অপমান যেন অন্ধকার হাইওয়ের ওপর অতর্কিতে জেগে ওঠা হাম্প। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমি দেখবে তোমার পায়ের নীচে মাটি নেই, দাঁড়ানোর জায়গা নেই কোনও। প্রশ্ন করারও কোনও অবকাশ পাবে না তুমি। তোমাকে ছিটকে ফেলে দিয়ে হাইওয়ে হাসতে হাসতে চলে যাবে পরবর্তী আক্রমণের দিকে। যদি না তুমি আগে থেকে সাবধান হ্ও। যদি আতাক্যালানের মতো রাস্তা দিয়ে হাঁটো। যদি না বিপদের সব চোরাবাঁকগুলো আগেভাগেই মুখস্থ রাখো।
তখন আমার ক্লাস সেভেন। প্রচণ্ড মনযোগ দিয়ে প্রেম করছি। আর প্রেম ব্যাপারটাকে বোঝারও চেষ্টা করছি। পড়াশোনা মোটামুটি ডকে। তার, মানে আমার সেই প্রেমিকের, আমাদের বাড়ি বেশ যাতায়াত ছিল।সে তখন বি.কম ফেল ক'রে আমাকে এসে বলছে "পাস" আর আমি আহ্লাদে আটখানা। তার আসার সময় ছিল হয় ছুটির দিনে ভর দুপুরবেলায়, নয়তো রাত ন'টা-দশটায়, যখন ঘুমে আমার দু'চোখের পাতা একহয়ে আসতো। সেই অবস্থায় প্যাঁ প্যাঁ ক'রে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে শোনাতে হতো তাকে। আর সে চেয়ারে বসে বিড় বিড় করতো, "এই গানটার জন্যেই আসা। নইলে কোনদিন লাথি মেরে চলে যেতাম।ওই তো ছিরির দেখতে।" তখন আমার গলার অবস্থা বেশ খারাপ। টনসিল ছিল। একটু সিজন চেঞ্জেই সর্দি-কাশি লেগে যেত। কান্না আর গানের যুগপৎ ধাক্কায় গলা চিরে যেত আমার। রক্ত বেরিয়ে আসতো। সেরক্ত হয়তো দেখা যেত না। সে রক্ত হয়তো দেখা যায় না, এমনকি আজও। শুধু সজনে গাছের আঠার মতো সেই রক্ত জমে উঠতে থাকে, তাল পাকিয়ে যায়, আর তা দিয়ে খেলনাবাটির মাংস রান্না করে দুনিয়ারযত কাচ্চাবাচ্চা।
আমরাও করতাম। গাছের পাতার ওপর ক্যান্থারাইডিনের শিশির ছিপি বসিয়ে গোল ক'রে কাটা লুচি আর সজনে-আঠার মাংস। সেজদাদুর বাড়ি থেকে খিড়কিপুকুর যাওয়ার পথে ডানদিকে একটা সজনেগাছপড়তো। গাছের গুঁড়িটা মাটির ওপর একেবারে হেলে থাকায় আমাদের খুব সুবিধে হতো গাছে উঠে নখ কিম্বা ব্লেড দিয়ে আঠা চেঁচে তুলতে। প্রায় রোজই আমাদের পিকনিক লেগে থাকতো ওই গাছটাকে কেন্দ্রকরে। মিছিমিছি লুচি-মাংস খাওয়ার পিকনিক। আমাদের স্বপ্নের পিকনিক।
গাছটার উল্টোদিকে, রাস্তার বাঁ পাশে একটা সিমেন্ট-বাঁধানো বেশ বড় গোল জায়গা ছিল। আমরা ছোট থেকেই জানতাম, ওটা শেয়ালের ভাত ভাত খাবার থালা। যদিও আমি কখনো ওই থালায় শেয়ালকে ভাতখেতে দেখিনি। পরে বড়মাসির কাছে গল্প শুনেছি। সেও এক মজার গল্প। সেজদাদুর বাড়ির খিড়কির দরজা থেকে বেরিয়ে, পেছনদিকের আম-জাম-কাঁঠালের বাগানের মধ্যে দিয়ে দুটো সরু পায়ে-চলার রাস্তাদু'দিকে চলে গিয়েছিল। একটা রাস্তা গিয়েছিল সোজা খিড়কিপুকুরের দিকে। খিড়কিপুকুরের ঘাটে বাড়ির বউ-ঝিরা চান করতে যেত। আমিও চান করেছি বহুবার, তখন অবশ্য আমার বে-আব্রু হওয়ার ভয় বাআব্রুরক্ষার দায়- কোনোটাই ছিল না। মোদ্দা কথা, তখন আমার কিছু ওঠেইনি।
চার
খিড়কির দরজা থেকে আরেকটা রাস্তা চলে গিয়েছিল ডানদিকে অর্থাৎ বড়পুকুরের দিকে। ওই রাস্তার ওপর ছিল পঞ্চবটী। দিদার এক পূর্বপুরুষ, তিনি ছিলেন কালীসাধক, পঞ্চবটীতে বসে ধ্যান করতেন।একবার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মা কালীর দর্শন পান তিনি। দেবী যেন তাকে বলছেন, "আমার খাবার জুটছে না, আমাকে খাওয়া।" এতবড় দায়িত্ব পেয়ে আত্মহারা হয়ে তিনি বলে ওঠেন, "কী করে খাওয়াব মা?" দেবীবলেন, "বাড়ির প্রথম ভাত শেয়ালকে পেট ভরে খাওয়া, তাতেই আমার খাওয়া হবে।"
