>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • অরুণ চক্রবর্তী

    SongSoptok | 4/15/2016 |




    শান্তিনিকেতন

    ট্রেনে ভীড় ছিল কিনা মনে নেই। গরম ছিল খুব। মেল ট্রেন বলে হুড়মুড়িয়ে ছোটার ট্রেন, তা না। স্টেশনে স্টেশনে থেমে থেমে চলছিল। লোক ওঠা নামা করছে। ভীড় থাকলেও আমার গায়ে লাগার কথা না, কেননা, আমি সিঙ্গল সিটে, জানালার ধারে। ভারত কত বড় দেশ তখনো জানি না। কিন্তু এটুকু জানি তেঁতুলিয়া টু টেকনাফ নয়। নানা স্টেশনের নাম দেখে দেখে উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। 'বোলপুর'এর পাশে শান্তিনিকেতন লেখা দেখতেই, আমাদের বগিতেই যেন উঠে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। দেখতে পেলাম, দাঁড়িয়েছিলেন জোব্বা পরে, প্লয়াটফর্মে, এখন উঠে এলেন। আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত। সাঁওতাল রমনী খুঁজতে থাকি। রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন, সাঁওতাল পল্লী আর সাঁওতাল রমনী... এ সব জানতাম। আনিসুর ভাইয়ের কাছে শুনেছি। দাদাকে যদি বলতে পারতাম, 'দাদা, আমি এখন শান্তিনিকেতনে!' হঠাৎ ক্যাশের কৌটোটা মুখ ব্যাজার করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মুখ ঘোরাই।

    দাদার বেডরুমে একটা চার্ট পেপার টাঙিয়েছিলাম। প্রতিদিন দু'বেলা দাদা দিনের রোজগারের টাকা প্যান্টের পকেট থেকে উগলে আমার হাতে দিতেন। তাঁর হাত মুখ ধুয়ে আসার ফাঁকে আমি তা গুণে, চার্ট পেপারে বিন্দু বসিয়ে রেখা টেনে দিতাম। আগের দিন থেকে টাকার অঙ্ক কম হলেই, 'বাব্লু, কাল আরো রোগী দেখতে হবে। গ্রাফকে কিছুতেই নিচের দিকে যেতে দেওয়া চলবে না।' দাদার দেড় দু বছরের নতুন ডাক্তারি। এটা ছিল আমাদের দু'জনের একটা খেলা। মা রাগ করতেন। 'এসবের কোন মানে হয়? বাব্লু পড়ায় মন দিচ্ছে না। টাকা পয়সার হিসাব বাচ্চুকে দে।ও ধীর স্থির।' দাদা ক্যাশিয়ার পাল্টান নি। মনে পড়ল, পরশু সকালে, সেই আদরের ক্যাশিয়ার, ক্যাশের কৌটো খুলে হাওয়া। দাদার জন্য মনটা হু হু করে উঠল। দাদা কি দুঃখ পেয়েছেন? হয়ত না। আমি ছাড়া কেউ জানেই না যে ওখানে পঞ্চাশ টাকা শর্ট হয়ে গেছে। তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোরের কি নিজের কাছে নিজেকে সাধু ভাবা মানায়? আর মানায় না বলেই দেখি জানালার বাইরে সবাই ফিক ফিক করে হাসছে। দৌড়ে চলা গাছপালা, টেলিগ্রাফ পোস্ট, আল ঘেরা মাঠ, মাঠে খাটতে থাকা মানুষ, আকাশের স্থির জমাট মেঘের দল সব সবাই আমাকে দেখে মুচকি হেসে হেসে যাচ্ছে। কামরার ভেতরের সবাই এতক্ষণ আমকে দেখছিল, আমি তাদের দিকে তাকাতেই সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মাস্টার মশয়, তাঁর বাড়ির লোকজন, নানা সিটে বসে থাকা যাত্রী, মাটিতে বসা, দাঁড়িয়ে থাকা কামরার সবাই মুখ ঘুরিয়ে... লজ্জা লজ্জা আর লজ্জা। এমন দাগী শরীরে পালানো যায়, অভিযান হয় না।

    দাদা কি এখন বাচ্চুকে ক্যাশিয়ার করেছেন? নাকি আর কোন ভাইকে দায়িত্বশীল ভাবতেই পারছেন না? মা'র হাতে তুলে দিচ্ছেন টাকা? দাদা কোনদিন মনি ব্যাগ ব্যবহার করেন নি। আয় করার সেই প্রথম দিনগুলোতেও না। শুরুতে হয় ভাইবোন, নয়ত মা, পরে বৌদি। দাদার ভরসার জায়গাআমার বেলায় তার সব পঁচে গেল, পঁচে গেল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, দাদা নিজেই পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে টেবিলের ওপর রেখে গুণছেন। একসময় বিরক্ত হয়ে মা'কে ডাকছেন। আর কোন ভাইকে ডাকছেন কী? জান্তে ইচ্ছে করছিল, জানতে ইচ্ছে করছিল।

