দরজাটা খোলাই ছিল
প্রবল জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছি এমন
একটা অস্বস্তিময় অনুভুতি নিয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল আমার। ঘড়িতে এখন সময় রাত তিনটা
বাইশ। তা’ বলে খুব একটা একা নই আমি, মনে হলো আশেপাশেই কেউ আছে। কি মুশকিল আমার পাশে তো দূরের
কথা এই বাড়িতেই কেউ থাকে না। থাকবে আর কি করে,
আমি হলাম
অবিবাহিত, একা একটি যুবক। বিরাট এই বাড়ীটা
বাবার কাছ থেকে পাওয়া। কিনতু সেই তো আমি একাই থাকি। আর কাকে কোথায় পাব বলুন!
রুবিনা নামের ঐ মেয়েটা যা কায়দা করে দুঃখ দিয়ে গেল তারপরে আর কাউকে পেতেও ইচ্ছে
করেনি। আজান পড়ামাত্রই বুঝলাম ভোর হয়ে আসছে। নামাজটা পড়ে নিই ভেবে মাটিতে পা
ছোঁয়াতেই অবাক হয়ে গেলাম। আমার পা মাটিতে পড়ছে না। কি আশ্চর্য! আমি ভেসে ভেসে
হাঁটছি! আরে বেশ মজার কান্ড তো! হাঁটতে হাঁটতে না ভাসতে ভাসতে আমি টয়লেটে ঢুকলাম।
পানির ট্যাপ ছাড়তেই পানি পড়া শুরু হল। কিন্তু ওগুলোও আমার হাতের আঙ্গুল গলে পড়ে
যাচ্ছে। তাজ্জবের কথা হল হাত ভিজছে না। এখন তো আমার রীতিমতো ভয় পাবার কথা। আমি ভয়ও
পাচ্ছি না, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়।
বাইরে এখন পাখি ডাকছে। সূর্যটা হামলে পড়েছে আমার জানালার কার্নিশে।
ব্যাপারটা জানাজানি হতে সময় লেগেছে।
আমার ছুটা বুয়া কাজে এসে দরজা ধাক্কিয়ে আমায় না পেয়ে চলে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির
মরিয়ম আপা শুনে বললেন, নাহ এটা তো অসম্ভব কথা। তরুণ তো ভোরে
ওঠা ছেলে। চল গিয়ে দেখি। এই দেখতে এসেই চারিদিকে সোরগোল। মানে হয়েছে কি আমি তো
দরজা খুলেই দিয়েছি, ওরাও সবাই ঘরে ঢুকেছে। কিনতু এতক্ষন
আমি যা প্রায় লক্ষ্যই করিনি তা হল আমার বিছানায় শায়িত আমি নিজেই। ওরা সব চীৎকার, কান্নাকাটি---দেখা গেল আমি মারা গেছি। আজব এক আফসোসে ভরে
উঠল আমার মন। হায়, হায় মরেই গেলাম! কিনতু সমস্যা হল
হঠাৎ করেই মরিয়ম আপার স্বামী দিলু ভাইয়ের শরীরে আমি ধাক্কা খেলাম। ব্যস যায় কোথায়!
উনি শুরু করলেন আরেক কাহিনী। উনার গায়ে নাকি ঠান্ডা বরফের মত কিছু ধাক্কা দিয়েছে।
কি যে হচ্ছে এসব? আরে বাবা আমি মরে গেছি তো কি! এ আবার
কোন জগতে এসে পড়লাম! সবাই বলে মরে গেলে আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা হয়। ফেরেশতা আসে।
আমার বেলায় সে সব কিছুই ঘটছে না কেন? তবে কি আমি স্বপ্ন দেখছি?
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার চাচাতো ভাই
মৃদুল, মামাতো বোন অর্চি আর শম্পা সহ বেশ
কিছু আত্মীয় এল। মাত্র ৩১ বছর বয়সের একটা ছেলে কোন কারন ছাড়া তো মরতে পারে না!
