৷

-    শোনো বউমা, তোমাকে আজ পর্যন্ত কিছু বলিনি, হাত ধরে কিছু দিতে পারিনি ৷ তোমাকে একটা জিনিস দিতে চাই ৷ না কোরো  না৷

-   জানি না  তোমার ভালো লাগবে কি না? তবে তোমাকে দিলে আমার ভালো লাগবে ৷

-   বেশ কী দেবেন, দিন তাড়াতাড়ি ৷

বাক্সটার ডালার উপর পড়ে থাকা জঞ্জাল সরিয়ে অনেক কষ্টে জিনিসটা  বের করে আনলাম৷ নিজের লুঙ্গি দিয়ে পরিষ্কার করে বউমার হাতে দিলাম ৷
-   এটা কী? অদ্ভুত তো৷ একটার মধ্যেই দা, কাস্তে, করাত ৷ অথচ বেশ হালকা ৷

-   হ্যাঁ,এটা  ছোটোবেলায় বানিয়েছিলা ৷ তোমার পছন্দ হয়েছে?

-   খুব পছন্দ হয়েছে ৷ এখনকার দা গুলো যা ভারী আর ভোঁতা – কাজ করতে বেশ অসুবিধা হয় ৷ আপনি তো হাঁপিয়ে গেছেন, চলুন বিছানায় দিয়ে আসি ৷

-   দুমিনিট কথা বলার সময় হবে বউমা ? বিছানায় বসতে বসতে বললাম ৷

-   হ্যাঁ, বসুন ৷ সারা জীবন আমি ঠকেছি স্বপ্নের পিছনে ঘুরে ৷ তুমিও আমাকে স্বপ্নুদা বলে ডাক ৷

-   কিছু মনে করবেন না সবাই ডাকে বলে –

-   না, না, ওটা কিছু নয় ৷ আসল কথা আজ বুঝেছি ৷ মরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার পর ৷ বাবা আমাকে বারবার বলেছিল যে আমার হাতের কাজ ভালো, ভবিষ্যতে ভালো লোহার কারিগর হবি ৷ কিন্তু আমি শুনিনি, কারণ বাবা আমাকে স্বপ্ন দেখাতে পারেনি ৷ বাবা যদি বলত তুই এই কাজটা করতে করতেই বিরাট লোক হয়ে যাবি – তবে ওইসব ভুয়ো স্বপ্ন দেখার লোকদের পিছনে সব ঘোচাতাম না ৷

-    ছেড়ে দিন না বাবা ৷ যা হওয়ার হয়ে গেছে ৷ আপনার সাধ একশ বছর করা – সেটা আপনাকে করতেই হবে৷

-   না না বউমা না৷ ওসব স্বপ্ন নয় বুজরুকী শোনো বউমা, আমার সোনামণি কে তুমি মিথ্যা স্বপ্ন দেখাব না – বলবে ঠিক পথে দৃঢ় ভাবে এগিয়ে যেতে –আর আর কুঁফ  . . . .৷

-   বাবা, বাবা কী হল বাবা

বউমা আছড়ে পড়ল বুকের উপর ৷  
Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.