    এই সময় মাস্টার মশয় ওপাশের জানালা থেকে আমাকে ডেকে বললেন, 'বাবলু, সাবধান। অনেক সময় জ্বলন্ত কয়লা গুঁড়ো চোখে পড়ে। তোমার চোখ তো কয়লায় জ্বালা করছে মনে হচ্ছে? চোখে মুখে জল দিয়ে এসো।' ভাঙা, পানের পিচে দাগী বেসিন। কলটা খুলতেই ফুটন্ত জল। আঁজলায় নিয়ে ঠান্ডা করে করে চোখে মুখে দেবার সময় বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে। সঙ্গে মা। জুটলেন বাবার আর এক বন্ধু। রোজ আসেন না। বাবা একসময় তাঁকে বলছিলেন, 'বিল্পবীদের মনে গ্লানি থাকে না, অনুশোচনাও না।' ট্রেনটা এই সময় ঝাঁকিয়ে দুলিয়ে দুরন্ত ছুটছিল কি? কারো কাঁধে হাত রেখে টাল সামলাচ্ছিলাম কি? মনে নেই।

    বর্ধমান এলো। ট্রেন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। খানিক পরে সবাই উঠে এলো, হাতে মিস্টির প্যাকেট। বারহাবা স্টেশনে সবাই 'চা, এই চা' বলে কাড়াকাড়ি করছিল, কেননা, সেখানকার চা নাকি বিক্যাত। টেস্ট করা হয়নি। আমার কাছে সীমিত পয়সা। বর্ধমানে হামলে পড়ার মিস্টির ক্ষেত্রেও তাই। মাস্টার মশয়কে বলেছি, পেটটা ঠিক নেই, তাই লাঞ্চ নেব না। এবার বললাম, আমার মিস্টি ভাল্লাগে না। বর্ধমান থেকে ট্রেন ছাড়তেই সবার মধ্যে সাজো সাজো রব। জানলাম, এবার আসবে কলকাতা-- আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা! আমার রক্তে যেন তখন 'শুধু তোমার সুর বাজে'*!



    কলকাতায় প্রথম দিন



    বিকেল গড়াতেই বর্ধমান। কখনো এপাশে কখনো ওপাশে কালো ধোঁয়ার মেঘ ছড়াতে ছড়াতে ঝিকঝিক গড়গড় শব্দ তুলে ছুটছে ট্রেন। এবার শেয়ালদা। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি আমার কাঁধের ঝোলাটার ফিতেটা মুঠিতে শক্ত করে ধরি। অচেনা দেশ, অচেনা শহর। যা চেনা তা সুচিত্রা-উত্তমের ছবিতে দেখা মিষ্টি সংগ্রাম আর অপার রোম্যান্টিকতা। আমার ভেতরের উত্তমকুমার চলেছে কলকাতায়। গান গাইবে নাকি রাস্তায় রাস্তায় হেঁকে চলা নিলামওয়ালা, ঠিক জানি না। এখন শুধু পৌঁছে যাওয়া। শিয়ালদা। কলকাতা।

    ডানকুনি আসতেই একটা শহরের আঁচ পেতে থাকি। ঢাকা থেকে ফেরার সময় দিনাজপুরের কাছাকাছি পৌঁছুলেই লাইনের দু'পাশের ঝোঁপ ঝাড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে দিনাজপুর শহরের গন্ধ নাকে লাগত। এখানেও নিশ্চই তেমনি। কলকাতার গন্ধ চিনি না বটে কিন্তু নাকে লাগতে লাগল। ট্রেনটা বাম দিকে অনেকটা হেলে হেলে উঠে গেল পাঁচতলায়। বালির স্টেশন, রেলগাড়ি, মানুষজন সবাই নিচে, আমরা অনেক ওপরে। একবার ব্রাক্ষমণবাড়িয়ার নদী পেরুতে রেললাইনটা এভাবেই দশ তলায় উঠে গিয়েছিল। বালিঘাটের পাঁচতলার স্টেশনটা পেরুতেই দেখি নিচে দূরে গঙ্গার পারে তিন চারটে মন্দিরের উদ্দেশ্যে সবাই প্রণাম করছে। অনেকে পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে গঙ্গায়। মাস্টারমশায় বললেন,' বাবলু, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। প্রণাম কর।' কেনো? মন্দিরকে প্রণাম করব কেন? মনে মনে ভাবলাম। কিচ্ছুটি করলাম না। আমি পরে দক্ষিনেশ্বার কালি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েছি বটে, আজো একবারো প্রণাম করিনি। কেন? পরে হবে সে কথা।