আবার দরজাও কে খুলে দিল! এসব তো রহস্যজনক। তাই ডাক্তার এল, পুলিশও এল। ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে লাশ নিয়ে পুলিশ
মর্গেও চালান করেছে। সারাটা দিন এভাবেই গেল। আমার বাসায় থেকে গেল বড়খালা, মৃদুল ভাই, মামী মানে অর্চি-শম্পার মা সহ ওরা
দুই বোন আর মৃদুল ভাইয়ের আম্মা মানে চাচীমনি।
আমার বাসার সবগুলো ঘরেই আমি ঘুরতে
পারছি কিন্তু বাইরে যেতে পারছি না। ভাসতে ভাসতে যখনই মেইন দরজার কাছে গেছি ছিটকে
পড়েছি এখানে সেখানে। নাহ এমন করে চেষ্টা করতে গিয়ে কোথায়, কখন পড়ে ব্যাথা পাই তাই বাইরে যাওয়ার চিন্তাই বাদ দিলাম।
রাত হয়ে আসছে। ওরা সবাই আমার ডাইনিং
টেবিলে বসে খাচ্ছে, গল্প করছে। খাবার এসেছে মরিয়ম আপার
বাসা থেকে।
‘বুঝলেন বড় আপা তরুণ তো কত বার চেয়েছিল অর্চিটাকে বিয়ে করতে।
ইস তখন যদি দিতাম বিয়েটা হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত। একা থাকার দুঃখেই মারা পড়ল, আহা রে’---বললেন মামি। আর আমার তো আক্কেল
গুড়ুম। আমি আবার অর্চিকে কখন বিয়ে করতে চাইলাম! তবে অর্চি খুব রূপবতী আছে সে বিষয়ে
সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই দেখেছি মৃদুল ভাই টাংকি মারা শুরু করেছে ওর সাথে। বেঁচে
থাকতে আমিও মেরেছি, মিথ্যে বলব না। শম্পাটা আবার দেখতে
এক্কেবারেই কুশ্রী। ইয়া মোটা আর নাক থ্যাবড়া তবে মেয়েটি চুপচাপ। অর্চির মতো
ওভারস্মার্ট না। আচ্ছা মামির মনে তবে এই ছিল! সেজন্যেই কেবল বলত, তরুণ তুমি কাজ না করলেও তো চলবে। অতবড় তিনতলা বাড়ি বনানীর
মত জায়গায়। দু’টো তলা ভাড়া দিলেই তোমার চলে যাবে।‘ আমি ত্যাড়ামো করে বলতাম,
বাড়ি ভাড়া দেব
না মামি---
‘তরুণ তো রুবিনার ওই ঘটনার পর সবার সাথে যোগাযোগ করাই ছেড়ে
দিয়েছিল, ও আবার অর্চিকেও পছন্দ করেছিল এটা
যদি একবার আমায় বলতো!’---বলে বড়খালা বিলাপ করা শুরু করলেন।
আহা, আহা রে আমার খালা রে! খালার জন্যে বুকে মোচড়
খেল।
খাবারের পাট চুকিয়ে সবাই শুতে গেল।
আমার ঘরে কেউ শোবে না। হাহ। (আজব লাগছে আমাদের পুলিশ প্রসাশনের কান্ড দেখে, এই ঘর তো আজ রাতে তালা দিয়ে সিলগালা করে রাখা উচিত
ছিল)। আমার মা-বাবা দু’জনেই এক এক করে যে ঘরটায় মারা গেছেন বছর সাত আর বছর বিশেক
আগে, সে ঘরেই শুতে গেল মৃদুল ভাই। ইচ্ছে করছে
ভীতুর ডিমটাকে একটু কাতুকাতু দিই রাত-বিরেতে ওই ঘরে ঢুকে। মামি, চাচী আর বড় খালা আমার গেস্ট রুমে। অর্চি, শম্পা ঘুমাতে গেল আমার পাশের ঘরটাতেই। আমি আর কি করি! ভেসে
ভেসে ওদের সবার ঘরে ঢুঁ মারছি। কি জ্বালাতন এমন করেই কি আমাকে থাকতে হবে নাকি? শালা আমি বেঁচেই ছিলাম লাশের মতো এখন মরেও ভূত হয়েছি লাশ
মার্কা।
যা হোক এখন ভূত হয়ে নানান কান্ড
কীর্তি দেখছি। এই যেমন একটু আগে মামি মেয়েদের ঘরে এসে ফিসফিস করে বলে গেলেন, ‘হাজারবার বলেছিলাম ছেলেটাকে পটানোর ব্যাবস্থা কর। এখন
বিয়েটা করলে এই বিশাল সম্পত্তির মালিক হতে পারতিস না! গাধাগুলো কোথাকার!’