এই বলে দেবী তো অন্তর্হিত হলেন, অর্থাৎ কিনা চম্পট দিলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন বাড়ির বড়কর্তার মাথার পোকাটিকে। তিনি তেড়েফুঁড়ে উঠে রাতারাতি বাগানের গাছ কাটিয়ে প্রতিষ্ঠাকরলেন শেয়ালের ভাত খাবার চাতাল যা কিনা পরবর্তীকালে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয়। সেই থেকে চালু হ'ল শেয়ালকে ভাত খাওয়ানোর প্রথা। সেও এক মজার প্রথা। বাড়ির প্রথম রান্না করা পাঁচ পো চালেরভাত, প্রথম তরকারি, অবশ্যই স্বগোত্রের লোকের স্বপাকসিদ্ধ, সন্ধেবেলা কাঁসার থালায় করে রেখে দেওয়া হতো সেই চাতালে আর চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসতো জ্বলজ্বলে চোখের শেয়ালেরা। মা কালী আরবাবা বুড়োশিবের চ্যালাচামুণ্ডারা। লোভে, লালায়, চেটেপুটে সাফ হয়ে যেত থালা। দূর-দূরান্তের গাঁ-গঞ্জ থেকে পূণ্যার্থী ও কৌতুহলীরা আসত সেই দৃশ্য দেখবে বলে। গ্রামের অনেকে আবার শেয়ালদের জন্যঘৃতপায়েস ইত্যাদি মানত করত।
আর যেদিন শেয়াল আসত না, একটা না একটা অঘটন নাকি ঘটতই সেদিন। বাড়ির লোকজন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। হয় মোকদ্দমায় হার, নয় তো বাড়িতে কোনো বড় অসুখ-বিসুখ। এরকমই এক শেয়াল না-আসা রাতে তেড়ে জ্বর এল মায়ের রাঙাদাদুর। টাইফয়েড। যায়-যায় অবস্থা। কান্নাকাটির ধূম পড়ে গেল বাড়িতে। মায়ের দাদু স্বপ্নাদেশ পেলেন, "বড়বাগানে পায়খানা করে রেখেছি। সেই পায়খানার মধ্যে ভাতআছে। এনে খাইয়ে দে ভাইকে। সেরে যাবে।"
আজ ভাবি, কত অসঙ্গতি ছিল এই গল্পের মধ্যে। অত যে বিশাল বড়বাগান, কত অসংখ্য গাছপালাই না ছিল সেখানে। তার ভেতরে কোথায় কোন গাছের নীচে, না হয় ভগবানেরই হ'ল, এক চামচ পায়খানা আরতার মধ্যে কুচোকৃমির মতো কয়েককুচি ভাত, এ কি সোজা ব্যাপার! সেই ভাত খুঁজে আনতে অন্ততঃ শ'খানেক লোক লাগিয়ে গোটা বাগান তোলপাড় করে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু গেল কে? না মায়ের দাদুনিজে। একা। আজ একথা ভাবলে স্রেফ গাঁজা মনে হয়। কিন্তু সেই বয়েসে, যখন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘটা বা না-ঘটা সমস্ত ঘটনাকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হতো, যখন পাশের বাড়ির দাঁত-উঁচু ঝুমুরদি আরপাতালপুরীর রাজকন্যা মিলেমিশে এক হয়ে যেত, যখন ডান কাঁধের ওপর টিকটিকি পড়লে মনে হত যে এক্ষুনি আকাশ থেকে পুষ্পকরথ নেমে আসবে আর আমাকে রানী করে নিয়ে যাবে ফুল আর ষড়যন্ত্রে ভরাএক রহস্যনীল দেশে, যে বয়েসে কল্পনার সত্যি সত্যিই পাখা ছিল আর সে নিমেষের মধ্যে পেরিয়ে যেত দেশ-কাল, সম্ভব-অসম্ভবের গণ্ডী, কোথায় গেল আমার সেই বয়েস? বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝখানে অথৈজলে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় চলে গেল সে? আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন দেখলাম, তলিয়ে যাচ্ছি। ভরাডুবি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমি দু'হাত দিয়ে বাস্তব আর স্বপ্নের দুটো হাতজড়িয়ে ধরার মরণপণ চেষ্টা করলাম। বাস্তব লাথি মেরে ফেলে দিল আমায়। আর স্বপ্ন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, "তোমার বয়েস হয়ে গেছে।"
Khub antorik o sabolil ageeo porechi mone holo janina thik kina tobe khub bhalo laglo aj,
ReplyDeleteOnek dhonyobad Jinat...
Delete