    একসময় রেল লাইন নিচের দিকে নামতে থাকে, দেখি, বাম দিকে একটা ভাঁজ ভাঁজ ছাদের পাশে, দেয়ালে, নীল নিয়নে লেখা 'ধীরেন কড়াই'. কথায় ও কড়াইয়ের রেখায়। ওটা দেখে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। একটা লোহার কোড়াইয়ের এত সম্মান? কলকাতা কি সত্যি সবাইকেই সম্মান করে? আরো রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছিল। একটা পাল্যাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছি, স্টেশনের নাম দমদম। আমি দমদম জায়গাটাকে চিনতাম। বাড়িতে চোঙা গ্রামোফোনের কাছে গায়কের গানে নিবিষ্ট কুকুর, 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস।' রেকর্ডের লেবেলে লেখা থাকত, গ্রামোফোন কোম্পানি, দমদম'. এই সেই দমদম? স্বপ্ন নয়ত? পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের কলকাতায়?

    সত্যি একসময় পৌঁছেই গেলাম। মাস্টার মশায়ের হাত থেকে একটা হালকা বাক্স বা টোপলা নিয়ে প্রায় সবার আগেই প্লয়াটফর্মে নামলাম। শিয়ালদা। চারপাশে তাকিয়ে প্রথমেই অনুভব করলাম আমি এই মুহূর্ত থেকে এক বিশাল শহরের মানুষ। এখানেই কাটাবো আমার দিন রাত, হাসি কান্না, আনন্দ উচ্ছাস। মা'র মুখটা ভেসে উঠতেই ঝটকায় তা সরিয়ে দেই। না। পিছনে তাকানো নয় আর। চারিদিকে অসংখ্য লোকজন নারী পুরুষের ব্যাস্ততায় আমি আরো উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। মাস্টার মশায়কে তাঁর জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছি কি দেই নি (ধন্যবাদ জানাবার শিক্ষা তখন আমার ছিল না)  খপ করে কে আমার বাম হাতের কব্জিটা মুঠো বন্দী করে ফেলে, যেন, মাস্টার মশায়ের জিনিস চুরি করেছি। ঘাবড়ে গেলাম। মুখ তুলে তাকাতেই দেখি, রাধুদা। আমার ছোটপিসির ছোট ছেলে। 'কী রে! খুব লায়েক হয়ে গেছিস? বাড়ি পালানো? কোত্থেকে এই ভুত চাপল মাথায়, অ্যাঁ?.' আমি হতবাক। ভেতরে ভেতরে কি খুশি হলাম? হয়ত। 'চল, মা কলকাতায় এসেছে, তোর জন্য অপেক্ষা করছে।' 'আপনারা জানলেন কী করে?' 'তাতে তোর কী দরকার?' মাস্টার মশয় কি জানতেন, আমাকে কেউ নিতে আসবেন? আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, 'আছা বাবলু, চলি'

    শিয়ালদার স্টেশনের বাইরে এসে চক্ষু চড়ক গাছ। লক্ষ মানুষ হুটোপুটি করছে, একটা লাল রঙের দোতলা বাস (আগে দেখিনি), এগারো নম্বর, মানুষের সেই সমুদ্র ঠেলে আস্তে আস্তে স্টেশনের দিকটায় আসছে। হাতে হ্যাঁচকা টান। 'আগে বাড়ি চ, কলকাতা পালিয়ে যাচ্ছে না। দু পা দূরে আমাদের বাড়ি।' কিন্তু সত্যি কলকাতা তখন পালিয়ে যাচ্ছিল আমার মাথার উত্তেজনার হাঁড়ি ভেঙে। দিশাহারা লাগছিল। কলকাতা দেখা হল না। আমরা মিনিট কয়েক পরেই এক গলিমুখে ঢুকে পড়লাম।