অর্চিও ফোঁস করে উত্তর দিল, হুম আর আমি এখন বিধবা হতাম সেটা বোঝো না?
মামিও কম যায় না, বলে, হলে হতিস—এই সম্পত্তি তো পেতিস। আর এই---বলে শম্পার দিকে ঘুরে বললেন, তুই আর কি করবি। যেমন হয়েছিস দেখতে, শুনতে তেমন বুদ্ধির ঢেঁকি। ওটাকে তো পার করতে পারব যা হোক।
তোর কি হবে? তুইও পারলিনা?
আমি কেবল শম্পার ফোঁপানো শুনতে
পেলাম।
বড়খালা মাথার উপর একটা হাত রেখে শুয়ে
আছে আর অঝোরে কাঁদছেন। খাবার টেবিলেও দেখেছি কিচ্ছু খেতে পারেননি। অথচ আমি কোনদিন
বড়খালার বাড়িমুখোই হতাম না। এত ভালবাসেন খালা আমায়! খুব ইচ্ছে হল মাথায় একটু হাত
বুলিয়ে দিতে। কিন্তু ‘ঠান্ডা’র ভয়ে আমি বিরত থাকলাম। চাচী খালার পায়ের কাছে বসে কোরান
শরীফ পড়ছেন। হঠাৎ আমি যেন বুঝলাম এটা একটা মড়া বাড়ি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
চাচীর চোখেও পানি। ভালবাসার মানুষগুলোকে আগে চিনিনি। আজব লাগছে। আমি মামির বাসাতেই
বেশি যেতাম।
সবাই শুয়ে পড়লে আমি ঘোরাঘুরি শুরু
করলাম এ ঘর থেকে ও ঘরে। এমা! কান্ড দেখো!! ড্রয়িং রুমে অর্চি আর মৃদুল ভাইয়ের ফিসফাস।
- না,
না আমি পারব
না—আপনি মা’কে বলবেন, বলল অর্চি।
- অর্চি তুমি জানো সেই প্রথম দিন থেকেই
তোমাকে আমি ভালবাসি, বলছে মৃদুল ভাই। বলে কি! বছর তিনেক
আগে আমার সাথেই গিয়েছিল ওদের বাড়িতে মৃদুল ভাই।
- আমি জানি। কিন্তু আজ অব্দি আমার
বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে পারলেন না, আমি আর কত অপেক্ষা করব?
- সেটা তো তরুনের কথা ভেবে আমি পারিনি, তুমি জানো। ভাইটাকে এত কষ্ট কি করে দিই বলো! কাল সকালেই বলি?
- আর যদি আপনার ভাই এখনো বেঁচে থাকত? একবার ভেবেছেন আমার কি হবে,
এসব কথা?
- এখন তো সমস্যার সমাধান পেলাম আমরা!
