সাবধানে
পা ফেলে ফেলে,আস্তে আস্তে,উঁচু টিলাটার
ওপর এসে দাঁড়াল জয়িতা। এটা ওর প্রতিদিন সকালের অভ্যেস। এখানে এসে দাঁড়ালেই মনটা হু
হু করে ওঠে। একান্ত আপন একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে। আজ খুব এলোমেলো
হাওয়া দিচ্ছে। শালটা ভাল করে পেঁচিয়ে নিয়ে জয়িতা তাকালো সামনের উন্মুক্ত প্রকৃতির
দিকে। দূরে দুধসাদা বরফে ঢাকা হিমালয় সূর্যের আলোয় যেন গলানো সোনা। আকাশে সূর্যের
সাত রঙের ক্যালাইডোস্কোপ। নীচে একটার পর একটা পর্বতমালা ক্রমশ হারিয়ে গেছে অতল,গভীর খাদের
অন্ধকারে। যেখানে সূর্যের আলোরও প্রবেশ নিষেধ। তারই মাঝে মাঝে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ
যেন অপেক্ষা করে আছে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙানোর। সারি সারি গাছেরা মাথা
তুলেছে আকাশপানে,যেন নীচের
তলার কোনও খবরই তাদের জানা নেই,জানার ইচ্ছেও নেই। নাম না জানা পাহাড়ি জংলি ফুল,ফোটার আনন্দে
মাতোয়ারা। নির্নিমেষ চোখে জয়িতা দেখছে আর দেখছে। শুষে নিচ্ছে প্রকৃতির রূপ,আলো,গন্ধ, নিস্তব্ধতা,নির্জনতা,প্রতিদিনের
নতুন নতুন আবিস্কারে যা সমৃদ্ধ। আজকাল এই আসীম নির্জনতা ভাল লাগে ওর।
কলকাতার
নামী স্কুলে অঙ্ক শেখাত জয়িতা, আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে। মেধাবী হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবারিত দ্বার। তার অমায়িক ব্যবহারের জন্য খুব জনপ্রিয় ছিল
জয়িতা। ঘরে বাইরে সবাই ভালবাসত ওকে। কলেজেই পথশিশুদের নিয়ে একটা সেমিনারে আলাপ
হয়েছিল আলোকের সাথে। অনায়াস বাচনভঙ্গী, দরদী মন, আর কাজের অদম্য উৎসাহ তাকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছিল। সবাই
যখন পরীক্ষা, চাকরি নিয়ে
ব্যস্ত, আলোক কলেজ
শেষ করেই ছুটত ট্রেন লাইনের লাগোয়া বস্তিতে। ওদের জন্য মুঠো ভর্তি আলো নিয়ে। ওদের
মনের জানলা দরজাগুলো খুলে দিয়ে ওদের মুখে হাসি দেখলেই তার সব পাওয়া। জয়িতা বেশ
কদিন ধরেই এসব খেয়াল করছিল। মনে মনে ইচ্ছেরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে একবার গিয়ে দেখে
আসার। কেন জানিনা ছেলেটার মধ্যে একটা বিষণ্ণতা আছে। অথচ খুব গায়েপড়ে আদিখ্যেতা
দেখানোটাও জয়িতা পারেনা একদম। শহুরে শিক্ষার বজ্র আঁটুনি। তবে সুযোগ একদিন আপনিই
এলো। সেদিন লাস্ট ক্লাসটা করতে জয়িতার আর ভাল লাগছিল না। ও এসে দাঁড়ালো বারান্দার
কোণে। এই কোনাটা খুব প্রিয় জয়িতার। দিনের মধ্যে অন্তত একবার ওর আসা চাই। গুলঞ্চ
গাছটার ডালপালাগুলো এখান থেকে হাত বাড়ালেই ধরা যায়। ফুলের সুগন্ধে মন ভরে যায়।
সেদিনও ফুলের গন্ধে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জয়িতা। খেয়াল করেনি কখন আলোক এসে
দাঁড়িয়েছে। মৃদু কাসির শব্দে সম্বিত ফিরতেই আলোককে দেখল জয়িতা। একেবারেই আশা করেনি
তাই একটু হকচকিয়ে গেল। তবে সপ্রতিভ জয়িতা এক মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। অবাক হয়ে
প্রশ্ন করল, ‘আপনি, এখানে, এসময়ে?’ একটি মুহূর্ত, তারপর দুজনেই
একসাথে সশব্দে হেসে উঠল। অতঃপর সেদিন দুজনের একসাথে না যাওয়ার আর কোনো কারনই আর
রইল না। দুজনেই পথ ধরল। পাশাপাশি কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগল ওরা। কথা আলোকই বলছিল।
সেদিন জয়িতা শুধুই শুনছিল আর শুনছিল। আর ভাবছিল তার নিজের চেনা গণ্ডীর বাইরে এই
তার প্রথম পা রাখা। নিজের অজান্তেই সে এক অজানার পথে পা বাড়িয়েছে। ভেতরে এক অমোঘ