    আশ্রয়



    ছোটপিসিমা অপেক্ষা করছিলেন দরজার কাছে। আমি দরজায় দাঁড়াতেই চৌকাঠের ভেতরে দাঁড়িয়েই আমার মাথায়, দু'হাতে, বুকে, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকেন, 'মা বরদেশ্বরী, এই পাগলা ঠাকুরর্কে সুমতি দিও!' পাগলা ঠাকুর? চমকে উঠি। বিন্যাফৈরের গ্রামে আমার ঠাকুর্দাকে সবাই পাগলা ঠাকুর বলে ডাকত! দাদুর মতিগতির ঠিক ছিল না। সেরেস্তার নিয়মকানুন মানতেন না বলে সন্তোষের মহারাজার সেরেস্তা থেক বিতাড়িত হয়েছিলেন। যজমানি করতেন। তাও ঠিকঠাক না। ঠাকুরের প্রতি আনুগত্যই নেই। লোকে তাঁকে ডাকাডাকি বন্ধ করে দিল। শুরু করলেন, গ্রামের কাছেপিঠের বাড়িগুলোতে দু'একটা পূজার। পোষায় না। এক ভোরে এক বিধবার কষ্ঠিপাথরের বরদেশ্বরী মূর্তিকে কাঁধে নিয়ে দে দৌড়। বাড়ির সবচেয়ে বড় টিনের চৌচালা ঘরে প্রতিষ্ঠা করলেন সেই কালী মূর্তি। 'পাগলা ঠাকুরের মন্দির।' থানা পুলিশ হলে বললেন, মা আমায় স্বপ্নাদেশ করেছেন, তাই। পিসিমা কিনা সেই পাগলা ঠাকুরকে দেখলেন আমার মধ্যে? বিস্ময়টাকে  ঢোক গিলে পেটে চালান করে দিয়ে পিসিমাকে জড়িয়ে ধরি (আমাদের পরিবারে প্রণাম-প্রথা বাবা বন্ধ করেছেন বহুদিন). পিসিমা কিছুটি জানতে চাইলেন না, কেন এসেছি। মা কেমন আছেন বা অন্যান্য ভাইবোন। যেন কাছের কোন স্টেশন থেকে এই বাড়িতে আসা।

    জানলাম, পিসিমা পরশু মেজছেলে আর মেজবৌকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে যাবেন। বাড়িতে থাকব, আমি, রাধুদা, বাড়ির বড়দা (শঙ্করদা) তাঁরা স্ত্রী, তিনটি ছেলেমেয়ে। ফ্লয়াটে মাত্র দুটি ঘর। দেখলাম এখানেও কালিয়াগঞ্জ। সংগ্রাম। কুণ্ঠিত হই। কিছু বলি না। স্নান করে ট্রেনের জামা পাজামা পরতেই হাহা করে উঠলেন মেজবৌদি। 'একি? তোমার আর কোন কাপড় জামা নেই? আমি মাথা নাড়ি, নেই। বেঁধেছেদে ফেলা একটা স্যুটকেশ খুলে তড়িঘড়ি আমাকে একটা ডুরে কাটা শাড়ি দিলেন, 'এটা লুঙ্গি করে পর।' আমি ইতস্তত করতেই, 'কলকাতায় এটাই দস্তুর। কাল সকালে বাজারে বেরুলে দেখতে পাবে।'

    পরদিন এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ সারকুলার রোডের ওপরে আমজাদীয়া রেস্টুরেন্টের উল্টো ফুটপাথে দাঁড়াতেই কলকাতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আমার দুচোখ ফুঁড়ে। ট্রাম, লম্বা লম্বা সরকারি বাস। মানুষের হুটোপুটি। এক ফার্লং দূরে শিয়ালদা স্টেশন, এই এলাকাটায় ব্যস্ততা সে কারণেও বেশি। বাস ট্রামের পেট ফুঁড়ে যেমন গলগল করে নারী-পুরুষ নেমেই ছুটছে, তেমনি হুড়মুড়িয়ে সেসবে একদলের ঢুকে পড়ার ঠেলাঠেলি তাগিদ। ঢাকার সদরঘাটে লঞ্চ স্টীমার নৌকো ধরতেও একই গাদাগাদির দৃশ্য। একটা ট্রাম সামনে আসতেই বৌদি বললেন, 'উঠে পড়। কেউ কোলে তুলে নেবে না।' উঠে পড়লাম তিনজনে। আমার প্রথম ট্রাম চড়া। সেই প্রথমের অভিজ্ঞতা এখন ফিকে হয়ে গেছে, তবে মনে পড়ছে, বৌদি কাঁধে হাত দিয়ে চেপে আমাকে একটা সিটে বসিয়ে দিলেন। আমরা বাজারে যাচ্ছি। আমার জন্য জামা কাপড় কিনবেন তুফুদা।