এসবই ধৈর্যের ফল। অর্চি, অর্চি প্লীজ এত রেগে থেকো না, প্লীজ।
এবার আমার চোখে জল আসার উপক্রম। আহা, মৃদুল ভাই! আর আমি কি-না মরতেই চাইতাম! ভাবতাম আমার কেউ
নেই। কি নিরাসক্ত হয়ে পরেছিলাম জীবনের প্রতি। আর অবাক লাগছে অর্চি’র কথা শুনে। একদিনও কি আমায় বলতে পারিসনি গাধি! আমি তো
ভাবতাম তুইও আমার প্রতি দুর্বল! বেচারি! রুবিনা চলে যাবার পর কি যত্ন করেই না আমার
জন্যে খাবার পাঠাত। আমার জামা-কাপড় পাঠিয়ে দিলে কেঁচে, ইস্তিরি করে পাঠাত। যদিও মুখোমুখি আমার সাথে অনেক চ্যাটাং
চ্যাটাং কথা বলত। কিন্তু সেটাকে আমি ভাবতাম প্রেম! ভেবেছিলাম, একটু সময় যাক। ভাগ্যিস!
কোন ঘরের দরজা খোলার শব্দে ওরা দু’জন ছিটকে যে যার ঘরে চলে গেল। আমি স্থানুর মত ভেসে রইলাম আর
জানলাম ভূতেরাও কষ্ট পায়।
আমি ভাসতে ভাসতে অর্চিদের ঘরে গিয়ে
ঢুকলাম।
- শম্পা, লক্ষী
বোন আমার আর কাঁদিসনা। সেই তখন থেকে কাঁদছিস, এবার থাম।
- আমি কেন বেঁচে আছি আপু? ও তো একদিনও আমায় ঘুরেও দেখেনি, কতটা ভালবেসেছি তুমি তো জানো—বলল
শম্পা। এবার সত্যিকারভাবে চমকালাম আমি। মানে কি?
কার কথা বলছে
শম্পা?
- আমি তো তোকে অনেক বার বলেছি যে আমি
জানিয়ে দিই তাকে। তুইই তো দিসনি বলতে। রান্না করে খাবার পাঠাতিস। ওর কাপড় পর্যন্ত
নিজের হাতে কেঁচে দিয়েছিস। বুয়াদের ধরতেও দিসনি। উজবুকটা জানলোই না যে ছোট্টবেলা
থেকে একটা অসাধারন মেয়ের ধ্যান-জ্ঞান সে।
এবার আমি আর পারলাম না। এতক্ষনে, এই প্রথম আবার বেঁচে উঠতে চাইলাম আর শোঁ করে ভেসে গিয়ে
শম্পাকে জড়িয়ে ধরলাম। ও একটু চীৎকার করেই থেমে গেল। অর্চি’র অবাক করা মুখের দিকে তাকিয়ে শম্পা অভিভুতের মত বলল, ও এসেছে আপু, ও আমায় জড়িয়ে ধরেছে—আমি টের পাচ্ছি—ঠান্ডা—
প্রবল জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছি এমন
একটা অস্বস্তিময় অনুভুতি নিয়েই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল আবার। এবার আমি হাসপাতালের একটা
ট্রলীতে শুয়ে। এপ্রন পরা ডাক্তার সামনে---শুধু জানলাম আমি মরিনি। ডাক্তারের অবাক
চোখের সামনেই আমি সুস্থ সবল মানুষের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আমি কি ট্রান্সের মধ্যে
ছিলাম যাকে কোমা বলা যায়? জানিনা। আমার সোমাটিক মৃত্যু ঘটেনি
এটা বুঝেছি।
সকালের রোদে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী।
পুলিশ ভ্যানে নয় গাড়িতে করে, পুলিশ অফিসারের পাশে বসে বাসায় এলাম।
সিঁড়ি টপকে সোজা চলে গেলাম শম্পার কাছে।
এতক্ষন যে গল্পটা বললাম, এটা আমার জীবনে গত দু’দিনের ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। বিশ্বাস
হল না তো? শম্পাকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন অথবা
আপনি-ই ভেবে দ্যাখেন আমি মরে যাবার পর বুয়া আর মরিয়ম আপার ডাকাডাকিতে দরজাটা কে
খুলেছিল?
[শাকিলা তুবা]