
বাংলার লোক নৃত্য
ভারতীয় নৃত্যকলার ঐতিহ্য অতি সুপ্রাচীন ।তবে উচ্চাঙ্গের ধ্রুপদী নৃত্য ছাড়াও আরও এক প্রাচীন নৃত্য পরম্পরার অস্তিত্ব আমরা প্রায় বিস্মৃত হয়ে থাকি। যে নাচ মাটির কাছাকাছি, সাধারণ জনজীবনের প্রাত্যহিক সুখ দুঃখের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তাকে লোকনৃত্য নামে অভিহিত করা হয়। গুজরাটের গরবা, পঞ্জাবের ভাঙ্গরা, রাজস্থানের ঘুমর আজ অতি পরিচিত নাম।তুলনামূলক ভাবে দেখতে গেলে বাংলার লোক নৃত্যের কথা সমগ্র ভারতে তেমন সুষ্ঠু ভাবে প্রচার হয় নি। এই নিবন্ধে বাঙলা লোক নৃত্যের সুপরিচিত নামগুলির পাশাপাশি দু একটি পুরাতন, বিস্মৃতপ্রায় নাচের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা করবো।

পুরুলিয়া অঞ্চলের ছৌ নৃত্য সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ বিখ্যাত। প্রচলিত মতামত অনুযায়ী ছৌ নামের উৎস ছায়া বা মুখোশ। সীতাকান্ত মহাপাত্রের মতে ছৌ নামটি এসেছে সামরিক ছাউনি কথা থেকে। চৈত্র পরবের সময় পুরুলিয়া অঞ্চলে ছৌ নাচের আখড়া বসে। ঢোল, ধামসা ও চড়চড়ই (ছোট গোলাকার ঢোল)এবং মহুরী(দো নলা বাঁশি)ছৌ নাচের বাদ্যযন্ত্র। ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেলা ও পুরুলিয়ার ছারদা গ্রামের মুখোশ অতি প্রসিদ্ধ।হিন্দু পৌরাণিক দেবদেবীর মুখ, পশু পাখির আকৃতির মুখোশ গুলি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। দ্রুত পদসঞ্চালন, দৈহিক অঙ্গভঙ্গি দ্বারা নর্তক নাচের ভাব প্রকাশ করে। ঝুটো মুক্তো,রঙ্গিন কাপড় , জরি, রাঙতা দিয়ে প্রস্তুত সুবিশাল মুখোশ ছৌ নাচের পোষাকে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে।রামায়ণ, মহাভারত বা পৌরাণিক বীর রস প্রধান আখ্যান ছৌ নৃত্যে জনপ্রিয়। এই নৃত্যে কখনো তলোয়ার নিয়ে আক্রমণ কখনো ঢাল দিয়ে প্রতিরক্ষা সবই বলিষ্ঠ পদসঞ্চালনে বা দৈহিক ভঙ্গিমায় প্রকাশ করা হয়।
গম্ভীরা আরেকটি স্বল্প পরিচিত লোক নৃত্য। এই নাচ দুজনে কিংবা দল বেঁধে করা চলে। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় এই নাচের সূত্রপাত হয়। পৌরাণিক দেব দেবী, শিব, কালী, পার্বতীকে ভালবেসে, ভক্তি সহকারে খুব কাছের মানব বা মানবী হিসেবে দেখানো হয় এই নাচের মাধ্যমে। মধ্য যুগে গম্ভীরা গান ধর্ম ঠাকুরের পুজায় গাওয়া হত। অধুনা শিবের গাজনে এই গান শোনা যায়। সেকালে একতাল, ত্রিতাল, কাহারবা তাল ব্যবহার হতো গম্ভীরা গানে। এখন চলতি ছায়াছবির সুর জনপ্রিয়।
বৃত্তা আরও একটি স্বল্প পরিচিত নৃত্য। নিঃসন্তান মহিলারা মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে গ্রাম দেবতার উদ্দেশ্যে এই নাচ্ করেন। মহামারীর থেকে রক্ষে পাওয়ার পরও এই বৃত্তা নাচের প্রচলন ছিল।
অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্ট অঞ্চলে ধামাইল নাচের প্রচলন ছিল। এই নাচে অংশগ্রহণ করতেন শুধুমাত্র মেয়েরা। বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে গোল বৃত্তাকারে ঘুরে হাতে তালি দিয়ে প্রথমে ধীরে পরে দ্রুত লয়ে ধামাইল সম্পন্ন হয়। রাধা কৃষ্ণের প্রেম লীলা, মানভঞ্জন গানের প্রধান বিষয়বস্তু। গানের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক-- ‘ও গো সই জলে কি রূপ হেরিয়া আইলাম মেঘের বরণ শ্যাম, ওগো বিশাখা।”
এই প্রসঙ্গে আরেকটি নাচের কথা এসে পড়ে। সেকালে ছোট্ট কনে বউদের মাটির উঠোনে ঘুরে ঘুরে এই নাচ দেখাতে হতো। বউ নাচের বিশেষত্ব হল নাচ হবে মাটির কোল ঘেঁসে অর্থাৎ কনে বউএর পা মাটি থেকে উপরে উঠবে না। ‘সোহাগ চাঁদ বদনি ধনি, নাচো ত দেখি’ এমনি এক বউ নাচের গান। এই গানের সঙ্গে পরিচিত নন এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পরিশেষে আরেকটি লুপ্ত প্রায় লোকনৃত্যের কথা উল্লেখ করতে হয়। এক্ সময় বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ জেলায় রায়বেঁশে নামক লাঠি নাচ, বাগদী সম্প্রদায়ের লাঠিয়ালদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।রায় অর্থ রাজ আর মুখনিঃসৃত ধ্বনি ও সামরিক অঙ্গভঙ্গি এবং বাঁশ এর নানা কসরৎ এই নাচের মূল উপাদান। লেঠেল পাইকদের সঙ্গে তাঁদের সম্প্রদায়ের বিশেষ নাচও হারিয়ে যেতো যদি না গুরুসদয় দত্ত মহাশয় এই নাচ পুনরত্থিত করতেন। রায়বেঁশে নর্তকরা মাল্ কোঁচা মারা ধুতির উপর লাল কাপড় বাঁধেন, ডান পায়ে থাকে ঘুঙ্গুর।বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোল ও কাঁসি ব্যবহার করা হয়। রায়বেঁশে নৃত্যর সঙ্গে কিছুটা মিল আছে বাঙালি ব্রতচারী নাচের।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রতচারী নৃত্য উপস্থাপন করেন শ্রী গুরুসদয় দত্ত মহাশয়। উপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে যুব সম্প্রদায়কে হাতিয়ার ধরতে উৎসাহিত করা ছিল ব্রতচারী নৃত্যর অন্যতম উদ্দেশ্য।তবে শাসককুলের সরাসরি বিরোধিতা না করে নাচের আবরণে শরীরচর্চা করা হতো সুকৌশলে । ব্রতচারী নাচ হয়ত সে অর্থে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের পরিচয় বহন করে না।তবে সেই সময়ে বাঙ্গালির কাছে এর আলাদা একটি মুল্য ছিল।
পরিশেষে বলা যায় উপরুল্লিখিত লোক নৃত্য গুলি আমাদের বিগত প্রজন্মের ঐতিহ্য বহন করে নৃত্যের পদক্ষেপে, বাদ্যযন্ত্রের তালে। আগামী প্রজন্মকে সচেষ্ট হতে হবে যাতে এই লৌকিক নৃত্য চর্চা সম্পূর্ণ অবলুপ্তির পথে না যায়।
External links:
• www.indianetzone.com/1/folk_dances_west_bengal.htm
• www.chhou.org
• www.indianetzone.com/54/raibenshe.htm
• bou dhamali.mp4 (youtube)
• folk-dances.tripod.com/id10.html