    আমরা যাচ্ছি ধর্মতলায়। খানিক বাদেই জানলার ধারে বসার সুযোগ পেলাম। খোলা জানালা। কলকাতা চলতে লাগল পাশে পাশে। বাম পাশের জানালা, চোখের সামনে কোন বাধা নেই। দিনাজপুরের কথা মনে পড়ল। হাঁটতাম। কখনো সাইকেলে। কখনই রিকশায় না। আমি যখন কৈশোরের শুরুতে, দেশ ভাগ হয়েছে তার দশ বছর আগে। আমাদের শহর থেকে খুব বেশি ষাট কিলোমিটার দূরে বিহার। দিনাজপুর শহর ভরে গেল মূলোৎপাটিত বিহারীতে। নারী পুরুষ, শিশু কিশোর যুবক। চারদিকে। সব পাড়ায়। কোথাও কোথাও তড়িঘড়ি গড়ে তোলা মস্ত মস্ত রিফ্যুজি কলোনীতে। ছিন্নমূল, সংগ্রাম, ভিনভাষী... এই শব্দগুলোর গূঢ় অর্থ যখন বুঝতে শিখলাম, তখন আমাদের শহরে বিহারীদের টিঁকে থাকার লড়াইয়ের তিন আনা চার আনা কমপ্লিট। শহরের এমাথা  ওমাথায় পাক খেতে খেতে যা দেখতে পাই, তা শহরের ঝাড়ুদার, সরকারী দফতর স্কুলে সাহেব এবং তাঁদের ছেলে মেয়েদের মাথার ওপরে যারা দড়ি টেনে টেনে দুলে দুলে মাদুর-পাখা দোলাচ্ছে, নর্দমা সাফাই করছে, পিঁপড়ে খাওয়া লজেঞ্চুস বিস্কিটের দোকানে মেলে ঝিমুচ্ছে, সকালে উঠে দোকানের সামনে ভেতরে ঝাড়াই মোছাই করছে, হাত নেই পা নেই কিংবা অকেজো অঙ্গে শুধু গলা ফাটিয়ে ভিক্ষা করছে, তাঁরা সবাই বিহারী। দিনাজপুরের ধার্মিক বিন্যাস, দেশভাগের আগে ছিল-- শহরে হিন্দু আর গ্রামে মুসলিম। তাই দাঙ্গা বাঁধেনি আমাদের শহরে। এক অমোঘ নিয়মে শুধু কমে গেছে হিন্দুর সংখ্যা আর বেড়ে গেছে গ্রাম থেকে উঠে আসা জোতদার শ্রেণীর পরিবার আর এই ছিন্নমূল বিহারী মুসলমান। জানালার ওপারে চলন্ত কলকাতায় আমি দিনাজপুরকেই দেখতে পাই। লড়াই লড়াই। জীবনটাকে ধরে রাখার লড়াই।

    দোকানটার নাম ছিল বোধয় 'ওয়ালিউল্লাহ', ম্যাডান স্ট্রিটের ক্রসিং্এর পাশে, ধর্মতলায়। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। অনেকদিন দোকানটা দেখলে রোমাঞ্চিত হতাম। এখন দেখি না। ওরা দু'জনে মিলে আমাকে এক জোড়া প্যান্ট শার্ট কিনে দিলেন। সেই সময়ে আমরা পাজামা আর শার্টের সঙ্গে শু পরতাম। আমার পায়েই ছিল দিনাজপুর থেকে পরে আসা জুতো জোড়া। মেজবৌদি বললেন, একটু আঘাত করেই, 'এখানে তোমার ওই পাকিস্তানী ফ্যাশান অচল, বাবলু মিঞা। এখানে পাজামার সঙ্গে স্যান্ডেল পরে, প্যান্টের সঙ্গে জুতো।' একটা চামড়ার স্যান্ডেল কেনা হল। পরের দিন আবার আসতে হবে। প্যান্ট অল্টার করতে হবে। বৌদিরা আজই চলে যাবেন, 'কী বাঙাল, আসতে পারবি তো?' আমি এমনই একটা চ্যালেঞ্জের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি একা একা দেখব কলকাতাকে এটা অনেক আগেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম। ভয় তো বাড়ির বেল কাঠালের ছায়ায় রেখেই বেড়িয়েছি। পরের দিন ২৭ জুন, ১৯৬২. রেড লেটার ডে। আমার কলকাতা অভিযানের দিন।
    -------------------
    ---------
    * বড় হয়ে সমর সেনের কবিতায় পড়া।
    (পরবর্তী সংখ্যায়)


    [অরুণ চক্রবর্তী]

    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.