টান অনুভব করছিল জয়িতা। বেশ পরিণত লাগছিল নিজেকে। এক ভাল লাগায় ক্রমশ ছেয়ে যাচ্ছিল
তার চেতনা। কথায় কথায় চলে এল আলোকের সাথে ছোট্ট একটা দর্মার একচালা ঘরে। পাশেই
ষ্টেশন চত্বরের গুদাম ঘর। আলোককে দেখেই ছুটে এলো হইহই করে একদল ছেলেমেয়ে। কেউ এসে
মেলে ধরল অঙ্কের খাতা, কেউ বা আঁকা
ছবিটা দেখাবার জন্য উদগ্রীব, কেউ চেঁচিয়ে কবিতা বলতে শুরু করল, কেউ ইংরেজি
ব্যাকরণের কাজ দেখাতে এগিয়ে এল। মৃদু ধমক দিয়ে আলোক আগে ওদের ঠিক করে বসতে বলল।
সবাই বসলে এবার জয়িতার সাথে ওদের আলাপ করাল। তারপর ফস করে বলল, ‘এই নতুন
দিদিমনি তোমাদের এখন থেকে অঙ্ক শেখাবে’। জয়িতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা ওদের অঙ্ক
খাতা খুলে জয়িতার সামনে হাসিমুখে এসে বসল। হতচকিত জয়িতা আলোকের দিকে তাকাতেই দেখল
আলোকের মুখে মৃদু হাসি। প্রথম জড়তা কাটিয়ে জয়িতাও কখন যে ওই নিষ্পাপ শিশুগুলোর
দিদিমণি হয়ে উঠলো বুঝতেও পারল না। কলেজ শেষে প্রতিদিনই দিদিমনি আসে অঙ্ক শেখাতে।
ওদের জন্যে কোনোদিন নিয়ে আসে তেলেভাজা, কোনোদিন মুড়িমাখা, কোনোদিন জিলিপি। মজা করে সবাই মিলে খাওয়া, অঙ্ক করা, গল্প করা, গান করা এই
নিয়ে বিকেল গুলো যেন নেশার মত পেয়ে বসল জয়িতাকে। প্রতিদিন আলোকের সাথে পথ হাঁটার
এই শুরু। কোনোদিন ভুল হয় নি জয়িতার। কোনোদিন একঘেয়ে লাগে নি, কোনোদিন
বিরক্ত হয় নি। এক অদ্ভুত ভাললাগায় অবশ হয়েছিল। ভালবেসেছিল জয়িতা আলোককে। পরীক্ষা
শেষে দুজনেই পাশ করে এবার যারযার গন্তব্যে যাওয়ার পালা। আলোক ফিরে যাবে তার নিজের
গ্রামে। জয়িতার ফল ভালো হয়েছিল তাই সহজেই চাকরির সুযোগ পেল শহরের নামী স্কুলে।
কিন্তু আলোক ছাড়া জয়িতা এখন আর পথ হাঁটতে চায় না। তাই ওরা ঠিক করল কলকাতার কাজটা
জয়িতাই চালাবে আর ছুটির সময় আলোকের গ্রামে যাবে জয়িতা। মাঝেমধ্যে আলোকও কলকাতায়
আসবে।
জয়িতা
কোনোদিন গ্রাম দেখে নি। স্কুলের ছুটিতে প্রথমবার সে আলোকদের গ্রামে এল। পাহাড়ের খাঁজে, তিরতির করে
বয়ে যাওয়া নদীর পাশে ছোট্ট গ্রাম ধূয়ালি। খুব বেশি হলে কুড়ি পঁচিশটা ঘর। আলোকদের
বাড়ি একদম উঁচু টিলাটার ঠিক বাঁকের মুখে। বাড়িতে শুধু তার মা। বাবা চাকরি থেকে
অবসর নেবার পর কলকাতা ছেড়ে এখানেই এসে প্রকৃতির মাঝে থাকতে চেয়েছিলেন। ছোট্ট এক
চিলতে গ্রামটা প্রথম দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেল জয়িতা। সবার সাথে মিশতে বেশি সময় লাগল না
তার। দিন কয়েকের মধ্যে সে এখানকারও অঙ্কের দিদিমনি হয়ে উঠলো। আলোকের সাথে, পাহাড়ি
রাস্তা ছাড়িয়ে,ছায়াঘেরা
গ্রামটা তাকে খুব আপন করে নিল। রোজ সকালে উঠে উঁচু ওই টিলাটার ওপর দাঁড়িয়ে সামনের
আদিগন্ত বিস্তৃত হিমালয় দেখে নিজেকে নগণ্য মনে হয় ওর,ভাগ্যবতীও।
স্কুলের
ছুটি শেষ হয়ে আসছে, এবার আবার ইট
কাঠ পাথরের শহর কলকাতায় ফেরার পালা। মনটা বেশ খারাপ জয়িতার। আবার অপেক্ষা,আবার
দিনগোনা। ফেরার আগের দিন সকালে শেষবারের মতো আলোকের সাথে সাবধানে,পায়ে পায়ে
হেঁটে,আস্তে আস্তে
গিয়ে উঠলো টিলাটার ওপর। ঘণ নীল আকাশ,দুধসাদা পাহাড় চূড়ার দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে আছে জয়িতা,খানিকটা
অন্যমনস্ক। হঠাৎ কেউ ওকে চীৎকার করে ডাকল। চকিতে পেছন ফিরে জয়িতা কাউকে দেখতে পেল
না। আলোক? আলোক কোথায়? ‘আলোক? আলোক? আলোওওওওওওক?’নাহ কোনো
সাড়া পেল না জয়িতা। আজও পায়নি। সীমাহীন নৈঃশব্দ্য চারিদিকে।
শহরেও আর ফেরা হয়নি জয়িতার।
নন্দিতা
ভট্টাচার্য্য